একটি নতুন ছাগল বাড়িতে/খামারে আনার আগে, এটিকে সমস্ত প্রযোজ্য টিকা দেওয়া উচিত। যেহেতু বেশ কয়েকটি রোগ রয়েছে যা আপনার ছাগলকে অসুস্থ করতে পারে, তাই সেগুলি কী এবং কীভাবে সঠিকভাবে টিকা দিতে হয় তা জানা গুরুত্বপূর্ণ।
তাই ইন বাংলা নেটের আজকের এই পোষ্টতে আমরা ছাগলের ভ্যাকসিন তালিকা এবং ছাগলের ভ্যাকসিন দেয়ার নিয়মগুলো সম্পর্কে জানব।
(১) ছাগলকে ভ্যাকসিন কেন দিতে হয়?

ভ্যাকসিন বা টিকা একটি জৈবিক প্রোডাক্ট। নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত প্রাণীর দেহ হতে উক্ত জীবাণু সংগ্রহ করে বিশেষ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়। পরে ওই জীবাণুকে নিস্তেজ বা অর্ধমৃত বা মৃত অবস্থায় এনে এক ধরনের জীবাণুজাত ওষুধ তৈরি করা হয় যা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে দেহে প্রবেশ করালে উক্ত ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস জাতীয় রোগের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে, যাকে ভ্যাকসিন বা টিকা বলে।
বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করার জন্য ভ্যাকসিন অতি গুরুত্বপূর্ণ। ছাগলের কিছু কিছু রোগ আছে যা শুধু ভ্যাকসিন প্রয়োগের মাধ্যমেই প্রতিরোধ করা যায়। আবার এ রোগগুলি যদি দেখা দেয় তাহলে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় এবং অনেক ছাগল মারা যায়।
ছাগলের রোগের কয়েকটি উদাহরণ হলো-
- এন্টারোটোক্সেমিয়া: একটি বহুল দেখা ছাগল রোগ যা সাধারণত হজম প্রক্রিয়াটি ধীর করে দেয় এবং পেটে ব্যথা হয় এবং সম্ভবত ছাগলেরও মৃত্যু ঘটায় তবে বার্ষিক টিকা এটিকে আটকাতে পারে। এর জন্য ভ্যাকসিনকে সিডিটি বলা হয় এবং এতে টিটেনাসও রয়েছে।
- জলাতঙ্ক: এমন একটি জিনিস যা কোনও প্রজাতির প্রাণীতে কেউ দেখতে চায় না। এটি সংক্রামিত প্রাণী থেকে কামড়ের মাধ্যমে সংক্রামিত হয় এবং মারাত্মক হতে পারে।
- নিউমোনিয়া: তাৎক্ষণিক ভাবে চিকিৎসা দেওয়া না হলে মৃত্যু হতে পারে। এই রোগের টিকা সাধারনত চার থেকে ছয় মাস বয়সের মধ্যে দিতে হয়।
(২) ছাগলকে কি কি ভ্যাকসিন দিতে হয়?

ছাগলের পি.পি.আর এবং এফ.এম.ডি বা ক্ষুরা রোগ সবচেয়ে বেশি হয়। ছাগলকে ২.৫-৬ মাস বয়সের মধ্য PPR, FMD, Pox Vaccine, Anthrax এই চারটি দিতে হবে। তবে একটা ভ্যাক্সিন দেয়ার ১৫ দিন পর আরেকটি ভাক্সিন দিতে হয়।
প্রাণী যত্নের একটি বড় অংশ হ’ল রোগ প্রশমন ও প্রতিরোধ। আপনার নিজে ও প্রাণীর ধরণের নির্বিশেষে, অসুস্থতা এবং রোগ এমন একটি সমস্যা যার সাথে আপনি মুখোমুখি হবেনই।
আপনার ছাগলের সুস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠার এবং বজায় রাখার ক্ষেত্রে নিয়মিত টিকা দেওয়া বিশেষ ভাবে ভূমিকা রাখে। একটি ভ্যাকসিনের উদ্দেশ্য হ’ল প্রতিটি ছাগলের রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা বাড়ানো।
(৩) ছাগলের ভ্যাকসিন তালিকা এবং ছাগলের ভ্যাকসিন দেয়ার নিয়ম সমূহ

নিম্নে চারটি কমন ছাগলের ভ্যাকসিন তালিকা এবং ছাগলের ভ্যাকসিন দেয়ার নিয়ম সমূহ তুলে ধরা হলো-
১। ছাগলের পি.পি.আর ভ্যাকসিন
- রোগের নাম: পি.পি.আর
- প্রদাহের স্থান: চামড়ার নিচে
- মাত্রা: ১ সিসি
- ইমিউনিটি: ৬ মাস
- ভ্যাকসিন দেয়ার নিয়ম: ছাগলের বাচ্চার বয়স ২ মাস হলেই এ টীকা দেওয়া যাবে। ৬ মাস পর বুস্টার ডোজ দিতে হবে।এর পর থেকে বছরে এক বার করে দিতে হবে।
২। ছাগলের ক্ষুরা রোগ বা এফ.এম.ডি ভ্যাকসিন
- টিকার নাম: ক্ষুরা রোগ টিকা
- প্রদাহের স্থান: চামড়ার নিচে
- মাত্রা: মনোভ্যলেন্ট- ১ সিসি; বাইভ্যালেন্ট- ২ সিসি; ট্রাইভ্যালেন্ট- ৩ সিসি
- ইমিউনিটি: ৬ মাস
- ভ্যাকসিন দেয়ার নিয়ম: ৪ মাস বয়স থেকে শুরু করে যেকোন বয়সের ছাগলকে এমনকি গর্ভবতী ছাগলকে দেওয়া যাবে।
৩। ছাগলের বসন্তের টিকা বা গোট পক্স ভ্যাকসিন
- টিকার নাম: Goat pox vaccine।
- প্রদাহের স্থান ও মাত্রা: পানিতে এ টিকা গুলে ২ মিলি প্রতি ছাগলের লেজের গোড়াতে ত্বকের নিচে ইনজেকশন করতে হয়।
- নিয়ম: ছাগলের বসন্তের টিকা ভায়ালে হিমায়িত অবস্থায় থাকে। ভায়ালের সাথে বিশুদ্ধ পানি থাকে। ছাগলের ৫ মাস বয়সে প্রথম এ টিকা দিতে হয়।
৪। ছাগলের তড়কা রোগের টিকা বা এ্যানথাক্স ভ্যাকসিন
- রোগের নাম: তড়কা
- প্রদাহের স্থান: ঘারের চামড়ার নিচে
- মাত্রা: ছাগল-১/২ সিসি
- ইমিউনিটি: ১ বৎসর। প্রথম বার ভ্যাকসিন দেবার পর বছরে ১বার করে দিতে হবে।
- ভ্যাকসিন দেয়ার নিয়ম: তড়কা টিকা ১০০ মিলি বোতলে তরল অবস্থায় থাকে। পশুর ৬ মাস বয়সে প্রথম টিকা দিতে হয়। ১ বছর অন্তর এ টিকা দিতে হয়। ছাগল/ভেড়ার ক্ষেত্রে গর্ভধারণের ৩ মাস পরে দেয়া যাবে না।
(৪) ছাগলের ভ্যাকসিন দেয়ার নিয়ম ও করণীয় সমূহ

ভ্যাকসিন বা টিকা দেয়ার উদ্দেশ্য হলো পশুপাখিকে রোগের হাত হতে রক্ষা করা কিন্ত অনেক সময় ভ্যাকসিন দিয়ে রোগের প্রকোপ কমানো যায় না এমনকি রোগ প্রতিরোধ তৈরির পূর্বে অনেক পশুপাখি দুর্ঘটনায় পড়ে। ভ্যাকসিন দেয়ার পর পরই প্রচন্ড ব্যথা হওয়া, লালা ঝরা, অস্থিরতাসহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায় এমনকি পশু সংগে সংগে/কয়েক ঘন্টার মধ্যে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। আবার অনেক সময় ভ্যকাসিনের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসেবে টিকা প্রদানের জায়গার মাংসপেশী অনেক ফুলে যায় অথবা ফোঁড়া হয়। এমনকি দুধ শুকিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। এসব দুর্ঘটনা এড়াতে হলে ভ্যাকসিন প্রদানকারীকে অবশ্যই নিম্নবর্ণিত বিষয়সমূহ মেনে চলতে হবে।
- টিকা বা ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার মেয়াদকাল দেখে নিতে হবে অর্থাৎ ভ্যাকসিনের মেয়াদ উর্ত্তীণের তারিখ নিশ্চিত হতে হবে।
- ব্যবহারের পূর্ব পর্যন্ত ভ্যাকসিন কুল বক্স বা ফ্লাক্সে রাখতে হবে।
- ব্যবহারের পূর্বে বোতল ভালোভাবে ঝাঁকিয়ে নিতে হবে যাতে টিকা সমভাবে মিশে যায়।
- ভ্যাকসিন সাধারণত ভোরে দেয়া উত্তম।
- সরাসরি সূর্য কিরণ থেকে টিকার বোতল দূরে রাখতে হবে।
- সব গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়া একত্র করে ভ্যাকসিন দিতে হবে।
- বোতল খোলার ২ ঘন্টার মধ্যে ভ্যাকসিন প্রদান শেষ করা উত্তম।
- ভ্যাকসিন কোনো ছায়াযুক্ত বা গাছের নীচে ব্যবহার করতে হবে।
- যে কোনো ভ্যাকসিন প্রথমে একটি পশুকে দিয়ে ১৫-২০ মিনিট লক্ষ্য করতে হবে কোনো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হয় কিনা যদি না হয় তবে নিশ্চিন্তে বাকী পশুদেরকে দেয়া যায়।
- যে সব টিকা চামড়ার নীচে দিতে হয় তা যেন কোনো অবস্থায় মাংসপেশীতে না যায়।
- টিকা কেবল সুস্থ সবল পশুকে দেওয়া উচিত।
- দুর্বল পশু ও ৪ মাসের নীচের পশুকে ভ্যাকসিন দেয়া ঠিক নয়।
(৫) সঠিকভাবে ছাগলের ভ্যাকসিন দেয়ার নিয়ম না মানলে, কখন ভ্যাকসিন আর কাজ করেনা?

সঠিকভাবে ছাগলের ভ্যাকসিন দেয়ার নিয়ম না মেনে, ছাগলকে ভ্যাকসিন দেবার পরেও, সেই ভ্যাকসিন কাজ না করার কারণসমূহ-
অর্থ্যাৎ, যেসব কারণে গবাদিপশুকে ভ্যাকসিন বা টিকা দেয়ার পরও রোগ প্রতিরোধ হয় না তা নীচে বর্ণিত হলো।
- পশুপাখির যে রোগের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে যদি ওই রোগের জীবাণু পূর্বেই পশুপাখির শরীরে সুপ্ত অবস্থায় থাকে তবে ওই ভ্যাকসিন কার্যকর হবে না বরং আরো দ্রুত রোগ দেখা দিবে।। এজন্য কোনো পশুপাখির খামার/ ঝাঁকে রোগের লক্ষণ দেখা দেয়ার পর ওই খামার/ঝাঁকে কোনো সময়ই ওই রোগের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন দেয়া উচিত নয় ।
- ভ্যাকসিনের গুণগতমান সঠিক না থাকলে অর্থাৎ নিম্নমানের হলে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করেও কাজ হয় না। সাধারণত রোগজীবাণুর স্ট্রেইন, টাইপ এবং ভ্যাকসিনের স্ট্রেইন, টাইপ এক হওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় ভ্যাকসিন প্রয়োগ করার পরও পশুপাখি রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
- ভ্যাকসিন ঠিকমতো বা পরিমাণমতো শরীরে প্রবেশ না করলে ভ্যাকসিন ফলপ্রসূ হয় না ।
- সুষ্ঠু পরিবেশ তথা যথাযথ তাপমাত্রায় ভ্যাকসিন সংরক্ষণ না করলে ওই ভ্যাকসিন দেয়ার পরও রোগ দেখা দিতে পারে।
- জীবিত জীবাণু দিয়ে তৈরি ভ্যাকসিনের জীবাণুগুলো মৃত হলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নষ্ট হতে পারে।
- ভ্যাকসিন দেয়ার যন্ত্রপাতি পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত না হলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নষ্ট হতে পারে।
- খাবার পানির মাধ্যমে ভ্যাকসিন দেয়ার সময় ক্লোরিনযুক্ত পানি ব্যবহার করা হলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়।
- ভ্যাকসিন পানির সাথে মিশানোর পর সাথে সাথে ব্যবহার করতে হবে এবং তা সংরক্ষণ করা যাবে না।
- ভ্যাকসিন ব্যবহারের সময় ভ্যাকসিন ফ্রিজ থেকে বের করার পর ১৫ থেকে ২৫ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় আনার পর প্রয়োগ করতে হয়। প্রয়োগের পূর্বে ভালোভাবে ঝাঁকিয়ে নিতে হয়। বোতল খোলার পর গ্রীষ্মকালে ৪ ঘন্টা ও শীতকালে ৮ ঘন্টার মধ্যে ভ্যাকসিন ব্যবহার করতে হয়। অন্যথায় ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ব্যাহত হতে পারে।
- যে ভ্যাকসিনের ব্যবহারের তারিখ শেষ হয়ে গেছে ওই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলে কোনো ফল পাওয়া যাবে না।
- অসুস্থ ও দুর্বল পশুকে ভ্যাকসিন দিলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় না।
বন্ধুরা, আশা করি উপরোক্ত আলেচনার মাধ্যমে আপনি- ছাগলের ভ্যাকসিন তালিকা এবং ছাগলের ভ্যাকসিন দেয়ার নিয়ম সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।
ছাগল খামার করতে হলে অবশ্যই ছাগলের ভ্যাকসিন তালিকাগুলো জানা থাকা প্রয়োজন। কিছু ভ্যাকসিন বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে তবে সেগুলি সবকটিই সব প্রাণীকে দিতে হয়না, তাই আগে থেকে এটি যাচাই করার জন্য সময় নিন কারণ অপ্রয়োজনীয় ও ভুল প্রাণীর ভ্যাকসিন ছাগলের জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে।
আশা করি এই পোষ্টিতে উল্লেখিত ছাগলের জন্য প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিনগুলোর নাম ও ছাগলের ভ্যাকসিন দেয়ার নিয়মগুলো আপনার কাজে আসবে।
ছাগলকে যথাযথভাবে এবং সময় মতোভাবে টিকা দেওয়া তাদের দীর্ঘ, স্বাস্থ্যকর জীবনের সেরা সুযোগ করে দেয়। একই সময়ে, এটি আপনাকে মনের প্রশান্তি দেয় যে তারা অসুস্থতা এবং রোগের ক্ষেত্রে সম্ভবত সুরক্ষিত।
প্রতিবার যখন আপনি একটি ভ্যাকসিন দিবেন তখন অবশ্যই এটির একটি রেকর্ড তৈরি করে নিন যাতে বার্ষিক টিকা দেওয়ার প্রক্রিয়াটি লিপিবদ্ধ থাকবে এবং আপনার জন্য ঝামেলা-মুক্ত হবে।
বিভিন্ন গবাদি পশু যেমন- গরু পালন, ছাগল পালন, মহিষ পালন, ভেড়া পালন ইত্যাদি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট গবাদি পশু’ (inbangla.net/gobadi) এর সাথেই থাকুন।
অনুরোধ!! পোষ্ট ভালো লাগলে প্লিজ উপরের শেয়ার আইকনে ক্লিক করে পোষ্টটি শেয়ার করে দিন।