লেবু ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ ফল।
লেবু বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সমাদৃত ফল এবং দেশের সর্বত্রই এর চাষ হয়।
লেবু বাংলাদেশের সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও মৌলভীবাজারে বেশি জন্মে। এ ছাড়া ঢাকার ধামরাই ও মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলায় প্রচুর পরিমাণে লেবু উৎপন্ন হয়।
(১) লেবুর জাতের নাম ও বৈশিষ্ট্য
ক) বারি লেবু-১ (এলাচী লেবু)
‘বারি লেবু-১’ জাতটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সংগৃহীত ৩০টি জাতের মধ্য থেকে বাছাই করা হয়েছে। বাংলাদেশে চাষাবাদের জন্য জাতটিকে ১৯৯৬ সালে অনুমোদন করা হয়।
- এ জাতের লেবু ‘এলাচী মসলা’ এর মত গন্ধযুক্ত বিধায় এর নাম এলাচী লেবু।
- এলাচী লেবুর গাছ, পাতা ও ফল আকারে বড়।
- এলাচী লেবুর গাছে সময়মতো ও পরিমাণমত সার ও পানি দিলে বছরে ২ বার ফল দিতে পারে।
- ফল জুলাই-আগস্ট (মধ্য-আষাঢ় থেকে মধ্য-ভাদ্র) মাসে খাওয়ার উপযুক্ত হয়।
- একটি গাছে ১০০-১৫০টি ফল ধরে। ফল ডিম্বাকার।
- প্রতিটি ফলের ওজন ২৫০-২৭০ গ্রাম।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ১৫ টন।
- ত্বক অমসৃণ ও পুরু, প্রায় ০.৭ সেমি।
- ফলে বীজের সংখ্যা ১০০-১১০টি।
- ফলে রস ২৫%, রসে ৫.৩% এসিড এবং ৩২ মিলি গ্রাম/১০০ গ্রাম ভিটামিন রয়েছে।
- এলাচী লেবু বাংলাদেশের সর্বত্র চাষাবাদ করা সম্ভব।
- তবে পাহাড়ি বৃষ্টিবহুল এলাকায় ফলন বেশি হয়।
খ) বারি লেবু-২
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে জাত মূল্যায়নের মাধ্যমে ‘বারি লেবু-২’ জাতটি উদ্ভাবন করা হয় এবং ১৯৯৭ সালে অনুমোদন দেয়া হয়।
- এটি প্রায় সারা বছর ফল উৎপাদনকারী উচ্চ ফলনশীল জাত।
- পাতা ছোট আকৃতির ও সবুজ।
- নিয়মিত ফল ধরে।
- ফল প্রায় গোলাকৃতির হয়।
- টিএসএস ৭.৩০%।
- প্রতিটি ফলের ওজন ৭৫-৮৫ গ্রাম।
- ফলের আকার ৬ ⨉ ৫ সেমি, বহিরাবরণ মসৃণ, খোসার পুরুত্ব ০.৩০ সেমি এবং বীজের সংখ্যা ৪০-৫০টি।
- ফলের স্বাদ মাঝারী টক, রসের পরিমাণ খুব বেশি, ৩১-৩৪%।
- রসে ৭.২% এসিড এবং ৮৪ মিলি গ্রাম/১০০ গ্রাম ভিটামিন রয়েছে।
- বীজের রং সাদাটে এবং লম্বা।
- প্রতি গাছে ১৮০-১৯০টি ফল ধরে।
- ‘বারি লেবু-২’ সমগ্র বাংলাদেশে চাষাবাদের জন্য উপযোগী।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ১২ টন।
গ) বারি লেবু-৩
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সংগৃহীত লেবুর জার্মপ্লাজম মূল্যায়নের মাধ্যমে বাছাইকৃত জাত ‘বারি লেবু-৩’ নামে ১৯৯৭ সালে অনুমোদন দেয়া হয়।
- পাতা ছোট আকৃতির ও সবুজ।
- নিয়মিত ফল ধরে।
- ফল গোলাকার।
- ফলের গড় ওজন ৫০-৬০ গ্রাম।
- ফলের আকার মাঝারী (৫.৩ ⨉ ৫.২ সেমি), বহিরাবরণ খুবই মসৃণ, খোসার পুরুত্ব ০.৩০ সেমি এবং বীজের সংখ্যা ১৮-২২টি।
- ফলের স্বাদ হালকা টক, রসের পরিমাণ খুব বেশি (৩৭.৭%), রসে ৬.৮% এসিড ও ৬২ মিলি গ্রাম/১০০ গ্রাম ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে।
- বীজের রং হালকা বাদামী থেকে সাদাটে।
- বীজ লম্বাটে।
- সাত বছর বয়স্ক গাছে ২০০-২২০টি ফল ধরে।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ১০ টন।
- এ জাতের লেবু বর্ষাকালে ভাল হয়।
- ‘বারি লেবু-৩’ জাতটি বাংলাদেশের সব এলাকায় চাষাবাদের জন্য উপযোগী।
ঘ) বারি লেবু-৪
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সংগৃহীত জার্মপ্লাজমের মধ্য থেকে বাছাই করে মূল্যায়নের মাধ্যমে ‘বারি লেবু-৪’ জাতটি উদ্ভাবন করা হয় এবং ২০১৭ সালে জাত হিসাবে অনুমোদন দেয়া হয়।
- সারাবছর ফলদানকারী উচ্চ ফলনশীল জাত।
- গাছ ঝোপালো স্বভাবের।
- পাতা মাঝারী, উপবৃত্তাকার, পত্রফলকের অগ্রভাগ ভোতা ও গাঢ় সবুজ বর্ণের।
- ফুল সাদা, ফল গোলাকার ও মাঝারী (প্রতি ফলের গড় ওজন ৮২ গ্রাম), ফল দেখতে হালকা সবুজ বর্ণের এবং ফল সাধারণত একক এবং গুচ্ছাকারে ধরে।
- ফলের অভ্যন্তরে ১২ টি খন্ড বিদ্যমান, টিএসএস ৫.৩৫% এবং খাদ্যোপযোগী অংশ প্রায় ৭০%।
- ফলে ৩-৪ টি বীজ থাকে।
- এই জাতটি প্রায় ৮ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে।
- জাতটি সাইট্রাস জাতীয় ফলের অন্যতম প্রধান রোগ ক্যাঙ্কারসহ অন্যান্য রোগ ও পোকামাকড় সহিষ্ণু।
ঙ) বারি লেবু-৫ (কলম্বো লেবু)
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত জার্মপ্লাজম বাছাই ও মূল্যায়নের মাধ্যমে বারি লেবু-৫ জাতটি উদ্ভাবন করা হয় এবং ২০১৮ সালে বাংলাদেশে চাষের জন্য জাত হিসাবে অনুমোদন করা হয়।
- ‘বারি লেবু-৫’ উচ্চ ফলনশীল, নিয়মিত ফলদানকারী কলম্বো লেবুর জাত।
- দ্রুতবর্ধনশীল, ঝোপালো স্বভাবের, মাঝারী থেকে অত্যাধিক শাখা সমৃদ্ধ।
- পাতা বড়, উপবৃত্তাকার, পত্রফলকের অগ্রভাগ সূঁচালো ও গাঢ় সবুজ বর্ণের।
- ফুল সাদা, ছোট, উভয়লিঙ্গি, পাঁচ (৫) পাপড়ি বিশিষ্ট।
- ফল ডিম্বাকৃতি, আকারে বড় (গড় ওজন ২৬৮ গ্রাম) ও লম্বাটে, ফলত্বক অসমান, বিশেষ সুগন্ধ যুক্ত, থোকাকারে ধরে।
- ফল দেখতে উজ্জ্বল ও সবুজ বর্ণের।
- এ জাতের লেবুর খোসাও ভক্ষণযোগ্য এবং তিতা বিহীন।
- খাদ্যোপযোগী অংশ প্রায় ৮২% এবং টিএসএস ৭%।
- প্রতিটি ফলে ১০ থেকে ৩৫ টি বীজ থাকে।
- বীজ সুচালো ও গোলাকার।
- কলম্বো লেবু বিদেশে রপ্তানিযোগ্য একটি সম্ভাবনাময় ফল।
(২) জারা লেবুর পরিচিতি
বারি জারা লেবু-১:
‘বারি জারাঞ্চলেবু-১’ নিয়মিত ফলদানকারী একটি উচ্চ ফলনশীল জাত। স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত জার্মপ্লাজমের মধ্য থেকে বাছাই করে মূল্যায়েনের মাধ্যমে ‘বারি জারাঞ্চলেবু-১’ জাতটি উদ্ভাবন করা হয় এবং জাতটি বাংলদেশে চাষ করার জন্য ২০১৮ সালে অনুমোদন করা হয়।
- এই জাতটির গাছ দ্রুতবর্ধনশীল, ঝোপালো স্বভাবের মাঝারী থেকে অত্যাধিক শাখা সমৃদ্ধ বৃক্ষ।
- পাতা বড়, উপবৃত্তাকার, পত্রফলকের অগ্রভাগ গোলাকৃতি ও গাঢ় সবুজ বর্ণের।
- ফুল সাদা, ছোট, পুরুষ ও উভয়লিঙ্গিক, পাঁচ (৫) পাপড়ি বিশিষ্ট।
- ফুলে ৫ টি বৃত্যাংশ বিদ্যমান।
- ফল তুলনামূলকভাবে বড় (গড় ওজন ৮৮২ গ্রাম), লম্বাকৃতি ও একক ভাবে ধরে।
- ফল দেখতে উজ্জ্বল সবুজ বর্ণের।
- ফলত্বক অসমান ও অমসৃণ, বিশেষ সুগন্ধ যুক্ত।
- এ জাতের লেবুর খোসা পুরু ও ভক্ষণযোগ্য।
- ফলের অভ্যন্তরে ১২টি খন্ড বিদ্যমান, খাদ্যোপযোগী অংশ প্রায় ৭০% এবং টিএসএস ৬.৭২%।
- ফলে বীজ বিদ্যমান।
- বীজ সুচালো ও গোলাকার।
- কলম্বো লেবু বিদেশে রপ্তানিযোগ্য একটি সম্ভাবনাময় ফল।
(৩) লেবু চাষ পদ্ধতি
ক) মাটি
লেবু হালকা দোআঁশ ও নিষ্কাশন সম্পন্ন মধ্যম অম্লীয় মাটিতে ভাল হয়।
খ) মাদা তৈরি
- চারা রোপণ করার ১৫-২০ দিন পূর্বে ২.৫ ⨉ ২.৫ বা ৩ ⨉ ৩ মিটার দূরত্বে ৬০ ⨉ ৬০ ⨉ ৬০ সেমি আকারের গর্ত করতে হবে।
- গর্তের উপরের মাটির সাথে ১০-১৫ কেজি জৈব সার, ২০০ গ্রাম টিএসপি ও ২০০ গ্রাম এমওপি সার ভালভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে তাতে পানি দিতে হবে।
- এই হিসেবে প্রতি হেক্টর জমিতে ১,১১১-১,৬০০টি চারা দরকার হয়।
গ) রোপণ পদ্ধতি
লেবুর চারা সারি করে বা বর্গাকার প্রণালীতে লাগালে বাগানে আন্তঃপরিচর্যা ও ফল সংগ্রহ সহজ হয়। পাহাড়ী ঢালু জমিতে আড়াআড়ি ভাবে লাইন বা সারি করে চারা লাগালে মাটি ক্ষয় কম হয়।
ঘ) রোপণ সময়
মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত চারা লাগানোর উত্তম সময় তবে যদি সেচ সুবিধা থাকে তাহলে সারা বছরই চারা লাগানো যায়।
ঙ) চারা/কলম রোপণ ও পরিচর্যা
- মাদা তৈরি করার ১৫-২০ দিন পর চারা বা কলম লাগাতে হয়।
- চারা গর্তের ঠিক মাঝখানে খাড়াভাবে লাগাতে হবে এবং চারার চারদিকের মাটি হাত দিয়ে চেপে ভালভাবে বসিয়ে দিতে হয়।
- তারপর চারাটি খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে এবং চারার গোড়ায় ঝাঝড়ি দিয়ে পানি দিতে হবে।
- প্রয়োজনে প্রতিটি চারায় পৃথকভাবে বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
চ) গাছে সার প্রয়োগ
চারা লাগানোর পর ভাল ফলন পেতে হলে নিয়মিতভাবে সময়মতো সার প্রয়োগ করতে হবে। নিম্নে বয়স অনুপাতে গাছপ্রতি সারের পরিমাণ দেওয়া হল।
গাছের বয়স (বছর) | পঁচা গোবর (কেজি) | ইউরিয়া (গ্রাম) | টিএসপি (গ্রাম) | এমওপি (গ্রাম) | জিপসাম (গ্রাম) | জিংক (গ্রাম) | বোরণ (গ্রাম) |
১-২ | ২৫ | ২৫০ | ২৫০ | ২৫০ | ১০০ | ১৫ | ৫০ |
৩-৫ | ৩০ | ৫০০ | ৪০০ | ২৫০ | ১৫০ | ৩০ | ৬০ |
৬ এবং তদুর্ধ | ৪০ | ৫০০ | ৪০০ | ৪০০ | ২০০ | ৪০ | ৭৫ |
ছ) সার প্রয়োগ পদ্ধতি
উল্লিখিত সার সমান তিন কিস্তিতে গাছের গোড়া হতে কিছু দূরে ছিটিয়ে কোদাল দ্বারা কুপিয়ে বা চাষ দিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
পাহাড়ের ঢালে ডিবলিং পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
প্রথম কিস্তি বর্ষার প্রারম্ভে (বৈশাখন্ডজ্যৈষ্ঠ), দ্বিতীয় কিস্তি মধ্য-ভাদ্র থেকে মধ্য-কার্তিক (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) মাসে এবং তৃতীয় কিস্তি মাঘ-ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারি) মাসে প্রয়োগ করতে হবে।
জ) অঙ্গ ছাঁটাই
গাছের গোড়ার দিকে জল-শোষক শাখা বের হলেই কেটে ফেলতে হবে। এছাড়া, গাছের ভিতরের দিকে যে সব ডালাপালা সূর্যালোক পায় না সেসব দুর্বল ও রোগাক্রান্ত শাখা প্রশাখা নিয়মিত ছাঁটাই করে দিতে হবে।
মধ্য-ভাদ্র থেকে মধ্য-কার্তিক (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) ছাঁটাই করার উপযুক্ত সময়। ছাঁটাই করার পর কর্তিত স্থানে বর্দোপেস্টের প্রলেপ দিতে হবে যাতে ছত্রাক আক্রমণ করতে না পারে।
ঝ) পানি সেচ ও নিষ্কাশন
খরা মৌসুমে ২-৩ বার সেচ প্রয়োগ করা দরকার। জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না বিধায় বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের সময় গাছের গোড়ায় যাতে পানি না জমে সেজন্য নালা করে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হয়।
(৩) লেবু চাষে পোকা দমন
লেবুর প্রজাপতি পোকা:
এ পোকার কীড়া পাতা খেয়ে ফেলে। এজন্য ফলন ও গাছের বৃদ্ধি ব্যবহত হয়।
প্রতিকার:
- ডিম ও কীড়াযুক্ত পাতা সংগ্রহ করে মাটির নিচে পুঁতে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
- সুমিথিয়ন ৫০ ইসি/লিবাসিড ৫ ইসি ২ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পরপর ২-৩ বার প্রয়োগ করতে হবে।
[সূত্র: বিএআরআই]