Skip to content

মেয়েদের ওভারিয়ান সিস্টঃ লক্ষণ, কারণ এবং চিকিৎসার বিকল্প

মেয়েদের ওভারিয়ান সিস্টঃ লক্ষণ, কারণ এবং চিকিৎসার বিকল্প

ওভারিয়ান সিস্ট একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা যা অনেক নারীর মধ্যে দেখা যায়, বিশেষ করে প্রজনন বয়সে। এটি শুনতে ভীতিকর মনে হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওভারিয়ান সিস্ট নিরীহ এবং নিজে থেকেই চলে যায়। তবে, কিছু ক্ষেত্রে এটি জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, যার জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

এই ব্লগ পোস্টে আমরা ওভারিয়ান সিস্ট সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব—এর লক্ষণ, কারণ, প্রকার, চিকিৎসা এবং কখন অপারেশনের প্রয়োজন হয়। এই তথ্যগুলো পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য এবং তথ্যবহুল হবে, যাতে আপনি এই বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

(১) ওভারিয়ান সিস্ট কী?

ওভারিয়ান সিস্ট কী
ওভারিয়ান সিস্ট

ওভারিয়ান সিস্ট হলো ডিম্বাশয়ে তৈরি হওয়া তরল-ভরা থলি বা বেলুনের মতো গঠন। এটি সাধারণত ডিম্বাশয়ের ভিতরে বা বাইরে তৈরি হয় এবং বিভিন্ন আকারের হতে পারে। কিছু সিস্ট খুবই ছোট (২-৪ সেন্টিমিটার), আবার কিছু বড় (১০ সেন্টিমিটার বা তার বেশি) হতে পারে।

বেশিরভাগ ওভারিয়ান সিস্ট কার্যকরী (functional) হয়, অর্থাৎ এগুলো মাসিক চক্রের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তৈরি হয় এবং কয়েক মাসের মধ্যে নিজে থেকে চলে যায়। তবে, কিছু সিস্ট প্যাথলজিকাল (pathological) হতে পারে, যা জটিলতার কারণ হতে পারে।

(২) ওভারিয়ান সিস্টের প্রকার

ওভারিয়ান সিস্ট বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রধান প্রকার হলো-

  1. কার্যকরী সিস্ট (Functional Cysts):
    • ফলিকুলার সিস্ট: মাসিক চক্রের সময় ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু নির্গত হয় না, তখন ফলিকল তরল জমা করে সিস্টে পরিণত হয়।
    • করপাস লুটিয়াম সিস্ট: ডিম্বাণু নির্গত হওয়ার পর ফলিকল করপাস লুটিয়ামে রূপান্তরিত হয়। এটি তরল জমা করলে সিস্ট তৈরি হয়।
    • এই সিস্টগুলো সাধারণত নিরীহ এবং কয়েক সপ্তাহ বা মাসের মধ্যে নিজে থেকে চলে যায়।
  2. পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS):
    • PCOS একটি হরমোনাল ডিসঅর্ডার, যেখানে ডিম্বাশয়ে একাধিক ছোট ছোট সিস্ট তৈরি হয়। এটি সাধারণত ওজন বৃদ্ধি, অনিয়মিত মাসিক, মুখে ব্রণ এবং অতিরিক্ত লোম বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত।
    • এই অবস্থায় অপারেশনের প্রয়োজন হয় না। লাইফস্টাইল পরিবর্তন এবং ওষুধ দিয়ে এটি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
  3. ডার্ময়েড সিস্ট:
    • এই সিস্টে চুল, ত্বক বা দাঁতের মতো টিস্যু থাকতে পারে। এগুলো সাধারণত নিরীহ, তবে বড় হলে অপসারণের প্রয়োজন হতে পারে।
  4. সিস্টাডেনোমা:
    • এগুলো ডিম্বাশয়ের বাইরের পৃষ্ঠে তৈরি হয় এবং তরল বা শ্লেষ্মা দিয়ে ভরা হয়। বড় হলে সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।
  5. এন্ডোমেট্রিওমা:
    • এন্ডোমেট্রিওসিসের কারণে তৈরি সিস্ট, যেখানে জরায়ুর টিস্যু ডিম্বাশয়ে জমা হয়। এগুলো ব্যথার কারণ হতে পারে এবং চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
পড়ুন
পিরিয়ড কি? মাসিক হলে কি কি করা যাবে না?

(৫) ওভারিয়ান সিস্টের লক্ষণ

ওভারিয়ান সিস্টের লক্ষণ

ছোট ওভারিয়ান সিস্ট সাধারণত কোনো লক্ষণ সৃষ্টি করে না এবং অনেক সময় আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে দৈবচয়ে ধরা পড়ে। তবে, বড় বা জটিল সিস্ট নিম্নলিখিত লক্ষণ সৃষ্টি করতে পারে-

  • পেটে ব্যথা বা অস্বস্তি, বিশেষ করে একপাশে।
  • মাসিক চক্রে অনিয়ম।
  • পেট ফাঁপা বা ভারী অনুভূতি।
  • যৌনমিলনের সময় ব্যথা।
  • ঘন ঘন প্রস্রাবের প্রয়োজন।
  • বড় সিস্টের ক্ষেত্রে পেটে দৃশ্যমান ফোলাভাব।

জরুরি লক্ষণ: নিম্নলিখিত লক্ষণ দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন-

  • তীব্র পেটে ব্যথা।
  • জ্বর বা বমি।
  • দুর্বলতা বা মাথা ঘোরা।
  • এগুলো সিস্ট ফেটে যাওয়া বা মোচড় খাওয়ার (torsion) লক্ষণ হতে পারে।

(৬) ওভারিয়ান সিস্টের কারণ

ওভারিয়ান সিস্টের বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে-

  1. হরমোনাল ভারসাম্যহীনতা:
    • মাসিক চক্রের সময় হরমোনের পরিবর্তন সিস্ট তৈরির কারণ হতে পারে।
    • PCOS-এর ক্ষেত্রে হরমোনাল ভারসাম্যহীনতা একটি প্রধান কারণ।
  2. জেনেটিক ফ্যাক্টর:
    • কিছু ক্ষেত্রে পারিবারিক ইতিহাস সিস্ট তৈরির ঝুঁকি বাড়ায়।
  3. লাইফস্টাইল:
    • অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, স্থূলতা এবং শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা PCOS-এর ঝুঁকি বাড়ায়।
  4. এন্ডোমেট্রিওসিস:
    • এই অবস্থায় জরায়ুর টিস্যু ডিম্বাশয়ে জমা হয়ে সিস্ট তৈরি করে।
  5. গর্ভাবস্থা:
    • গর্ভাবস্থায় কিছু কার্যকরী সিস্ট তৈরি হতে পারে, যা সাধারণত নিরীহ।

(৭) ওভারিয়ান সিস্ট নির্ণয়

ওভারিয়ান সিস্ট নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকরা সাধারণত নিম্নলিখিত পদ্ধতি ব্যবহার করেন-

  1. আল্ট্রাসাউন্ড:
    • এটি সিস্টের আকার, অবস্থান এবং প্রকৃতি (তরল-ভরা বা সলিড) নির্ণয়ের সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতি।
  2. রক্ত পরীক্ষা:
    • CA-125 পরীক্ষা করে ক্যান্সারের ঝুঁকি মূল্যায়ন করা হয়, বিশেষ করে সলিড কম্পোনেন্টযুক্ত সিস্টের ক্ষেত্রে।
    • হরমোনের মাত্রা পরীক্ষা করে PCOS নির্ণয় করা হয়।
  3. CT স্ক্যান বা MRI:
    • জটিল সিস্টের ক্ষেত্রে বিস্তারিত চিত্র পেতে এই পরীক্ষাগুলো করা হয়।
  4. ল্যাপারোস্কপি:
    • কিছু ক্ষেত্রে, সিস্টের প্রকৃতি নির্ণয় এবং অপসারণের জন্য ল্যাপারোস্কপি করা হয়।

(৮) ওভারিয়ান সিস্টের চিকিৎসা

ওভারিয়ান সিস্টের চিকিৎসা

ওভারিয়ান সিস্টের চিকিৎসা নির্ভর করে এর আকার, প্রকার এবং লক্ষণের উপর। সাধারণ চিকিৎসার বিকল্পগুলো হলো-

পড়ুন
যোনি কালো হয় কেন?

ক) পর্যবেক্ষণ (Watchful Waiting)

  • ছোট এবং নিরীহ সিস্টের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা সাধারণত নিয়মিত আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে এটি পর্যবেক্ষণ করেন।
  • বেশিরভাগ কার্যকরী সিস্ট কয়েক মাসের মধ্যে নিজে থেকে চলে যায়।

খ) লাইফস্টাইল পরিবর্তন

  • PCOS-এর ক্ষেত্রে ওজন কমানো, স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ এবং নিয়মিত ব্যায়াম গুরুত্বপূর্ণ।
  • কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত খাবার, যেমন শাকসবজি, ফল এবং গোটা শস্য, PCOS নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

গ) ওষুধ

  • জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল: মাসিক চক্র নিয়ন্ত্রণ এবং নতুন সিস্ট তৈরি রোধ করতে ব্যবহৃত হয়।
  • মেটফরমিন: PCOS-এর ক্ষেত্রে ইনসুলিন সংবেদনশীলতা উন্নত করতে ব্যবহৃত হয়।
  • হরমোনাল থেরাপি: হরমোনের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে ব্যবহৃত হয়।

ঘ) সার্জারি

  • বড় বা জটিল সিস্টের ক্ষেত্রে সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে। সার্জারির ধরন নির্ভর করে সিস্টের প্রকৃতির উপর:
    • ল্যাপারোস্কপি: ছোট ছিদ্রের মাধ্যমে সিস্ট অপসারণ করা হয়। এটি কম আক্রমণাত্মক এবং দ্রুত পুনরুদ্ধার সম্ভব।
    • ল্যাপারোটমি: বড় সিস্ট বা ক্যান্সারের সন্দেহ হলে পেটে বড় ছেদ দিয়ে অপারেশন করা হয়।
  • PCOS-এর ক্ষেত্রে সার্জারি খুবই বিরল। শুধুমাত্র গর্ভধারণে সমস্যা হলে ল্যাপারোস্কপিক ড্রিলিং করা হতে পারে।

(৯) কখন সার্জারির প্রয়োজন হয়?

বেশিরভাগ ওভারিয়ান সিস্টের ক্ষেত্রে সার্জারির প্রয়োজন হয় না। তবে, নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে সার্জারি প্রয়োজন হতে পারে-

  • বড় সিস্ট: ৫ সেন্টিমিটারের বেশি আকারের সিস্ট যদি ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
  • জটিলতা: সিস্ট ফেটে যাওয়া, মোচড় খাওয়া (torsion) বা সংক্রমণ।
  • ক্যান্সারের ঝুঁকি: সিস্টে সলিড কম্পোনেন্ট, দুই দিকে সিস্ট বা পেটে জল (ascites) থাকলে ক্যান্সারের ঝুঁকি মূল্যায়ন করা হয়।
  • তীব্র লক্ষণ: ব্যথা বা অন্যান্য সমস্যা যদি জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে।

গুরুত্বপূর্ণ: PCOS-এর ক্ষেত্রে সার্জারি প্রায় কখনোই প্রয়োজন হয় না। এটি একটি ভুল ধারণা যে PCOS-এর জন্য অপারেশন করতে হবে।

(১০) ওভারিয়ান সিস্ট প্রতিরোধ

সম্পূর্ণভাবে ওভারিয়ান সিস্ট প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও, কিছু পদক্ষেপ ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে-

  • স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখুন: স্থূলতা PCOS-এর ঝুঁকি বাড়ায়।
  • নিয়মিত ব্যায়াম: শারীরিক সক্রিয়তা হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখে।
  • স্বাস্থ্যকর খাদ্য: প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে ফল, শাকসবজি এবং গোটা শস্য খান।
  • নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: আল্ট্রাসাউন্ড এবং রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সমস্যা আগে থেকে ধরা সম্ভব।
পড়ুন
ওভারিয়ান সিস্টঃ কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

(১১) ওভারিয়ান সিস্ট নিয়ে সাধারণ ভুল ধারণা

  1. সব সিস্টের জন্য অপারেশন প্রয়োজন:
    • এটি সম্পূর্ণ ভুল। বেশিরভাগ সিস্ট নিরীহ এবং নিজে থেকে চলে যায়।
  2. PCOS মানে ক্যান্সারের ঝুঁকি:
    • PCOS এবং ক্যান্সারের মধ্যে সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। তবে, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ।
  3. সিস্ট থাকলে গর্ভধারণ সম্ভব নয়:
    • PCOS বা সিস্ট থাকলেও সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে গর্ভধারণ সম্ভব।

(১২) কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?

নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন-

  • তীব্র বা অবিরাম পেটে ব্যথা।
  • মাসিক চক্রে তীব্র অনিয়ম।
  • পেটে ফোলাভাব বা অস্বাভাবিক লক্ষণ।
  • গর্ভধারণে সমস্যা।

(১৩) শেষ কথা

ওভারিয়ান সিস্ট একটি সাধারণ সমস্যা, তবে সঠিক জ্ঞান এবং চিকিৎসার মাধ্যমে এটি সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বেশিরভাগ সিস্ট নিরীহ এবং অপারেশনের প্রয়োজন হয় না। PCOS-এর ক্ষেত্রে লাইফস্টাইল পরিবর্তন এবং ওষুধই যথেষ্ট। তবে, বড় বা জটিল সিস্টের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে আমরা আশা করি আপনি ওভারিয়ান সিস্ট সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেয়েছেন এবং এটি নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারবেন।


মানব শরীর ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট স্বাস্থ্য’ (inbangla.net/sastho) এর সাথেই থাকুন।

অনুরোধ!! পোষ্ট ভালো লাগলে প্লিজ উপরের শেয়ার আইকনে ক্লিক করে পোষ্টটি শেয়ার করে দিন।

Leave a Reply

nv-author-image

ইন বাংলা নেট স্বাস্থ্য

মানব শরীর ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত যা কিছু বাংলাতে।View Author posts