(১) ভেড়া পালনের সুবিধা
নিম্নে বাংলাদেশে ভেড়া পালনের সুবিধাগুলো তুলে ধরা হলো-
১। ভেড়া পরিচর্যা সহজ | তাই ভেড়ার খামারে তুলনামূলকভাবে কম শ্রমের প্রয়োজন হয়। ভেড়া শান্ত প্রাণী হওয়ায় একজন মহিলা বা বাচ্চা ছেলের পক্ষেও একসাথে অনেকগুলো ভেড়ার পরিচর্যা করা সম্ভব।
২। ছোট প্রাণী হওয়ায় ভেড়ার একক মূল্য কম। তাই ভেড়া পালনের জন্য তুলনামূলকভাবে কম মূলধনের প্রয়োজন হয়। ফলে দরিদ্র বা নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষেও ভেড়া পালনে বিনিয়োগ করা সম্ভব।
৩। অল্প জায়গাতেই ভেড়া পালন করা সম্ভব।
৪। ভেড়া পালনের জন্য খুব বেশী খাদ্যের প্রয়োজন হয় না। বসত-বাড়ির আশেপাশের পতিত জমি, ক্ষেতের আইল এবং রাস্তার পার্থের ঘাস ও লতাপাতা খেয়ে এরা প্রয়োজনীয় খাদ্যের সংস্থান করতে পারে।
৫। বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে যে সব ভেড়া পালন করা হয় তা মূলত মাংস উৎপাদনের জন্য | ভেড়ার মাংস সুস্বাদু।
৬। চারণ-ভূমিভিত্তিক এবং ভূমিহীন উৎপাদন ব্যবস্থায় ভেড়া পালন করা হয়।
৭। গরু ও ছাগলের মত একই সাথে পালন করা যায়।
৮। ভেড়া দলবদ্ধ হয়ে বসবাস ও বিচরণ করে, চুরি হওয়ার সম্ভাবনা কম, চড়ানোর জন্য বাড়তি কর্মীর প্রয়োজন নেই, অপেক্ষাকৃত কম খেয়ে অধিক মাংস ও পশম উৎপাদন করে।
৯। ভেড়া তার নরম মুখ দিয়ে অতি ছোট ছোট ঘাস লতাপাতা খেয়ে কৃষি জমির আগাছা কমাতে পারে।
১০। প্রতি বছরে প্রতিটি ভেড়া ৩.৫-৫.৫ কেজি পশম উৎপাদন করতে পারে।
১১। ভেড়া অত্যন্ত নিম্নমানের খাদ্য গ্রহন করে তা উচ্চমূল্যের প্রোটিনে পরিণত করে বলে ভূমিহীন কৃষক, প্রান্তিক চাষী এবং নারী ও কর্মহীন মানুষদের সংসারে বাড়তি আয়ের একটা ভালো যোগান হতে পারে ভেড়া পালন।
১২। ভেড়ার মাংস তুলনামূলকভাবে নরম, রসালো ও গন্ধহীন এবং মাংশের আঁশ চিকন বলে সহজপাচ্য।
১৩। ভেড়া সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে পছন্দ করে তাই কেউ যদি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ভেড়া পালন করতে চায় সেক্ষেত্রে একজন লোক সহজেই ১০০-১৫০ ভেড়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।
১৪। ভেড়ার অভিযোজন ক্ষমতা ছাগলের চেয়ে বেশি তাই যেকোন প্রতিকূল পরিবেশে খাপ খাওয়ায়ে চলতে পারে। ভেড়া গরুর পালের সাথে একসাথে পালন করা যায়।
১৫। ভেড়া পালন করে থেকে শুধু মাংসই পাওয়া যায় না, ভেড়া থেকে পাওয়া যায় উন্নতমানের গরম কাপড় তৈরির জন্য পশম এবং চামড়া।
১৬। বাংলাদেশে মোট ১.৬৯ মিলিয়ন ভেড়া আছে। জাতীয় আয় ও সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশে পশুসম্পদের মধ্য ভেড়ার স্থান চতুর্থ। ভেড়া উৎপাদন বৃদ্ধির হার ১২%, যাহা গরু, ছাগল ও মহিষের তুলনায় অনেক বেশি। ভেড়া ভূমিহীন, ক্ষুদ্রও মাঝারী চাষিদের অতিরিক্ত আয়ের উৎস।
১৭। ভেড়া প্রধানতঃ বছরে ২ বার বাচ্চা প্রদান করে এবং প্রতি প্রসবে অনুন্য ২টি বাচ্চা দেয় এ কারণে কম সময়ে দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধি হয়।
১৮। ভেড়ার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি।
১৯। ভেড়া ছোট নিরীহ প্রাণি। এদের খাদ্য খরচ কম, রাখার জন্য অল্প জায়গা দরকার হয় এবং প্রাথমিক বিনিয়োগ কম বলে শুধুমাত্র বসত বাড়ি আছে এমন কৃষক আনায়সে ৫-১০ ভেড়া পালন করতে পারেন। যে কোন প্রাণি প্রতিপালনের চেয়ে ভেড়া পালনে উৎপাদন খরচ কম।
২০। ভেড়া পালন খুবই সম্ভাবনাময় কারণ ভেড়া পালনে অতিরিক্ত তেমন কোন খরচ নেই। সামান্য যত্নে অতি তাড়াতাড়ি ভেড়া বংশ বিস্তার করে এবং দিনের বেলায় ফসলের খালি ক্ষেতে, রাস্তার ধারে ও ফলের বাগানে ছেড়ে বা বেধে পালন করা যায়।
২১। ঢাকার অদূরে কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারের সন্নিকটে বাংলাদেশ প্রাণি সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ভেড়া উন্নয়ণের গবেষণা কাজ চলছে।
২২। বর্ষাকালে মৃত্যুর হার বেশি এবং শুকনা মৌসুমে কম থাকে। বয়স্ক ভেড়ার মৃত্যুর হার খুবই কম কারণ ভেড়ার রোগ-বালাই তেমন দেখা যায় না।
(২) ভেড়া পালনের অসুবিধা

নিম্নে বাংলাদেশে ভেড়া পালনের অসুবিধাগুলো তুলে ধরা হলো-
১। ভেড়া পালন সংকান্ত জ্ঞানের অভাব।
২। ভেড়া পালনে আগ্রহের অভাব এদেশে ভেড়া উৎপাদন বৃদ্ধির পথে একটি অন্যতম অন্তরায়।
৩। ভেড়ার খাদ্য, বাসস্থান ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকা।
৪। বাংলাদেশে পারিবারিকভাবে যে সব ভেড়া পালন করা হয় তা উন্নত জাতের নয়।
৫। উচ্চ উৎপাদনশীল ভেড়া এদেশে পালন না করার কারণে এদের পশমের গুনগত মানও নিম্ন। বাংলাদেশি ভেড়ার লোমের কোন মূল্য পাওয়া যায় না। তাই খামারিরা ভেড়ার পশম সংগ্রহ ও বিক্রি করেনা।
৬। মাংস উৎপাদনও কম। একটি পূর্ণ বয়স্ক ভেড়া হতে গড়ে ২৫-৩০ কেজি মাংস পাওয়া যায়।
৭। ভেড়া সাধারণত ১২-১৫ মাস পরপর বাচ্চা দেয় এবং প্রতিটি ভেড়া প্রতিবারে ১-৩টি বাচ্চা দেয়।
৮। উন্নত দেশে তাজা কাঁচা ঘাস, সংরক্ষিত ঘাস, শুকণা ঘাস এবং দানাদার খাদ্য খাওয়ানো হয় যে কারণে অধিকাংশ সময়ই ভেড়া পালন ব্যয়বহুল হয়।
৯। মাত্র ০.৬% ভেড়া ভূমিহীন অবস্থায় পালিত হয়। কৃষিজমি ও চারণ-ভূমি কমে যাচ্ছে বিধায় বাংলাদেশেও তাই ভূমিহীন পদ্ধতিতে ভেড়ার উৎপাদন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
১০। শংকর জাতের ভেড়ায় রোগ-ব্যাধি বেশি হতে পারে।
১১। স্ট্রাক, এন্টেরোটক্সিমিয়া বা পাল্পি, কিডনী ডিজিজ, ব্রাক্সি, ব্লাক ডিজিজ, ভেড়ার বাচ্চার আমাশয় ও ওলান পাকা বা ম্যাসটাইটিস, নিউমোনিয়া, ভিবরিওসিস, ব্রুসেলোসিস, ধনুষ্টংকার, ফুটরট, সালমোনেলোসিস, বর্ডার ডিজিজ, বসন্ত, প্লেগ বা পিপিআর, ক্ষুরা রোগ, একযাইমা, কক্সিডিওসিস, টক্সোপ্লাসমোসিস, কলিজা কৃমি, হিমোনকোসিস মেনুজ, উঁকুন, আঁঠালী, প্রেগনেন্সি টক্সিমিয়া, নিয়োনেটাল হাইপোগ্লাইসেমিয়া ইত্যাদি রোগ ভেড়ার হতে পারে।
১২। খামারীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের অভাব রয়েছে এবং এদেশে পালন উপযোগী ভেড়া আমদানী করলে বাংলাদেশের খামারীগন ভেড়া পালন করে লাভবান হতে পারবে |
১৩। বাংলাদেশে স্থানীয় ভাবে পালিত ভেড়াগুলো উন্নত জাতের না হওয়ায় এদের পশমও উন্নত মানের নয়। তবে এসব ভেড়া হতে প্রাপ্ত পশম হতে রাজশাহী, ঠাকুরগাঁও প্রভৃতি অঞ্চলে কম্বল তৈরী করা হয়।
১৪। আঞ্চলিক আবহাওয়া, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং স্বল্প খরচে ও সহজ-প্রাপ্য খাদ্যসামগ্রীর উপর ভেড়া পালন নির্ভরশীল।
১৫। বাংলাদেশে অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় ভেড়া পালন খুবই লাভজনক নয়। কারণ বাংলাদেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি গরু ও ছাগলের মাংস ভক্ষণ করে। খাদ্য হিসেবে ভেড়ার চাহিদা কম। তাই ভেড়ার মূল্য কম।
(৩) উপসংহার
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ভোক্তার চাহিদা, ভোক্তার যদি যথেষ্ট বাজার না থাকে তাহলে কোন পশুকে যতই কম খরচে বা সহজে পালন করা গেলেও সফল হওয়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে যদি আমরা বাংলাদেশের তদকে দেখি তবে এখানে গরু ও ছাগলের মাংসের চাহিদা বেশি, অপরদিকে ভেড়ার মাংসের তেমন চাহিদা এখনো তৈরি হয়নি।
বিভিন্ন গবাদি পশু যেমন- গরু পালন, ছাগল পালন, মহিষ পালন, ভেড়া পালন ইত্যাদি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট গবাদি পশু’ (inbangla.net/gobadi) এর সাথেই থাকুন।