Skip to content
বিভব পার্থক্য কী, বিস্তারিত আলোচনা

বিভব পার্থক্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যা বিদ্যুৎ এবং ইলেকট্রনিক্সের মৌলিক বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি সাধারণত বিদ্যুৎ প্রবাহের সাথে সম্পর্কিত এবং বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সার্কিটের কার্যকারিতা বোঝার জন্য অপরিহার্য।

এই ব্লগ পোস্টে আমরা বিভব পার্থক্য কী, এর সংজ্ঞা, গুরুত্ব, গণনা পদ্ধতি, ব্যবহার এবং আরও অনেক বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। আমাদের লক্ষ্য হলো এই বিষয়টিকে সহজবোধ্য এবং তথ্যবহুলভাবে পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করা, যাতে বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ পাঠক সবাই এটি সহজে বুঝতে পারেন।

(১) বিভব পার্থক্য কী?

বিভব পার্থক্য কি

বিভব পার্থক্য (ইংরেজিতে Voltage বা Potential Difference) হলো দুটি বিন্দুর মধ্যে বৈদ্যুতিক শক্তির পার্থক্য, যা বিদ্যুৎ প্রবাহের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে।

সহজভাবে বললে, বিভব পার্থক্য হলো একটি বৈদ্যুতিক চার্জকে এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দুতে স্থানান্তর করতে যে পরিমাণ কাজ করতে হয়, তার পরিমাপ।

বিভব পার্থক্যকে প্রায়ই “ভোল্টেজ” বলা হয় এবং এর একক হলো ভোল্ট (V)। এটি পরিমাপ করা হয় একটি যন্ত্রের মাধ্যমে, যাকে বলা হয় ভোল্টমিটার। বিভব পার্থক্য যত বেশি হবে, তত বেশি শক্তি বিদ্যুৎ প্রবাহের জন্য সরবরাহ করা হবে।

বিভব পার্থক্যের সংজ্ঞা:

দুটি বিন্দুর মধ্যে প্রতি একক ধনাত্মক আধানকে এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দুতে স্থানান্তর করতে যে পরিমাণ কাজ সম্পন্ন করতে হয় তার পরিমাপকে বিভব পার্থক্য বা ভোল্টেজ বলে।

অন্যভাবে বলা যায়, তড়িৎ ক্ষেত্রের দুটি বিন্দুর মধ্যে আধান স্থানান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তিই হলো বিভব পার্থক্য।

বিভব পার্থক্যে বা ভোল্টেজ নিম্নলিখিত সূত্র দ্বারা প্রকাশ করা হয়-

V = W / Q

যেখানে,

  • V = বিভব পার্থক্য (ভোল্টে)
  • W = কাজ বা শক্তি (জুলে)
  • Q = চার্জ (কুলম্বে)

এই সূত্র থেকে বোঝা যায় যে, এক কুলম্ব চার্জকে এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দুতে নিয়ে যেতে যদি এক জুল কাজ করতে হয়, তবে বিভব পার্থক্য হবে এক ভোল্ট।

(২) বিভব পার্থক্যে বা ভোল্টেজ বরে গুরুত্ব

বিভব পার্থক্য বা ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক সার্কিটের একটি মৌলিক উপাদান। এটি ছাড়া বিদ্যুৎ প্রবাহ সম্ভব নয়। নিচে বিভব পার্থক্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করা হলো-

  1. বিদ্যুৎ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ: বিভব পার্থক্য বিদ্যুৎ প্রবাহের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। ওহমের সূত্র (V = IR) অনুযায়ী, বিভব পার্থক্য বাড়লে বিদ্যুৎ প্রবাহও বাড়ে, যদি রোধ (Resistance) স্থির থাকে।
  2. বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির কার্যকারিতা: টেলিভিশন, ফ্রিজ, কম্পিউটার ইত্যাদি যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ বিভব পার্থক্য প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে গৃহস্থালি বিদ্যুৎ সাধারণত 220-240 ভোল্টে সরবরাহ করা হয়।
  3. শক্তি রূপান্তর: বিভব পার্থক্য বৈদ্যুতিক শক্তিকে অন্যান্য শক্তিতে (যেমন, তাপ, আলো, যান্ত্রিক শক্তি) রূপান্তর করতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি বৈদ্যুতিক বাল্বে বিভব পার্থক্যের কারণে বিদ্যুৎ তাপ এবং আলোতে রূপান্তরিত হয়।
  4. ইলেকট্রনিক্সে ব্যবহার: আধুনিক ইলেকট্রনিক্সে, যেমন মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ইত্যাদিতে, বিভব পার্থক্যের সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

(৩) বিভব পার্থক্যের ধরন

ভোল্টেজ বা বিভব পার্থক্যকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়-

  1. ডাইরেক্ট কারেন্ট (DC) বিভব পার্থক্য: এটি এমন বিভব পার্থক্য যেখানে বিদ্যুৎ একদিকে প্রবাহিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাটারি থেকে সরবরাহকৃত বিদ্যুৎ DC বিভব পার্থক্য সৃষ্টি করে।
  2. অল্টারনেটিং কারেন্ট (AC) বিভব পার্থক্য: এটি এমন বিভব পার্থক্য যেখানে বিদ্যুৎ পর্যায়ক্রমে দিক পরিবর্তন করে। গৃহস্থালি বিদ্যুৎ সাধারণত AC বিভব পার্থক্যের উপর নির্ভর করে।

(৪) বিভব পার্থক্য পরিমাপ

বিভব পার্থক্য পরিমাপের জন্য ভোল্টমিটার ব্যবহার করা হয়। এটি একটি সার্কিটের দুটি বিন্দুর মধ্যে সংযুক্ত করা হয় এবং এটি ভোল্টে বিভব পার্থক্য প্রদর্শন করে।

ভোল্টমিটার সবসময় সমান্তরালভাবে সংযুক্ত করতে হয়, কারণ এটি সার্কিটে বিদ্যুৎ প্রবাহে বাধা সৃষ্টি না করে শুধুমাত্র বিভব পার্থক্য পরিমাপ করে।

ভোল্টেজ বা বিভব পার্থক্যের পরিমাপ:

বিভব পার্থক্য বা ভোল্টেজ হিসাব জন্য সাধারণত ওহমের সূত্র ব্যবহার করা হয়-

V = I × R

যেখানে,

  • V = বিভব পার্থক্য (ভোল্টে)
  • I = বিদ্যুৎ প্রবাহ (অ্যাম্পিয়ারে)
  • R = রোধ (ওহমে)

উদাহরণ: যদি একটি সার্কিটে 2 অ্যাম্পিয়ার বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় এবং রোধ 10 ওহম হয়, তবে বিভব পার্থক্য হবে-

V = 2 × 10 = 20 ভোল্ট

(৫) বিভব পার্থক্যের ব্যবহার

বিভব পার্থক্যের ব্যবহার আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এবং শিল্পে বিস্তৃত। নিচে কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যবহার দেওয়া হলো-

  1. গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি: টেলিভিশন, ফ্রিজ, এয়ার কন্ডিশনার ইত্যাদি চালানোর জন্য বিভব পার্থক্য প্রয়োজন। বাংলাদেশে সাধারণত 220-240 ভোল্ট AC বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।
  2. ইলেকট্রনিক ডিভাইস: মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট ইত্যাদি চার্জ করার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ DC বিভব পার্থক্য প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, একটি মোবাইল ফোনের চার্জার সাধারণত 5V DC সরবরাহ করে।
  3. শিল্পে ব্যবহার: বড় বড় মেশিন, যেমন মোটর, পাম্প ইত্যাদি চালানোর জন্য উচ্চ বিভব পার্থক্য প্রয়োজন।
  4. চিকিৎসা ক্ষেত্রে: ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম (ECG), এমআরআই মেশিন ইত্যাদি চালানোর জন্য নির্দিষ্ট বিভব পার্থক্য ব্যবহৃত হয়।

(৬) বিভব পার্থক্য এবং বিদ্যুৎ প্রবাহের সম্পর্ক

বিভব পার্থক্য (Voltage) এবং বিদ্যুৎ প্রবাহ (Current) একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ওহমের সূত্র অনুসারে, বিভব পার্থক্য বাড়লে বিদ্যুৎ প্রবাহও বাড়ে, যদি রোধ স্থির থাকে।

এটি একটি পানির পাইপের সাথে তুলনা করা যায়। বিভব পার্থক্য হলো পানির চাপ, বিদ্যুৎ প্রবাহ হলো পানির প্রবাহ এবং রোধ হলো পাইপের সংকীর্ণতা। চাপ বাড়লে পানির প্রবাহ বাড়ে, ঠিক তেমনি বিভব পার্থক্য বাড়লে বিদ্যুৎ প্রবাহ বাড়ে।

(৭) বিভব পার্থক্য এবং শক্তি

বিভব পার্থক্য শক্তির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। একটি বৈদ্যুতিক সার্কিটে, বিভব পার্থক্য যত বেশি, তত বেশি শক্তি চার্জ বহন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি 12V ব্যাটারি একটি 6V ব্যাটারির তুলনায় বেশি শক্তি সরবরাহ করতে পারে।

শক্তি গণনার সূত্র হলো-

E = V × Q

যেখানে,

  • E = শক্তি (জুলে)
  • V = বিভব পার্থক্য (ভোল্টে)
  • Q = চার্জ (কুলম্বে)

(৮) বিভব পার্থক্যের সাথে সাধারণ ভুল ধারণা

বিভব পার্থক্য বা ভোল্টেজ নিয়ে অনেকের মধ্যে কিছু ভুল ধারণা থাকে। নিচে কিছু সাধারণ ভুল ধারণা এবং তার সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া হলো-

  1. ভুল ধারণা: বিভব পার্থক্য এবং বিদ্যুৎ প্রবাহ একই জিনিস।
    সঠিক ব্যাখ্যা: বিভব পার্থক্য এবং বিদ্যুৎ প্রবাহ ভিন্ন ধারণা। বিভব পার্থক্য হলো শক্তির পার্থক্য, আর বিদ্যুৎ প্রবাহ হলো চার্জের প্রবাহ।
  2. ভুল ধারণা: বিভব পার্থক্য শুধুমাত্র AC সার্কিটে থাকে।
    সঠিক ব্যাখ্যা: বিভব পার্থক্য AC এবং DC উভয় সার্কিটেই থাকে।
  3. ভুল ধারণা: উচ্চ বিভব পার্থক্য সবসময় বিপজ্জনক।
    সঠিক ব্যাখ্যা: বিভব পার্থক্যের বিপদ নির্ভর করে বিদ্যুৎ প্রবাহ এবং শরীরের রোধের উপর। তবে সাধারণত 50V-এর বেশি বিভব পার্থক্য মানুষের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।

(৯) বিভব পার্থক্যের নিরাপত্তা

বিভব পার্থক্যের (Voltage) সাথে কাজ করার সময় নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে কিছু নিরাপত্তা টিপস দেওয়া হলো-

  1. বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি পরীক্ষা: বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের আগে তারের ক্ষতি বা ত্রুটি আছে কিনা তা পরীক্ষা করুন।
  2. সঠিক সরঞ্জাম ব্যবহার: বিভব পার্থক্য পরিমাপের জন্য সঠিক ভোল্টমিটার ব্যবহার করুন।
  3. প্রশিক্ষণ: বৈদ্যুতিক সার্কিটের সাথে কাজ করার আগে প্রশিক্ষণ নিন।
  4. পানির সংস্পর্শ এড়ানো: বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির কাছে পানি বা ভেজা হাতে কাজ করবেন না।

(১০) উপসংহার

বিভব পার্থক্য বা ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক বিজ্ঞানের একটি মৌলিক ধারণা, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এবং শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এটি বিদ্যুৎ প্রবাহের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে এবং বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য অপরিহার্য।

এই ব্লগ পোস্টে আমরা বিভব পার্থক্য কী, বিভব পার্থক্যের সংজ্ঞা, গুরুত্ব, গণনা পদ্ধতি, ব্যবহার এবং নিরাপত্তা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আশা করি, এই পোস্টটি পাঠকদের জন্য তথ্যবহুল এবং সহজবোধ্য হবে।

আপনার যদি বিভব পার্থক্য বা বৈদ্যুতিক বিজ্ঞান সম্পর্কে আরও কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে কমেন্টে জানান। আমরা আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত!

প্রকৌশল বিদ্যা বা ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট ইঞ্জিনিয়ারিং’ (inbangla.net/eng) এর সাথেই থাকুন।

অনুরোধ!! পোষ্ট ভালো লাগলে প্লিজ উপরের শেয়ার আইকনে ক্লিক করে পোষ্টটি শেয়ার করে দিন।

Leave a Reply

nv-author-image

ইন বাংলা নেট ইঞ্জিঃ

প্রকৌশল বিদ্যা বা ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পর্কিত যা কিছু বাংলাতে।View Author posts