Skip to content

কামরাঙ্গা গাছ চাষ পদ্ধতি

কামরাঙ্গা গাছ চাষ পদ্ধতি

অম্লমধুর স্বাদযুক্ত এবং ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ সমৃদ্ধ ফল কামরাঙ্গা আমাদের বাংলাদেশে সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ফল।

বাংলাদেশের সর্বত্র বাড়ির আঙ্গিনায় ২/১টি কামরাঙ্গা গাছ দেখা যায়। গাজীপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, ঢাকা, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় কামরাঙ্গা বেশি উৎপন্ন হয়।

কামরাঙ্গা গাছ
কামরাঙ্গা গাছ

কামরাঙ্গা ফল হতে জ্যাম, জেলী, মোরব্বা, চাটনি, আচার ইত্যাদি তৈরি করা হয়। কামরাঙ্গা একটি রপ্তানিযোগ্য ফল হওয়ায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষাবাদের প্রচুর সম্ভবনা রয়েছে।

(১) কামরাঙ্গার জাত পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্য

ক) বারি কামরাঙ্গা-১

বারি কামরাঙ্গা-১
বারি কামরাঙ্গা-১
  • উচ্চ ফলনশীল নিয়মিত ফলদানকারী জাত।
  • গাছ মাঝারী, মধ্যম খাড়া ও ঝোপালো।
  • বছরে তিনবার ফল দেয় (জুলাই-আগস্ট, নভেম্বর-ডিসেম্বর এবং ফেব্রুয়ারি)।
  • ফল মাঝারী (গড় ওজন ৯৭ গ্রাম), লম্বাটে, রং হালকা হলুদ, শাঁস সাদা, রসালো, কচকচে মিষ্টি (টিএসএস ৭.৫%) এবং ভক্ষণযোগ্য অংশ ৯৯%।
  • হেক্টরপ্রতি ফলন ৩৫ টন।
  • সমগ্র দেশে চাষোপযোগী এবং জাতটি রপ্তানিযোগ্য।

খ) বারি কামরাঙ্গা-২

বারি কামরাঙ্গা-২
বারি কামরাঙ্গা-২
  • উচ্চ ফলনশীল নিয়মিত ফলদানকারী জাত।
  • গাছ মাঝারী, মধ্যম খাড়া ও মধ্যম ঝোপালো।
  • বছরে তিনবার ফল দেয় (জানুয়ারি, জুলাই, এবং অক্টোবর)।
  • ফল মাঝারী (গড় ওজন ১০০ গ্রাম), ডিম্বাকৃতির ও রং হালকা হলুদ।
  • শাঁস সাদা, রসালো, কচকচে ও মিষ্টি (টিএসএস ৮.০%)।
  • এবং ভক্ষণযোগ্য অংশ ৯৯%।
  • হেক্টরপ্রতি ফলন ৫৩ টন।
  • সমগ্র দেশে চাষোপযোগী এবং জাতটি রপ্তানিযোগ্য।

(২) কামরাঙ্গা চাষ পদ্ধতি ও নিয়মসমূহ

ক) মাটি ও জলবায়ু

যে কোন প্রকার মাটিতে এর চাষ করা যায়। তবে সুনিষ্কাশিত গভীর দোআঁশ মাটি কামরাঙ্গা চাষের জন্য উত্তম।

উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু কামরাঙ্গা চাষের জন্য উপযোগী। বাংলাদেশের সকল অঞ্চলের আবহাওয়ায় কামরাঙ্গা চাষ করা সম্ভব। তবে দেশের পাহাড় অঞ্চলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কামরাঙ্গা চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।

এদের কিছুটা ঠান্ডা সহ্য করার ক্ষমতা আছে।

খ) বংশ বিস্তার

  • বীজ ও অঙ্গজ পদ্ধতিতে কামরাঙ্গার বংশ বিস্তার হয়ে থাকে।
  • বীজের গাছে মাতৃ গাছের গুণাগুণ পুরোপুরি বজায় থাকে না। বীজের গাছে ফল দিতে ৩-৪ বছর সময় লাগে।
  • অঙ্গজ পদ্ধতিতে তৈরি কলমের গাছে মাতৃ গাছের গুণাগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে এবং লাগানোর পরবর্তী বছর থেকেই ফল দিতে শুরু করে।
  • বীজ থেকে চারা তৈরি করে ১০-১২ মাস বয়ষ্ক সুস্থ সবল চারার উপর ৫-৬ মাস বয়ষ্ক উপজোড় ভিনিয়ার বা ফাটল পদ্ধতির মাধ্যমে কলম করা হয়।
  • সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাস কলম করার উপযুক্ত সময়।
  • এক বছর বয়ষ্ক কলমের চারা জমিতে রোপণের জন্য নির্বাচন করতে হবে।

গ) জমি নির্বাচন ও তৈরি

বর্ষায় পানি দাঁড়ায় না এমন উঁচু এবং মাঝারী উঁচু জমি কামরাঙ্গার জন্য নির্বাচন করতে হবে।

উন্মুক্ত বা আংশিক ছায়াযুক্ত স্থানে কামরাঙ্গা চাষ করা যায়।

বাগান আকারে চাষ করতে হলে নির্বাচিত জমি ভাল করে চাষ ও মই দিয়ে সমতল এবং আগাছামুক্ত করতে হবে।

ঘ) রোপণের সময় ও পদ্ধতি

  • সমতল ভূমিতে বর্গাকার বা আয়তাকার এবং পাহাড়ী ভূমিতে কন্টুর পদ্ধতিতে চারা রোপণ করা হয়।
  • গর্তের মাঝখানে চারা বসিয়ে গোড়ার মাটি একটু উঁচু করে দিতে হবে।
  • চারা লাগানোর পর একটা শক্ত কাঠির সঙ্গে বেঁধে দিতে হবে। তারপর সেচ দিতে হবে।
  • চারা বা কলম রোপণের উপযুক্ত সময় মধ্য-জ্যৈষ্ঠ থেকে মধ্য-ভাদ্র (জুন-সেপ্টেম্বর) মাস। তবে সেচ সুবিধা থাকলে আশ্বিন- কার্তিক (অক্টোবর) মাস পর্যন্ত চারা/কলম রোপণ করা যেতে পারে।

ঙ) গর্ত তৈরি

রোপণের ১৫-২০ দিন পূর্বে ৭ ⨉ ৭ মিটার দূরত্বে ১ ⨉ ১ ⨉ ১ মিটার আকারের গর্ত করতে হবে।

গর্তের উপরের মাটির সাথে ১০-১৫ কেজি জৈব সার, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি ও ১০০ গ্রাম জিপসাম সার ভালভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে পরিমাণমতো পানি দিতে হবে এবং এ অবস্থায় ১০-১৫ দিন রেখে দিতে হবে।

চ) সার প্রয়োগ

নিম্নে উল্লিখিত সার ২ কিস্তিতে প্রথমবার বর্ষার আগে ও দ্বিতীয়বার বর্ষার শেষের দিকে প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পর প্রয়োজনে পানি সেচ দিতে হবে।

সারের নাম১-৩ বছর বয়সের গাছপ্রতি৪-৬ বছর বয়সের গাছপ্রতি৭-১০ বছর বয়সের গাছপ্রতি১০ বছরের ঊর্ধ্বে বয়সের গাছপ্রতি
জৈব সার (কেজি)১০-১৫১৫-২০২০-৩০৩০-৪০
ইউরিয়া (গ্রাম)৩০০-৪০০৪০০-৬০০৬০০-৮০০৮০০-১০০০
টিএসপি (গ্রাম)২৫০-৩০০৩০০-৪০০৪০০-৫০০৫০০-৬০০
এমওপি (গ্রাম)২৫০-৩০০৩০০-৪০০৪০০-৪৫০৪৫০-৫০০

ছ) সেচ প্রয়োগ

  • চারা রোপণের পর ১ মাস নিয়মিত সেচ প্রদান করতে হবে।
  • শুষ্ক মৌসুমে এবং ফল ধরার পর প্রতি ১৫ দিন অন্তর ২-৩ বার সেচ দিলে ফল ঝরার মাত্রা কমে এবং ফলন বৃদ্ধি পায়।
  • বর্ষা মৌসুুমে বাগানে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।

জ) ডাল ছাঁটাইকরণ

  • রোপণকৃত চারা/কলমকে সুন্দর কাঠামো দেয়ার জন্য এর গোড়ার দিকের ডাল ছাঁটাই করতে হবে।
  • প্রধান কান্ডটিতে মাটি থেকে কমপক্ষে ১ মিটারের মধ্যে কোন ডাল রাখা চলবে না।
  • এ ছাড়া শীতকালীন ফল সংগ্রহের পর মচকানো, মরা, রোগাক্রান্ত, পোকাক্রান্ত ও অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে।

ঝ) ফল সংগ্রহ

  • পুষ্ট, রং উজ্জ্বল ও হালকা হলুদ হলেই ফল সংগ্রহ করতে হয়।
  • গাছে ঝাকি দিয়ে ফল আহরণ করা যাবে না এবং আহরণ কালে ফল যাতে মাটিতে না পড়ে এবং কোনভাবে আঘাতপ্রাপ্ত না হয় সেদিকে সতর্ক নজর রাখতে হবে।
  • বৃষ্টির পরপরই ফল সংগ্রহ করা ঠিক নয়। হাত দিয়ে বা জাল লাগানো কোটার সাহায্যে খুব সাবধানে ফল সংগ্রহ করতে হবে।
  • সংগৃহীত ফল সরাসরি রোদে না রেখে ছায়ায় রাখতে হবে।

(৩) কামরাঙ্গা গাছ চাষে রোগ ও পোকা ব্যাবস্থাপনা

ক) এ্যানথ্রাকনোজ রোগ

এ্যানথ্রাকনোজ রোগাক্রান্ত পাতা
এ্যানথ্রাকনোজ রোগাক্রান্ত পাতা
এ্যানথ্রাকনোজ রোগাক্রান্ত কামরাঙ্গা ফল
এ্যানথ্রাকনোজ রোগাক্রান্ত কামরাঙ্গা ফল
  • এক প্রকার ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়। পাতা, ফুল ও ফলে এ রোগ হতে পারে।
  • প্রথমে ছোট ছোট বাদামী রঙের দাগের মাধ্যমে এ রোগের শুরু হয় এবং আস্তে আস্তে এ দাগগুলো বড় হয়ে কালো বর্ণ ধারণ করে এবং আক্রান্ত স্থান পচে যায়।
  • আক্রান্ত পাতা, ফুল ও ফল ঝরে যেতে পারে।

প্রতিকার:

  1. আক্রান্ত পাতা, ফুল ও ফল সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
  2. রোগের লক্ষণ দেখা দিলে অটোস্টিন অথবা নোইন ৫ ডব্লিউপি প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন অন্তর ২/৩ বার স্প্রে করতে হবে।

খ) বাকল ও ডাল ছিদ্রকারী পোকা

কামরাঙ্গার ক্ষতিকর পোকাসমূহের মধ্যে এটি অন্যতম।

  • এ পোকা গাছের বাকল ও ডাল ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে। তাছাড়া কখনও কখনও এরা প্রশাখার কর্তিত অংশ দিয়েও ডালের ভিতর প্রবেশ করে।
  • এ পোকার কীড়া রাতের বেলায় গাছের বাকল খেয়ে গাছের খাদ্য চলাচলে ব্যাঘাত ঘটায়। আক্রমণ বেশি হলে পুরো গাছটাই এক সময় শুকিয়ে মারা যায়।
  • গাছে এ পোকার উপস্থিতি খুব সহজেই ডালের গায়ে ঝুলে থাকা কাঠের গুঁড়া-মিশ্রিত মলের ছোট ছোট দানা দ্বারা চিহ্নিত করা সম্ভব।
  • দিনের বেলায় কীড়া গর্তের মধ্যে লুকিয়ে থাকে এবং রাতের বেলা সচল হয়।

প্রতিকার:

  1. ডালের গায়ে ঝুলে থাকা কাঠের গুঁড়া মিশ্রিত মল পরিষ্কার করতে হবে ও কান্ডের ভিতরের পোকা বের করে মেরে ফেলতে হবে।
  2. ডালের গর্তের মধ্যে কেরোসিন বা পেট্রোল অথবা ন্যাপথোলিন প্রবেশ করিয়ে কাদা মাটি দ্বারা ছিদ্রের মুখ বন্ধ করে দিতে হবে।
  3. মার্শাল-২০ ইসি অথবা রগর/রকসিয়ন-৪০ ইসি জাতীয় কীটনাশক ২ মিলি প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে গাছে এক সপ্তাহ পর পর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে।
  4. পোকায় খাওয়া বাকল চেঁছে কপার জাতীয় ছত্রাকনাশকের প্রলেপ দিতে হবে।

গ) ফল ছিদ্রকারী পোকা

ফল ছিদ্রকারী পোকা আক্রান্ত কামরাঙ্গা ফল
ফল ছিদ্রকারী পোকা আক্রান্ত কামরাঙ্গা ফল
  • টক জাতের কামরাঙ্গায় এ পোকার আক্রমণ কম হলেও বারি কামরাঙ্গা-১, বারি কামরাঙ্গা-২ ও অন্যান্য মিষ্টি জাতে মাঝে মাঝে ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ দেখা যায়।
  • এ পোকা ফলের গায়ে ডিম পাড়ে এবং ডিম থেকে উৎপন্ন শুককীট ফলের শাঁস খেয়ে ভিতরে ঢুকে। এতে ফল খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যায়।

প্রতিকার:

  1. আক্রান্ত ফল সংগ্রহ করে কীড়াসহ মাটির গভীরে পুঁতে ফেলতে হবে।
  2. বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
  3. আলোক ফাঁদ ব্যবহার করেও এদের দমন করা যায়।
  4. ফল ধরার পর সুমিথিয়ন/লেবাসিড ২ মিলি হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।

ঘ) টিয়া পাখি

টিয়া পাখি কামরাঙ্গার প্রধান শত্রু। এরা যতটুকু ফল খায় তার চেয়ে অনেক বেশি নষ্ট করে। ফল সামান্য বড় হওয়ার পর থেকেই টিয়া পাখির আক্রমণ শুরু হয়।

প্রতিকার:

গাছকে জাল দ্বারা ঢেকে অথবা টিন পিটিয়ে শব্দ সৃষ্টির মাধ্যমে টিয়া পাখির আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষা করতে হবে।

বিভিন্ন উদ্ভিদ, গাছ ও ফসল যেমন- বিভিন্ন শস্য, সবজি, ফুল, ফল ইত্যাদি চাষাবাদ সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট চাষাবাদ’ (inbangla.net/casabad) এর সাথেই থাকুন।

Leave a Reply

nv-author-image

ইন বাংলা নেট চাষাবাদ

বিভিন্ন উদ্ভিদ, গাছ ও ফসল যেমন- বিভিন্ন শস্য, সবজি, ফুল, ফল ইত্যাদি চাষাবাদ সম্পর্কিত যা কিছু বাংলাতে।View Author posts