নিম্নে ছাত্রজীবনে পরিশ্রম, ধৈর্য, অধ্যবসায়, ঈর্ষার, আসক্তি ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ছাত্রদের জন্য মোটিভেশনাল কথা তুলে ধরা হলো-
(১) ছাত্রদের জন্য মোটিভেশনাল কথাঃ ছাত্রজীবনে পরিশ্রম, ধৈর্য, অধ্যবসায় ও ঈর্ষার ফলাফল
ছাত্রজীবনে অধ্যাবসায়ের গুরুত্ব অনেক।
ধৈর্য ধরে কঠিন অধ্যাবসায় করলে যে কোন খারাপ ছাত্রই কালক্রমে পরিণত হতে পারে আকাংক্ষিত ভাল ছাত্র হিসেবে।
ছাত্রজীবনে সবার আগে অর্জন করতে হবে পবিত্রতা, ধৈর্য ও অধ্যাবসায়।
পবিত্রতার অর্থ সব রকমের মলিনতা থেকে মুক্তি। চঞ্চলতা ঈর্ষা, আলস্য ও তীব্র আসক্তি দূর করলে তবেই মন পবিত্র হয়। চঞ্চলতা মানে একাগ্রতার অভাব। ফালুক ফুলুক করা। কোন কিছুই সিরিয়াস ভাবে না নেওয়া এগুলো চঞ্চলতার লক্ষণ।
ঈর্ষার কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমরা সবাই কম বেশী ঈর্ষাপরায়ণ এবং কম বেশী অন্যের ঈর্ষার শিকার। ঈর্ষা থেকেই আত্মবিশ্বাসের অভাব ঘটে। ও কয়েকটি পরীক্ষায় লেটার পেয়েছে, কারণ ওর বাবার টাকা আছে। গাদা গাদা প্রাইভেট টিউটর রেখেছে- কোচিং করেছে। সুতরাং পরীক্ষায় সে ভাল করতেই পারে- এই ধরনের চিন্তাই ঈর্ষা। আর এক কথা যত আমি ভাবব ততই আমার কাজেকর্মে উৎসাহ কমতে থাকবে।
কারণ ঈর্ষাপরায়ণ হওয়া মানেই নিজেই আগে ভাগ্যে পরাজয় স্বীকার করে নেওয়া।
ঈর্ষাকে জয় করতে গেলে সমস্ত মনোযোগ অন্যের দিকে না দিয়ে নিজের দিকে দিতে হবে।
আমরা ইংরেজদের ঈর্ষা করি। ওরা শোষণকারী সাম্রাজ্যবাদী কতকিছু বলে ওদেরকে গালি দিই। আবার ঈর্ষাকাতর হয়ে ওদের মত হবার জন্য ওদের সাজপোশাক, সমাজ ব্যবস্থার নকল করি। ভাবি অনুকরণ করে সাহেব হলেই ওদের সমকক্ষ হবো। কিন্তু ওদের চরিত্রের নানা ইতিবাচক দিকগুলি কখনও গ্রহণ করার চেষ্টা করিনা।
তোমাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছে যারা ভাল ছাত্র বা ছাত্রীদের প্রতি গভীর বিদ্বেষপূর্ণ ঈর্ষা পোষণ করে। ভাবে, একমাত্র বড়োলোকের সন্তান বলেই তারা এত ভাল ফলাফল অর্জন করতে পেরেছে।
কিন্তু বাস্তবে সবাই তাই নয়।
এমনও দেখা গেছে তোমাদের মধ্যেই এমন সফল ছাত্র আছে যারা নিজের পরিবারের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজেদের পরিশ্রমে, উদযোগে ভাল ছাত্র হবার সাধনা করে চলেছে।
এমন অনেক ছাত্র বা ছাত্রীর খোঁজ আমি দিতে পারি- যারা একবেলা নিজেদের শ্রম দিয়ে উপার্জন করে অপর বেলায় পড়াশোনা করে।
আমাদের বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে এমন কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে শ্রমজীবী শিশুদের পড়াশোনা করানো হয়। এইসব প্রতিষ্ঠানে সেইসব ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে- যারা সারাবেলা অন্যের বাড়িতে কাজ করে। এবং দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে তারা এখানে পড়তে আসে।
উক্ত প্রতিষ্ঠানের এমন অনেক ছাত্র বা ছাত্রীকে আমি তোমাদের সামনে প্রমাণ হিসেবে হাজির করতে পারি- যারা এখন এক একজন সফল ব্যক্তিত্ব।
এগুলো ঘটেছে প্রবল আত্মবিশ্বাস আর অধ্যাবসায়ের জোরে।
তাদের লক্ষ্য ছিল তারা তাদের বর্তমান অবস্থাকে অতিক্রম করে সফল মানুষ হিসেবে সমাজে আত্মপ্রকাশ করবে।
এদের মধ্যে যে সবাই তা করতে পেরেছে তা কিন্তু নয়। তবে যদি তাদের মধ্যেকার অর্ধেক অংশও এই কাজে সফল হয়- সেটাও কি সমাজ বা সংসারের জন্য বিশাল পাওয়া নয়?
সঠিকভাবে ভাল ছাত্র বা ছাত্রী হতে হলে তোমাকে অধ্যাবসায়ী হতে হবে। ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
সফলতা একবারে আসে না। ভাল কোন কাজ করতে গেলে বার বার তোমাকে হোঁচট খেতে হতে পারে।
প্রকৃত অধ্যাবসায়ের অর্থ হলো— কোন কাজ সম্পন্ন করতে গিয়ে কখনও কখনও মানুষকে বিফলও হতে হয়। এই বিফলতাকে অগ্রাহ্য করে সফলতার আশায় আবার সেই কাজে নিজেকে নিয়োজিত করার নামই অধ্যাবসায়।
নিজের ভেতর প্রবল ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষার সাথে সাথে দৃঢ় মানসিক শক্তি বা মনের প্রকৃত গতি সঞ্চয় করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই আসল অধ্যাবসায়ীর লক্ষণ।
অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের জীবনী থেকে আমরা জেনেছি একটা ইংরেজি বাক্য- Failures are the pillars of success অর্থাৎ অসফলতা হচ্ছে সফলতার স্তম্ভস্বরূপ।
সুতরাং তুমি একবার অসফল হলেই যে বারবার তাই ঘটবে তা কিন্তু মোটেই নয়। বরং তুমি যদি প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে বারবার চেষ্টা করে যাও— তাহলে দেখবে একদিন না একদিন তুমি সফল হবেই হবে।
একটা কথা মনে রাখতে হবে তোমাকে কোন মানুষই রাতারাতি সফল হতে পারে না। প্রকৃত অর্থে সফল হতে হলে তাকে স্বীকার করতে হয় নানা ত্যাগ আর শ্রম।
তুমি যদি একবার পরীক্ষায় ফেল করে মনে করো তোমার দ্বারা আর ভাল ফল আশা করা বৃথা। তাহলে বলবো তুমি সত্যিকার অর্থেই অসফল ব্যক্তি।
তোমার ভুলে যাওয়া উচিত নয়, যে কোন মানুষ যদি উদ্যম না হারিয়ে বারবার মানসিক শক্তি দিয়ে গভীর আত্মপ্রত্যয়ের সাথে কাজ করে যায় তাহলে সফলতা সে অর্জন করবেই করবে।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে আমরা এমন অনেক অসফল ব্যক্তিত্বের সন্ধান পাই— যারা একবার অসফল হয়েই সবকিছু বিসর্জন দেননি। বরং বারবার চেষ্টা করে চূড়ান্ত পরিণতিতে সফল হতে পেরেছেন।
রবার্ট ব্রুশ ইংল্যান্ডের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন পরপর ছয়বার। এই ছয়বারই তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। লোকবল, অর্থবল অনেককিছুই তিনি হারিয়েছেন এই ছয়বারের যুদ্ধে। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েন নি। কঠোর অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেও যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছেন। সাতবারের বেলায় ঠিকই তিনি জয়ী হয়েছিলেন।
মোঘল সম্রাট বাবর একবার এক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হতোদ্যম অবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এক গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেইসময় তিনি দেখেছিলেন একটি পিঁপড়া গুহার পাথুরে দেয়াল বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। কৌতূহলী বাবর লক্ষ্য করলেন, পিঁপড়াটি ঊনষাটবার উঠতে গিয়ে অকৃতকার্য হলো এবং ষাটবারের বেলায় ঠিকই উঠে পড়তে পারল। দৃশ্যটি বাবরের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করল। তিনি ভাবলেন, একটি ক্ষুদ্র প্রাণী পিঁপড়া যদি ঊনষাটবার অকৃতকার্য হবার মতো শক্তি রেখে পরবর্তীতে ষাটবারের মতো শক্তি সঞ্চয় করতে পারে তাহলে আমি কেন পারব না। সত্যি কথা বলতে কী এই দৃশ্য দেখেই সম্রাট বাবরের মনে প্রবল উদ্দিপনা জাগ্রত হল। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আবার যুদ্ধে যোগদান করলেন। এবার তাঁর জয় ঠিকই হলো।
বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ডাঃ লুৎফর রহমান বলেছেন- গিরিশির হতে যখন পাহাড় খন্ড নামতে থাকে, তখন তাকে প্রথমটা দেখে মনে হয় এই নগন্য পাহাড়ের টুকরোটা কিছুই নয়। ক্রমে যখন সে নীচে নেমে আসে, তখন তার শক্তি হয় অতি ভয়ানক। সম্মুখে যা কিছু পায়— ভেঙ্গে চূর্ণ করে নিয়ে যায়।
আমার বাড়ির সামনে একটি পানের দোকান আছে। আমার ঘরের জানালা দিয়ে সেই দোকানটি দেখা যায়। আমি রোজই দেখি একটি লোক সামান্য একটু জায়গার মধ্যে পা মুড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন বসে পান বিক্রি করছে।
পৃথিবীতে কত কী ঘটে যাচ্ছে। তারই চারপাশে এ শহরে হাজার হাজার মানুষ সিনেমা থিয়েটারে যাচ্ছে, নানা ধরনের প্রমোদখানা থেকে বেরুচ্ছে। খেলা দেখে ফিরছে, বাড়ি গিয়ে তারা চা থেতে খেতে টিভির সামনে বসবে। কিন্তু এই পানওয়ালা হাঁটু মুড়ে বসে তেমনি রাত বারোটা পর্যন্ত এভাবে পান সেজে যাবে। ‘খদ্দের এলো তো এলো। না এলো তো না এলো। ধৈর্য ও নিষ্ঠা কী আমরা এদের কাছ থেকে শিখতে পারি না?
ধৈর্য ও অধ্যাবসায় ছাড়া কোন কিছু লাভ করা যায় না। একটা সাধারণ বাড়িও দেড় বছরের আগে হয় না।
তাজমহল গড়তে ২২ বছর লেগেছিল। একজন মহাপুরুষের আগমনের জন্য কত প্রজন্ম অপেক্ষা করতে হয়।
অনেক অকৃতকার্য ছাত্র-ছাত্রী আম’কে প্রশ্ন করতে পারো, ধৈর্য তো ধরলাম, কিন্তু যদি শেষ পর্যন্ত ফল না পাই।
নাও পেতে পারো। কিন্তু ধৈর্য ধরলে ফল পাওয়ার শতকরা ৭৫ ভাগ আশা থাকে। তবে সেই ধৈর্যের সাথে যুক্ত করতে হয় আত্মবিশ্বাসের সাথে পথ চলা। শুধু আত্মবিশ্বাস থাকলে যেমন কাজ হবে না। তেমনি শুধু ধৈর্য ধরে ঘরে বসে থাকলেও কাজ হবে না।
কোন কাজের মধ্যে ধৈর্য না ধরলে পাওয়ার আশা শূন্য।
ছিপ ফেলে বসে থাকলে মাছ পেলেও পেতে পারো। কিন্তু ছিপ না ফেললে মাছ পাবার আশা করবে কী করে?
শিক্ষাজীবন-শেষে একজন ডাক্তার বা উকিল হলেই যে পসার হবে মানে নেই। কিন্তু ডাক্তারি বা ওকালতি পাশ করে প্র্যাকটিস না করা পর্যন্ত তুমি তো বুঝতে পারছো না তোমার পসার হবে কি হবে না।
ধৈর্য আশার সন্তান। আশাবাদী না হলে বিশ্বাসী ধৈর্য ধরা যায় না। আর একমাত্র আত্মবিশ্বাসী ছাড়া আশ্বাদী হওয়া যায় না।
যারা নিজের ওপরেই আশা নেই সে অন্য কোন বস্তুর ওপর আশা করবে কী ভাবে?
অসাধারণ মানুষ বলে যাঁরা পরিচিত তাঁদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের বিদ্যাবুদ্ধির যে খুব ফারাক তা নয়, তফাৎটা হল, বিরাট লোকদের দৃঢ়সঙ্কল্পের পরিধিটা বিরাট আর সাধারণ লোকের দৃঢ় সঙ্কল্পের পরিধি ছোট।
সাধারণ মানুষের ভাবনাটাও সাধারণ আর বিরাট মানুষের ভাবনাটাই বিরাট।
যা হারিয়েছো তার জন্য অনর্থক শোক না করে যেটুকু রয়েছে সেটুকুর দিকেই তাকাও। আগুন লেগে যাদের বাড়ি পুড়ে যায় তারা কতখানি ক্ষতি হয়েছে তার হিসাব করতে বসে না, কতটুকু বাঁচানো যায় তার চেষ্টা করে। তারপর আত্মবিশ্বাস দিয়ে পুনরায় সেগুলি গড়ে তোলার চেষ্টা করে।
উপরের এইসব উদ্ধৃতি দেখে নিশ্চয় বুঝতে পারছো- তোমার মধ্যেই এক অপরিশীম শক্তি অবদমিত হয়ে আছে। যে শক্তির সাহায্যে অকৃতকার্যদের তালিকা থেকে তুমি নিজেকে অনায়াসে কৃতকার্যদের তালিকায় উজ্জ্বল করে তুলতে পার।
প্রতিভাধর যে মানুষকেই তুমি দেখবে- তাদের প্রতিভার সাথে কঠিন অধ্যাবসায় এবং গভীর আত্মবিশ্বাসও যুক্ত হয়ে আছে। এই আপাত শক্তির সাহায্য ছাড়া সে কিছুতেই উপরে উঠতে পারবে না। দরিদ্রের ঘরে জন্ম নিয়েও সফলতার শিখরে উঠে আসার নিদর্শন আছে অনেক। নিজের অবস্থার উন্নতির জন্য চেষ্টা করাটাই হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
আমি স্বীকার করি, পড়াশোনাটা একটা কঠিন মানসিক এবং কায়িক শ্রমের কাজ। কিন্তু তাই বলে এই শ্রমকে অস্বীকার করা তো যাবে না। কিন্তু তাই বলে, পরিশ্রমের ভয়ে পিছিয়ে গেলে তো চলবে না।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে, God helps those who help themselves. অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা তাকেই সাহায্য করেন- যে নিজেকে সাহায্য করে।
সুতরাং তোমাকে ঈর্ষা ত্যাগ করে সুপরিমিত মাত্রার ধৈর্য ধারণের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাসের সাথে অধ্যাবসায়ী হতে হবে। তবেই তুমি তোমার ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে।
সবসময় মনে রাখবে, যে যত বেশি আত্মবিশ্বাসী সে তত অধ্যাবসায়ী। কোন কাজের দুরূহতার কথা চিন্তা করে সেই কাজ পরিহার করবে না। তোমার লক্ষ্যে তোমাকে পৌঁছাতেই হবে। সুতরাং এই পথে যে বাধাই আসুক না কেন- সেটাকে জয় করতে হবে তোমাকেই।
(২) ছাত্রদের জন্য মোটিভেশনাল কথাঃ আসক্তির সাথে নিরাসক্তির চিরন্তন যুদ্ধ
পরিমিত আসক্তি না থাকলে কোন বিষয়ে আগ্রহ জন্মায় না। সেটা লেখাপড়ার ক্ষেত্রে যেমন- ঠিক তেমনি জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও।
তোমার ভেতর যদি পড়াশোনার প্রতি গভীর আসক্তি না জন্মায় তাহলে তুমি চেষ্টা করলেও পড়াশোনায় মনযোগ বসাতে পারবে না। লেখার প্রতি আমার আসক্তি আছে বলেই আমি লিখি। এই লেখাতে আমি একদিকে যেমন আনন্দ পাই- ঠিক তেমনি এই লেখা আমাকে এনে দিয়েছে খ্যাতি আর প্রাচুর্য।
কিন্তু একটা কথা তোমাদের মনে রাখতে হবে, আসক্তি কখনই যেন তীব্র না হয়ে ওঠে।
কোনকিছুর প্রতি তীব্র আসক্তি মারাত্মক। তাই যতখানি আসক্তি না করলে নয়, সেটা করতে হবে। কিন্তু সেটা যেন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে না যায়। আসক্তি তীব্র হয়ে গেলে তখন মানুষের মন তৃপ্তির ওপারে চলে যায়। নতুন কিছুতে মনে তৃপ্তি আসে না। নতুন পড়ায়ও মন বসে না।
তীব্র আসক্তি থেকে মন মুক্ত রাখতে পারলে তখন আর মায়া বদ্ধ হতে হয় না অথবা নেশার দাস হতে হয় না। তুমি যদি এরকম একটা মনোভাব গ্রহণ করো যে যেটুকু দরকার তার চেয়ে বেশী না পড়লেও তোমার চলবে। তবে সেটুকুতেই তোমার পড়াশোনা সীমাবদ্ধ রেখো।
যেমন, প্রতিটি সংসারী ব্যক্তিরই সুখের স্পৃহা চিরন্তন। কোন সংসারীর পক্ষে এই স্পৃহা একেবারে ত্যাগ করা সম্ভব নয়। সুখ নিশ্চয়ই চাইতে হবে। কিন্তু যদি যেমনটি চাওয়া হচ্ছে, তেমনটি সুখ অর্জন করা সন্তব না হয়। তাহলে মনে অতৃপ্তি আসবে। দুঃখবোধ আসবে। অমনি আত্মবিশ্বাস কমে যাবে।
তাই যেটুকু পাওয়া যায় সেটুকুই প্রাপ্য বলে গ্রহণ করতে হবে। এবং তাতেই আপাতত তৃপ্ত থাকতে হবে। তারপর আবার উঠে পড়ে লাগতে হবে আরও একটু পাওয়ার জন্য। এইভাবে তিল তিল করেই তোমার সঞ্চয় তোমাকেই গড়ে তুলতে হবে। আর তাহলেই তোমার শিক্ষাজীবনে আসবে স্থিতি। আসবে সফলতা।
(৩) ছাত্রদের জন্য মোটিভেশনাল কথাঃ ভেতরের ব্যক্তিত্বকে জাগ্রত করতে হবে
হতাশাকে কখনও তোমার ভেতর বাসা বাধতে দেবে না। একবার অকৃতকার্য হয়েছো তাতেই নিজেকে হতাশাবাদীদের দলে ঠেলে দেবে না।
সেই কবিতাটার কথা কি তোমাদের মনে আছে?
পারিব না এ কথাটি বলিও না আর, একবার না পারিলে দেখ শতবার।
এই কবিতার কথাগুলি আক্ষরিকভাবে তোমার জীবনে প্রতিভাত কর। কখনও হতাশ হয়ে নিজের সহ পরিবার তথা সমগ্র দেশের ক্ষতি করো না। কারণ কেউ জানে না তোমার মধ্যে সুপ্ত কোন প্রতিভা লুকিয়ে আছে। যে প্রতিভার দ্বারা সমস্ত দেশ ও জাতি উপকৃত হতে পারে।
একটা মৌমাছি সারা জীবন ধরে এক কেজির মত মধু সংগ্রহ করে এবং তার সঞ্চয় নিয়েই সে সন্তুষ্ট থাকে। যদি তার সঞ্চয় নষ্ট হয়ে যায় তাহলে আবার সে সংগ্রহে নামে।
তুমি ছোট, তোমার বয়স কম। কিন্তু তুমি নিজেও জানো না, তোমার ভেতর কী অপরিশীম শক্তি লুকিয়ে আছে। কেউ জানে না। কার্যক্ষেত্রে তার প্রমাণ মেলে। তবে প্রমাণ তখনই মেলে যখন কার্ষক্ষেত্রে তার যথার্থ প্রয়োগ ঘটে।
তুমি কখনও তোমার সাথে তোমার আর সব সহপাঠির তুলনা করবে না। তুমি ছোট ঘরে জন্মেছো বলে নিজেকে কখনও হীন মনে করবে না। পৃথিবীর ইতিহাস একটু ঘেটে দেখ। অনেক বড়ো বড়ো মনীষীদেরই পারিবারিক কোন ইতিহাস নেই। এদের অনেকেই এসেছেন অতি সাধারণ পরিবার থেকে। কিন্তু তাই বলে তাদের মধ্যে কখনও এই হিনমন্যতা আসেনি- যে তারা ছোট ঘরের মানুষ। তাই যদি হতো, তাহলে তাদের কাছ থেকে পৃথিবী কখনও কোন বিষয়ে উপকৃত হতো না। এটা সৃষ্টির চিরন্তন সত্য।
সুতরাং যে যেখানেই থাক, নিজের বলে বড় ও উন্নত হতে চেষ্টা কর। জীবনের সকল অবস্থায় নিজেকে বড় করে তোলা যায়-এ তুমি বিশ্বাস কর।
জাতীয়তা ও স্বাধীনতার কথা ভাববার আগে তুমি নিজেকে মানুষ করো। মানুষের ব্যক্তিত্রে উন্নতি ও মার্জিত-বিকাশ ছাড়া স্বাধীনতা আর কিছুই নয়। এক ব্যক্তি বলেছেন-স্বাধীনতা শব্দের সঙ্গে সঙ্গে দেশের এক একটা মানুষের আত্মোন্নতির কথা মনে না করে আমি থাকতে পারি না।
তুমি তোমার ব্যক্তিত্বকে দৃঢ় করে তোল। কেউ তোমার উপর অন্যায় আধিপত্য করতে পারবে না -এ কথা দার্শনিক মিল বলেছেন।
তুমি যদি নিজের ক্ষতি নিজে কর, অজ্ঞতা ও পাপে নিজের উপর অত্যাচার আরম্ভ করো, তাহলে কে তোমাকে বড় করবে? তুমি কাজ কর-তোমার বন্ধু তুমি-হীন নও। তোমার ভিতরে যে শক্তি আছে, সেই শক্তির চর্চা তুমি কর, তুমি মহামানুষ হতে পারবে।
তুমি ছোট বংশে জন্মহণ করেছ বলে, তোমায় যে ছোট করে রাখতে চায় সে বড় ছোট। তুমি মানুষ, তোমার ভিতরে আত্মা আছে, এটাই তোমার জন্যে যথেষ্ট। মনে প্রাণে তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে তুমি ছোট নও।
খুব বড় বড় রাজারাই যে জগতে কীর্তি রেখে যাবে, এমন কোন কথা নয়। শিক্ষা শুধু ভদ্র নামধারী এক শ্রেণীর জীবের জন্য নয়। বস্তুত জদ্রবেশী বলে কোন কথা নাই। ক্ষুদ্র, ছোট এবং নগণ্য যারা তারাও জদ্র হতে পারে-তাদেরও শক্তি আছে, একথা তারা বিশ্বাস করুক।
শিক্ষা, জ্ঞানালোচনা, চরিত্র ও পরিশ্রমের দ্বারা দরিদ্র মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র তুমি হতে পার। যে অবস্থায় থাক না কেন- জ্ঞান অর্জন কর, পরিশ্রমী হও। মানুষ তোমাকে শ্রদ্ধা করবে।
তুমি অতি সামান্য ঘরে জন্মথহণ করেছো- কিন্তু তুমি যদি শিক্ষাক্ষেত্রে নিজের ওজ্ভবললতা জাহির করতে পারো, সাধু ও চরিত্রবান হও, সেই অবস্থায় মনের দীনতা ও মূর্খতা দূর করতে একটু একটু পড় ও বড় বড় লোকের উপদেশাবলী ও জ্ঞানের কথা আলোচনা কর, দেখতে পাবে, দিন দিন তোমার সকল দিক দিয়ে উন্নতি হচ্ছে- শিক্ষাক্ষেত্রে তথা সমাজ সংসারে তোমার প্রতিপত্তি বাড়ছে।
সফলতা তখন তো তোমার হাতের মুঠোয়। পরীক্ষায় তুমি কৃতকার্য হও নাই, ভাল কোন স্কুলে বা কলেজে তুখি পড়তে পারছো না, সেজন্য দুর্খিত হয়ো না। মানুষ চায় চরিত্র, জ্ঞান, ব্যক্তিত্ব ও শক্তি।
মানব-সমাজে, রাস্তাঘাটে, দোকানীর দোকানে, রেলে, শ্টামারে-লক্ষ্য করে পর্যবেক্ষণ কর, তুমি যদি ইচ্ছে কর গ্রভৃত জ্ঞান লাভ করতে পারবে। নিজের চিন্তা করবার শক্তি জাগিয়ে তোল, দৃষ্টি খুলে যাবে। সে দৃষ্টি দিয়ে সব কিছুর ভিতর-বাহির দেখতে থাক, তুমি মানুষ হবে।
স্কুল বা কলেজ শুধু তোমায় পথ দেখিয়ে দেয়- সারাজীবন তোমার নিজেকেই দেখতে হবে, শিখতে হবে, জ্ঞানার্জন করতে হবে।
স্কুল-কলেজের কাজ তোমাকে স্বার্থপর, চতুর, অর্থগৃধুত ও তস্কর করা নয়। বাড়িতে দালান দেবে, চোর-দারোগা হয়ে, পুকুর কেটে সমাজে মর্যাদা লাভ করবে সে জন্য শিক্ষার্জন নয়। শিক্ষা তোমাকে জীবনের কর্তব্য পথ দেখিয়ে দেয়, তোমাকে দৃষ্টিসম্পন্ন, কর্তব্যপরায়ণ ও চরিত্রবান, আত্মনির্ভরশীল, বিনয়ী ও সাহসী হতে বলে। শিক্ষার যে এই লক্ষ্য, তা তুমি ঠিক করে নিয়ে নিজেকে নিজে গঠন করতে চেষ্টা করো।
ভাল কোন স্কুল বা কলেজে অধ্যয়ন করতে পারলে ভাল যদি তা তোমার অবস্থায় না কুলায়, তাহলে নিরাশ হয়ো না। তোমাকে ছোট হয়ে থাকতে হবে না। জীবনের সকল অবস্থায়, সকল বয়সে তুমি তোমার নিজের চেষ্টার দ্বারা বড় হতে পার। তুমি মানুষ, তুমি অগ্নিক্ষুলিঙ্গ, তোমার পতন নাই, তোমার ধ্বংস নাই। অর্থ ও পশুতু সুখের বিনিময়ে জীবনের অপমান করো না।
নিজেকে নিজে বড় কর, জগৎ তোমাকে বড় বলে মেনে নেবে। নিজেকে নিজের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র করে তোল-মানুষের শ্রদ্ধা তুমি লাভ করবে।
শেক্সপীয়ার একজন সামান্য লোকের ছেলে ছিলেন, আমাদের দেশে হলে তাঁকে ছোটলোকের ছেলে ছাড়া আর কেউ কিছু বলতো না। যে মহামানুষের কাছে সমন্ড ইংরেজ জাতির শক্তি ও সভ্যতা অনেক অংশে ঝণী, তিনি ছিলেন সামান্য লোবের ছেলে। উপযুক্ত জ্ঞানচর্চার দ্বারা নিজের ব্যক্তিত্বকে তিনি এত বড় আসন দিতে সক্ষম হয়েছিলেন যার তুলনা পাওয়া কঠিন।
ডাক্তার লিভিংস্টোনের নাম তোমরা জান? লিভিংস্টোন ছিলেন একজন জোলা।
নৌ-যুদ্ধবিশারদ স্যার ক্লাউডেসলে শোভেল (Sir Cloudesly Shoel) তড়িত্তত্বিদ স্টার্জন, লেখক সেমুয়েল ড্র, পাদরী উইলিয়াম ক্যারি চামারের কাজ করতেন।
সাধনার দ্বারা এঁরা জগতে কীর্তি রেখে গিয়েছেন। যে কীর্তি শ্রেষ্ঠ মানুষেরা রেখে যেতে পারে না। বন্তৃত কর্ম ও কীর্তিহীন শ্রেষ্ঠ মানুষের কোন মূল্য নাই।
সমুদ্র উপকূলের এক নগরে এক ইংরেজ বালক কোন এক দরজীর দোকানে কাজ করছিল। তার কাছ দিয়ে একখানা যুদ্ধ জাহাজ যাচ্ছিল। অন্যান্য ছেলেদের মত সে-ও সেই জাহাজের দৃশ্য দেখতে গেল।
জাহাজের মূর্তি দেখে সহসা তার ইচ্ছে হলো, সেই জাহাজে কোন কাজ নেয়। তাড়াতাড়ি একখানা নৌকা নিয়ে সুঁচ-কাঁচির কথা ভুলে বালক জাহাজের অধ্যক্ষের নিকট উপস্থিত হলো। অধ্যক্ষ বালকের উৎসাহ দেখে চমৎকৃত হলেন এবং তাকে গ্রহণ করলেন। কালক্রমে এই সামান্য দরজী বালক একদিন এডমিরাল (Admiral) হয়েছিলেন। তাহলে বুঝতে পারছো তো চেষ্টা আর ইচ্ছা থাকলে অনেক কিছুই করা সম্ভব।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক এন্ডরু জনসনকে এক সময়ে একজন ঠাট্টা করে বলেছিলেন- দেশমান্য রাষ্ট্রনায়ক হলেও আপনি এককালে দরজী ছিলেন। নায়ক সে কথায় লজ্জিত না হয়ে বললেন- দরজী ছিলাম, কিন্তু সবসময়েই ঠিক কাজ করেছি, কোনদিন কাউকে ঠকাই নি।
তোমার পিতা বা পরিবারের কর্তা যে কাজই করুক না কেন। তাতে লজ্জা নাই। লজ্জা হয় অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করায়, ভিক্ষা করায় কিংবা মূর্খ হয়ে থাকায়। জ্ঞান লাভ কর, নিজের ভিতরে যে শক্তি আছে তাই জাগিয়ে তোল, তুমি ছোট হয়ে পড়ে থাকবে না।
জর্জ স্টিফেনশন ছিলেন কয়লাওয়ালা। নিউটন ছিলেন চাষার ছেলে। মিলটনের বাবা পোদ্দার।
স্যার হামফে ডেভি বলেছেন- তাঁর উচ্চাসনের কারণ হচ্ছে তার এঁকান্তিক চেষ্টা। রাজা এড্রিয়ান যখন বালক, তখন তাঁর পড়বার তেলও জুটতো না, রাস্তার আলোতে তিনি পড়তেন। এই সহিষ্ণুতা এবং এই সাধনাই তাঁকে বড় করেছিল- অদৃষ্ট নয়।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা তো তোমরা জানই। তিনি যখন তোমাদের বয়সী ছাত্র- তখন তিনি পড়াশোনার জন্যে বেছে নিয়েছিলেন রাস্তার বাতিকে। সেই বাতির তলে গিয়ে তিনি পড়তেন। আজ তিনি একজন জ্ঞানীদের জগতে একজন প্রাতঃম্মরণীয় ব্যক্তি।
ফক্স সাহেব যখন বক্তৃতা দিতে উঠেন, তখন প্রত্যেক বারেই এই কথা বলে আর্ত করতেন- যখন নরউইচ শহরে তাঁতের কলে আমি চাকর ছিলাম…।
ইংল্যাণ্ডের বহু মনীষীর জনুবৃত্তত্ত খুবই হীন। পরিশ্রম ও জ্ঞানার্জন দ্বারা তারা মানুষ হতে সক্ষম হয়েছিলেন। তুমি কেন পারবে না?