নিম্নে ‘প্রতিবন্ধকতা কোন বাঁধা নয়’ এর আলোকে একটি শিক্ষার্থী জন্য মোটিভেশনাল কথা/বক্তব্য তুলে ধরা হলো-
যে কথাটা বলতে চাই যে বড় হবার জন্য চাই দৃঢ় সঙ্কল্প। আমি বড় হতে চাই এই সঙ্কল্প। যারা সেই সঙ্কল্প করে আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে পরেন তাদের কাছে আর কোন বাধা বাধা হয়ে দীড়ায় না। না বাইরের প্রতিবন্ধকতা, না নিজের দেহের প্রতিবন্ধকতা।
একবার হান্নান নামের ৩৭ বছরের এক যুবকের সাইকেল কসরৎ দেখেছিলাম। ভদ্রলোক সাইকেলের ৪০০ ধরণের কৌশল জানেন। ২০ ফুট উচু একটি পাটাতনের ওপর তিনি সাইকেল চালিয়ে উঠে যেতে পারেন।
এই সাইকেলের কসরৎ দেখিয়ে তিনি জীবিকা অর্জন করেন। হঠাৎ একদিন রেল দুর্ঘটনায় তার একটি পা কাটা যায়। তখন ঢাকায় অবস্থিত একটি বিদেশী সংস্থা তাকে একটি কৃত্রিম পা লাগিয়ে দেয়।
আত্মবিশ্বাস না হারিয়ে ওই পা নিয়ে তিনি আজও সাইকেলের কসরৎ দেখিয়ে যাচ্ছেন। সাইকেলের খেলা দেখাতে তিনি কয়েকবার বিদেশেও গিয়েছেন।
এই ঢাকারই আর একজন পঙ্গু সন্তান আব্দুল মোতালেব। যিনি কৃত্রিম পা পরে যোগব্যয়াম গ্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছেন। তাও আবার ইন্দোনেশিয়ার মতো একটা জায়গায় গিয়ে।
এরা প্রতিবন্ধকতা সত্তেও ছোটখাটো ব্যাপারে কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। কিন্তু প্রতিবন্ধীদের মধ্যে এত মানুষ বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন যে তাদের তালিকা দিতে গেলে একটা পুরো বই লিখতে হবে।
- সারা বার্ণ হার্ট (১৮৪৪-১৯২৩) ছিলেন আগের দিনের এক বিখ্যাত ফরাসি অভিনেত্রী। ফরাসিরা তার নাম দিয়েছিল স্বগীয় সারা (devine)। ইনি মঞ্চে অভিনয় করতেন। ১৯০৫ সালে তার পায়ে চোট লাগে। এই পায়ের ব্যথাটা প্রায় নয় বছর ধরে চলে। এর মধ্যে তিনি অভিনয় করে গেছেন। ১৯১৪ সালে তার পায়ের অবস্থার এত অবনতি হয় যে ডান পা কেটে বাদ দিতে হয়। এর পরেও তিনি অভিনয় ছাড়েননি।
- অন্ধদের লেখাপড়ার জন্য ব্রেল পদ্ধতির আবিষ্কারক লুই ব্রেল (১৮০৯- ১৮৫২) তিন বছর বয়সে অন্ধ হয়ে যান। অন্ধ অবস্থাতেই তিনি ব্রেল পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
- ডন কুইকজোটের লেখক মিুয়েল দ্য কারভানতেস (Miguel De Cervantes) যুদ্ধে বা হাতটি হারান। তদুপরি তিনি ছিলেন খুবই গরিব। ওই অবস্থার মধ্যে ডন কুইকজোট লিখে পৃথিবী বিখ্যাত হন।
- বিখ্যাত পুলিৎজার পুরস্কারের প্রবর্তক ও আমেরিকার বিখ্যাত সংবাদপত্র প্রকাশক জোসেফ পুলিৎজার (১৮৪৭-১৯১১)। ৪০ বছর বয়সে অন্ধ হয়ে যান। অন্ধ অবস্থায় ৪০ বছর ধরে তিনি বহু উল্লেখযোগ্য কাজ করেন।
- আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্লিন রুজভেল্টের (১৮৮২-১৯৪৫) ৩৯ বছর বয়সে দুটো পা পক্ষঘাতদুষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু তা সত্তেও তিনি চারবার প্রেসিডেন্ট হন এবং তার শাসনে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তিনি আমেরিকাকে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করেন।
- বিখ্যাত সাংবাদিক ও নিউইয়র্ক ম্যাগাজিনের কা্টুনিষ্ট জেমস থারবারের (১৮৯৪-১৯৬১) একটি চোখ ছোটবেলায় দুর্ঘটনায় নষ্ট হয়ে যায়। বড় হয়ে তার বাকি চোখটাও নষ্ট হয়ে যায়। তবুও তিনি তীর কর্ম থেকে পিছিয়ে পড়েননি।
- বিখ্যাত ফরাসি শিল্পী Henri De Touluse (১৮৬৪-১৯০১) ১৪ বছর বয়সে পড়ে গিয়ে বিকলাঙ্গ হয়ে যান। এই অবস্থাতেই তিনি কালজয়ী ছবি এঁকে গেছেন। হেনরি ভিসকার্ডি জন্মেছিলেন বিকলাঙ্গ হয়ে। জন্মের সময় থেকেই তীর দুটো পা ছিল না। কিন্তু তিনি পরবর্তীতে শিক্ষাক্ষেত্রে ১৩টি উচ্চপর্যায়ের ডিগ্রি পান। নয়টি বিখ্যাত বই লেখেন। বহু মানবহিতৈষী সংগঠনের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন।
এঁরা দৈহিক প্রতিবন্ধকতা সত্তেও কীভাবে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছেন? গভীর আত্মবিশ্বাসই তাদের নিজেদের লক্ষ্যে নিয়ে গিয়েছে। তারা সেই লক্ষ্য স্থির ছিলেন।
এই স্থিরলক্ষ্যে পৌছবার জন্য সব সময় ভাল কোন স্কুল বা কলেজের শিক্ষার প্রয়োজন হয় না। আবার প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়েও শিক্ষা শেষ করা যায়। এজন্য আর্থিক মূলধনেরও দরকার হয় না। দরকার হয় শুধু দৃঢ় মনোবলের ৷ দেখা গেছে বহু বিখ্যাত ব্যক্তি যেভাবে জীবন শুরু করেছিলেন, পরবর্তীকালে জীবনের গতিপথ পরিবর্তন করেছেন।
- বিখ্যাত ইংরাজি কবি রবাট বার্নস ছিলেন বর্গাচাধী। অভিনেতা জেমস ক্যাগনি ওয়োরের কাজ করতেন যেমন দেবানন্দ ও উত্তম কুমার কেরানী হিসাবে জীবন শুরু করেন।
- আইনষ্টাইনও ছিলেন কেরানী। ওপন্যাসিক উইলিয়ম ফকনার ছিলেন রঙের মিস্ত্রি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জেরান্ড ফোর্ড মডেল ছিলেন।
- গ্রারিবন্ডি ছিলেন নাবিক।
- হিটলার পোস্টার আকতেন।
- ইতালির ডিক্টেটর মুসোলিনি ও ইজরায়েলের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী গোন্ডামেয়ার ছিলেন স্কুল শিক্ষক।
- লেখক হেনরি একসময় রাখালের কাজ করতেন।
- গায়ক এলভিস প্রিসলি ট্রাক চালাতেন।
এই তালিকা আরও অসংখ্য নামের তালিকার মাত্র কয়েকটি।
এঁরা কেউ রূপোর চামচ মুখে দিয়ে জন্মাননি। কিন্তু ছোটবেলা থেকে একটা লক্ষ্য ঠিক করে নিয়েছিলেন। তারপর আত্মবিশ্বাসকে সম্বল করে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গেছেন।
অনেকেই নানা কারণে পড়া ছেড়ে চাকরিতে যোগ দিতে বাধ্য হন। কিন্তু যদি দৃঢ়সঙ্কল্প থাকে তারা পরবর্তীকালে তাদের শিক্ষা শুধু চালিয়ে যেতে পারেন তাই-ই নয়, বিদ্যাবুদ্ধিও অর্জন করে খ্যাতিমান হতে পারেন।
আমি বহু আই.এ.এস. অফিসারকে জানি, যীরা প্রথমে কেরানী, মাস্টারি অথবা ডাব্লিউ.বি.সি.এস-এর চাকরি নিয়েছিলেন বাধ্য হয়ে। কিন্তু তারা পরে পরীক্ষা দিয়ে কেউ আই.এ.এস. ও আই.পি.এস. হয়েছেন।
মানুষ যদি তার লক্ষ্যের প্রতি একা থাকে এবং লক্ষ্যে পৌছনর ব্যাপারে তার আত্মবিশ্বাস যদি অটুট থাকে তাহলে সে তার লক্ষ্যে পৌছবেই।
এর জন্য সবাইকে স্কুল-কলেজে মেধাবী ছাত্র হওয়ার দরকার হয় না, ধনীর ছেলে হবারও প্রয়োজন হয় না।
তা বলে আমি বলছি না পড়াশোনায় ভাল হবার দরকার নেই। যারা ভাল তারা ভালই। কিন্তু যারা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী তাদের হতাশ হবার কারণ নেই। তাদের দরকার শুধু লক্ষ্য ঠিক রাখা। ব্যবসা, রাজনীতি, সৃজনশীল কাজে অতি
সাধারণ ছাত্রছাত্রী পরবর্তীকালে কৃতী হয়েছে।
আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশও স্কুল-কলেজে অতি সাধারণ মাত্রার ছাত্র ছিলেন। তিনি যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারেন একথা কেউ ভাবেনি।
কিন্তু আমি বিদেশী উদাহরণের মধ্যে যেতে চাইনা। কারণ আমাদের দেশেই অসংখ্য উদাহরণ আছে যেখানে স্কুল কলেজে বারবার অকৃতকার্য হয়েও একসময় কৃতিত্বের সাথে পড়াশোনা শেষ করতে পেরেছেন। শুধুমাত্র নিজের প্রবল আত্মবিশ্বাস আর সাধনার জোরে তারা তাদের লক্ষ্যে পৌছেছেন।
আজকাল অনেক ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেই কঠোর সংকল্প পালন করার মত আত্মবিশ্বাস যেন মন থেকে অন্তর্হিত হয়ে যাচ্ছে। অথচ সচেতন মনে সকলেরই ভাল ছাত্র হবার ষোল আনা ইচ্ছা আছে। যদি না পরিশ্রম করে কিছু পাওয়া যায়, অথবা অল্প পরিশ্রম করে বেশী কিছু পাওয়া যায়!
ইউনিভার্সিটিতে পড়ার আমার একজন বন্ধু একসময় একটা দেশী দৈনিক পত্রিকায় মফস্বল সম্পাদকের পদে চাকরিতে ঢুকেছিল। পত্রিকাটির মালিক ছিলেন একজন সোনার ব্যবসায়ী।
সোনার ব্যবসায়ে হাতে-নাতে লাভ। তিনি সিনেমার ব্যবসাও করতেন। এটাতেও হাতে নাতে লাভ। কিন্তু খবরের কাগজের ব্যবসায়ে এলেন। কারণ এতে প্রেস্টিজ আছে কিন্তু লাভের মুখ দেখতে অন্তত পাচ বছর।
ততদিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা তার পোষাল না। একবছরের মাথায় তিনি ব্যবসা তুলে দিলেন। সেও হয়ে পড়ল বেকার।
এই যে পরিশ্রম না করে সহজে মুনাফার ইচ্ছা বা রাতারাতি বড়লোক হবার ধান্দা এর পিছনে আছে অবচেতন মনের তাড়না।
অনেক ছাত্র-ছাত্রীর মনের মধ্যেও এটা কাজ করে। অনেকে আবার কয়েকটি কোচিং সেন্টারে যাতায়াত করেই মনে করে “যথেষ্ঠ হয়েছে। এর চাইতে আর বেশি পরিশ্রম পোশাবে না। এই পরিশ্রমেই ভাল ফল লাভ করা যাবে।
এটা হচ্ছে একধরনের লোভ। অবচেতন মনের মধ্যে বাসা বেঁধে থাকে এই লোভ। এখান থেকে জন্ম নেয় ঈর্ষা, বাসনা ৷
অবচেতন মন শিশুর মতই অবোধ। চেতন মন যুক্তিবাদী। সে বিচার করে অযৌক্তিক অবচেতন মনকে চাপা দিয়ে রাখে। কিন্তু চেতন মন দুর্বল হয়ে পড়লেই অবচেতন মনই তখন চেতনের স্তরেউঠে আসে। তখন যুক্তিতর্ক না শুনে সেই অবচেতন মন চেতন মনের উপর প্রভুত্ বিস্তার করে।
আবার অবচেতন মন যখন বলে আমি পারব না। একাজ আমায় দিয়ে হবে না। চেতন মন বলে, “তোমায় পারতেই হবে।”
মানুষের অসাধ্য কোন কাজ নেই। এইভাবে চেতন মনকে দিয়ে অবচেতন মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হয়। আত্মবিশ্বাস বাড়াবার এটাই মূল উপাদান।