আধুনিক জীবনে আমরা ক্রমশ পরিবেশের প্রতি সচেতন হয়ে উঠছি। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে, ফসলের গুণগত মান কমাচ্ছে এবং পরিবেশের ক্ষতি করছে। এই পরিস্থিতিতে জৈব সার একটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। সবচেয়ে ভালো দিক হলো, আপনাকে বাজার থেকে জৈব সার কিনতে হবে না; বাড়িতেই সহজে এবং কম খরচে এটি তৈরি করা সম্ভব।
এই ব্লগে আমরা আলোচনা করব বাড়িতে জৈব সার তৈরির বিভিন্ন উপায়, এর উপকারিতা, প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং ধাপে ধাপে প্রক্রিয়া। আপনি যদি বাগান করতে ভালোবাসেন বা পরিবেশের জন্য কিছু করতে চান, তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য।
নিম্নে বাড়িতে সহজে জৈব সার তৈরির উপায় বর্ণানা করা হলো-
(১) জৈব সার কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ?
জৈব সার হলো প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি একটি পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ পদার্থ, যা গাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে এবং মাটির উর্বরতা বাড়ায়।
- জৈব সার রাসায়নিক সারের বিপরীতে কোনো ক্ষতিকর উপাদান ধারণ করে না।
- জৈব সারে প্রচুর পরিমাণে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম এবং অন্যান্য খনিজ থাকে, যা গাছের জন্য অপরিহার্য।
- এছাড়া এটি মাটির গঠন উন্নত করে, জল ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়ায় এবং ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ থেকে সুরক্ষা দেয়।
- বাড়িতে জৈব সার তৈরি করলে আপনি রান্নাঘরের বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করতে পারেন, যা পরিবেশ দূষণ কমায় এবং আপনার খরচও বাঁচায়।
তাই জৈব সার শুধু গাছের জন্য নয়, আমাদের গ্রহের জন্যও উপকারী।
(২) বাড়িতে জৈব সার তৈরির উপকারিতা
বাড়িতে জৈব সার তৈরির অনেক সুবিধা রয়েছে।
প্রথমত- এটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বা খুবই কম খরচে তৈরি করা যায়। রান্নাঘরের উচ্ছিষ্ট, বাগানের শুকনো পাতা বা গৃহস্থালির জৈব বর্জ্য দিয়ে এটি তৈরি করা সম্ভব।
দ্বিতীয়ত- এটি পরিবেশবান্ধব—আপনি বর্জ্য ফেলে পরিবেশ দূষণের পরিবর্তে তা দিয়ে উপকারী কিছু তৈরি করছেন।
তৃতীয়ত- জৈব সার গাছের জন্য নিরাপদ এবং ফসলের গুণগত মান বাড়ায়। যারা বাড়িতে সবজি বা ফল চাষ করেন, তাদের জন্য এটি একটি আদর্শ সমাধান। এছাড়া, জৈব সার তৈরির প্রক্রিয়া শিখলে আপনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একটি শিক্ষণীয় ও মজার কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেন।
(৩) জৈব সার তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ
বাড়িতে জৈব সার তৈরি করতে আপনার বড় কোনো বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। সাধারণ গৃহস্থালির জিনিস দিয়েই এটি সম্ভব।
জৈব সার তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো হলো-
- জৈব বর্জ্য: রান্নাঘরের উচ্ছিষ্ট যেমন সবজির খোসা, ফলের ছিবড়া, চায়ের পাতা, ডিমের খোসা ইত্যাদি।
- শুকনো উপাদান: শুকনো পাতা, খড়, কাঠের গুঁড়ো বা কাগজের টুকরো।
- পাত্র: একটি প্লাস্টিকের বিন, বালতি বা মাটির পাত্র।
- পানি: উপাদানগুলোকে আর্দ্র রাখার জন্য।
- যত্র: একটি কোদাল বা লাঠি মিশ্রণের জন্য।
এই উপকরণগুলো প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই পাওয়া যায়, তাই আপনাকে বাড়তি কিছু কিনতে হবে না।
(৪) জৈব সার তৈরির বিভিন্ন উপায়
বাড়িতে জৈব সার তৈরির জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি রযয়েছে। আমরা এখানে কয়েকটি সহজ ও কার্যকর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব।
ক) কম্পোস্টিং (কম্পোস্ট তৈরি)
কম্পোস্টিং হলো জৈব সার তৈরির সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি। এটি প্রাকৃতিকভাবে জৈব বর্জ্য পচিয়ে সারে রূপান্তরিত করে।
- ধাপ ১: একটি পাত্রে শুকনো পাতা বা খড়ের একটি স্তর বিছিয়ে দিন। এটি বায়ু চলাচলের জন্য সাহায্য করবে।
- ধাপ ২: এর উপর রান্নাঘরের জৈব বর্জ্য যেমন সবজির খোসা, ফলের ছিবড়া বা চায়ের পাতা যোগ করুন।
- ধাপ ৩: প্রতিটি স্তরের পর সামান্য পানি ছিটিয়ে দিন যাতে উপাদানগুলো আর্দ্র থাকে, কিন্তু ভিজে না যায়।
- ধাপ ৪: প্রতি ৩-৪ দিন পর কোদাল দিয়ে মিশ্রণটি নাড়ুন যাতে অক্সিজেন প্রবেশ করে এবং পচন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়।
- ধাপ ৫: ৪-৬ সপ্তাহ পর মিশ্রণটি গাঢ় বাদামি রঙের হয়ে মাটির মতো গন্ধ পাবে। তখন এটি ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত।
কম্পোস্ট তৈরির জন্য একটি ছায়াযুক্ত জায়গা বেছে নিন এবং পাত্রের নিচে ছিদ্র রাখুন যাতে অতিরিক্ত পানি বেরিয়ে যায়।
খ) ভার্মিকম্পোস্টিং (কেঁচো দিয়ে সার তৈরি)
ভার্মিকম্পোস্টিং হলো কেঁচো ব্যবহার করে জৈব সার তৈরির একটি দ্রুত ও কার্যকর পদ্ধতি। কেঁচো জৈব বর্জ্য খেয়ে তা পুষ্টিকর সারে রূপান্তরিত করে।
- ধাপ ১: একটি প্লাস্টিকের বিনে মাটি ও শুকনো পাতার স্তর তৈরি করুন।
- ধাপ ২: এতে জৈব বর্জ্য যোগ করুন এবং তার উপর ৫০-১০০টি কেঁচো ছেড়ে দিন। (কেঁচো বাজারে বা কৃষি খামার থেকে কিনতে পাওয়া যায়।)
- ধাপ ৩: পাত্রটি ঢেকে রাখুন এবং সপ্তাহে একবার পানি ছিটিয়ে আর্দ্র রাখুন।
- ধাপ ৪: ২-৩ মাস পর কেঁচোরা বর্জ্যকে কালো, গন্ধহীন সারে পরিণত করবে।
এই সার গাছের জন্য অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং মাটির গুণগত মান বাড়ায়। তবে মাংস, দুধজাত পণ্য বা তেলযুক্ত খাবার ব্যবহার করবেন না, কারণ এগুলো কেঁচোর জন্য ক্ষতিকর।
গ) তরল জৈব সার তৈরি
তরল জৈব সার গাছের জন্য দ্রুত পুষ্টি সরবরাহ করে এবং তৈরি করা খুবই সহজ।
- ধাপ ১: একটি বালতিতে সবজির খোসা, ফলের ছিবড়া বা কলার খোসা ভরুন।
- ধাপ ২: এতে পানি যোগ করুন এবং ঢাকনা দিয়ে ঢেকে ৭-১০ দিন রেখে দিন।
- ধাপ ৩: প্রতিদিন মিশ্রণটি নাড়ুন যাতে গাঁজন প্রক্রিয়া ভালোভাবে হয়।
- ধাপ ৪: ১০ দিন পর মিশ্রণটি ছেঁকে পানি আলাদা করুন। এই তরলটি গাছে স্প্রে করা বা মাটিতে দেওয়া যায়।
কলার খোসা থেকে তৈরি তরল সারে পটাশিয়াম বেশি থাকে, যা ফুল ও ফলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
ঘ) গোবর দিয়ে জৈব সার
যদি আপনার বাড়িতে গরু, মুরগি বা ছাগল থাকে, তাহলে গোবর দিয়ে জৈব সার তৈরি করা যায়।
- ধাপ ১: তাজা গোবর সংগ্রহ করুন এবং এটি শুকনো পাতা বা খড়ের সঙ্গে মিশিয়ে একটি গর্তে রাখুন।
- ধাপ ২: মিশ্রণটি আর্দ্র রাখতে সামান্য পানি দিন এবং ঢেকে রাখুন।
- ধাপ ৩: ২-৩ মাস পর গোবর পচে সারে পরিণত হবে।
এই সার মাটির জন্য অত্যন্ত উপকারী এবং বড় আকারে চাষের জন্য উপযুক্ত।
(৫) জৈব সার ব্যবহারের নিয়ম
জৈব সার তৈরির পর এটি সঠিকভাবে ব্যবহার করা জরুরি। গাছের গোড়ায় সার ছড়িয়ে দিন এবং মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিন। তরল সারের ক্ষেত্রে ১ঃ১০ অনুপাতে পানির সঙ্গে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করুন। অতিরিক্ত সার ব্যবহার করবেন না, কারণ এটি গাছের ক্ষতি করতে পারে। সাধারণত মাসে একবার সার দেওয়াই যথেষ্ট।
(৬) জৈব সার তৈরির সময় সতর্কতা
- পচন প্রক্রিয়ায় দুর্গন্ধ হতে পারে, তাই পাত্রটি বাড়ির বাইরে বা বারান্দায় রাখুন।
- প্লাস্টিকের বদলে মাটির পাত্র ব্যবহার করলে পরিবেশের জন্য ভালো।
- মাংস, তেল বা দুধজাত পণ্য ব্যবহার করবেন না, কারণ এগুলো পচে কীটপতঙ্গ আকর্ষণ করে।
- পাত্রে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখুন, না হলে পচন প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে।
(৭) জৈব সারের পরিবেশগত প্রভাব
বাড়িতে জৈব সার তৈরি করলে আপনি পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখছেন। এটি বর্জ্য কমায়, ল্যান্ডফিলে আবর্জনার পরিমাণ হ্রাস করে এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমায়। এছাড়া রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমলে মাটি ও পানির দূষণ রোধ হয়। তাই এটি শুধু আপনার বাগানের জন্য নয়, পৃথিবীর জন্যও একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।
তাই সবাল গৃহস্ত পরিবরাদের বলব, বাড়িতে সহজে জৈব সার তৈরি করা একটি সহজ, সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়া। উপরে উল্লিখিত পদ্ধতিগুলো আপনি আজ থেকেই শুরু করতে পারেন। এটি আপনার গাছকে সুস্থ রাখবে, ফসলের গুণগত মান বাড়াবে এবং পরিবেশের প্রতি আপনার দায়িত্ব পালনে সাহায্য করবে। জৈব সার তৈরির এই অভ্যাস গড়ে তুলে আপনি নিজের জীবনযাপনকে আরও টেকসই করে তুলতে পারেন। তাই আর দেরি না করে আজই শুরু করুন এবং প্রকৃতির সঙ্গে একটি সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলুন।
বিভিন্ন উদ্ভিদ, গাছ ও ফসল যেমন- বিভিন্ন শস্য, সবজি, ফুল, ফল ইত্যাদি চাষাবাদ সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট চাষাবাদ’ (inbangla.net/casabad) এর সাথেই থাকুন।
অনুরোধ!! পোষ্ট ভালো লাগলে প্লিজ উপরের শেয়ার আইকনে ক্লিক করে পোষ্টটি শেয়ার করে দিন।