হুন্ডি (hundi) একটি শব্দ যা আমাদের অনেকের কাছে পরিচিত, বিশেষ করে যারা প্রবাসে থাকেন বা আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু হুন্ডি কি আসলে? হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো হয় কীভাবে? হুন্ডি কি বৈধ? হুন্ডি ব্যবসা কি হালাল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে অনেকেই বিভ্রান্তিতে পড়েন।
এই ব্লগ পোস্টে আমরা হুন্ডি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো—এর ইতিহাস, কার্যপ্রণালী, বৈধতা, এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর অবস্থান। আপনি যদি হুন্ডি সম্পর্কে সবকিছু জানতে চান, তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য।
(১) হুন্ডি কি (hundi ki)?

সহজ ভাষায়-
হুন্ডি কি: হুন্ডি হলো এক ধরনের অবৈধ উপায়ে টাকা পাঠানো পদ্ধতি, যেখানে একজন প্রবাসী বেশি বিনিময় মূল্য পাবার আশায়, বিদেশ থেকে অর্জিত টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে না পাঠিয়ে, ব্যক্তিগতভাবে বা দালালের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠান।
মানে, প্রবাসে থাকা কেউ তার পরিবারের জন্য টাকা পাঠাতে চাইলে, সে যদি হুন্ডির মাধ্যমে পাঠায়, তাহলে—
- সে প্রবাসে থাকা এক লোককে টাকা দেয়,
- সেই লোকের বাংলাদেশে থাকা আরেকজন লোক,
- তার পরিবারের হাতে টাকা দিয়ে দেয়।
হুন্ডিকে ইংরেজিতে কি বলে?
হুন্ডিকে ইংরেজিতে সাধারণভাবে বলা হয়-
🔹 Informal money transfer system
🔹 Underground banking
🔹 Hawala system (বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে)
👉 তবে সবচেয়ে কাছাকাছি ও পরিচিত ইংরেজি শব্দ হলো ‘Hawala’।
(২) হুন্ডির একটি উদাহরণ
ধরা যাক, রহিম নামে একজন ব্যক্তি দুবাইয়ে কাজ করেন। তিনি প্রতি মাসে তার গ্রামের পরিবারের কাছে ৫০,০০০ টাকা পাঠাতে চান। ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে গেলে তাকে ফি দিতে হবে, কাগজপত্র জমা দিতে হবে, এবং বিনিময় হারে ১ ডলারে ১১০ টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু রহিম শুনেছেন, হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠালে দ্রুত এবং বেশি দামে (ধরা যাক, ১ ডলারে ১১৮ টাকা) পাওয়া যায়। তাই তিনি হুন্ডি বেছে নিলেন।
কীভাবে কাজ হয়?
- রহিম দুবাইয়ে একজন হুন্ডি ব্যবসায়ীর কাছে যান। তিনি ব্যবসায়ীকে ৫০০ দিরহাম (দুবাইয়ের মুদ্রা) দেন, যা বাংলাদেশি ৫০,০০০ টাকার সমান।
- রহিম ব্যবসায়ীকে বলেন, “এই টাকা আমার গ্রামে আমার ভাইয়ের কাছে পৌঁছে দিন।” তিনি ভাইয়ের নাম ও ফোন নম্বর দেন।
- হুন্ডি ব্যবসায়ী বাংলাদেশে তার এজেন্টকে ফোন করেন এবং বলেন, “রহিমের ভাইকে ৫০,০০০ টাকা দিয়ে দাও।”
- বাংলাদেশের এজেন্ট রহিমের ভাইয়ের কাছে গিয়ে নগদ ৫০,০০০ টাকা হাতে দেন।
- পরে দুবাইয়ের ব্যবসায়ী এবং বাংলাদেশের এজেন্ট তাদের নিজেদের মধ্যে হিসাব মিটিয়ে নেন—হয়তো অন্য কোনো লেনদেনের মাধ্যমে।
এটাই হুন্ডি।
এখানে কোনো ব্যাংক বা কাগজপত্র জড়িত নেই। সবকিছু হয় মুখের কথায় এবং আস্থার ওপর। রহিমের জন্য এটি দ্রুত এবং লাভজনক হলেও, এটি বাংলাদেশে আইনত অবৈধ। যদি ব্যবসায়ী টাকা নিয়ে পালায়, রহিমের কিছু করার থাকবে না।
(৩) হুন্ডি কাকে বলে?

হুন্ডি কাকে বলে তা বোঝার জন্য আমাদের এর সংজ্ঞা ও কার্যপ্রণালী জানতে হবে।
হুন্ডি হলো এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তি তার অর্থ একটি মধ্যস্থতাকারী বা হুন্ডি ব্যবসায়ীর কাছে জমা দেয়, এবং সেই ব্যবসায়ী তার প্রতিনিধি বা এজেন্টের মাধ্যমে টাকাটি গন্তব্যে পৌঁছে দেয়।
হুন্ডির আরেকটি প্রচলিত নাম হলো “হাওয়ালা“। হাওয়ালা শব্দটি আরবি থেকে এসেছে, যার অর্থ “স্থানান্তর”। যদিও হুন্ডি এবং হাওয়ালা মূলত একই ধরনের কাজ করে, তবে এদের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে।
হুন্ডি সাধারণত ভারত, পাকিস্তান, এবং বাংলাদেশে বেশি প্রচলিত, আর হাওয়ালা মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার দেশগুলোতে বেশি ব্যবহৃত হয়।
হুন্ডিতে টাকা সরাসরি স্থানান্তর করা হয়, যেখানে হাওয়ালায় একটি বিশাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ঋণ এবং পুঁজির সমন্বয় ঘটিয়ে লেনদেন সম্পন্ন করা হয়। উভয়টাই ব্যংক বহির্ভূত আর্থিক লেনদেন।
(৪) হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো হয় কীভাবে?

হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়াটি খুবই সহজ, কিন্তু এটি সম্পূর্ণভাবে আস্থার ওপর নির্ভরশীল।
ধরা যাক, একজন প্রবাসী সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে ১ লাখ টাকা পাঠাতে চান। তিনি কী করবেন? হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো হয় কীভাবে? এই প্রক্রিয়াটি নিচে ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করা হলো-
- হুন্ডি ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ: প্রবাসী প্রথমে স্থানীয় একজন হুন্ডি ব্যবসায়ী বা “হাওলাদার”-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এই ব্যবসায়ী সাধারণত একটি বিশ্বস্ত নেটওয়ার্কের অংশ হয়ে থাকেন।
- টাকা জমা দেওয়া: প্রবাসী হুন্ডি ব্যবসায়ীকে সৌদি রিয়ালে টাকা দেন। ধরা যাক, তিনি ৪,০০০ রিয়াল দিলেন, যা বাংলাদেশি টাকায় ১ লাখ টাকার সমান।
- নির্দেশনা প্রদান: প্রবাসী ব্যবসায়ীকে বলেন যে, এই টাকা বাংলাদেশে তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। তিনি পরিবারের সদস্যের নাম, ঠিকানা, এবং ফোন নম্বর দেন।
- দেশে টাকা পৌঁছানো: হুন্ডি ব্যবসায়ী বাংলাদেশে তার এজেন্ট বা প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এজেন্ট প্রবাসীর পরিবারের কাছে ১ লাখ টাকা হাতে হাতে পৌঁছে দেন।
- লেনদেন সমন্বয়: হুন্ডি ব্যবসায়ী এবং তার এজেন্ট পরে তাদের নিজেদের মধ্যে ঋণ বা পুঁজির সমন্বয় করে নেন। এটি হতে পারে অন্য কোনো লেনদেনের মাধ্যমে বা নগদে।
এই প্রক্রিয়ায় কোনো আনুষ্ঠানিক কাগজপত্র বা ব্যাংকিং চ্যানেল জড়িত থাকে না। সবকিছুই আস্থা এবং মৌখিক চুক্তির ওপর ভিত্তি করে হয়। তবে এই পদ্ধতির একটি বড় ঝুঁকি হলো—যদি ব্যবসায়ী টাকা আত্মসাৎ করে, তাহলে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না, কারণ এটি অবৈধ।
(৫) হুন্ডি ব্যবসা কী?
হুন্ডি ব্যবসা হলো এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে প্রবাসীদের অর্থ এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তর করে। এটি একটি সমান্তরাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে পরিচালিত হয়।
হুন্ডি ব্যবসায়ীরা সাধারণত একটি বিশাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করে, যেখানে বিভিন্ন দেশে তাদের এজেন্ট বা প্রতিনিধি থাকে।
হুন্ডি ব্যবসার মূল আকর্ষণ হলো এর গতি, কম খরচ, এবং সহজলভ্যতা। ব্যাংকের তুলনায় হুন্ডিতে টাকা পাঠানো অনেক দ্রুত এবং সস্তা। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংকে টাকা পাঠাতে ফি, ট্যাক্স, এবং কাগজপত্রের ঝামেলা থাকে, যেখানে হুন্ডিতে এসব কিছুই লাগে না। এছাড়া, খোলা বাজারে ডলারের দাম বেশি পাওয়া যায়, যা প্রবাসীদের জন্য লাভজনক।
তবে হুন্ডি ব্যবসার একটি অন্ধকার দিকও রয়েছে। এটি প্রায়ই অর্থ পাচার, চোরাচালান, এবং দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৪৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যার একটি বড় অংশ হুন্ডির মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে।
(৬) হুন্ডি কি বৈধ?

হুন্ডির বৈধতা নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। অতীতে, হুন্ডি একটি বৈধ এবং নিরাপদ ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হতো। মুঘল আমলে এবং ব্রিটিশ শাসনের প্রথম দিকে এটি ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। কিন্তু আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রচলনের পর থেকে হুন্ডি বেআইনি হিসেবে গণ্য হতে শুরু করে।
বর্তমানে, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশে হুন্ডি অবৈধ। বাংলাদেশে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ অনুযায়ী, হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ লেনদেন একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর কারণ হলো-
- রাষ্ট্রীয় ক্ষতি: হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠালে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে যোগ হয় না, ফলে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- অর্থ পাচার: হুন্ডি প্রায়ই অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচারের জন্য ব্যবহৃত হয়।
- ট্যাক্স ফাঁকি: এটি সরকারি রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করে।
তবে কিছু দেশে, যেখানে ব্যাংকিং সুবিধা সীমিত বা নেই, সেখানে জরুরি পরিস্থিতিতে হুন্ডি ব্যবহারের অনুমতি থাকতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে ব্যাংকিং ব্যবস্থা উন্নত, সেখানে এটি সম্পূর্ণ অবৈধ।
(৭) হুন্ডি ব্যবসা কি হালাল?

হুন্ডি ব্যবসা হালাল কি না, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, বিশেষ করে মুসলিম প্রবাসীদের জন্য। ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি বিশ্লেষণ করা যাক।
ক) শরিয়তের দৃষ্টিকোণ
ইসলামে মুদ্রা বিনিময় বা অর্থ লেনদেন জায়েজ, যদি তা সৎ উদ্দেশ্যে এবং নির্দিষ্ট শর্ত মেনে করা হয়। হুন্ডি মূলত একটি মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা। তাই কিছু আলেম মনে করেন, এটি নিজে থেকে হারাম নয়। তবে এর বৈধতা নির্ভর করে কয়েকটি শর্তের ওপর।
শর্তগুলো হলো-
- চুক্তির স্বচ্ছতা: লেনদেনের সময় কমপক্ষে এক পক্ষকে মুদ্রা হস্তান্তর করতে হবে। যদি দুই পক্ষই মুদ্রা হাতে না নেয়, তবে তা জায়েজ হবে না।
- আইন মানা: রাষ্ট্রীয় আইন যদি শরিয়তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়, তবে তা মানা ওয়াজিব। বাংলাদেশে হুন্ডি অবৈধ, তাই এটি করা রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণার শামিল।
- অবৈধ কাজে ব্যবহার: যদি হুন্ডি অর্থ পাচার বা চোরাচালানের জন্য ব্যবহৃত হয়, তবে তা হারাম।
খ) হাদিসের আলোকে
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
“যে ধোঁকা দেয়, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।”
(সহিহ মুসলিম, হা/১০১)
হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠালে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়, যা প্রতারণার শামিল। আবার সূরা মায়িদার ২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, “পাপ ও সীমালঙ্ঘনে একে অপরের সাহায্য করো না।” হুন্ডি যদি অবৈধ কাজে ব্যবহৃত হয়, তবে তা নিষিদ্ধ।
গ) ব্যতিক্রম
কিছু আলেম বলেন, যদি কোনো দেশে ব্যাংকিং সুবিধা না থাকে বা জরুরি পরিস্থিতিতে হুন্ডি ছাড়া উপায় না থাকে, তবে তা জায়েজ হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে ব্যাংকিং ব্যবস্থা সহজলভ্য, সেখানে হুন্ডি করা শরিয়তের দৃষ্টিতে অনুমোদিত নয়।
(৮) হুন্ডির ইতিহাস
হুন্ডি শব্দটি সংস্কৃত শব্দ “হুন্ড” থেকে এসেছে, যার অর্থ “সংগ্রহ করা”। এটি একটি প্রাচীন আর্থিক ব্যবস্থা, যা ব্যাংকিং চ্যানেলের আগে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অর্থ স্থানান্তরের জন্য ব্যবহৃত হতো।
হুন্ডি হলো একটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনানুষ্ঠানিক অর্থ লেনদেনের ব্যবস্থা, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো, যেমন ভারত, পাকিস্তান, এবং বাংলাদেশে কয়েক শতাব্দী ধরে প্রচলিত। এটি মূলত একটি লিখিত বা শর্তহীন আদেশ, যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি অন্য একজনকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধের নির্দেশ দেয়।
অতীতে, যখন নগদ অর্থ বা মূল্যবান সম্পদ পরিবহন করা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, তখন হুন্ডি একটি নিরাপদ বিকল্প হিসেবে কাজ করতো। উদাহরণস্বরূপ, অষ্টম শতাব্দীতে সিল্ক রুটে ব্যবসা-বাণিজ্যের সময় ডাকাতির ভয়ে ব্যবসায়ীরা হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করতেন। মুঘল আমলেও হুন্ডি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল, যেমন বাংলা থেকে দিল্লিতে ভূমি রাজস্ব পাঠানোর জন্য। তৎকালীন সময়ে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের “সররাফ” বলা হতো, এবং তারা ছিলেন অত্যন্ত বিশ্বস্ত।
বর্তমানে, হুন্ডি প্রবাসীদের মধ্যে টাকা পাঠানোর একটি জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে একটি সমান্তরাল ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে, যেখানে পারস্পরিক আস্থা এবং প্রবাসীদের নেটওয়ার্ক এর মূল ভিত্তি।
(৯) প্রবাসীরা কেন ব্যাংকে না পাঠয়ে হুন্ডিতে টাকা পাঠান?
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলের বদলে হুন্ডি ব্যবহারের প্রতি বেশি ঝুঁকছেন। এর পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে-
- উচ্চ বিনিময় হার: হুন্ডিতে ডলারের দাম ব্যাংকের চেয়ে বেশি পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংকে ১ ডলারে ১১০ টাকা পেলেও হুন্ডিতে ১১৫-১২০ টাকা পাওয়া যায়।
- সরকারের প্রতি অনাস্থা: সাম্প্রতিক আপষ্ট-২৪ এর গণঅভ্যুত্থান এবং সরকারি নীতির ত্রুটির কারণে প্রবাসীরা হুন্ডিকে সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছেন।
- দ্রুততা ও সহজলভ্যতা: হুন্ডিতে কাগজপত্রের ঝামেলা নেই, এবং টাকা দ্রুত পৌঁছে যায়।
- বিধিনিষেধ: ব্যাংকে এলসি খুলতে বা বৈদেশিক মুদ্রা কিনতে বিধিনিষেধ থাকায় অনেকে হুন্ডির দিকে ঝুঁকছেন।
(১০) হুন্ডির প্রভাব
হুন্ডির অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব বিশাল। একদিকে এটি প্রবাসীদের জন্য সুবিধাজনক, অন্যদিকে এটি দেশের জন্য ক্ষতিকর।
ক) ইতিবাচক দিক
- দ্রুত ও কম খরচে টাকা পাঠানো যায়।
- প্রত্যন্ত এলাকায়ও টাকা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।
খ) নেতিবাচক দিক
- অর্থনৈতিক ক্ষতি: বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমে যায়, যা মূদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ হয়।
- অর্থ পাচার: দুর্নীতিবাজরা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করে।
- অপরাধ: চোরাচালান, মাদক ব্যবসা, এবং সন্ত্রাসবাদের অর্থায়নের জন্য হুন্ডি ব্যবহৃত হয়।
(১১) হুন্ডি বন্ধে করণীয়
হুন্ডি বন্ধ করতে সরকার ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। কিছু সমাধান হতে পারে-
- ব্যাংকিং সুবিধা বাড়ানো: ব্যাংকে ডলারের বিনিময় হার বাজারের কাছাকাছি রাখা এবং লেনদেন সহজ করা।
- সচেতনতা: জনগণকে হুন্ডির ক্ষতি সম্পর্কে সচেতন করা।
- কঠোর আইন: হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।
(১২) উপসংহার
প্রিয় বন্ধু, আশা করি উপরোক্ত অালোচনার মাধ্যমে হুন্ডি কি (hundi ki), হুন্ডি কাকে বলে, হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো হয় কীভাবে, হুন্ডি ব্যবসা কী, হুন্ডি কি বৈধ, হুন্ডি ব্যবসা কি হালাল নাকি হারাম; প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে আপনার সকল প্রশ্নে উত্তর পেয়ে গেছেন।
হুন্ডি একটি প্রাচীন ও জনপ্রিয় অর্থ লেনদেনের ব্যবস্থা হলেও আধুনিক যুগে এটি বেআইনি এবং অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। হুন্ডি কি, কীভাবে কাজ করে, এবং এর বৈধতা ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ—এই সবকিছু বিবেচনা করে আমাদের বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠানো উচিত। হুন্ডি ব্যবসা হালাল কি না, তা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে, তবে বাংলাদেশের মতো দেশে এটি এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।
আপনার যদি হুন্ডি সম্পর্কে আরো প্রশ্ন থাকে, তাহলে কমেন্টে জানান। এই পোস্টটি শেয়ার করে অন্যদেরও জানার সুযোগ করে দিন।
ডিসক্লেমার: এই ব্লগ পোস্টটি শুধুমাত্র তথ্য ও শিক্ষার উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে। এটি কোনো আইনি বা ধর্মীয় পরামর্শ নয়। হুন্ডি বা অর্থ লেনদেন সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
অর্থ ও ইনকাম এর সাথে সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট ইনকাম’ (inbangla.net/income) এর সাথেই থাকুন।
অনুরোধ!! পোষ্ট ভালো লাগলে প্লিজ উপরের শেয়ার আইকনে ক্লিক করে পোষ্টটি শেয়ার করে দিন।