Skip to content
ঔষধ কিভাবে কাজ করে

আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, একটি ছোট্ট ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল খাওয়ার পর তা আপনার শরীরে কীভাবে কাজ করে? কীভাবে বোঝে যে মাথার ব্যথা কমাতে হবে, পায়ের ব্যথা দূর করতে হবে, নাকি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে? এই প্রশ্নটি অনেকের মনেই ঘুরপাক খায়। আজকের এই ব্লগ পোস্টে আমরা বিস্তারিতভাবে জানবো ঔষধ কিভাবে কাজ করে, এর পেছনের বিজ্ঞান কী, এবং কীভাবে এটি আমাদের শরীরের নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে নির্দিষ্ট কাজ করে। এটি হবে একটি তথ্যবহুল, সহজবোধ্য লেখা, যা আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দেবে।

(১) ঔষধ কী এবং এটি শরীরে কীভাবে প্রবেশ করে?

ঔষধ কী এবং এটি শরীরে কীভাবে প্রবেশ করে

ঔষধ হলো এমন একটি রাসায়নিক পদার্থ, যা আমাদের শরীরের বিভিন্ন সমস্যা যেমন ব্যথা, জ্বর, এলার্জি, বা সংক্রমণের বিরুদ্ধে ঔষধ কিভাবে কাজ করে। আমরা যখন একটি ঔষধ খাই—সেটা ট্যাবলেট, সিরাপ, বা ইনজেকশনের মাধ্যমে হোক—তখন এটি আমাদের শরীরে প্রবেশ করে এবং রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটি কীভাবে বোঝে কোথায় গিয়ে কী করতে হবে? এর পেছনে কি কোনো “ব্রেন” আছে? না, আসলে বিষয়টি এতটা জটিল নয়, বরং এটি একটি আশ্চর্যজনক বিজ্ঞানের খেলা।

(২) “লক এবং কী” মডেল: ঔষধের কাজের মূল রহস্য

ঔষধ কিভাবে কাজ করে তা বোঝার জন্য আমাদের প্রথমে জানতে হবে “লক এবং কী” (Lock and Key) মডেল সম্পর্কে। আমাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের রিসেপ্টর (Receptor) থাকে। এই রিসেপ্টরগুলো হলো প্রোটিন, যা শরীরের নির্দিষ্ট জায়গায় থাকে এবং নির্দিষ্ট কাজ করে। ঔষধের অণুগুলো (মলিকিউল) এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যে, তারা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট রিসেপ্টরের সঙ্গে “ফিট” করে। এটি ঠিক যেন একটি তালা (রিসেপ্টর) এবং চাবি (ঔষধ)। যেমন, একটি চাবি দিয়ে আপনি সব তালা খুলতে পারেন না, তেমনি একটি ঔষধ সব রিসেপ্টরে বসে না।

উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক-

লোরাটাডিন (Loratadine) একটি এলার্জির ঔষধ। এটি শরীরে গিয়ে হিস্টামিন রিসেপ্টর (Histamine Receptor)-এর সঙ্গে বাঁধা পড়ে। হিস্টামিন হলো এমন একটি পদার্থ, যা এলার্জির লক্ষণ যেমন হাঁচি বা চোখ দিয়ে পানি পড়া তৈরি করে। লোরাটাডিন এই রিসেপ্টরে বসে হিস্টামিনকে ব্লক করে, ফলে এলার্জির সমস্যা কমে।

(৩) ঔষধ শরীরে কীভাবে ছড়িয়ে পড়ে?

আপনি যখন একটি ঔষধ খান, তখন এটি পাকস্থলী বা অন্ত্রে গিয়ে রক্তে মিশে যায়। রক্তের মাধ্যমে এটি শরীরের প্রতিটি অংশে পৌঁছে যায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ঔষধটি শুধু সেই জায়গায় কাজ করে, যেখানে তার জন্য উপযুক্ত রিসেপ্টর আছে। এটি এলোমেলোভাবে কাজ করে না। এর পেছনে রয়েছে বিজ্ঞানীদের সুনির্দিষ্ট ডিজাইন।

উদাহরণস্বরূপ-

  • প্যারাসিটামল (Paracetamol) মাথার ব্যথা বা জ্বর কমাতে কাজ করে। এটি মস্তিষ্কে গিয়ে প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন নামক পদার্থ তৈরি বন্ধ করে, যা ব্যথা এবং জ্বরের জন্য দায়ী।
  • সালবুটামল (Salbutamol) হাঁপানির ঔষধ। এটি ফুসফুসের বিটা-২ রিসেপ্টর (Beta-2 Receptor)-এ কাজ করে এবং শ্বাসনালী প্রশস্ত করে, যাতে শ্বাস নিতে সুবিধা হয়।

(৩) ঔষধের “ব্রেন” আছে কি?

না, ঔষধের কোনো ব্রেন নেই। এটি কোনো জীবিত জিনিস নয় যে নিজে থেকে চিন্তা করবে। ঔষধের কাজ নির্ভর করে তার রাসায়নিক গঠন (Chemical Structure) এবং শরীরের রিসেপ্টরের সঙ্গে তার মিলের ওপর। বিজ্ঞানীরা ঔষধ তৈরি করার সময় এমনভাবে এর অণু ডিজাইন করেন, যাতে এটি শুধুমাত্র নির্দিষ্ট রিসেপ্টরে বা নির্দিষ্ট জায়গায় কাজ করে।

ধরা যাক, আপনার রক্তচাপ বেশি। প্রোপ্রানোলল (Propranolol) নামক ঔষধটি হৃৎপিণ্ড এবং রক্তনালীতে থাকা বিটা রিসেপ্টর (Beta Receptor)-এ কাজ করে। এটি হৃদস্পন্দন কমিয়ে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এটি ফুসফুসে গিয়ে হাঁপানির সমস্যা তৈরি করতে পারে না, কারণ এর কাজের জায়গা ভিন্ন।

(৪) বিভিন্ন ধরনের ঔষধ কিভাবে কাজ করে?

বিভিন্ন ধরনের ঔষধ কীভাবে কাজ করে

শরীরে ঔষধ বিভিন্ন উপায়ে কাজ করে। কিছু ঔষধ রিসেপ্টরে বসে কাজ করে, আবার কিছু রিসেপ্টর ছাড়াই কাজ করে।

চলুন কয়েকটি উদাহরণ দেখি-

ক) রিসেপ্টর-ভিত্তিক ঔষধ

  • লোরাটাডিন: এলার্জির জন্য হিস্টামিন রিসেপ্টরে কাজ করে।
  • প্রোপ্রানোলল: হৃদয়ের বিটা রিসেপ্টরে বসে রক্তচাপ কমায়।
  • ওমেপ্রাজল (Omeprazole): পাকস্থলীতে প্রোটন পাম্প বন্ধ করে এসিড কমায়।

খ) রিসেপ্টর ছাড়া ঔষধ

  • অ্যান্টাসিড: পাকস্থলীতে এসিডের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে এসিডিটি কমায়। এর জন্য কোনো রিসেপ্টর লাগে না।
  • অ্যামোক্সিসিলিন (Amoxicillin): এটি একটি অ্যান্টিবায়োটিক, যা ব্যাকটেরিয়ার কোষ প্রাচীর (Cell Wall) ধ্বংস করে। এটি আমাদের শরীরের রিসেপ্টরে কাজ করে না, বরং ব্যাকটেরিয়ার ওপর সরাসরি আক্রমণ করে।

(৫) ঔষধ কিভাবে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে?

ঔষধ যখন রক্তে মিশে যায়, তখন এটি শরীরের সব জায়গায় যায়। কিন্তু কাজ করে শুধু সেখানে, যেখানে তার জন্য উপযুক্ত “তালা/লক” আছে। এটি ঔষধের নির্বাচনী ক্ষমতা (Selectivity) নামে পরিচিত।

উদাহরণস্বরূপ-

  • সালবুটামল ফুসফুসে গিয়ে বিটা-২ রিসেপ্টরে কাজ করে, কিন্তু হৃৎপিণ্ডে বিটা-১ রিসেপ্টরে কাজ করে না।
  • অ্যামোক্সিসিলিন শুধু নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়ার সেল ওয়ালে কাজ করে, আমাদের কোষে নয়।

(৬) বিজ্ঞানীরা কীভাবে ঔষধ ডিজাইন করেন?

বিজ্ঞানীরা আমাদের শরীরের রিসেপ্টর, অণু, এবং রোগের কারণ বিশ্লেষণ করে ঔষধ তৈরি করেন। তারা দেখেন-

  • কোন রিসেপ্টর বন্ধ করলে বা খুললে সমস্যা সমাধান হবে।
  • ঔষধটি যেন শুধু নির্দিষ্ট জায়গায় কাজ করে, অন্য জায়গায় না।

যেমন, কোভিড-১৯ এর জন্য ঔষধ তৈরি করতে বিজ্ঞানীরা ভাইরাসের গঠন বিশ্লেষণ করেছেন। তারা এমন ঔষধ তৈরি করার চেষ্টা করছেন, যা ভাইরাসের নির্দিষ্ট অংশে গিয়ে বাঁধা পড়ে এবং তাকে নিষ্ক্রিয় করে।

(৭) ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কেন হয়?

ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কেন হয়

ঔষধ খাওয়ার পর অনেক সময় আমরা লক্ষ্য করি যে, এটি আমাদের সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি কিছু অপ্রত্যাশিত সমস্যাও তৈরি করে। এগুলোকে বলা হয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Side Effects)। কিন্তু এটি কেন হয়? এর পেছনে রয়েছে কয়েকটি কারণ, যা আমরা এখানে বিস্তারিতভাবে দেখবো।

ক) একাধিক রিসেপ্টরে কাজ করা

কিছু ঔষধ শুধু একটি রিসেপ্টরে কাজ না করে একাধিক রিসেপ্টরে বাঁধা পড়ে। এর ফলে ঔষধটি তার মূল কাজের পাশাপাশি অন্যান্য শারীরিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে। উদাহরণস্বরূপ, প্রোপ্রানোলল (Propranolol) হলো একটি বিটা ব্লকার, যা রক্তচাপ কমাতে হৃৎপিণ্ডের বিটা-১ রিসেপ্টরে কাজ করে। কিন্তু এটি ফুসফুসের বিটা-২ রিসেপ্টরেও কাজ করতে পারে, যার ফলে শ্বাসকষ্টের মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।

খ) শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ

ঔষধ যখন শরীরের কোনো নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া বন্ধ বা সক্রিয় করে, তখন এটি অন্যান্য প্রক্রিয়ার ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন, অ্যাসপিরিন (Aspirin) ব্যথা কমাতে প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন তৈরি বন্ধ করে। কিন্তু প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন পাকস্থলীর আস্তরণ রক্ষায়ও ভূমিকা রাখে। ফলে অ্যাসপিরিনের ফলে পাকস্থলীতে আলসার বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হতে পারে।

গ) ব্যক্তিগত শারীরিক পার্থক্য

প্রতিটি মানুষের শরীর আলাদা। একই ঔষধ একজনের জন্য ভালো কাজ করলেও অন্যজনের জন্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, প্যারাসিটামল সাধারণত নিরাপদ, কিন্তু যাদের লিভারের সমস্যা আছে, তাদের ক্ষেত্রে এটি লিভারের ক্ষতি করতে পারে। এটি নির্ভর করে শরীরের বিপাক (Metabolism) এবং ঔষধ ভাঙার ক্ষমতার ওপর।

ঘ) ঔষধের ডোজ বা সময়ের প্রভাব

ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক সময় ডোজ (Dose) বা এটি কতক্ষণ শরীরে থাকে তার ওপর নির্ভর করে। যেমন, অ্যান্টিবায়োটিক বেশি দিন খেলে শরীরের ভালো ব্যাকটেরিয়াও মরে যেতে পারে, যা হজমের সমস্যা বা ডায়ারিয়ার কারণ হয়।

ঙ) অন্য ঔষধের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া

যদি আপনি একাধিক ঔষধ একসঙ্গে খান, তবে একটি ঔষধ আরেকটির কাজে বাধা দিতে পারে বা অতিরিক্ত প্রভাব তৈরি করতে পারে। যেমন, ওয়ারফারিন (Warfarin) রক্ত পাতলা করার ঔষধ। এটির সঙ্গে অ্যাসপিরিন খেলে রক্তপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

সুতরাং, ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার পেছনে এই বিভিন্ন কারণ কাজ করে।

(৮) শেষকথা

আশা করি ঔষধ কিভাবে কাজ করে তা এখন নিশ্চয়ই পরিষ্কার হয়েছে। এটি কোনো জাদু বা ব্রেনের কাজ নয়, বরং বিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট প্রয়োগ। ঔষধের অণুগুলো আমাদের শরীরের রিসেপ্টরের সঙ্গে মিলে গিয়ে কাজ করে, যেমন করে একটি চাবি তালাকে খোলে। আশা করি, এই লেখাটি আপনার কৌতূহল মিটিয়েছে। আপনার যদি আরো প্রশ্ন থাকে, কমেন্টে জানান। নিজে সুস্থ থাকুন, অন্যদেরও সুস্থ রাখুন!

ডিসক্লেমার:

এই ব্লগ পোস্টটি শুধুমাত্র সাধারণ তথ্য ও শিক্ষার উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে। এটি কোনো পেশাদার চিকিৎসা পরামর্শ, রোগ নির্ণয় বা চিকিৎসার বিকল্প নয়। ঔষধ সেবন বা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই একজন যোগ্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এই লেখার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে যদি কোনো সমস্যা হয়, তবে লেখক বা প্রকাশক এর জন্য দায়ী থাকবেন না।

মানব শরীর ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট স্বাস্থ্য’ (inbangla.net/sastho) এর সাথেই থাকুন।

অনুরোধ!! পোষ্ট ভালো লাগলে প্লিজ উপরের শেয়ার আইকনে ক্লিক করে পোষ্টটি শেয়ার করে দিন।

Tags:

Leave a Reply

nv-author-image

ইন বাংলা নেট স্বাস্থ্য

মানব শরীর ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত যা কিছু বাংলাতে।View Author posts