Skip to content

গুলশা/টেংরা মাছের চাষ পদ্ধতি

গুলশা-টেংরা মাছের চাষ পদ্ধতি
আলোচ্য বিষয়:

আবহমানকাল হতে বাংলাদেশে মিঠা পানির জলাশয়ে বিশেষ করে পুকুর, নদী-নালা, খাল-বিল ইত্যাদিতে যে মাছগুলো পাওয়া যায় তার মধ্যে গুলশা/টেংরা মাছ বাঙ্গালীর খুব প্রিয় এবং সুস্বাদু মাছ হিসাবে সমধিক প্রসিদ্ধ।

বর্তমানে বাজারে সরবরাহ কম এবং চাহিদা বেশী হওয়ার কারণে টেংরা মাছের বাজার মূল্য রুই জাতীয় মাছের তুলনায় অনেক বেশী। কিন্তু শস্যক্ষেতে অতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরা, কল-কারখানার বর্জ্য নিঃসরণ ইত্যাদি নানাবিধ কারণে বাসস্থান ও প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস হওয়ায় টেংরা মাছের প্রাচুর্যতা ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে।

এই আর্টিকেলটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- টেংরা মাছের ইংরেজি নাম জানতে পারবেন, টেংরা মাছের উপকারিতা বুঝতে পারবেন, টেংরা মাছের ছবি ও বৈশিষ্ট্যসমূহ চিনতে পারবেন, টেংরা মাছের খাদ্য কি তা সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন, সর্বপরি টেংরা মাছের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা অর্জন করতে পারবেন।

নিম্নে গুলশা/টেংরা মাছের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

(১) টেংরা মাছের ইংরেজি নাম

টেংরা মাছের ইংরেজি নাম

টেংরা মাছের স্থানীয় নাম হলৈা- ভিটা টেংরা, টেংরা এবং টেংরা মাছের ইংরেজি নাম হলো- Batasio

টেংরা মাছের বৈজ্ঞানিক নাম হলো দুইটা- Mystus vittatus এবং Batasio tengana। এটি Bagridae পরিবার এর অন্তর্গত। এটি বাংলাদেশ এর স্থানীয় মাছ।

(২) টেংরা মাছের উপকারিতা

টেংরা মাছের উপকারিতা

টেংরা মাছের পুষ্টিমান অন্যান্য মাছের তুলনায় অধিক, প্রতি ১০০ গ্রাম মাছে আমিষের পরিমাণ ১৯.২ গ্রাম, স্নেহ ৬.৫ গ্রাম, লোহা ০.৩০ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ০.২৭ গ্রাম, ফসফরাস ০.১৭ গ্রাম ও পানি ৭২.৬০ গ্রাম।

(৩) টেংরা মাছের ছবি ও বৈশিষ্ট্য

টেংরা মাছের ছবি ও বৈশিষ্ট্য
  • টেংরা মাছের দেহ আঁইশবিহীন চকচকে;
  • টেংরা মাছ ছোট, মাঝারি-বড়, বাৎসরিক/মৌসুমী ইত্যাদি প্রায় সব ধরনের পুকুরেই চাষ করা যায়;
  • টেংরা মাছ একক চাষের পাশাপাশি পাবদা ও কার্প জাতীয় মাছের সাথেও মিশ্র চাষ করা যায়;
  • এটি ক্যাটফিশ জাতীয় মাছ এবং খেতে খুবই সুস্বাদু;
  • চাহিদা ও বাজারমূল্য বেশী থাকায় এই মাছ চাষে বেশী আয় করা সম্ভব;
  • টেংরা মাছ ১ বছরে পরিপক্কতা লাভ করে, তবে দুই বছর বয়সি ব্রুড মাছ কৃত্রিম প্রজননে বেশী উপযোগী;
  • অধিক ঘনত্বে চাষ করার ক্ষেত্রে এ্যারেশনের ব্যবস্থা রাখলে ভাল উৎপাদন পাওয়া যায়;
  • জীবন্ত অবস্থায় বাজারজাত করা যায় ফলে অধিক মুনাফা;
  • এ মাছের রোগ ব্যাধি কম;
  • কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে সহজেই পোনা উৎপাদন করা যায়;

(৪) টেংরা মাছ চাষের পুকুরে ভৌত রাসায়নিক গুণাবলী

টেংরা মাছ চাষের পুকুরে ভৌত রাসায়নিক গুণাবলী
  • pH: ৭.০ হতে ৮.০ মাত্রা এ মাছ চাষের জন্য উত্তম;
  • পানির স্বচ্ছতা: ২৪-২৬ সে.মি. সেক্কি থাকা ভাল;
  • খরতা (Hardness): ৮০-২০০ মি.গ্রাম/লিটার রাখা প্রয়োজন;
  • তাপমাত্রা: ২৫-৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলে মাছের বর্ধন ভাল হয়;
  • আয়রন: ০-০.০২ পিপিএম থাকাই উত্তম;
  • মাটি: বেলে-দোঁআশ হওয়া উত্তম;
  • অক্সিজেনের মাত্রা: ৫ পিপিএম এর উপরে থাকতে হবে;

(৫) টেংরা মাছের খাদ্য কি?

টেংরা মাছের খাদ্য কি

টেংরা মাছ কাইরোনমিড লার্ভা, টিউবিফেক্স ওয়ার্ম, কুচো চিংড়ি, কেঁচো, জলজ পোকা-মাকড়, শ্যাওলা ও পাতার নরম অংশ খায়। এ মাছ সর্বভূক, বটম ফিডার এবং সম্পূরক খাদ্য হিসাবে সরিষার খৈল, চালের কুড়া, ফিসমিল দিয়ে তৈরি খাবার খায়। শিল্প কল- কারখানায় তৈরি ভাসমান খাবার খেয়ে এ মাছ দ্রুত বড় হয়। টেংরা মাছ নিশাচর ভাই রাতে খাদ্য গ্রহণে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

See also  পাবদা ও গুলশা/টেংরা মাছের চাষ পদ্ধতি

(৬) টেংরা মাছের মজুদপূর্ব ব্যবস্থাপনা

টেংরা মাছের মজুদপূর্ব ব্যবস্থাপনা
  • টেংরা মাছ চাষের জন্য পুকুর প্রস্তুতি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে;
  • পুকুর শুকানো, তলদেশের কাদা, জৈব অবশেষ অপসারণ করতে হবে;
  • পুকুর শুকিয়ে প্রস্তুত করলে মাছচাষকালীন অনেক সমস্যা মুক্ত থাকা যায়;
  • পাড় পরিস্কার, মেরামত ও সংস্কার করতে হবে, পুকুরের তলা মই দিয়ে সমান করে দেয়া ভাল;
  • পুকুরের পানি ঢুকানো ও বের করে দেয়ার জন্য ইনলেট ও আউটলেট থাকা উত্তম;
  • পুকুরের চারপাশ নাইলন নেট দিয়ে ঘিরে দিতে হবে;
  • পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে রোটেনন প্রয়োগ করে রাক্ষুসে ও অবাঞ্চিত মাছ দূর করা যায়;
  • এ ক্ষেত্রে ১.১% শক্তিমাত্রার রোটেনন ২৫ গ্রাম/শতাংশ ফুট পানিতে অথবা ৭% শক্তিমাত্রার রোটেনন ৩৫ গ্রাম/ শতাংশ/ ফুট পানিতে প্রয়োগ করতে হয়। এর বিষক্রিয়ার মেয়াদ: ৫-৭ দিন বিদ্যমান থাকে;
  • যেসব পুকুরে খরতা এবং pH দ্রুত উঠা নামা করে এবং প্রাকৃতিক খাদ্য সহজে উৎপাদন হয় না এ ধরনের পুকুরে প্রতি শতাংশে ১-১.৫ কেজি জিপসাম ডলোচুন প্রয়োগ করতে হবে। টেংরা মাছের পুকুর প্রস্তুতিতে সার ব্যবহার করার প্রয়োজন নাই;
  • পুকুরের তলদেশ ভিজা থাকা অবস্থায়। শতকে ১-১.৫ কেজি চুন প্রয়োগ করতে হবে;
  • পুকুরের তলা আলোড়িত (হররা টানা) করতে হবে;

পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য বিশেষ করে জুপ্লাংকটন তৈরির জন্য নিম্নোক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে-

প্রয়োজনীয় উপাদানমাত্রাব্যবহার পদ্ধতি
অটোকুঁড়া/মিহিকুঁড়া২০০ গ্রাম/শতাংশ একত্রে ৩ গুণ পানিতে ২৪ ঘণ্টা ভিজানোর পর কেবল জলীয় অংশ পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। এভাবে পর পর ৩ দিন প্রয়োগ করতে হবে।
চিঁটাগুড়২০০ গ্রাম/শতাংশ 
ইস্ট৫-১০ গ্রাম/শতাংশ 
অটোকুড়ার পরিব ৩৫-৪০% প্রোটিন সমৃদ্ধ নার্সারি-১ ফিড (পাউডার) ব্যবহার করতে হবে ৩০০ গ্রাম/শতাংশ

(৭) সুস্থ সবল টেংরা মাছের পোনার বৈশিষ্ট্য

সুস্থ সবল টেংরা মাছের পোনার বৈশিষ্ট্য
  • গাত্রবর্ণ উচ্ছ্বল ও চকচকে, পিঠের দিকে কালচে বর্ণের হয়;
  • স্রোতের বিপরীতে ঝাঁক বেধে দ্রুত চলাচলে সক্ষম;
  • গা পিচ্ছিল এবং গায়ে কোন প্রকার ক্ষত চিহ্ন থাকবে না;

(৮) টেংরা মাছের পোনা সংগ্রহ, টেকসইকরণ ও পরিবহণ

টেংরা মাছের পোনা সংগ্রহ, টেকসইকরণ ও পরিবহণ
  • পরিচিত, স্বনামধন্য, বিশ্বস্ত হ্যাচারি থেকে খোঁজ খবর নিয়ে ভালমানের পোনা সংগ্রহ করতে হবে;
  • টেংরা মাছের পোনা মজুদের উদ্দেশ্যে পরিবহণের পূর্বেই টেকসই করে নিতে হবে;
  • সরবরাহের উদ্দেশ্যে পোনা ধরার আগের শেষরাত থেকে খাদ্য প্রদান বন্ধ রাখতে হবে;
  • আহরণকৃত পোনাগুলো ট্যাংক বা সিস্টার্ণে ৮-১২ ঘন্টা ঝরণা ধারায় রেখে টেকসই করতে হবে;
  • টেংরা মাছের পোনা ড্রামে পরিবহণ করা যায়। 
  • ২-৪ সে. মি. আকারের পোনা অক্সিজেন যুক্ত ব্যাগে (৩৬” x ২২” x ২৪”) ব্যাগ প্রতি ১০০০টি হারে ৪-৬ ঘণ্টার দূরত্বে পরিবহণ করা যায়। পোনার আকার ৪-৫ সে. মি. হলে একই সময়ের দূরত্বে ৫০০টি পোনা ঐ ব্যাগে পরিবহণ করা যায়।
  • পোনা ভালো রাখার জন্য ৪৫ লিটার পানির প্রতি ২০টি ব্যাগের জন্য ১০ গ্রাম অক্সিজেন পাউডার, ১ প্যাকেট ওরস্যালাইন বা ভিটামিন-সি ১০ গ্রাম হারে পৃথকভাবে গুলিয়ে ২০টি ব্যাগে সমহারে ভাগ করে দিতে হবে:
  • টেংরা পানির তাপমাত্রার সাথে ধীরে ধীরে খাপ খাইয়ে পুকুরে ছাড়তে হবে;

(৯) টেংরা মাছের মজুদ ঘণত্ব

টেংরা মাছের মজুদ ঘণত্ব
  • সাধারণত ৪৫-৫০ দিন বয়সের পোনা মজুদের উপযুক্ত হয়;
  • এ বয়সের পোনার বাঁচার হার শতকরা ৭০-৮০%;
  • টেংরা মাছ চাষের একক চাষে প্রতি শতকে ৩৬ সে.মি. আকারের ১০০০-১২০০টি পোনা মজুদ করা উত্তম;
  • সমআকারের পোনা মজুদের চেষ্টা করতে হবে;
  • টেংরা মাছ এককভাবে এবং অন্যান্য মাছের সাথেও মিশ্র পদ্ধতিতে চাষ করা যেতে পারে;
  • উপরের স্তরে বসবাসকারী পাবদা মাছের সাথে নিম্ন স্তরে বসবাসকারী টেংরা মাছের যৌথভাবে অধিক ঘনত্বে মিশ্রচাষ বেশ জনপ্রিয়;
See also  গুলশা/ট্যাংরা মাছের পোনা উৎপাদন পদ্ধতি

নিম্নে পোনা মজুদের একক ও মিশ্র কয়েকটি মডেল প্রদান করা হলো-

প্রজাতিমডেল-১
(সংখ্যা)
মডেল-২
(সংখ্যা)
মডেল-৩
(সংখ্যা)
মডেল-৪
(সংখ্যা)
মডেল-৫
(সংখ্যা)
টেংরা১০০০-১২০০৬০০-৭০০৪০০-৫০০৪০০-৫০০৩০০-৪০০
পাবদা৩০০-৪০০৬০০-৭০০
রুই জাতীয়৪-৬৮-১০৮-১০৮-১০১০-১২
শিং/মাগুর১০০-২০০৬০০-৭০০
গুলশা৫০০-৬০০
  • যে সকল পুকুরে এ্যারেশন, পানি পরিবর্তন এবং তলানি অপসারণের ব্যবস্থা আছে সেসব পুকুরে শতকে ২০০০-৪০০০টি পোনা মজুদ করা যেতে পারে;
  • পুকুরের ধারণ ক্ষমতা বিবেচনায় রেখে প্রয়োজনে আংশিক আহরণ করতে হবে;
  • ছোট প্রজাতির মাছের (শিং, গুলশা, টেংরা) সাথে পাবদা মাছের মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে পাবনা পরে ছাড়তে হবে বা অন্যদের চেয়ে ছোট আকারের পাবদার পোনা ছাড়তে হবে;

(১০) টেংরা মাছের মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা

টেংরা মাছের মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা

সাধারণ:

  • পোনা মজুদের পরদিন পোনা বাঁচার হার পর্যবেক্ষণ করতে হবে;
  • যদি পোনার মৃত্যুহার বেশী হয় তবে পুনরায় মজুদ করতে হবে;

খাদ্য ব্যবস্থাপনা:

  • পোনা মজুদের পরদিন থেকে মাছের মোট ওজনের শতকরা ৩০ ভাগ থেকে শুরু করে মাছ বৃদ্ধির সাথে সাথে কমিয়ে শতকরা ৩ ভাগ হারে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে;
  • ভাসমান খাবার নিয়ে এ মাছ চাষ করলে দ্রুত ভাল ফলন পাওয়া যায়;
  • রুই জাতীয় মাছের জন্য ভিজা বা ডুবন্ত খাবার ব্যবহার করা যেতে পারে;
  • টেংরা মাছের আকার ১-১.৫ ইঞ্চি পর্যন্ত ৩৫-৪০% আমিষ যুক্ত পাউডার খাবার দেয়া যেতে পারে, পরবর্তী-তে আমিষের পরিমাণ কমিয়ে ৩০-৩৫% আমিষ সমৃদ্ধ খাবার দেয়া যেতে পারে;
  • ১.৫ ইঞ্চির পর থেকে মাছের আকারের ওপর ভিত্তি করে ০.৫-২.০ মিমি আকারের ভাসমান দানাদার খাবার দিতে হবে;
  • টেংরা মাছ নিশাচর এবং রাতে খাবার খেতে পছন্দ করে, তাই শেষ রাতে ও সন্ধ্যা রাতে দৈনিক দুই বার খাবার দিতে হবে;
  • সাধারণত ভাসমান খাবার প্রয়োগ করলে ১৫-২০ মিনিট ধরে যে পরিমাণ খাবার খাবে সে পরিমাণ খাবার সরবরাহ করাই নিরাপদ;
  • মাছের খাবারের প্রতি আগ্রহ দেখেই খাবার দেয়া ভাল। অতিরিক্ত খাবার দেয়া কোনভাবেই উচিৎ নয়;
  • মেঘলা আবহাওয়া এবং তাপমাত্রা কম থাকলে (শীত কালে) খাদ্য প্রয়োগ কমিয়ে দিতে হবে;

নমুনাকরণ:

  • মাছের বৃদ্ধি হার এবং স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের জন্য নমুনাকরণ করতে হয়;
  • কোনভাবেই জাল টেনে মাছ ধরে দেখা যাবে না কারণ টেংরা মাছের দেহে কোন আঁইশ থাকে না বিধায় অসাবধানতাবসত মাছের কাঁটার আঘাতে মাছের গায়ে ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে এবং সেখান থেকে সংক্রমণ সকল মাছে ছড়িয়ে পড়তে পারে;
  • সাধারণত খাবার দিলে টেংরা মাছ পানির উপরে চলে আসে তা দেখে আমাদের ধারণা করতে হবে মাছ কত বড় হয়েছে বা তাদের সাড়া দেখে বুঝতে হবে মাছ কেমন আছে;
  • খুব প্রয়োজন হলে ঠেলা জাল দিয়ে কয়েকটি মাছ ধরে পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে;

অন্যান্য পরিচর্যা:

  • মাছের চাষ নিরাপদ রাখার জন্য নিম্নলিখিত কাজগুলো করা প্রয়োজন-
  • সপ্তাহে ১ বার বেলা ১১ ১২টার মধ্যে পুকুরে হররা টানতে হবে;
  • কোন সমস্যা না থাকলেও প্রতিদিন সকালে ১-২ ঘণ্টা পানি ঝরণাকারে দিতে হবে;
  • পুকুরে পানি কমে গেলে বাহির থেকে বিশুদ্ধ আয়রনমুক্ত পানি সরবরাহ করতে হবে;
  • পানির স্বচ্ছতা ২৪. ২৬ সে.মি সেকি এর মধ্যে রাখতে হবে;
  • সাধারণত টেংরা মাছ চাষের ক্ষেত্রে কোন সার প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না;
  • মাছের স্বাস্থ্য ভাল রাখা এবং বর্ধন স্বাভাবিক রাখার জন্য ১০-১৫দিন পর পর খাদ্যের সাথে ভিটামিনের প্রিমিক্স মিশিয়ে খাওয়াতে হবে;
  • প্রতি মাসে একবার শতকে ১৫০-২০০ গ্রাম চুন প্রয়োগ হবে;
  • পুকুরের তলদেশের গ্যাস দূর করার জন্য জিওলাইট দিতে হবে;
See also  পাবদা ও গুলশা/টেংরা মাছের চাষ পদ্ধতি

(১১) টেংরা মাছের একক চাষ পদ্ধতি

টেংরা মাছের একক চাষ পদ্ধতি

পুকুর প্রস্তুতি:

  • সাধারণতঃ ১৫-২৫ শতাংশের যে কোন পুকুরে যেখানে পানির গভীরতা ১.০-১.৫
  • মিটার থাকে এমন পুকুর এই মাছের একক চাষের জন্য উপযোগী।
  • পুকুরের পাড় মেরামত ও জলজ আগাছা পরিস্কার করে নিতে হবে এবং শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ আবশ্যক।
  • চুন প্রয়োগের ২-৩ দিন পর শতাংশে ৬ কেজি হারে গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে।
  • গোবর সার প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর প্রতি শতাংশে ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি পানিতে গুলিয়ে ছিটিয়ে দিতে হয়।

পোনা মজুদ:

  • সার প্রয়োগের ৩-৪ দিন পর ৩-৪ গ্রাম ওজনের পোনা শতাংশে ২৫০টি হারে মজুদ করা যেতে পারে।
  • পুকুরে পোনা ছাড়ার পূর্বে পানির তাপমাত্রা ও অন্যান্য গুনাবলী যাতে সহনশীল হয় সে জন্য পোনাকে ধীরে ধীরে খাপ খাইয়ে পুকুরে ছাড়তে হবে।

খাদ্য ও সার প্রয়োগ:

  • পোনা মজুদ করার পর দিন থেকে মাছের দেহ ওজনের শতকরা ২০-৬ ভাগ হারে সম্পুরক খাদ্য হিসাবে চালের কুঁড়া (২০%), ফিশমিল (৩০%), সরিষার খৈল (১৫%), মিট ও বোন মিল (১০%), সয়াবিন পাউডার (২০%), আটা (৪%), ভিটামিন ও খনিজ লবণ (১%) এর মিশ্রণ সরবরাহ করতে হবে।
  • প্রতি ১৫ দিন অন্তর জাল টেনে মাছের দৈহিক বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করে খাদ্যের পরিমাণ বাড়াতে হবে।
  • রৌদ্রজ্জল দিনে জৈব সার গোবর (প্রক্রিয়াজাত) সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
  • সপ্তাহে একবার পুকুরে হররা টানতে হবে।
  • পুকুরে পানি কমে গেলে বাহির হতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে।
  • পানির স্বচ্ছতা ২০ সেঃমিঃ এর মধ্যে সীমিত থাকলে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।

মাছ আহরণ ও উৎপাদন:

এই চাষ পদ্ধতিতে ৬ মাসে গুলশা মাছ ৫০-৬০ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। মাছ আহরণ কালে পুকুরের সমস্ত পানি শুকিয়ে মাছ ধরার ব্যবস্থা করতে হবে। আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে গুলশা মাছ চাষ করে ৬-৭ মাসে হেক্টরে ২,২০০ থেকে ২,৫০০ কেজি মাছ উৎপাদন করা যায়।

আর-ব্যয়:

একক চাষ পদ্ধতিতে গুলশা মাছ চাষে ৬ মাসে হেক্টরে ২.২০ লক্ষ টাকা ব্যয় করে প্রায় ১.৫০-১.৮০ লক্ষ টাকা মুনাফা অর্জন করা সম্ভব।

(১২) রুই জাতীয় মাছের সাথে টেংরা মাছের মিশ্র চাষ পদ্ধতি

রুই জাতীয় মাছের সাথে টেংরা মাছের মিশ্র চাষ পদ্ধতি

অর্থনৈতিক বিবেচনায় রুই জাতীয় মাছের সাথে গুলশা মাছের মিশ্র চাষ করা লাভজনক। ফলে সহ অবস্থানের মাধ্যমে একই পুকুর থেকে গুলশাসহ রুই জাতীয় মাছের উৎপাদন পাওয়া সম্ভব। নিম্নে চাষ পদ্ধতির ধাপসমূহ বিধৃত করা হলোঃ

পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি:

  • মিশ্র চাষের জন্য ৪০-৬০ শতাংশ আয়তনের পুকুর নির্বাচন করতে হবে, যেখানে বছরে কমপক্ষে ৮-৯ মাস ৪-৬ ফুট পানি থাকে।
  • পুকুর থেকে রাক্ষুসে ও অবাঞ্চিত মাছ দূর করার জন্য মিহি ফাঁসের জাল বার বার টেনে এদের সরাতে হবে।
  • রাক্ষুসে ও অবাঞ্চিত মাছ দূর করার পর শতাংশে ১ কেজি চুন, ৩-৪ দিন পর ৬-৮ কেজি পঁচা গোবর, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি পানিতে গুলিয়ে ছিটিয়ে দিতে হয়।
  • সার প্রয়োগের ৩-৫ দিন পর পুকুরের পানি সবুজাভ হলে পোনা মজুদ করতে হবে।

পোনা মজুদ:

প্রতি শতাংশে ৫-৭ সে.মি. আকারের ৮০টি গুলশা এবং ১০-১২ সে.মি. আকারের ৮টি কাতলা, ১২টি রুই, ১০টি মৃগেল ও ২টি গ্রাস কার্প এর সুস্থ পোনা মজুদ করতে হবে।

See also  গুলশা/ট্যাংরা মাছের পোনা উৎপাদন পদ্ধতি

খাদ্য ও সার প্রয়োগ:

  • পোনা ছাড়ার পরের দিন থেকে চালের কুঁড়া (৪০%), গমের ভূষি (২৫%) সরিষার খৈল (২০%) ও ফিশমিল (১৫%) মাছের দেহ ওজনের শতকরা ৮-৩ ভাগ হারে দেয়া যেতে পারে।
  • পোনা মজুদের পর ১৫ দিন অন্তর শতাংশ প্রতি ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ৪ কেজি গোবর (প্রক্রিয়াজাত) প্রয়োগ করতে হবে।

চাষ ব্যবস্থাপনা:

অপেক্ষাকৃত ভাল উৎপাদন পাওয়ার লক্ষ্যে নিম্নবর্ণিত বিষয় সমূহের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে-

  • নিয়মিতভাবে খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
  • প্রতি সপ্তাহে একবার হররা টানতে হবে।
  • পুকুরের পানি কমে গেলে বাহির হতে পানি সরবরাহ করতে হবে।
  • পানির স্বচ্ছতা ২০ সে.মি. এর মধ্যে সীমিত থাকলে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।

আহরণ ও উৎপাদন:

  • গুলশা মাছ ৬০-৮০ গ্রাম ওজনের হলে বিক্রয়ের জন্য আহরণ করা যেতে পারে।
  • পোনা মজুদের ৮-৯ মাস পর সমস্ত মাছ আহরণ করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • গুলশা মাছ ধরার জন্য প্রথমে ঝাঁকি জাল এবং পরে পুকুর শুকিয়ে ধরা যেতে পারে।
  • উল্লেখিত চাষ পদ্ধতিতে হেক্টরে গুলশা ৮০০-৯০০ কেজি এবং রুই জাতীয় মাছ ৪,৫০০-৫,০০০ কেজি উৎপাদন পাওয়া সম্ভব।

আয়-ব্যয়:

গুলশা মাছের সাথে রুই জাতীয় মাছ চাষে হেক্টরে প্রায় ২.০ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে ২.৫০ লক্ষ টাকা মুনাফা অর্জন করা যায়।

(১৩) টেংরা মাছ আহরণ ও উৎপাদন

টেংরা মাছ আহরণ ও উৎপাদন
  • টেংরা মাছ ৭-৮ মাসে কেজিতে ৩৫-৪০টি পর্যন্ত হয়ে থাকে; 
  • সাধারণত জাল দিয়ে সমস্ত টেংরা মাছ ধরা যায় না তাই মাছ আহরণকালে পুকুরের সমস্ত পানি শুকিয়ে ধরার ব্যবস্থা করতে হবে;
  • আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে টেংরা মাছ চাষ করে ৭-৮ মাসে হেক্টরে ৪০০০-৫০০০ কেজি মাছ উৎপাদন করা যায়;

(১৪) টেংরা মাছ বাজারজাতকরণ

টেংরা মাছ বাজারজাতকরণ
  • টেংরা মাছ জীবন্ত অবস্থায় বাজারজাত করলে বাজারমূল্য বেশী পাওয়া যায়;
  • জীবন্ত অবস্থায় বাজারজাত করার জন্য টেংরা মাছ আহরণের পর হাউজ বা ট্যাংকে ৮-১২ ঘন্টা পানির ঝরণা ধারায় রাখতে হয়;

(১৫) টেংরা মাছ চাষে সতর্কতা

টেংরা মাছ চাষে সতর্কতা
  • টেংরা চাষের ক্ষেত্রে চাষীদেরকে অক্সিজনের স্বল্পতা প্রতিরোধে সোডিয়াম পার কার্বোনেট ও গ্যাস নিবারক সংগ্রহে রাখা প্রয়োজন;
  • পানির pH ৮ এর উপর হলে তা কমানোর ব্যবস্থা হিসেবে পানি পরিবর্তন করা বা তেতুল ব্যবহার করা বা শতকে ১ কেজি হারে জিপসাম প্রয়োগ করা যেতে পারে;
  • পানি যাতে বেশি সবুজ না হয়ে যায় সে দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে;
  • মাছে অসুখ দেখা দিলে পরিবেশগত চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে;
  • অনেক সময় মাছের খাবার গ্রহণ হার কমে যেতে দেখা যায়, এ ক্ষেত্রে পুকুরে পানি দেয়া যেতে পারে, ১৫০- ২০০ গ্রাম / শতক মাত্রায় চুন প্রয়োগ করলে সমস্যা সমাধান হতে পারে। মাছ থাকা অবস্থায় চুন ব্যবহারের ক্ষেত্রে চুন ভালোভাবে গুলিয়ে সকাল ৮-১০টার মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে;
  • সবসময় একই আকারের পোনা ছাড়তে হবে;
  • মাছ চাষে কোন প্রকার সমস্যা দেখা দিলে স্থানীয় মৎস্য অফিসের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

প্রিয় পাঠক বন্ধু, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা টেংরা মাছের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় যেমন- টেংরা মাছের ইংরেজি নাম, টেংরা মাছের উপকারিতা, টেংরা মাছের ছবি ও বৈশিষ্ট্য, টেংরা মাছ চাষের পুকুরে ভৌত রাসায়নিক গুণাবলী, টেংরা মাছের খাদ্য কি, টেংরা মাছের মজুদপূর্ব ব্যবস্থাপনা, সুস্থ সবল টেংরা মাছের পোনার বৈশিষ্ট্য, টেংরা মাছের পোনা সংগ্রহ, টেকসইকরণ ও পরিবহণ; টেংরা মাছের মজুদ ঘণত্ব; টেংরা মাছের মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা; টেংরা মাছের একক চাষ পদ্ধতি; রুই জাতীয় মাছের সাথে টেংরা মাছের মিশ্র চাষ পদ্ধতি; টেংরা মাছ আহরণ ও উৎপাদন; টেংরা মাছ বাজারজাতকরণ; টেংরা মাছ চাষে সতর্কতা প্রভৃতি বিষয় জানতে পারলাম।

বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা, দারিদ্র বিমোচন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। এদেশের মানুষের দৈনিক মাথাপিছু ৬০ গ্রাম মাছের চাহিদার বিপরীতে প্রাপ্তির পরিমাণ ৬২.৫৮ গ্রাম।

তাই লাগসই প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে চাহিদা সম্পন্ন ও উচ্চমূল্যের এ সুস্বাদু টেংরা মাছটির উৎপাদন বৃদ্ধি করে বাজারে প্রাচুর্যতা নিশ্চিত করা যায়।


বিভিন্ন ধরণের মৎস্য বা মাছ চাষ সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট মৎস্য’ (inbangla.net/motsyo) এর সাথেই থাকুন।

Leave a Reply

nv-author-image

ইন বাংলা নেট কৃষি

পশু-পাখি পালন ও চাষাবাদ সম্পর্কিত যা কিছু বাংলাতে।View Author posts