(১) মুদ্রাস্ফীতি কি, কাকে বলে, বলতে কি বুঝায়?
মুদ্রাস্ফীতি কি: মুদ্রাস্ফীতি হলো একটি অর্থনৈতিক অবস্থা যেখানে পণ্যের দাম ও সেবার মূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। এটি সাধারণত তখন ঘটে যখন একটি দেশের মুদ্রার মূল্যমান কমে যায়, ফলে পণ্য ও সেবার জন্য বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়। মুদ্রাস্ফীতি বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যহীনতা, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, বা মুদ্রার অতিরিক্ত সরবরাহ।
মুদ্রাস্ফীতি কাকে বলে: কোন কালপরিধিতে পণ্য ও সেবার মূল্য টাকার অঙ্কে বেড়ে গেলে অর্থনীতির ভাষায় তাকে মুদ্রাস্ফীতি বলে। সাধারণত পণ্য/সেবার দাম বেড়ে গেলে স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে ঐ পণ্য/সেবা ক্রয়ে বেশি পরিমাণ মুদ্রার প্রয়োজন হয় কিংবা একই পরিমাণ মুদ্রা দিয়ে কোনো পণ্য/সেবা কিনতে গেলে আগের চেয়ে পরিমাণে কম পাওয়া যায়।
মুদ্রাস্ফীতি বলতে কি বুঝায়: সহজভাবে বলতে গেলে, মুদ্রাস্ফীতি তখন ঘটে যখন আপনি একই পরিমাণ পণ্য বা সেবা কিনতে আগের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য হন। উদাহরণস্বরূপ, যদি গত বছর একটি পাউরুটি ১৫ টাকা দিয়ে কিনতে পারতেন, কিন্তু এই বছর সেটি ২০ টাকা হয়ে যায়, তাহলে এটি মুদ্রাস্ফীতির একটি উদাহরণ।
মানুষের আয় না বাড়লেও জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির সাথে মানিয়ে নিতে না পারার অন্যতম কারণ হলো মুদ্রাস্ফীতি। মুদ্রাস্ফীতি এবং দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির সাথে অর্থনীতির যে কয়েকটি বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত তার মধ্যে অন্যতম হলো খেলাপি ঋণ।
সাধারনত মুদ্রাস্ফীতির ফলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়। ফলে কোন পণ্যর দাম আগে যদি হত ১০০ টাকা তাহলে মুদ্রাস্ফীতির পর তার নাম হবে ১১০ টাকা অথবা ১০০ টাকায় সেই পণ্য আগের চেয়ে অনেক কম পরিমাণে পাওয়া যাবে, এর ফলে অর্থনীতিতে পণ্যের আসল বিনিময় মূল্য কমে যায়।
আরো সহজ করে বলতে গেলে দেশের সর্বমোট যত সম্পদ আছে তার মূল্য ওই দেশের বর্তমান মোদ মুদ্রামান বা মোট টাকার সমান।
মনে করুন, বাংলাদেশের সর্বমোট ১০০ টাকা আছে এবং দেশের মোট সম্পদ হলো দশটি আম। যেহেতু দেশের মোট সম্পদের মূল্য মোট মূল্যমানের সমান, সেহেতু এই দশটি আমের মূল্য ১০০ টাকা, তার মানে প্রতিটি আমের মূল্য ১০ টাকা। এখন যদি আরো ৫০ টাকা ছাপানো হয় তাহলে মোট মুদ্রা মান হয়ে যাবে ১০০ + ৫০ = ১৫০ টাকা। আম কিন্তু আগের সেই দশটায় আছে, কিন্তু টাকা বেড়েছে, এখন নতুন করে ৫০ টাকা ছাপানোর পর ১০ টি আমের মোট মূল্য হয়ে গেল দেড়শ টাকা অর্থাৎ প্রতিটি আমের বর্তমান মূল্য ১৫ টাকা, যা আগে ছিল ১০ টাকা। সম্পদ না বাড়িয়ে অতিরিক্ত টাকা ছাপানোর ফলে আমের দাম ১০ টাকা থেকে ১৫ টাকা হয়ে গেল, এটা সহজ ভাষায় মুদ্রাস্ফীতি। একই পণ্য আগের থেকে বেশি দামে ক্রয় করা মানেই মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে।
(২) মুদ্রাস্ফীতির কারণ কি?
মুদ্রাস্ফীতির পেছনে বহু কারণ থাকলেও সহজ ভাষায় বলা যায় কোন দেশের সম্পদের পরিমাণ না বাড়িয়ে টাকা ছাপালে মুদ্রাস্ফীতি হয়।
মুদ্রাস্ফীতির প্রধান কারণগুলো হলো-
- চাহিদা জনিত মুদ্রাস্ফীতি: যখন কোনো পণ্যের চাহিদা সরবরাহের চেয়ে বেশি হয়, তখন দাম বাড়ে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো পণ্যের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যায় কিন্তু সরবরাহ অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে সেই পণ্যের দাম বাড়বে।
- মূল্য জনিত মুদ্রাস্ফীতি: যখন উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়, তখন পণ্যের দামও বাড়ে। উদাহরণস্বরূপ, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পেলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় এবং সেই সাথে পণ্যের দামও বেড়ে যায়।
- মুদ্রার অতিরিক্ত সরবরাহ: যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপায়, তখন বাজারে মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যায়। এর ফলে মুদ্রার মূল্যমান কমে যায় এবং পণ্যের দাম বাড়ে।
- সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি: যখন সরকার অতিরিক্ত ব্যয় করে, তখন বাজারে মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যায় এবং মুদ্রাস্ফীতি ঘটে।
- বৈদেশিক ঋণ: বৈদেশিক ঋণ বাড়লে মুদ্রাস্ফীতি হতে পারে কারণ ঋণ পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপাতে হয়।
(৩) বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির কারণ
বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির কারণ: মুদ্রা মুদ্রাস্ফীতির পেছনে বহু অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত থাকে, তার মধ্যে অন্যতম হলো অন্যতম হলো খেলাপি ঋণ, অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খেলাপি ঋণ একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করলে সেই ঋণকে খেলাপি ঋণ বলা হয়।
মনে করুন বাংলাদেশের ১০০ টাকা থেকে এক ব্যক্তি ২০ টাকা ঋণ নিয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত ঋণের ২০ টাকা দেশের মধ্যে থাকবে ততক্ষণ দেশের মোট মুদ্রা মান ১০০ টাকায় থাকবে, তার মানে প্রতিটি আমের মূল্য ১০ টাকায় থাকবে। কিন্তু ওই ব্যক্তি যদি ঋণের ২০ টাকা ডলার অন্য কোন বৈদেশিক মুদ্রায় কনভার্ট করে বিদেশে গিয়ে খরচ করে ফেলে এবং সে ঋণ পরিশোধ করতে না পারে তাহলে বেশ কিছু সমস্যা তৈরি হয়।
প্রথমত ডলারে কনভার্ট করার কারণে ওই ২০ টাকা এখন আর বাংলাদেশের মধ্যে নেই অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেবে বাংলাদেশের মোট টাকা এখনো ১০০ই আছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাস্তবে টাকা আছে ৮০ টাকা, ওই খেলাপি ২০ টাকার ক্ষতি পুষে নিতে সরকার আবার ২০ টাকা অতিরিক্ত ছাপায় অর্থাৎ ব্যাংকের হিসেবে মোট মুদ্রামান হয়ে যায় ১২০ টাকা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে টাকা আছে মাত্র ৮০ টাকা।
খেলাপি ঋণ এবং দেশের টাকা বিদেশে পাচার করার কারণে কিভাবে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি হয় এবার সে সম্পর্কে আলোচনা করা যাক।
যেহেতু খেলাপি ঋণের কারণে নতুন করে টাকা ছাপানো হয়েছে সেহেতু মুদ্রাস্ফীতি হবে অর্থাৎ একই আমের দাম আগে ছিল ১০ টাকা এখন হয়ে যাবে ১২ টাকা। এই বিষয়টিও খুব বেশি প্রভাব ফেলত না যদি সত্যি সত্যি দেশে ১২০ টাকা থাকতো তাহলে পণ্যের দাম বাড়ার সাথে সাথে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়তো, দেশে যেহেতু ১২০ টাকা নেই আছে ৮০ টাকা তার মানে চল্লিশ টাকা দেশের অর্থনীতি থেকে হারিয়ে গেছে, এর ফলে আমাদের কাছে আছে ৮০ টাকা, কিন্তু পণ্য কিনতে হচ্ছে এমন দামে যেন আমাদের কাছে ১২০ টাকাই আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবরণী থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের শেষের দিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, ২০২১ সালের শেষে খেলাপি ঝণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৮৮ কোটি টাকা। তারমানে এক বছরে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫৭২৮ কোটি টাকা। লক্ষ কোটি টাকারও বেশি খেলাপি ঋণ দেশের অর্থনীতিকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দেয় অথচ আমরা পণ্য ক্রয় সময় এমন ভাবে মূল্য পরিশোধ করছি যেন ওই ১ লক্ষ ১৬৮ কোটি টাকা আমাদের মুদ্রা মানে যুক্ত আছে, সে কারণেই ৩০০ টাকার গরুর মাংস ৭০০ টাকায় উঠে এসেছে, কিন্তু মানুষের ক্রয় ক্ষমতা এখনও ৩০০ ঢাকায় আছে।
এছাড়া ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ৪ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ের অর্থ পাচারের সঠিক হিসাব জানা নেই, তবে অতীতের সমীক্ষা থেকে ধারণা করা যায় প্রতি বছর গড়ের প্রায় লক্ষ কোটি টাকা আমাদের বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে।
বাংলাদেশের ব্যাংকাররা বলছেন, দেশের নথিপত্রে খেলাপি ঋণ যত দেখানো হয় প্রকৃত চিত্র তার চেয়ে তিন গুণ বেশি, অনেক শিল্প গ্রুপের ঋণ আদায় না হলেও বছরের পর বছর খেলাপি করা হয় না, আবার একিই বারবার পুনঃ তফসিল করে ঋণ নিয়মিত রাখা হয়, এর ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখায়।
আন্তর্জাতিক মূদ্রা তাহবিল বা আএমএফ ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল, সেখানে বলা হয়েছে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ আড়াল করে রাখা আছে, এখানে খেলাপি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করা হয় প্রকৃত খেলাপি দিন তার তুলনায় অনেক বেশি। আইএমএফ এর মতে বাংলাদেশের খেলাফি ঋণের পরিমাণ হবে প্রায় আড়াই লক্ষ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরোর হিসেব মতে, ২০১৭ থেকে ২০২১ এই চার বছরে মুদ্রাস্ফীতির হার ২৮.৭ শতাংশ অর্থাৎ ২০১৭ সালে ১০০ টাকা দিয়ে যে পণ্য কেনা যেত ২০২১ সালে এসে সেই পণ্য কিনতে খরচ করতে হচ্ছে প্রায় ১৩১ টাকা বাস্তবে মুদ্রাস্ফীতি সরকারি হিসেবে চেয়েও অনেক বেশি।
কনজিউ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ২০২১ সালের একটি তথ্য মতে, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের নিত্য প্রয়োজনীয় সকল পণ্যের দাম ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে, মুদ্রাস্ফীতি, খেলাপি ঋণ এবং দ্রব্যমূল্যের দাম ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, কিন্তু মানুষের আয় সেভাবে বাড়ছে না বরং অনেক ক্ষেত্রেই আয় কমেছে।
২০১৯ সালে ঘটিত করোনা মহামারির কারণে, গত দুই বছরে অনেক মধ্যবিত্ত চাকরি হারিয়েছে যাদের চাকরি আছে তাদের দুই বছর ধরে বেতন বাড়েনি বরং মহামারীর অজুহাতে কারো কারো বেতনের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমেছে অথবা বেতন বকেয়া রেখে দিয়েছে মালিকপক্ষ, অনেক মধ্যবিত্ত এখন নিম্ন মধ্যবিত্তের কাতারে চলে এসেছে। বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেক মধ্য আয়ের দেশেপরিণত হলেও সাধারন মানুষের জীবনে তার প্রভাব খুব কমই পড়েছে।
একটি দেশের মুদ্রাস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার সংকর যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার অন্যতম উদাহরণ শীলংকা। ২০২২ সালে শ্রীলংকার পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হয়েছিল যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য এবং জ্বালানি তেল কেনার মত টাকাও ছিল না সরকারের কাছে, তার উপর হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক আছেই, অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও বেপরোয়া ঋণ গ্রহণের কারণে দেশটির সরকার নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছিল।