এই আর্টিকেলটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- ফল ও শাকসবজি প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্পর্কে ধারণা পাবেন; ফল ও শাকসবজি বাজারজাতকরণ সম্পর্ক ধারণা পাবেন।
(১) ফল ও শাকসবজি বাজারজাতকরণ
ফল ও শাকসবজি দ্রুত পচনশীল পণ্য এবং এদের উৎপাদন মৌসুম সীমিত বলে এসব পণ্যের বাজারজাতকরণ একটি স্পর্শকাতর বিষয়। তবে মৌসুমের সময় প্রচুর উৎপাদন হয় বলে এদের দাম কম থাকে। যদিও অন্যান্য খাদ্যোপাদানের সাথে সাথে ফল ও শাকসবজির প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
এই পরিস্থিতি সুষ্ঠ বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একদিকে যেমন কৃষক ন্যায্য মূল পাবে তেমনি ক্রেতাসাধারণও পর্যাপ্ত পরিমাণে ভালমানের ফল ও শাকসবজি কিনতে পারবে। ফলে কৃষক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা সবাই লাভবান হবে।
আমাদের বাংলাদেশে ফল ও শাকসবজি বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া এখনও তেমন সুনির্দিষ্ট কোন পদ্ধতির আওতায় আসে নাই।
ফল ও সবজি সাধারণত তিনটি ধাপে কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছায়-
- ধাপ-১: কৃষক সবজি উৎপন্ন করার পর সংগ্রহ করে এবং আড়তে বিক্রি করে।
- ধাপ-২: আড়ত থেকে ফরিয়া বা মধ্যস্বত্বভোগীরা ফল ও সবজি শহরের পাইকারী বাজারে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে।
- ধাপ-৩: খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে ভোক্তারা ফল ও সবজি ক্রয় করে।
এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল এবং এর ফলে কৃষক যেমন ন্যায্যমূল্য পায় না তেমনি ক্রেতা বা ভোক্তাদেরও উচ্চমূল্যে পণ্য কিনেতে হয়। এই পদ্ধতিতে ফল ও সবজি বাজারে পৌছাতে সময় বেশি লাগে। তাই বাজারে নেওয়ার পূর্বে ফল ও সবজি ভালভাবে প্রস্তুত করে নিতে হবে। তা না হলে ফল ও সবজি পচে গিয়ে অপচয় বেড়ে যায়।
বাজারজাতকরণের ত্রুটি দূর করার জন্য নিম্নের কাজগুলো করতে হবে-
- যথাসময়ে সংগ্রহ: ফল বা শাকসবজি গাছ থেকে সময়মত সংগ্রহ করতে হবে। অতিরিক্ত পাকা বা অপরিপক্ক ফল বা সবজি দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।
- গ্রেডিং করা (Grading): ফল ও শাকসবজিকে আকার, আকৃতি, বর্ণ ইত্যাদি বাহ্যিক গুণের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। গ্রেডিং করা ফল ও শাকসবজির সংরক্ষণ কাল বেড়ে যায় এবং গ্রেডিং করা শাকসবজি ও ফলের বাজারমূল্য ভাল পাওয়া যায়।
- ফল ও শাকসবজি শীতল করা: শাকসবজি ও ফল সংগ্রহের পরও শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া চলতে থাকে এবং এতে এইসব পণ্য দ্রুত পচে যায়। তাই মাঠ থেকে ফল উত্তোলনের পর এগুলোকে বায়ুচলাচলের সুবিধাযুক্ত ছায়াযুক্ত স্থানে কিছুক্ষণ রেখে ঠান্ডা করে নিতে হয়। অনেক সময় ঠান্ডা করার জন্য উন্নত পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যেমন: সবজি বা ফলের উপর দিয়ে আর্দ্র ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত করা হয়। বরফ পানি ছিটানো হয় বা বরফ পানিতে ফল ও সবজি ডুবানো হয়। এতে করে ফল ও সবজি দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যায়। বরফ পানিতে ডুবানোর একটি সুবিধা হলো এর সাথে ছত্রাকনাশক মিশিয়ে ফল ও শাকসবজি জীবাণুমুক্ত করা যায়। বাণিজ্যিকভাবে ফল ও শাকসবজি দূরের কোন স্থানে পরিবহণ করার আগে এভাবে ঠান্ডা করে নিলে বেশিদিন এগুলো সংরক্ষণ করা যায়।
- প্যাকেজিং: প্যাকেজিং নির্ভর করে পণ্য কতদূরে এবং কিভাবে যাবে তার উপর। প্যাকেট এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে পরিবহনের সময় পণ্য আঘাত প্রাপ্ত না হয়। উন্নত বিশ্বে বাতাস চলাচলে সুবিধাযুক্ত প্লাস্টিক কাঠ বা হাডবোর্ডের বাক্সে শাকসবজি ও ফল পরিবহন করা হয়।
- পরিবহণ: পরিবহণের সময় পণ্য বেশি গাদাগাদি করে বোঝাই করা উচিৎ নয়। এতে, ফল ও সবজি আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। তাই পরিবহণের সময় ফল ও সবজি যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। শীতকালে একটানা ১২ ঘন্টা এবং গ্রীষ্মকালে ৮ ঘন্টার বেশি ফল ও শাকসবজি যানবাহনে রাখা যাবে না। পরিবহনকালে শাকসবজির প্যাকেট বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য।
(২) ফল ও শাকসবজি প্রক্রিয়াজাতকরণ
মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য তাকে নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। মানুষের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ছয়টি খাদ্য উপাদানের মধ্যে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ উল্লেখযোগ্য।
ফল ও শাকসবজি এই ভিটামিন ও খনিজের প্রধান উৎস, ফল ও শাকসবজি যেমন আমাদের রসনার তৃপ্তি দেয়, তেমনি আমাদের দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে।
ফল ও সবজিতে ভিটামিন ও খনিজ ছাড়াও সহজ প্রাপ্য শর্করা আমিষ ও স্নেহজাতীয় খাদ্য উপাদান রয়েছে। এসব খাদ্য শরীর গঠনে যেমন সাহায্য করে তেমনি বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধক হিসাবে কাজ করে।
এতগুণ সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও ফল ও সবজি দীর্ঘদিন তাজা অবস্থায় রেখে খাওয়া যায় না। এগুলো পচনশীল পণ্য। তাই ফল ও সবজি প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন খাদ্য তৈরি করে সংরক্ষণ করা যায়। এসব প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যসম্মত।
বিভিন্ন ফল ও সবজির গুণগত মানের পরিবর্তন না করে ভৌত ও রাসায়নিক পদ্ধতির মাধ্যমে তাদের আকৃতি প্রকৃতি পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
নিম্নে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করণের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো-
- পুষ্টিমান সংরক্ষণ: প্রক্রিয়াজাত করনের ফলে সবজি ও ফলের গুণগত মানের তেমন কোন পরিবর্তন হয় না। ফলে সারাবছর ঐ ফল বা সবজির স্বাদ গ্রহণ করা যায় ও পুষ্টি ও পাওয়া যায়।
- উৎপাদিত পণ্যের অপচয় রোধ: আমাদের দেশে মৌসুমের সময় যে ফল ও সবজি উৎপাদিত হয় সংগ্রহ পরবর্তী সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাবে এর বড় একটি অংশ পচে নষ্ট হয়। তাই শাকসবজি ও ফলকে প্রক্রিয়াজাত করে বিভিন্ন খাবার যেমন, জ্যাম, জেলী, জুস, আচার, ইত্যাদি তৈরি করলে সবজি ও ফল অপচয় রোধ করা যাবে।
- কৃষকের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি: উৎপাদন মৌসুমে সাধারণত ফল ও সবজির দাম কম থাকে। এ সময় অপচয়ও হয় বেশি। কিন্তু এসব দিয়ে প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য তৈরি করা হলে কৃষক ন্যায্য মূল্য পাবে।
- কর্মসংস্থান সৃষ্টি: খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের সাথে অনেক কাজ জড়িত। ফলে সেখানে প্রচুর লোকের প্রয়োজন হয়। এবং এভাবে অনেক লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়।
- বৈদেশিক মুদ্রা আয়: প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আর করা সম্ভব।
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা ফল ও শাকসবজি বাজারজাত করণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা অর্জন করলাম।
ফল ও শাকসবজি দ্রুত পঁচনশীল পণ্য বলে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন খাদ্য তৈরি করা হয়। এতে পুষ্টিমান সংরক্ষণ হয় তেমনি উৎপাদিত পণ্যের অপচয় রোধ করা যায়। তাছাড়া ও কৃষক তার ন্যায্য মূল্য পায়, নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। ফল ও শাকসবজি বাজারজাতকরণ এর ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে সংগ্রহ, গ্রেডিং, শীতলকরণ, প্যাকেজিং ও পরিবহণের কাজগুলি করতে হয়। সুষ্ঠ বাজারজাতকরণের মাধ্যমে কৃষক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা সবাই লাভবান হবে।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।