ধনী হওয়ার কৌশলঃ বুদ্ধি ও স্মার্ট উপায়ে টাকা আয়

আপনি কি কখনো ভেবেছেন, ধনী হওয়ার সবচেয়ে দ্রুত উপায় কী? অনেকেই বলেন, চাকরি, ব্যবসা, রিয়েল এস্টেট, শেয়ার মার্কেট বা ই-কমার্স। কিন্তু সত্যি বলতে, ধনী হওয়ার পথ শুধু কঠোর পরিশ্রমের উপর নির্ভর করে না। এটি একটি শিল্প, একটি দক্ষতা, যেখানে বুদ্ধি ও কৌশলের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ।

এই ব্লগ পোস্টে আমরা আলোচনা করব কীভাবে আপনি স্মার্ট উপায়ে টাকা আয় করতে পারেন, বিশেষ করে বিখ্যাত সেলফ-মেড মিলিয়নেয়ার নাবাল রবিকান্তের কৌশল ও জাপানি পদ্ধতির আলোকে।

(১) কাজ নয়, বুদ্ধি দিয়ে টাকা আয়

নাবাল রবিকান্ত, যিনি একটি দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছেছেন, বলেনঃ “টাকা আয় করা একটি দক্ষতা।” তিনি কঠোর পরিশ্রমের চেয়ে কৌশলের উপর বেশি জোর দেন। তিনি ২০০টির বেশি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছেন, বড় বড় কোম্পানির সিইও হয়েছেন এবং হাজারের বেশি ফিনান্সিয়াল বই পড়ে এই সাফল্য অর্জন করেছেন। তাঁর মতে, ধনী হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় কৌশল হলো—অন্য সবাই যা করছে, তার থেকে আলাদা ভাবুন এবং মানুষের সমস্যার সমাধান করুন।

উদাহরণ: রাস্তা চেনার গল্প

ধরুন, আপনি গাড়ি নিয়ে এক জায়গায় যাচ্ছেন। যদি রাস্তা চেনা থাকে, তাহলে আপনি সহজেই গন্তব্যে পৌঁছে যাবেন। কিন্তু রাস্তা অচেনা হলে? আপনার সময় লাগবে, পরিশ্রম হবে, এমনকি ভোগান্তিও হতে পারে। নাবাল রবিকান্ত বলেন, সাফল্যের রাস্তা আগে থেকে জানলে কেউ আপনাকে থামাতে পারবে না। তিনি এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে বলেছেন, “আমার সব সম্পদ কেড়ে নিয়ে আমাকে শূন্য থেকে শুরু করতে দিলেও, আমি ৫-৭ বছরের মধ্যে আবার একই জায়গায় পৌঁছে যাব।”

(২) ধনী হওয়ার মূল কৌশল

নাবাল রবিকান্তের মতে, ধনী হওয়ার জন্য হাজারটা কৌশলের দরকার নেই। শুধু একটি সঠিক কৌশল মেনে চললেই হবে। তিনি বলেনঃ

• অন্যদের থেকে আলাদা ভাবুন।
• মানুষের সমস্যা সমাধান করুন। যত বড় সমস্যা সমাধান করবেন, তত বেশি আয় করবেন।

এই কৌশল তাঁকে একটি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে চরম উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তিনি বিশ্বাস করেন, যে কেউ এই নীতি মেনে চললে ধনী হতে পারে।

(৩) জাপানি পদ্ধতিঃ সাফল্যের তিনটি নীতি

নাবাল রবিকান্ত তাঁর সাফল্যের পেছনে তিনটি জাপানি পদ্ধতি মেনে চলেন। জাপানিরা তাদের উন্নত চিন্তাভাবনা ও শৃঙ্খলার জন্য বিখ্যাত। এই পদ্ধতিগুলো কী?

ক) ভাবনা লিখে রাখুন

আপনার মাথায় যে ভাবনা আসে, তা লিখে ফেলুন। এটি আপনার সাবকনশাস মাইন্ডে সংরক্ষিত থাকে। যদি শুধু ভাবেন, কাল হয়তো ভুলে যাবেন। কিন্তু লিখে রাখলে তা মনে থাকবে এবং কাজে লাগবে। আজ থেকেই একটি নোটবুক নিন এবং আপনার পরিকল্পনা, লক্ষ্য বা আইডিয়া লিখতে শুরু করুন। ২১ দিন এটি চালিয়ে যান, আপনি নিজেই পরিবর্তন দেখতে পাবেন।

খ) প্যাশন অনুসরণ করুন

জাপানের সফল ব্যক্তিরা তাদের প্যাশন বা শখের অনুসরণ করেন। আপনি যে কাজ ভালোবাসেন, তা করলে কখনো বিরক্তি আসবে না। প্যাশন বা শখের অনুসরণ করলে আপনি সারাদিন কাজ করলেও উৎসাহ থাকবে। এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে প্যাশন থেকে আয় করবেন? আপনার শখ বা প্যাশনের সঙ্গে মানুষের সমস্যা সমাধানের একটি উপায় খুঁজুন। উদাহরণস্বরূপ,যদি আপনি গাছপালা বা বাগান করা ভালোবাসেন, তাহলে আপনি স্থানীয়ভাবে নার্সারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, ফেসবুক, ইউটিউব ও অন্যনয সোস্যাল মিডিয়াতে ডিজিটাল মার্কিটিং সারা দেশে ও শহরে আপনার নার্সারির গাছ বিক্রি করতে পরবেন। পাশাপাশি এই গাছ লাগানো, গাছের যত্ন ও নার্সারির বিষয়ে একটা চ্যনেল খুলে তাতে কন্টেন্ট নিয়মিত আপলোড করলে ভিডিও থেকে এটা বাড়তি ডলার ইনকাম করতে পারবেন বা আয় করতে পারেন।

গ) টাকা ম্যানেজ করুন

আয় করা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই গুরুত্বপূর্ণ টাকা ম্যানেজ করা। নাবাল রবিকান্ত ৫০-৩০-২০ নিয়মের কথা বলেনঃ

• ৫০%: প্রয়োজনীয় খরচ (বাড়ি ভাড়া, বিল, খাবার)।
• ৩০%: বিনোদন ও ব্যক্তিগত খরচ।
• ২০%: সঞ্চয় ও বিনিয়োগ।

এই নিয়ম মেনে চললে আপনার আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় থাকবে এবং ভবিষ্যতের জন্য সম্পদ তৈরি হবে।

(৪) ধনীরা কেন চাকরি করে না?

নাবাল রবিকান্ত বলেন, চাকরি আপনাকে কখনো ধনী করবে না। কারণ-

• সীমিত আয়: চাকরিতে আপনার আয় সীমিত। একটি প্রাইভেট চাকরিতে ১৫,০০০-৩৫,০০০ টাকা বা সরকারি চাকরিতে ৪০,০০০-৫০,০০০ টাকা পেতে পারেন। এই টাকা বাড়ি ভাড়া, বিল, পরিবহন ও অন্যান্য খরচে চলে যায়।
• অন্যের স্বপ্ন পূরণ: চাকরিতে আপনি অন্য কারো স্বপ্ন পূরণের জন্য কাজ করেন। আপনার নিজের স্বপ্নের জন্য সময় বা সুযোগ থাকে না।
• মধ্যবিত্ত ফাঁদ: চাকরির আয় আপনাকে মধ্যবিত্ত জীবনে আটকে রাখে। লোন, ইএমআই এবং দৈনন্দিন খরচে জীবন কেটে যায়।

তাই তিনি পরামর্শ দেন, চাকরির পাশাপাশি এমন কিছু করুন যা আপনার নিজের সম্পদ তৈরি করবে।

(৫) ব্যবসাঃ ধনী হওয়ার সিঁড়ি

ব্যবসা হলো ধনী হওয়ার অন্যতম সেরা উপায়। তবে ব্যবসা শুরু করতে হলে কী জানতে হবে?

• মার্কেট রিসার্চ: কোন পণ্য বা সেবার চাহিদা আছে? আপনার টার্গেট গ্রাহক কারা?
• কস্টিং ও প্রফিট: ব্যবসার খরচ কত? কত মুনাফা রাখবেন?
• সেলিং স্কিল: পণ্য বা সেবা বিক্রির দক্ষতা অর্জন করুন।

ব্যবসা শুরুর আগে ইউটিউবে ফ্রি কোর্স দেখে শিখুন। রিসার্চ করুন এবং ছোট থেকে শুরু করুন।

ব্যবসায় ভয়? এটাই স্বাভাবিক

অনেকেই ব্যবসা শুরু করতে ভয় পান—যদি লস হয়? এটি স্বাভাবিক। তবে ব্যবসায় উত্থান-পতন থাকবেই। আপনার যদি অল্প পুঁজি এবং সময় থাকে, তাহলে ঝুঁকি নিন। রিসার্চ করে, পরিকল্পনা করে এগোলে লসের সম্ভাবনা কমবে।

(৬) বিনিয়োগঃ সম্পদ তৈরির চাবিকাঠি

আয় করার পাশাপাশি বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ। নাবাল রবিকান্ত বলেন, “টাকা আয় করুন এবং তা ম্যানেজ করুন।” কোথায় বিনিয়োগ করবেন?

• রিয়েল এস্টেট: জমি বা ফ্ল্যাটে বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদে মুনাফা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, কলকাতার নিউটাউনে ১০ বছর আগে ৪০ লাখ টাকার ফ্ল্যাট এখন ১ কোটি টাকার কাছাকাছি।
• গোল্ড: সোনার দাম ক্রমাগত বাড়ছে। গত ৫ বছরে সোনার মূল্য দ্বিগুণ হয়েছে।

বড় অঙ্কের টাকা না থাকলেও বিনিয়োগ সম্ভব। কীভাবে?

• রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট (REITs): এটি একটি ডিজিটাল বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্ম। আপনি ৩০০-৩৫০ টাকা দিয়েও শপিং মল, অফিস বা হোটেলের মতো বড় প্রপার্টিতে বিনিয়োগ করতে পারেন। REITs থেকে ভাড়ার আয় এবং শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে মুনাফা পাওয়া যায়।
• গোল্ড ETF: স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার গোল্ড ETF-এ বিনিয়োগ করলে ফিজিক্যাল সোনা কেনার ঝামেলা ছাড়াই সোনার দামের মুনাফা পাবেন। ২০২১ সালে ৪২ টাকায় গোল্ড ETF এখন ৭৪ টাকার কাছাকাছি, অর্থাৎ প্রায় ৯০% রিটার্ন।

মাসে ৫০০ টাকা জমিয়েও আপনি REITs বা গোল্ড ETF-এ বিনিয়োগ শুরু করতে পারেন। তবে বিনিয়োগের আগে রিসার্চ করুন এবং বিশ্বস্ত প্ল্যাটফর্ম বেছে নিন।

(৭) ইন্টারনেট থেকে আয়ঃ ইউটিউব ও কন্টেন্ট ক্রিয়েশন

ইন্টারনেট এখন আয়ের একটি বিশাল ক্ষেত্র। ইউটিউব এবং কন্টেন্ট ক্রিয়েশন এমন একটি উপায়, যেখানে আপনি অল্প সময় বিনিয়োগ করে বড় আয় করতে পারেন।

কেন ইউটিউব?

• অতিরিক্ত আয়: ইউটিউবে কন্টেন্ট বানিয়ে অতিরিক্ত আয় করা সম্ভব।
• নাম ও সম্মান: সফল ইউটিউবার হলে আপনি পরিচিতি পাবেন।
• স্বাধীনতা: ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ।

উদাহরণ: সৌরভ জোসি

সৌরভ জোসি একজন জনপ্রিয় ইউটিউবার এবং ব্লগার। তিনি কন্টেন্ট ক্রিয়েশনের মাধ্যমে ৩ কোটি টাকার গাড়ি কিনেছেন। এটি কি চাকরি করে সম্ভব? না। ইউটিউবের মাধ্যমে তিনি আয়, সম্মান এবং স্বাধীনতা অর্জন করেছেন।

কীভাবে শুরু করবেন?

• নিশ নির্বাচন: আপনার প্যাশনের উপর ভিত্তি করে একটি বিষয় বেছে নিন (যেমন, রান্না, টেক, ফাইনান্স)।
• শেখা: ইউটিউবে ফ্রি কোর্স দেখে কন্টেন্ট তৈরি, এডিটিং এবং এসইও শিখুন।
• ধৈর্য: ইউটিউবে আয় আসতে সময় লাগে। কমপক্ষে ৬ মাস থেকে ১ বছর ধৈর্য ধরুন।

দিনে মাত্র ১ ঘণ্টা সময় দিয়ে শুরু করুন। আপনার চাকরি বা ব্যবসার পাশাপাশি এটি করতে পারেন।

(৮) কন্টেন্ট ক্রিয়েশনের শক্তি

কন্টেন্ট ক্রিয়েশন শুধু টাকা আয়ের মাধ্যম নয়, এটি আপনার সৃজনশীলতা ও প্রতিভা প্রকাশের একটি প্ল্যাটফর্ম। উদাহরণস্বরূপ, একজন ট্রাক ড্রাইভার ব্লগিং শুরু করে আজ লাখ লাখ সাবস্ক্রাইবার এবং মাসে লাখ টাকা আয় করছেন। এটাই কন্টেন্ট ক্রিয়েশনের শক্তি।

কনফিউশন দূর করুন!

ইউটিউবে শুরু করতে অনেকের মনে কনফিউশন থাকে। এটি স্বাভাবিক, কারণ ইউটিউব একটি বিশাল প্ল্যাটফর্ম। তবে শেখার মাধ্যমে এই কনফিউশন দূর করা সম্ভব। ইউটিউব এসইও, ভিডিও এডিটিং এবং মনিটাইজেশন সম্পর্কে শিখুন। ধীরে ধীরে আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়বে।

(৯) আপনার জীবনের উদ্দেশ্য

জীবনের মূল উদ্দেশ্য হলো স্বাধীনতা। আপনি কোথায় থাকবেন, কত টাকা আয় করবেন, কোন কাজ করবেন—এসব আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিত। চাকরিতে এই স্বাধীনতা পাওয়া যায় না। তাই নিজের প্রতিভা ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে এমন কিছু করুন, যা আপনাকে আর্থিক ও মানসিক স্বাধীনতা দেবে।

(১০) উপসংহার

ধনী হওয়ার পথে কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি বুদ্ধি ও কৌশলের প্রয়োজন। নাবাল রবিকান্তের কৌশল এবং জাপানি পদ্ধতি অনুসরণ করে আপনি আপনার জীবনে পরিবর্তন আনতে পারেন। আজ থেকেই শুরু করুন-

• আপনার ভাবনা লিখে রাখুন।
• প্যাশন অনুসরণ করুন।
• টাকা ম্যানেজ করুন এবং বিনিয়োগ শুরু করুন।
• ইউটিউব বা ব্যবসার মাধ্যমে অতিরিক্ত আয়ের পথ তৈরি করুন।

প্রধান ধনী হওয়ার কৌশলটিই হলে আপনার হাতে যা আছে, তাই দিয়ে শুরু করুন। ছোট পদক্ষেপই আপনাকে বড় সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে। আপনার যদি ইউটিউব বা বিনিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন থাকে, তাহলে কমেন্টে জানান। আমরা আরও বিস্তারিত গাইড নিয়ে আসব।

আত্ম-উন্নয়ন ও মোটিভেশন সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট মোটিভেশন’ (inbangla.net/motivation) এর সাথেই থাকুন।