“ফ্যাসিবাদ কি” এই প্রশ্নটি ইতিহাস, রাজনীতি এবং সমাজবিজ্ঞানের আলোচনায় বারবার উঠে আসে। ফ্যাসিবাদ একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ, যা বিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে, বিশেষ করে ইতালি ও জার্মানিতে, ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। এটি একটি সৈরাচারী শাসনব্যবস্থা, যেখানে একক নেতার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং বিরোধী মত দমন প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই লেখায় আমরা ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি, বৈশিষ্ট্য, ইতিহাস এবং এর প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। আমাদের লক্ষ্য হলো পাঠকদের জন্য এই জটিল বিষয়টি সহজবোধ্য করে তোলা।
(১) ফ্যাসিবাদ কি?

ফ্যাসিবাদ কি: ফ্যাসিবাদ হলো একটি সৈরাচারী ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক মতাদর্শ, যেখানে রাষ্ট্রের ক্ষমতা একজন নেতার হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। এই ব্যবস্থায় ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং মুক্ত মত প্রকাশের কোনো স্থান নেই। ফ্যাসিবাদী নেতারা নিজেদের “জনগণের প্রতিনিধি” হিসেবে দাবি করলেও, তারা জোর করে নিজেদের মতাদর্শ অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেয়। এটি একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করে, যেখানে বিরোধীদের দমন করা হয়।
(২) ফ্যাসিস্ট কথার অর্থ কি?
ফ্যাসিস্ট কথার অর্থ কি: “ফ্যাসিস্ট” কথাটি এসেছে ইতালীয় শব্দ “ফ্যাসিস্তা” থেকে, যার মূল উৎস ল্যাটিন “ফ্যাসেস” (fascēs)। “ফ্যাসেস” ছিল প্রাচীন রোমে একটি প্রতীক—একটি কুঠারের চারপাশে বাঁধা লাঠির আঁটি, যা ঐক্য ও শক্তির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ফ্যাসিস্ট বলতে এমন একজন ব্যক্তিকে বোঝায়, যিনি ফ্যাসিবাদের মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং এটি প্রচার ও বাস্তবায়ন করেন।
(৩) ফ্যাসিস্ট শব্দের অর্থ কি?
ফ্যাসিস্ট শব্দের অর্থ কি: “ফ্যাসিস্ট” শব্দটির অর্থ হলো ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের অনুসারী বা সমর্থক। এটি এমন একটি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে নির্দেশ করে, যারা উগ্র জাতীয়তাবাদ, একক নেতৃত্ব এবং সৈরাচারী শাসনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। এই শব্দটি প্রথমে ইতালির বেনিতো মুসোলিনির সমর্থকদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল।
(৪) ফ্যাসিস্ট অর্থ কি?

ফ্যাসিস্ট অর্থ কি: ফ্যাসিস্ট অর্থে বোঝায় এমন একটি ব্যক্তি বা আন্দোলন, যারা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ও শৃঙ্খলার ওপর জোর দেয়। এরা ভিন্নমত সহ্য করে না এবং জোরপূর্বক নিজেদের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ফ্যাসিস্টরা সাধারণত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরোধী এবং সামরিক শক্তিকে গুরুত্ব দেয়।
(৫) ফ্যাসিস্ট কি?
ফ্যাসিস্ট কি: ফ্যাসিস্ট হলো ফ্যাসিবাদের ধারক ও বাহক। এরা এমন ব্যক্তি বা সংগঠন, যারা রাষ্ট্রকে একটি একক ইউনিট হিসেবে দেখে এবং সকল ক্ষমতা একজন নেতার হাতে কেন্দ্রীভূত করতে চায়। ইতালির “ব্ল্যাকশার্ট” সদস্যরা ছিল ফ্যাসিস্টদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ, যারা মুসোলিনির নির্দেশে বিরোধীদের দমন করত।
(৬) ফ্যাসিজম কি?
ফ্যাসিজম কি: “ফ্যাসিজম” হলো ফ্যাসিবাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ (Fascism)। এটি একটি রাজনৈতিক দর্শন, যেখানে রাষ্ট্রের শক্তি ও ঐক্য সবকিছুর ওপরে স্থান পায়। ফ্যাসিজম ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিবর্তে সমষ্টিগত আনুগত্যকে প্রাধান্য দেয় এবং উগ্র জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে জনগণকে একত্রিত করে।
(৭) ফ্যাসিবাদ অর্থ কি?
ফ্যাসিবাদ অর্থ কি: ফ্যাসিবাদ অর্থে বোঝায় একটি স্বৈরশাসনভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেখানে একজন নেতা বা দল সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। এটি গণতন্ত্র ও মুক্তবাজার অর্থনীতির বিপরীত। ফ্যাসিবাদে শিল্প, বাণিজ্য ও গণমাধ্যম রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং বিরোধী মতকে কঠোরভাবে দমন করা হয়।
(৮) ফ্যাসিস্ট মানে কি?
ফ্যাসিস্ট মানে কি: “ফ্যাসিস্ট” মানে এমন একজন ব্যক্তি, যিনি ফ্যাসিবাদের নীতি মেনে চলেন। এরা উগ্র জাতীয়তাবাদী, সামরিক শক্তির সমর্থক এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বিরোধী। উদাহরণস্বরূপ, মুসোলিনির ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টির সদস্যরা ছিল ফ্যাসিস্ট।
(৯) ফ্যাসিবাদ কাকে বলে?
ফ্যাসিবাদ কাকে বলে: ফ্যাসিবাদ এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে রাষ্ট্রের স্বার্থ ব্যক্তির স্বার্থের ওপরে স্থান পায়। এটি একক নেতৃত্বের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এবং জনগণকে একটি সাধারণ লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য প্রোপাগান্ডা ব্যবহার করে। ফ্যাসিবাদে বিরোধী দল বা মতামতের কোনো স্থান থাকে না।
(১০) ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য

ফ্যাসিবাদের কিছু মূল বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা এটিকে অন্যান্য রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে আলাদা করে।
মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লরেন্স ব্রিট ফ্যাসিবাদের ১৪টি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য হলো-
- উগ্র জাতীয়তাবাদ: ফ্যাসিস্টরা দেশের গৌরব ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রচার করে। তারা বিশ্বাস করে, তাদের জাতিই সবচেয়ে উন্নত।
- মানবাধিকার সংকট: ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও মানবাধিকারকে দমন করা হয়।
- সামরিক আধিপত্য: সামরিক শক্তি ও যুদ্ধকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
- গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ: সংবাদমাধ্যম রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং প্রোপাগান্ডার জন্য ব্যবহৃত হয়।
- বিরোধী মত দমন: ভিন্নমত পোষণকারীদের কণ্ঠরোধ করা হয়।
- পুঁজিপতিদের সাথে সম্পর্ক: ধনী শ্রেণীর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা হয়।
- লিঙ্গ বৈষম্য: নারীদের অধিকার সীমিত করা হয়।
এছাড়াও, ফ্যাসিবাদ মুক্তবাজার অর্থনীতির বিরোধী। এটি শিল্প ও বাণিজ্যকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনকে দমন করে।
(১১) ফ্যাসিবাদের জনক কে?

ফ্যাসিবাদের জনক কে: ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি হয় ১৯২২ সালে, ফ্যাসিবাদের জনক হলেন- বেনিতো মুসোলিনি।
বেনিতো মুসোলিনি ১৮৮৩ সালের ২৯ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পেশায় প্রথমে স্কুল শিক্ষক ছিলেন, পরে সাংবাদিকতায় যোগ দেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অবাধ্য, উশৃঙ্খল এবং বদমেজাজি। তবে তার মেধা ও প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা তাকে জনগণের মধ্যে পরিচিত করে তোলে। তিনি নিজেকে “ম্যান অফ দ্য পিপল” হিসেবে পরিচয় দিতেন।
ফ্যাসিবাদের সূচনা ঘটে ইতালিতে, বেনিতো মুসোলিনির নেতৃত্বে। ১৯২২ সালের অক্টোবরে “মার্চ অন রোম” নামে পরিচিত একটি ঐতিহাসিক ঘটনার মাধ্যমে মুসোলিনি ক্ষমতায় আসেন। এই সময়ে হাজার হাজার ফ্যাসিস্ট সমর্থক রোমের রাস্তায় মিছিল করে, তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সরকার গঠন ও ক্ষমতা দখল। কিন্তু এই ঘটনার পেছনে দীর্ঘ প্রস্তুতি এবং ইতালির তৎকালীন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে মুসোলিনি ফ্যাসিবাদের প্রচার শুরু করেন। ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে তিনি “ব্ল্যাকশার্ট” নামে একটি সশস্ত্র সংগঠন গঠন করেন। এই সংগঠন স্থানীয় সরকার ও বামপন্থী প্রশাসনের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের ক্ষমতা দখল থেকে বিরত রাখে। ১৯২২ সালে “মার্চ অন রোম” এর মাধ্যমে মুসোলিনি চূড়ান্ত ক্ষমতা অর্জন করেন এবং ইতালিতে ফ্যাসিবাদের সূচনা ঘটে।
(১২) ফ্যাসিবাদের উত্থান
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ফ্যাসিবাদের উত্থানের জন্য মাটি তৈরি করে। ইতালির ক্ষেত্রে, যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও ভার্সাই চুক্তির কারণে দেশটি কাঙ্ক্ষিত সুবিধা পায়নি। আফ্রিকায় উপনিবেশ বিস্তারের স্বপ্ন ভেঙে যায়, আলবেনিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। এর ফলে জনগণ সরকারের ওপর আস্থা হারায়।
একই সময়ে, অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে, উৎপাদন কমে, বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। শ্রমিকরা ধর্মঘট শুরু করে, কৃষকরা জমি দখল করে। ১৯১৮ সালে ইতালিতে ২৯২টি আন্দোলন হয়, যা ১৯২০ সালে ১০ গুণ বেড়ে যায়। গণতান্ত্রিক সরকার এই পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ হয়, ফলে জনগণ বিকল্প খুঁজতে থাকে।
এই সংকটের মধ্যে ফ্যাসিবাদের প্রবর্তক/জনক মুসোলিনি ফ্যাসিবাদের প্রচার শুরু করেন। তিনি “ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি” গঠন করেন, যা জনগণের হতাশা ও ক্ষোভকে কাজে লাগায়। ১৯২২ সালের অক্টোবরে “মার্চ অন রোম” এর পর তৎকালীন রাজা তৃতীয় ভিক্টর ইমানুয়েল মুসোলিনিকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। ১৯২৬ সালে নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে অন্য সব দল নিষিদ্ধ করা হয়, এবং মুসোলিনি একক শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
(১৩) ফ্যাসিবাদের প্রভাব
ফ্যাসিবাদ শুধু ইতালিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৯১৯ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে এটি জার্মানি (নাৎসিবাদ), জাপান, মধ্যপ্রাচ্য এবং লাতিন আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলার ফ্যাসিবাদের একটি রূপ, নাৎসিবাদ, প্রতিষ্ঠা করেন। এই মতাদর্শ বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ, গণহত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী।
ইতালিতে মুসোলিনির শাসনকালে অর্থনীতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও, এটি জনগণের স্বাধীনতার মূল্যে এসেছিল। গণমাধ্যম, শিক্ষা ও শিল্প রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। বিরোধীদের গুম, হত্যা ও নির্বাসনের ঘটনা ঘটতে থাকে।
(১৪) ফ্যাসিবাদের সমালোচনা
বিখ্যাত সাংবাদিক রজনী পাম দত্ত ফ্যাসিবাদকে “বুর্জোয়া শ্রেণীর আন্দোলন” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তার মতে, এটি ধনকুবের ও পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষার জন্য শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবকে দমন করতে গঠিত। হেগেলের “সর্বাত্মক রাষ্ট্র” ধারণার সাথে ফ্যাসিবাদের মিল রয়েছে, যেখানে ব্যক্তির চেয়ে রাষ্ট্র বড়।
রবার্টো প্যাক্সটন তাঁর “অ্যানাটমি অফ ফ্যাসিজম” গ্রন্থে বলেন, ফ্যাসিবাদ ব্যক্তিস্বার্থের বিরোধী ছিল। তবে বাস্তবে এটি পুঁজিপতিদের সাথে সখ্য গড়ে তুলেছিল।
(১৫) ফ্যাসিবাদের পতন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালি ও জার্মানির পরাজয়ের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটে। ১৯৪৩ সালে মুসোলিনি ক্ষমতাচ্যুত হন এবং ১৯৪৫ সালে তাকে হত্যা করা হয়। তবে ফ্যাসিবাদের প্রভাব আজও রাজনৈতিক আলোচনায় দেখা যায়।
পরিশেষে এটা বলা যায় যে, ফ্যাসিবাদ কি? এটি একটি জটিল রাজনৈতিক মতাদর্শ, যা ইতিহাসে গভীর ছাপ রেখেছে। এটি শক্তি, ঐক্য ও জাতীয়তাবাদের নামে জনগণের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল। ইতালির মুসোলিনি থেকে জার্মানির হিটলার—ফ্যাসিবাদ বিশ্বকে যুদ্ধ ও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। আজকের দিনে এটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে, অতিরিক্ত ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ ও গণতন্ত্রের অবনমন কতটা বিপজ্জনক হতে পারে।
আপনার মতামত কী? ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে আপনি কী ভাবেন? কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানান!
ইতিহাস সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট ইতিহাস’ (inbangla.net/itihas) এর সাথেই থাকুন।
অনুরোধ!! পোষ্ট ভালো লাগলে প্লিজ উপরের শেয়ার আইকনে ক্লিক করে পোষ্টটি শেয়ার করে দিন।