নিম্নে ছাত্রজীবনে বিশ্বাস ও ধর্য্যের প্রভাব সম্পর্কে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে নসিহতমূলক কিছু কথা তুলে ধরার চেষ্টা হলো-
তুমি যে কাজই কর, প্রথম বারেই কৃতকার্য হবে তা নয়। চেষ্টার দ্বারা ব্যর্থতা জয় করতে হবে। চেষ্টা কর, বারে বারে আঘাত কর; তোমার চেষ্টা ফলবতী হবে। শিক্ষাগ্রহণ করা একধরনের কঠিন সাধনা। একধরনের সহিষ্কুতা। ছাত্রজীবন হচ্ছে সত্যিকারের পরিশ্রমের জীবন।
কে কবে ভাগ্যবলে বড় হয়েছে? সাধনা ও পরিশ্রম ব্যতীত কে অর্থ ও সম্মান লাভ করেছে?বড় মানুষ যারা, তাদেরও গৌরব-সম্মানের মূলে অনেক বছরের ধৈর্য ও সাধনা আছে। যে সমস্ত মানুষ ব্যর্থতাকে ভয় করে না-জয়ী হবে, এ বিশ্বাসে যারা কাজ করে তারাই জয়ী হয়।
অনেক খারাপ ছাত্রও পরবর্তী জীবনে শুধু নিজের প্রতিভার বলে অসাধারণ সব উন্নতিমূলক কাজ করতে পারে। |
কিন্তু শিক্ষাযুক্ত বহু বছরের সহিষ্ণু সাধনার খাছে প্রতিভার কোন মূল্য নাই। সুতরাং তোমাকে শিক্ষার্জন করতে হবে। এটাই তোমার কর্তব্য। ধীর শান্ত হয়ে তুমি তোমার কর্তব্য করে যাও, একদিন দেখতে অনেক বড়ো বড়ো প্রতিভা তোমাকে দেখে সক্কোচ বোধ করবে।
জগতে বহু বড় মানুষ জন্মেছেন। তাঁদের মধ্যে প্রতিভাবান অপেক্ষা পরিশ্রমী মানুষ অধিক।
এক লেখক বলেছেন-প্রতিভার অর্থ ধৈর্য ও পরিশ্রম।
নিউটন বলেছেন- আমার আবিষ্কারের কারণ আমার প্রতিভা নয়। বহু বছরের পরিশ্রম ও নিরবচ্ছিত্র চিন্তার ফলেই আমি আমাকে সার্থক করেছি, যা যখন আমার মনের সামনে এসেছে, শুধু তারই মীমাংসায় আমি ব্যস্ত থাকতাম। অস্পষ্টতা হতে ধীরে ধীরে স্পষ্টতার মধ্যে উপস্থিত হয়েছি।
ডাক্তার বেনটলেকে তিনি একবার বলেছিলেন- মানব সাধারণের যদি কোন কল্যাণ আমার ছারা হয়ে থাকে, তবে তা আমাদের অনেক বছরের সহিষ্ণু সাধনার দ্বারা হয়েছে।
ভলটেয়ার বলেছেন- প্রতিভা বলে কোন জিনিস নাই। পরিশ্রম কর, সাধনা কর, প্রতিভাকে গ্রাহ্য করতে পারবে।
ডালটনকে লোকে প্রতিভাবান বলতো। তিনি অস্বীকার করে বলতেন- পরিশ্রম ছাড়া আমি কিছু জানি না। পরিশ্রম, পর্যবেক্ষণ ও সহিষ্ণু সাধনার সম্মুখে কিছু অসম্ভব নয়।
জগৎ ও সমাজ যারা গড়ে তুলেছেন, তারা যে-সব প্রতিভাবান অসাধারন বিশিষ্ট ক্ষমতায় ভাগ্যবান ছিলেন তা নয়। তাঁরা ছিলেন পরিশ্রমী, সহিষ্ণ্ এবং সাধক। প্রতিভাকেও যদি সাধনা বা পরিশ্রম দ্বারা উজ্ত্বল করে না তোলা যায়, তবে তার আদর হয় না। জগতের কল্যাণে তা আর বড় আসে না।
স্যার রাবাট পিল যখন বালক, তখন তার বাপ তাকে একখানা ছোট টেবিলের উপর তুলে দিয়ে বক্তৃতা দিতে বলতেন। প্রথম প্রথম কিছু হতো না, কিন্তু বার বারে চেষ্টা করার ফলে বালকেরশক্তি জেগে উঠল। শেষ বয়সে তিনি বলতেন, তার অসাধারণ বাগ্মিতা ও তর্ক করবার ক্ষমতা সেই ছেলে বয়সের সাধনার মধ্যেই ছিল।
ধীর হয়ে লেগে থাক, তোমাকে দুঃখ করতে হবে না। ধীরভাবে লেগে থাকাই হচ্ছে কৃতকার্য হবার পথ। হাল কখনও ছেড়ো না। তরী জেগে উঠবে।
ভাল রকম কাজ করতে হলে তোমাকে অসহিষ্ণু হলে চলবে না। সে যে কাজই হোক না কেন।
এক বাদককে এক যুবক জিজ্ঞেস করেছিল- বাজনা শিখতে আমার কত দিন লাগবে? তিনি বলেছিলেন-প্রত্যহ ১২ ঘন্টা করে যদি পরিশ্রম কর, তাহলে বিশ বছর লাগবে।
এক পভিত বললেন- যে ব্যক্তি ধীরভাবে অপেক্ষা করে, সে-ই সফল হতে পারে। বস্তুত কত কাল অপেক্ষা করতে হবে, তা কে জানে? আশায় বুক বেঁধে খোদাকে ভরসা করে কাজ করতে থাক, তুমি সফল হবে। সাধনাকে আনন্দ দিয়ে পূর্ণ করে তোল। কবে তুমি কৃতকার্য হবে, সে কথা ভেবো না- তাহলে সাধনায় ক্লান্তি আসবে। ব্যর্থতা তোমাকে ভেঙ্গে দেবে। আনন্দ ভরা সাধনা, নিয়ত ফল সম্বন্ধে উদাসীন তোমার মন, ধীরে ধীরে অজ্ঞাতসারে তোমার গন্তব্যস্থানে নিয়ে যাবে। শুভ প্রভাতে দেখতে পাবে, তোমার মাথা বিজয় মুকুট শোভিত হয়েছে। তুমি নিজেই জয়ে বিশ্মিত হবে।
আশাশুন্য ও নিরানন্দ মনে কোন কাজ করো না।
পাদরী উইলিয়াম ক্যারি যেমন উদ্যমশীল কর্মী পুরুষ ছিলেন, তেমনি তিনি তাঁর কর্ম সম্বন্ধে আশা ও বিশ্বাস পোষণ কৃরতেন। ভারতের বিখ্যাত শ্রীরামপুর কলেজ তারই চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
এক সময় এই বরেণ্য পুরুষকে এক ব্যক্তি মুচির ছেলে বলে উপহাস করেছিল। ক্যারি কিছুমাত্র লজ্জিত না হয়ে উত্তর করলেন-এতে আমার একটুও লজ্জা নাই। ছোটকালে একবার তিনি এক গাছে উঠতে যেয়ে পা ফসকে পড়ে যান। ফলে পা ভেঙ্গে গিয়েছিল। কয়েক মাস পরে বিছানা থেকে উঠে পুনরায় সেই এই গাছে উঠলেন, তবে ছাড়লেন। এইখানেই মহাপুরুষদের জীবনের বিশেষত্ব।
দার্শনিক ইয়ং বলতেন, মানুষ যা করেছে, মানুষ তা পারবে।
এর সম্বন্ধে একটা মজার গল্প আছে। একবার তিনি (দার্শনিক ইয়ং) এক বন্ধুর সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলেন। এর আগে তিনি কখনো ঘোড়ায় চড়েন নি, সেইবার প্রথম। বন্ধু খুব ভাল ঘোড়সোয়ার, তিনি অবাধে একটি উচু বেড়া পার হয়ে গেলেন। ইয়ং এরও ইচ্ছা হলো, বেড়া টপকে যান। যে কোন কালে ঘোড়ায় চড়েনি তার পক্ষে কাজটা সহজ নয়। লাফ দিতে গিয়ে ঘোড়া হতে পড়ে গেলেন ক্ষুণ্ন না হয়ে দ্বিতীয়বার চেষ্টা করলেন। এবারে ঘোড়া থেকে পড়লেন না ঠিক, কিন্তু ঘোড়ার গলা জড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। আবার চেষ্টা। এবার কৃতকার্য হলেন।
বিশ বছর পরিশ্রম করে নিউটন একখানি বই লেখেন। তাঁর প্রিয় কুকুর একটি জ্বলন্ত বাতি ফেলে এই বইখানি মুহুর্তের মধ্যে ছাই করে দিয়েছিল। বিশ বছর পরিশ্রমজাত-চিন্তা হঠাৎ সর্বনাশ হয়ে গেল। নিউটনের খুব দুঃখ হয়েছিল। কিন্তু কি আশ্চর্য সহিষ্ণুতা। তিনি দমলেন না। আবার সেই বই লেখা আরব করলেন এবং শেষ করলেন।
কারলাইল ফরাসী বিপ্রবের ইতিহাস লিখে এক প্রতিবেশী সাহিত্যিককে পড়তে দেন। বন্ধু মহোদয় বইখানি ভুলবশতঃ বাইরেই ফেলে রাখেন। ফলে বইখানি হারিয়ে গেল। অনুসন্ধানে জানা গেল বাড়ীর চাকরাণী বাজে কাগজ মনে করে মূল্যবান গ্রন্থখানি পুড়িয়ে ফেলেছে।
কারলাইল যখন এই ভয়ানক সংবাদ শুনলেন, তখন তাঁর মানসিক অবস্থাটা অনুমানসাপেক্ষ ৷
এই পুস্তক নতুন করে লিখতে কারলাইলকে কত কষ্ট পেতে হয়েছিল, তা বলা যায় না। না লিখে উপায় ছিল না। কঠিন অধ্যবসায়, ধীরতা এবং মনের বলে তিনি আবার সেই বই লিখলেন। কারলাইলের এই ধীরতা ও মনের বল যারপর নাই বিন্ময়াবহ।
জর্জ স্টিফেনশন তাঁর ছেলেদের বলতেন- তোমাদেরকে কি বলবো! আমাকে অনুসরণ করো; আঘাতের পর আঘাত করো।
ওয়াট ত্রিশ বছর ধরে পরিশ্রম করে জগৎকে খণী করে গিয়েছেন। দীর্ঘ ত্রিশ বছরের সাধনা-কম নয়।
কমতি-দি-বাফুন দেখিয়েছেন ধীরভাবে পরিশ্রম করলে আমরা কত বড় হতে পারি। তিনি বলতেন- প্রতিভা মানে ধৈর্য ও পরিশ্রম।
বাফুনের স্মরণশক্তি ছিল না, কিন্তু সাংসারিক অবস্থা ছিল খুব ভাল। ফলে, স্বভাবে কুড়েমি ঢুকেছিল। অনেক চিন্তা করেও তিনি এই রোগ হতে অব্যাহতি না পেয়ে শেষকালে উপায়ান্তর না দেখে ভূত্য যোসেফকে বলেন- কাল হতে সকাল সকাল তুমি আমায়- উঠিয়ে দেবে। প্রত্যেক দিনের জন্য পুরস্কার এক টাকা। পরদিন বেচারা যোসেফ প্রভুকে উঠাতে গিয়ে কিল-ঘুষি খেয়ে ফিরে এল।
বাফুন যখন দুপুর বেলা যোসেফকে তার কর্তব্য কাজের অবহেলার জন্য খুব তিরক্কার করলেন তখন মনে মনে পণ করলো, পরের দিন প্রভুকে যেমন করেই হোক উঠাবে।
সকাল বেলা বিছানার কাছে যেয়ে যোসেফ আগের দিনের মত প্রভুকে উঠাতে চেষ্টা করলো, ঘুমের ঘোরে প্রভু ভৃত্যকে গালি দিলেন। বললেন-আমার অসুখ হয়েছে-রাত্রিতে ভাল ঘুম হয় নি-যাও বিরক্ত করো না। প্রভুর কথা অমান্য করলে চাকরি থাকবে না-ইত্যাদি। যোসেফ ফিরে গেল।
বাফুন আবার যোসেফকে তার আসল হুকুম পালন করা হয় নাই বলে তিরস্কার করলেন। পরদিন প্রভুকে উঠাতে যেতে যোসেফ কোন কথাই শুনলো না। প্রভু কিছুতেই ঘুম থেকে উঠবেন না।-যোসেফও নাছোড়বান্দা। বালতি ভরা ঠাভা পানি প্রভুর বিছানার উপর সে যখন ঢেলে দিল তখন বাফুনকে বাধ্য হয়ে আরাম ছেড়ে উঠতে হলো। সেদিন ভৃত্য যোসেফ পুরস্কার লাভ করলো।
প্রত্যহ নয় ঘণ্টা করে চন্রিশ বছর ধরে বাফুন পরিশ্রম করেন। একদিনও তিনি নষ্ট করেন নি। দীর্ঘ চল্লিশ বছর জ্ঞানার্জন করেন। পরিশ্রম না করে তিনি থাকতে পারতেন না। সেটা তার অভ্যাস হয়েছিল। তাঁর জীবনচরিত রচয়িতা লিখেছেন-খেলার চেয়ে কাজই তার কাছে বেশি আমোদের ছিল। অনবরত পড়তে তাঁর কোন কষ্ট হতো না।
এক একখানা বই তিনি বহুবার করে বদলিয়েছেন-লিখেছেন। পুস্তক প্রণয়নে কোন সাহিত্যিক বোধ হয় বাফুনের মত পারেন নাই।
পঞ্চাশ বছর ভেবে তিনি একখানি বই লেখেন; আশ্চর্য! এতেও তিনি সত্তৃষ্ হতে পারেন নাই। একবার, দুবার, এমনি এগার বার তিনি সেই বইখানা লিখেন।
বাফুনের মত ধৈর্য আর কারো ছিল না।
পীড়ার মধ্যে থেকেও তিনি বড় বড় বই লিখেছেন। কাজে থাকাই ছিল তাঁর আনন্দ ও শান্তি।
স্যার ওয়াল্টার স্কট পরিশ্রমী ছিলেন। অফিসের কাজের সঙ্গে সঙ্গে তিনি জ্ঞানালোচনা ও সাহিত্যসেবা করতেন। অফিসের কাজ কম নয়-তার উপর সাহিত্যসেবার কঠিন পরিশ্রম ৷
ভোর পাঁচটার সময় উঠে নিজেই চুলো ধরাতেন, একটু খেয়ে বই-এর বোঝা সামনে নিয়ে সাহিত্যসেবায় বসে যেতেন।
বহু বছরের পরিশ্রম ও গভীর জ্ঞানার্জন সত্তেও স্কট বলতেন-আমি আমার অজ্ঞতার কথা মনে করে লজ্জিত না হয়ে পারি না।
ট্রিনিটি কলেজের অধ্যাপকের কাছে যেয়ে এক ছাত্র বি. এ. উপাধি লাভ করে বলল-স্যার, আমার লেখাপড়া তো শেষ হয়েছে। কতকাল পরিশ্রম করবো-বাড়ী গিয়ে এখন আরাম করি।
অধ্যাপক বিস্মিত হয়ে উত্তর দিলেন, তোমার জ্ঞানার্জন শেষ হয়েছে! আমি কিন্তু মাত্র আর করেছি!
যারা কিছু জানে না তাদের কাজ শেষ হয়ে যায়।
মহাপপ্তিত নিউটন জীবন শেষে বলেছিলেন- জ্ঞানসমুদ্রের বেলাভুমিতে দাঁড়িয়ে কেবল ধূলোবালি নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি- অনন্ত সমুদ্রের কিছুই দেখা হয় নি।
জন ব্রিটন- তার কাকা, দোকান হতে একেবারে অসহায় করে তাড়িয়ে দেন। বিটন যখন ছোট তখন তার বাপ পাগল হয়ে যান। বাপ ছিলেন কুটিওয়ালা।
বিটন তার হোটেলওয়ালা কাকার কাছে থাকত এবং কাজ-কাম করে কিছু কিছু পয়সা উপায় করতো।
হঠাৎ তার অসুখ হয়ে পড়লো। এমন অসুখ যে, তাতে তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেল, কাজ করার সামর্থ রইল না। নিষ্ঠুর কাকা এ ক্ষতি সহ্য করতে পারলেন না। ভাইপোর হাতে গোটা দশেক টাকা ফেলে দিয়ে বললেন- এখানে আর তোমার থাকার দরকার নাই।
এরপর সাত বছরের বালক বিটনের কষ্টের অবধি ছিল না। কিন্তু কোন দিন সে পড়া ত্যাগ করে নাই। সকল অবস্থায় সে একটু-একটু করে জ্ঞানার্জন করতো। নিজের উপার্জনে সে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। কখনও হতাশ হয়ে বসে ছিল না। জ্ঞান এবং শক্তি যার মাঝে আছে, সে যতবারই অকৃতকার্য হোক।
যদি প্রবল আত্মবিশ্বাস এবং সাধনা থাকে, একদিন না একদিন সে উচ্চাসন লাভ করবেই। এটা প্রাকৃতিক চিরন্তন নিয়ম।
ব্রিটনের জীবনী পড়ে জানি, কত কষ্টের তার জীবন। যে ঘরে সে বাস করতো, সে ঘরটি ছিল ভেঙে পড়ার উপক্রম। পায়ে কত সময় জুতো জুটতো না। দারুণ শীতে কত সময় গা খালি থাকতো। কত সময় পকেটে পয়সা থাকতো না। হাতে পয়সা নাই-না পড়লেও চলে না। খানিকক্ষণের জন্য হলেও পরের বই নিয়ে বিটন তার ব্যথ মনের জ্ঞান-তৃষ্তা নিবারণ করতো।
যখন তাঁর বয়স আটাশ, তখন প্রথম তিনি গ্রন্থকাররূপৈ প্রকাশ হন। এরপর পঞ্চাশ বছর ধরে তিনি সাহিত্যসেবা করেন। জন বিটন মোট সাতাশিখানা বই লেখেন। কোন বাধা তার জীবনকে ব্যর্থ করে দিতে পারে নাই। জীবনের মালিক তুমি-দুঃখ-বেদনা ও অভাবকে বাধা না মনে করে সেগুলিকে বরং আশীর্বাদরূপে ধরে নাও। কিছুই তোমার গতিকে রোধ করতে পারবে না। যেমন করে হোক, তুমি বড় হবেই। বুক ভেঙ্গে গেছে-ভয় নাই। ভাঙ্গা বুক নিয়ে খোদা ভরসা করে দাঁড়াও।
এডিনবার্গ শহরের কাছে লাউডেন নামে এক বালক ছিল। তার বাপ ছিলেন একজন কৃষক। বাপ ইচ্ছে করলেন ছেলেকে বাগানের কাজ শিখাবেন। এই কাজে লাউডেনকে দিনের বেলা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতো হতো। এই খাটুনির মধ্যেও বালক লাউডেন সপ্তাহে দুই দিন সারা রাত জেগে পাঠাভ্যাস করতো।
লাউডেনের মনের দৃঢ় বাসনা ছিল, সঠিক শিক্ষার্জনের মাধ্যমে জীবনকে উন্নত ও গৌরবময় করে সেই জ্ঞানকে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানো।
একজন সামান্য বালকের মনে এই উন্নত কল্পনা কত সুন্দর! অল্পকালের মধ্যে লাউডেন ফরাসী ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করলো। ফরাসী ভাষা শেখা হলে সে জামান ভাষা শেখায় আগ্রহাবিত হলো। জার্মান ভাষাও অল্পকালের মধ্যে তার আয়ত্ব হয়ে গেল।
স্যামুয়েল এবং জেবেজ বলে আরও দুটি বালক ছিল। তাদের বাপ ছিলেন একজন কুলি। দরিদ্র পিতা দু’ভাইকে এক পাঠশালায় পাঠালেন। জেবেজের বেশ স্মরণশক্তি ছিল কিন্তু স্যামুয়েল ছিলেন যেমন দুষ্ট তেমনি বোকা। লেখাপড়ায় সুবিধা হল না বলে কিছুদিন পরে বাপ তাকে কাজ শেখাবার জন্য এক জুতোর মিন্ত্রীর কাছে দিলেন। সেখানে কাজের চাপে চোখে তার সরষে ফুল ফুটতে লাগল।
বদমাইশী, আম চুরি এসব কাজে স্যামুয়েলের খুব উৎসাহ ছিল। একবার এক দুষ্টামি করতে গিয়ে তাকে সমুদ্বের মাঝে নৌকা ডুবে প্রাণ হারাতে হয়েছিল আর কি! তুমি শুনে বিশ্মিত হবে-দুই মাইল সাঁতরিয়ে কূলে উঠে সে প্রাণ বাঁচায়। এই ঘটনার পর থেকে দুর্দান্ত স্যামুয়েলের স্বভাব বদলে গেল। এই চোর, এই বদমাইশ, এই মাথা গরম যুবক যে একদিন তার বিদ্যা ও বুদ্ধির দ্বারা জগৎকে চমতকৃত করবে একথা তখন কে ভেবেছিল?
তার মনের এই দুর্দমনীয় উগ্রতা ভাল হবার দিকে ফিরে গেল। জীবনের এই দুর্ঘটনার পর হতে তার স্বভাবে একটা আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা গেল। সে চাপল্য, সে হঠকারিতা আর রইল না।
সে সময় হতে স্যামুয়েল জ্ঞানানুশীলনের দিকে মন দিলেন। যতই পড়তে লাগলেন, ততই নিজের অজ্ঞতা ও মূর্খতা বুঝে লজ্জিত হতে লাগলেন। মনের এই অন্ধকার দূর করার জন্য ভিতরে এক দুর্দম বাসনা জেগে উঠল।
এরূপ জীবিকা অর্জনে যে সময় ব্যয় হতো তা ছাড়া বাকী সময় তিনি লেখা-পড়া করতে লাগলেন। এক মিনিটও তিনি বৃথা সময় নষ্ট হতে দিতেন না। কাজের ভিড়ে পড়বার সময় যখন খেতেন তখন সামনে একখানা বই রেখে স্যামুয়েল ভাত খেতেন।
বিশেষ একখানা বই পড়ে তার মন আরও উন্নত হয়ে গেল-নির্মল চরিত্র ও আধ্যাত্মিক ভাবাপন্ন হয়ে পড়লেন।
কিছুদিন পরে তিনি স্বাধীনভাবে ব্যবসা আরন্ত করলেন। ধার হবে এই ভয়ে অনেক সময়ে রাতের বেলা না খেয়ে শুয়ে থাকতেন।
ব্যবসা, সাহিত্যসেবা ও জ্ঞানালোচনা করে যে সময় বাঁচত, সে সময় তিনি জনসাধারণের সমুখে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতেন।
শেষ বয়সে স্যামুয়েল বলতেন- নিতান্ত জঘন্য অবস্থা হতে আমি নিজেকে টেনে তুলেছি। আমার এই সাধনার সঙ্গী ছিল পরিশ্রম, চরিত্র এবং মিতব্যয়িতা। আর সেই সাথে শিক্ষার্জনের প্রতি অদম্য স্পৃহা।
মানুষ মৃত্যুর পর তার কোন সঞ্চয়ই নিয়ে যেতে পারে না একমাত্র সুনাম ছাড়া। তাও বহুলোক সারাজীবনে যত সুনাম অর্জন করেছেন, মৃত্যুকে সেটাও দান করে যান।