বাচ্চা নেওয়ার সঠিক সময় বা বয়স কখন—এই প্রশ্নটি অনেক নতুন দম্পতি বা পরিবার পরিকল্পনাকারীদের মনে ঘুরপাক খায়। কেউ কেউ বলেন, ৩০ বছরের আগে বাচ্চা নেওয়াই ভালো। আবার কেউ বলেন, বিয়ের কয়েক বছর পরে সন্তান নেওয়া উচিত। কিন্তু সত্যিটা কী? আসলে এই প্রশ্নের কোনো একক বা সোজাসাপ্টা উত্তর নেই। বাচ্চা নেওয়ার সঠিক বয়স বা সময় নির্ভর করে আপনার জীবনযাপন, স্বাস্থ্য, ক্যারিয়ার, আর্থিক অবস্থা এবং কয়টি সন্তান চান তার উপর।
এই লেখায় আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব—বাচ্চা নেওয়ার সঠিক বয়স কত হতে পারে, কখন চেষ্টা শুরু করা উচিত, কী কী বিষয় বিবেচনা করতে হবে এবং সন্তান ধারণে সমস্যার লক্ষণগুলো কী কী।
(১) বাচ্চা নেওয়ার সঠিক বয়স কত?

“বাচ্চা নেওয়ার সঠিক বয়স” শব্দটি শুনলেই অনেকের মনে হয়, এর একটা নির্দিষ্ট সংখ্যা আছে। কিন্তু বাস্তবে এটা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে নারী ও পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা বয়সের সাথে পরিবর্তিত হয়। তবে শুধু জৈবিক দিকই নয়, জীবনের অন্যান্য দিক যেমন—পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং মানসিক প্রস্তুতি—এগুলোও গুরুত্বপূর্ণ।
ক) নারীদের প্রজনন ক্ষমতা এবং বয়স
নারীদের ক্ষেত্রে সন্তান ধারণের ক্ষমতা বয়সের সাথে সাথে কমতে থাকে। একজন নারী জন্মের সময় প্রায় ১০ থেকে ২০ লাখ ডিম্বাণু নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই ডিম্বাণুর সংখ্যা ও গুণগত মান কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ-
- ২০-৩০ বছর: এই সময়ে নারীদের প্রজনন ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি থাকে। প্রতি মাসে গর্ভধারণের সম্ভাবনা থাকে ২০-২৫%।
- ৩৫ বছর: ৩৫ বছর বয়সে ডিম্বাণুর সংখ্যা কমে প্রায় ২৫,০০০-এ নেমে আসে। গর্ভধারণের সম্ভাবনা কমে ১৫-২০%-এ।
- ৪০ বছর: ৪০ বছরের পর গর্ভধারণের সম্ভাবনা আরও কমে, প্রায় ৫%-এর কাছাকাছি।
তবে এর মানে এই নয় যে ৩৫ বা ৪০ পার হলেই সন্তান নেওয়া সম্ভব নয়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাহায্যে অনেকে এই বয়সেও সুস্থ সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন।
খ) পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা এবং বয়স
পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রজনন ক্ষমতা নারীদের তুলনায় অনেক দেরিতে কমে। বয়ঃসন্ধিকাল থেকে শুক্রাণু তৈরি শুরু হয় এবং প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের শরীরে প্রতিদিন প্রায় ৩০ কোটি শুক্রাণু তৈরি হয়। ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত শুক্রাণুর গুণগত মান খুব একটা কমে না। তবে ৫০-এর পর শুক্রাণুর গতিশীলতা এবং সংখ্যা কিছুটা হ্রাস পেতে পারে।
(২) বিয়ের কত দিন পর বাচ্চা নিলে ভালো?
“বিয়ের কত দিন পর বাচ্চা নেওয়া উচিত?”—এই প্রশ্নের উত্তরও সবার জন্য এক নয়। কিছু দম্পতি বিয়ের পরপরই সন্তান নিতে চান, আবার কেউ কেউ ২-৩ বছর অপেক্ষা করতে চান। এটি নির্ভর করে আপনার জীবনের পরিকল্পনার উপর। যেমন-
- বিয়ের পরপর: যদি আপনি তরুণ বয়সে বিয়ে করেন (২০-২৫ বছর) এবং আর্থিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন, তাহলে বিয়ের পরপরই বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন।
- ২-৩ বছর পর: অনেকে পড়াশোনা শেষ করতে বা ক্যারিয়ার গড়তে এই সময়টুকু অপেক্ষা করেন। এটি দম্পতি হিসেবে একে অপরকে বোঝার জন্যও ভালো সময়।
- ৫ বছর পর: যারা একটু দেরিতে বিয়ে করেন বা জীবনে স্থিতিশীলতা আনতে চান, তারা এই সময়টি বেছে নিতে পারেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিয়ের পর কমপক্ষে ৬ মাস থেকে ১ বছর দম্পতি হিসেবে সময় কাটানো ভালো। এতে একে অপরের সাথে সম্পর্ক মজবুত হয় এবং সন্তান নেওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া যায়।
(৩) কয়টি সন্তান চান তার উপর ভিত্তি করে বাচ্চা নেওয়ার সঠিক সময়
আপনি কয়টি সন্তান চান, এটি বাচ্চা নেওয়ার সঠিক বয়স নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে।
ক) একটি সন্তান চাইলে
যদি আপনি শুধু একটি সন্তান চান, তাহলে ৩০-৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেতে পারে। এই সময়ে নারীদের গর্ভধারণের সম্ভাবনা ৭৫-৮০% থাকে। তবে স্বাস্থ্যগত কোনো সমস্যা থাকলে আগে থেকে চেষ্টা শুরু করা ভালো।
খ) দুটি সন্তান চাইলে
দুটি সন্তানের জন্য সাধারণত প্রতি সন্তানের মাঝে ২-৩ বছর ব্যবধান রাখা হয়। তাই ২৫-৩০ বছর বয়সে প্রথম সন্তানের জন্য চেষ্টা শুরু করা উচিত। এতে দ্বিতীয় সন্তানের সময় আপনার বয়স ৩৫-এর বেশি হবে না।
গ) তিনটি সন্তান চাইলে
তিনটি সন্তান চাইলে আরও আগে পরিকল্পনা করতে হবে। ২২-২৫ বছর বয়সে প্রথম সন্তানের জন্য চেষ্টা শুরু করলে তিনটি সন্তানের জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ-
- প্রথম সন্তান: ২৫ বছরে
- দ্বিতীয় সন্তান: ২৮ বছরে
- তৃতীয় সন্তান: ৩১ বছরে
এতে ৩৫ বছর পার হওয়ার আগেই আপনার পরিবার পরিকল্পনা সম্পন্ন হবে।
(৪) বাচ্চা নেওয়ার ক্ষমতা কখন থেকে কত দ্রুত কমে?
ক) নারীদের ক্ষেত্রে
নারীদের প্রজনন ক্ষমতা ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রায় স্থিতিশীল থাকে। ৩৫ বছরের পর থেকে এটি দ্রুত কমতে শুরু করে। ৪০-এর পর গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ে এবং গর্ভধারণ কঠিন হয়ে পড়ে। তবে সঠিক জীবনযাপন ও চিকিৎসার মাধ্যমে এই সময়টি কিছুটা বাড়ানো যায়।
খ) পুরুষদের ক্ষেত্রে
পুরুষদের ক্ষেত্রে ৫০ বছর পর্যন্ত প্রজনন ক্ষমতা ভালো থাকে। তবে ধূমপান, মদ্যপান, স্থূলতা বা স্ট্রেসের কারণে শুক্রাণুর গুণগত মান কমতে পারে।
(৫) কোন কোন লক্ষণ থাকলে সন্তান ধারণে সমস্যা হতে পারে?
কিছু শারীরিক লক্ষণ থাকলে আগে থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এগুলো হলো-
ক) নারীদের ক্ষেত্রে
- অনিয়মিত মাসিক: যদি মাসিক নিয়মিত না হয় বা কয়েক মাস বন্ধ থাকে, তবে এটি পিসিওএস (পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম) এর লক্ষণ হতে পারে।
- অতিরিক্ত লোম: মুখে, বুকে বা পিঠে অতিরিক্ত লোম গজানো হরমোনের সমস্যার ইঙ্গিত দেয়।
- তলপেটে ব্যথা: মাসিকের সময় তীব্র ব্যথা বা অতিরিক্ত রক্তপাত ফাইব্রয়েড বা এন্ডোমেট্রিওসিসের লক্ষণ হতে পারে।
- থাইরয়েড সমস্যা: ক্লান্তি, ওজন বৃদ্ধি বা কোষ্ঠকাঠিন্য থাইরয়েডের সমস্যা নির্দেশ করে, যা গর্ভধারণে বাধা দিতে পারে।
খ) পুরুষদের ক্ষেত্রে
পুরুষদের ক্ষেত্রে বাইরে থেকে লক্ষণ বোঝা কঠিন। তবে বীর্য পরীক্ষার মাধ্যমে শুক্রাণুর সংখ্যা ও গুণগত মান পরীক্ষা করা যায়।
(৫) বাচ্চা নেওয়ার সঠিক সময়ে গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়ে

বয়স যাই হোক না কেন, কিছু নিয়ম মেনে চললে গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়ে। যেমন-
- সঠিক সময়ে সহবাস: মাসিক চক্রের মাঝামাঝি সময়ে (ওভুলেশন) সহবাস করলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা বেশি থাকে।
- স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন: ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, ধূমপান ত্যাগ করা এবং স্ট্রেস বা দুঃশ্চিন্তা কমানো গুরুত্বপূর্ণ।
- নিয়মিত চেকআপ: অন্য কোন স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে আগে থেকে চিকিৎসা নিন।
(৬) বাচ্চা নেওয়ার সিদ্ধান্ত কীভাবে নেবেন?
বাচ্চা নেওয়ার সঠিক সময় বা বয়স নির্ধারণ করা একান্তই আপনার এবং আপনার সঙ্গীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। বিজ্ঞান আপনাকে তথ্য দিতে পারে, কিন্তু জীবনের হিসেব আপনাকেই করতে হবে। আপনি কি পড়াশোনা শেষ করতে চান? ক্যারিয়ারে একটু এগোতে চান? নাকি পরিবার বাড়ানোই আপনার প্রথম লক্ষ্য? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই নির্ধারণ করবে আপনার জন্য সঠিক সময়।
(৭) শেষকথা
বাচ্চা নেওয়ার সঠিক বয়স বা সময় নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। একজনের জন্য ২৫ বছর যেমন উপযুক্ত হতে পারে, অন্যজনের জন্য ৩৫ বছরও ঠিক হতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনার শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি এবং জীবনের পরিকল্পনা। এই লেখায় আমরা চেষ্টা করেছি আপনাকে বিস্তারিত তথ্য দিতে, যাতে আপনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে চিন্তিত হন, তবে একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন।
আপনার সুস্বাস্থ্য এবং সুখী পরিবার কামনা করি!
ডিসক্লেইমার: এই লেখাটি শুধুমাত্র সাধারণ তথ্য প্রদানের উদ্দেশ্যে লেখা। এটি পেশাদার চিকিৎসা পরামর্শের বিকল্প নয়। সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা বা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত যেকোনো সিদ্ধান্তের আগে একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন।
পরিবার ও সংসার সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট সংসার’ (inbangla.net/songsar) এর সাথেই থাকুন।
অনুরোধ!! পোষ্ট ভালো লাগলে প্লিজ উপরের শেয়ার আইকনে ক্লিক করে পোষ্টটি শেয়ার করে দিন।