স্প্রিংকলার সেচ এমন একটি সেচ পদ্ধতি যা প্রাকৃতিক বৃষ্টিপাতের অনুরূপ। এই পদ্ধতিতে ভূ-গর্ভস্থ্ বা ভূপৃষ্ঠস্থ জলাধার হতে পাম্পদ্বারা পাইপ ও স্প্রিংকলার সিস্টেমের মাধ্যমে পানি বাতাসে স্প্রে করা হয় যা ছোট ছোট ফোঁটা আকারে বৃষ্টির ন্যায় ফসলের মূলা লকে সিক্ত করে।
সব ধরনের ফসলেই স্প্রিংকলার পদ্ধতিতে সেচ প্রদান করা যায়, তবে যেসব ফসলের মূল অগভীর ও পরিমিত পরিমাণ পানি দ্বারা ঘন ঘন সেচ প্রয়োগ করতে হয় সে সব ফসলে এই পদ্ধতি অধিক উপযোগী। তাছাড়া বেলে মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা কম হওয়ায় স্প্রিংকলার পদ্ধতিতে সেচ প্রয়োগ করলে পানির ব্যবহার দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
মসলা জাতীয় ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ ও রসুন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফসল। পেঁয়াজ ও রসুন বিভিন্ন রকমের রান্নার গন্ধ, রূচি ও স্বাদ বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। তাছাড়া বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও রসুন ব্যবহার হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে চাহিদার তুলনায় পেঁয়াজ ও রসুনের উৎপাদন বেশিরভাগ সময়ই কম লক্ষ্য করা যায়। সেচ পানির সঠিক বিতরণ ব্যবস্থা ও দক্ষ সেচ ব্যবস্থাপনার অভাব উৎপাদন কম হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ।
পেঁয়াজ ও রসুন একটি অগভীর মূলীয় কন্দ জাতীয় ফসল হওয়ায় এর বৃদ্ধি ও অধিক ফলনের জন্য স্বল্প পরিমাণ সেচ ঘন ঘন প্রয়োগের প্রয়োজন হয়। আর ঘন ঘন হালকা সেচের জন্য স্প্রিংকলার একটি উপযুক্ত সেচ পদ্ধতি।
(১) স্প্রিংকলার সেচ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যসমূহ
এটা এমন একটি সেচ পদ্ধতি যা জলাধার হতে পাম্প, পানি বিতরণের পাইপ এবং স্প্রিংকলার সিস্টেমের মাধ্যমে পানি বাতাসে স্প্রে করে ছোট ছোট ফোঁটা আকারে বৃষ্টির মতো করে ফসলের জমিতে প্রয়োগ করা হয়। এটা ওভারহেড সেচ পদ্ধতি নামেও পরিচিত।
- পানি পরিবহনে নালা তৈরির প্রয়োজন হয় না তাই পানির পরিবহনজনিত কোনো ক্ষতি নেই।
- এঁটেল মাটি ছাড়া সব ধরনের মাটির জন্যই এ পদ্ধতি উপযোগী।
- পাহাড়ী এলাকা বা উঁচু-নিচু জমিতে যেখানে অন্য পদ্ধতি উপযোগী নয়।
- খুব কাছাকাছি লাগানো ফসলের ক্ষেত্রে।
- সেচ পানি সাশ্রয়ী ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়।
- এ পদ্ধতিতে সেচ প্রয়োগ করলে পানির অনুস্রবণ জনিত বা গড়িয়ে যাওয়া ক্ষতি হয় না।
- এই পদ্ধতি অগভীর মূলের ফসলে যেখানে ঘন ঘন পানি দেয়ার প্রয়োজন পড়ে যেমন- পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি ফসলে উপকারি।
- বীজ বোনার পর এই পদ্ধতিতে হালকা সেচ দিলে বীজের অঙ্কুরোদগম নিশ্চিত হয় এবং বীজের কোন পচনজনিত ক্ষতি হয় না।
- সেচ পানির সুষম বণ্টন হয় ফলে পানি ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
- প্রাথমিক খরচ অন্যান্য সেচ পদ্ধতির চেয়ে বেশি।
- এঁটেল মাটির ফসলের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি অনুপযোগী।
- সেচ প্রয়োগের সময় বাতাসের বেগ বেশি থাকলে পরিষ্কার পানির প্রয়োজন।
- অপরিষ্কার পানি দ্বারা সেচ প্রয়োগ করলে স্প্রিংকলার নজেল বন্ধ হয়ে যায়।
- এই পদ্ধতিতে পানির বাষ্পীভবনজনিত ক্ষতি বেশি হয় যদি নজেল প্রেসার, বায়ু প্রবাহ, তাপমাত্রা বেশি হয়।
(২) স্প্রিংকলার সেচ পদ্ধতিতে রসুন চাষ পদ্ধতি

ক) সুবিধা
পেঁয়াজ অগভীর মূলীয় ফসল হওয়ায় ভাল ফলন পেতে ঘন ঘন সেচ প্রদান করতে হয়, যা একমাত্র স্প্রিংকলার পদ্ধতিতেই সম্ভব।
- স্প্রিংকলার পদ্ধতিতে প্রস্বেদনের ১০০-১২০% মাত্রার সেচ ৭ দিন অন্তর প্রয়োগ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
- চারা লাগানোর পর ২/৩ দিন অন্তর সেচ প্রয়োগ করতে হবে ১৫ দিন পর্যন্ত।
পেঁয়াজ ফসল তোলার ১৫ দিন পূর্বে সেচ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। - স্প্রিংকলার পদ্ধতিতে সেচ প্রদান করলে প্রায় ৩০% পানি সাশ্রয় এবং ৪০-৪৫% ফলন বৃদ্ধি হয়। এর ফলে বেশি এলাকায় সেচের আওতায় আনা সম্ভব হবে।
- স্প্রিংকলার পদ্ধতিতে পেঁয়াজ উৎপাদনের আয়-ব্যয়ের অনুপাত ৩:১।
- স্প্রিংকলার পদ্ধতিতে সেচ প্রয়োগে পেঁয়াজে থ্রিপ্স পোকার আক্রমণ কম হয়।
খ) রোপণের সময় ও পদ্ধতি
- মধ্য অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত রসুনের কোয়া লাগানোর উপযুক্ত সময়।
- ৪-৫ টি চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। এসময় জমিতে আগাছা থাকলে তা পরিষ্কার করতে হবে।
- রসুনের কোয়া রোপণের সময় এক সারি থেকে অন্য সারির দূরত্ব হবে ১০ সেমি। সাধারণত ০.৭৫-১ গ্রাম রসুনের কোয়া বীজ হিসেবে ব্যবহার করলে ফলন বেশি পাওয়া যায়।
গ) সার প্রয়োগ
রসুনের জন্য প্রতি হেক্টরে নিম্নলিখিত হারে সার প্রয়োগ করতে হবে।
সারের নাম | পরিমাণ (কেজি/হেক্টর) |
ইউরিয়া | ২১৭ কেজি |
টিএসপি | ২৬৭ কেজি |
এমওপি | ৩৩৩ কেজি |
জিপসাম | ১১০ কেজি |
গোবর | ৫ টন |
সম্পূর্ণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম, অর্ধেক ইউরিয়া ও অর্ধেক এমওপি জমি তৈরির শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করে জমি ভালভাবে তৈরি করতে হবে। বাকি ইউরিয়া ও এমওপি দুই কিস্তিতে সমানভাগে রসুন বপনের ২৫ দিন এবং ৫০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে।
ঘ) ভূ-পৃষ্ঠস্থ (প্লাবন সেচ) ও স্প্রিংকলার পদ্ধতিতে পেঁয়াজে সেচ প্রয়োগের নির্ঘণ্ট (সিডিউল)
প্রতি সেচে পানির পরিমাণ (মিমি):
পদ্ধতি | পদ্ধতি প্রাথমিক পর্যায় (০-২৫ দিন) | বৃদ্ধি পর্যায় (২১-৪৫ দিন) | কন্দ গঠন ও বৃদ্ধ পর্যায় (৪৫-৬৫ দিন) | কন্দ পরিপক্ক পর্যায় (৬৬-৯০ দিন) |
ভূ-পৃষ্ঠস্থ সেচ (১৫ দিন অন্তর) | ২০-২৫ | ৩৫-৪০ | ৪৫-৫০ | ৪০-৪৫ |
স্প্রিংকলার সেচ (৭ দিন অন্তর) | ১০-১২ (২-৩ দিন অন্তর) | ১৫-১৮ | ৩৫-২৮ | ২২-২৫ |
(৩) স্প্রিংকলার সেচ পদ্ধতিতে পেঁয়াজ চাষ পদ্ধতি

ক) সুবিধা
- রসুনে ফসলের চাহিদা অনুযায়ী ৮ থেকে ১০ দিন অন্তর স্প্রিংকলার পদ্ধতিতে সেচ প্রয়োগ করলে প্রচলিত সেচ পদ্ধতির চেয়ে শতকরা প্রায় ১৫-২০ ভাগ বেশি ফলন পাওয়া যায় এবং শতকরা প্রায় ২০-২৫ ভাগ পানি সাশ্রয় হয়।
- স্প্রিংকলার পদ্ধতিতে প্রস্বেদনের ৮০-১০০% মাত্রার সেচ ১০ দিন অন্তর প্রয়োগ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
- মাটিতে রস কম থাকলে রসুনের কোয়া লাগানোর পর পর হালকা সেচ দিতে হবে।
- এই পদ্ধতিতে রসুন চাষ করলে কৃষক পদ্ধতি অপেক্ষা প্রতি হেক্টরে প্রায় ১ লাখ টাকা বেশি আয় সম্ভব।
- স্প্রিংকলার সেচ পদ্ধতিতে রসুন উৎপাদনের আয়-ব্যয়ের অনুপাত ২:১।
খ) বপনের সময় এবং পদ্ধতি
- সাধারণত নভেম্বর মাস বীজ উৎপাদনের জন্য পেঁয়াজের কন্দ বপনের উপযুক্ত সময়।
- বেডের সাইজ ১.৫ মিটার প্রস্থ এবং ৩ মিটার লম্বা হওয়া বা নীয়।
- সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫ সেন্টিমিটার এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২০ সেন্টিমিটার হওয়া উচিত। প্রতি হেক্টরে প্রায় ১০ টন পেঁয়াজের কন্দ বপন করা প্রয়োজন।
গ) সারের মাত্রা ও ব্যবহার
রবি মৌসুমে বীজ উৎপাদনের জন্য পেঁয়াজ চাষে নিম্নরূপ হারে সার প্রয়োগ করতে হবে।
সারের নাম | পরিমাণ/হেক্টর |
ইউরিয়া | ৩২০-৩৩০ কেজি |
টি এস পি | ৫০০ কেজি |
এমওপি | ৩৬০ কেজি |
জিপসাম | ১১০ কেজি |
জিঙ্ক সালফেট | ১০ কেজি |
বরিক এসিড | ১০ কেজি |
গোবর | ৮-১০ টন |
শেষ চাষের সময় সম্পূর্ণ পরিমাণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম, জিংক, রোরাক্স, এমওপি এবং ইউরিয়া সারের অর্ধেক জমিতে সমানভাবে ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া কন্দ রোপণের ২৫ এবং ৫০ দিন পর সমান ২ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে।
ঘ) রসুনে সেচ প্রয়োগে বিবেচ্য বিষয়াবলী
- রসুন অগভীর মূলীয় ফসল হওয়ায় সতর্কতার সাথে সেচ প্রদান দরকার। সেচ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হলে মূলাঞ্চলে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয় ফলে গাছ হলুদ বর্ণ ধারণ করে।
- রসুনের প্রাথমিক বৃদ্ধি পর্যায়ে পানি কম লাগে তবে গাছ বৃদ্ধির সাথে সাথে পানির চাহিদা বেড়ে যায়।
- সাধারণত ১০/১৫ দিন অন্তর সেচ প্রদান করতে হয়। তবে রসুন পরিপক্ক হওয়ার অন্তত ২০ দিন পূর্বে সেচ প্রদান বন্ধ রাখতে হয়।
- কন্দ গঠন এবং বৃদ্ধি পর্যায়ে পানির চাহিদা বৃদ্ধি পায় এ সময়ে সেচ প্রদান না করলে ফলনের মারাত্মক ক্ষতি হয়। তাই এ পর্যায়কে সেচ প্রদান করলে কন্দের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় আবার অধিক সেচ প্রয়োগ করলে রসুনের কন্দে পচন ধরে।
- অতিরিক্ত ভেজা অবস্থায় রসুনের বাইরের খোসা (scale) ফেটে যায়।
ঙ) ভূ-পৃষ্ঠস্থ (প্লাবন সেচ) ও স্প্রিংকলার পদ্ধতিতে রসুনে সেচ প্রয়োগের নির্ঘণ্ট
প্রতি সেচে পানির পরিমাণ (মিমি):
পদ্ধতি | পদ্ধতি প্রাথমিক পর্যায় (০-৩০ দিন) | বৃদ্ধি পর্যায় (৩১-৭০ দিন) | কন্দ গঠন ও বৃদ্ধ পর্যায় (৭০-১০০ দিন) | কন্দ পরিপক্ক পর্যায় (১০১-১২৫ দিন) |
ভূ-পৃষ্ঠস্থ সেচ (১৫ দিন অন্তর) | ২০-২৫ | ৩৫-৪০ | ৪৫-৫০ | ৪০-৪৫ |
স্প্রিংকলার সেচ (৭ দিন অন্তর) | ১৫-১৮ | ১৫-১৮ | ৩৫-২৮ | ২২-২৫ |
বিভিন্ন উদ্ভিদ, গাছ ও ফসল যেমন- বিভিন্ন শস্য, সবজি, ফুল, ফল ইত্যাদি চাষাবাদ সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট চাষাবাদ’ (inbangla.net/casabad) এর সাথেই থাকুন।