(১) সুইস ব্যাংক কি?
সুইস ব্যাংক কি: ব্যাংক সুইস ব্যাংক বলতে কোন একটি ব্যাংককে বোঝায় না, সুইজারল্যান্ডের ব্যাঙ্কিং নীতিমালার অধীনে পরিচালিত প্রায় ২৫০ টি ব্যাংক এবং আর্থিক সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে সুইস ব্যাংক নামে পরিচিত।
পৃথিবীর শীর্ষ ধনীদের নগদ অর্থ বা সম্পদ জমানোর সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য হলো সুইস ব্যাংক।
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের অসাধু দুর্নীতিবাজ বৃত্তশালীদের টেক্স ফাঁকি দেওয়া অবৈধ সম্পদ জমা রাখার জন্য সুইচ ব্যাংক বিখ্যাত। ৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো গোপনীয়তার সাথে এই কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
সুইজারল্যান্ডের সকল ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে সুইস ফেডারেল ব্যাংকিং কমিশন। সুইস ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট অন্য যেকোনো সাধারণ ব্যাংকের মতোই কাজ করে, তবে এসব ব্যাংকের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মূলধনের সর্বনিম্ন ঝুঁকি এবং গ্রাহকের সর্বোচ্চ গোপনীয়তা।
নিম্নে এই বহুল আলোচিত সুইচ ব্যাংক সম্পর্কে আরও কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো।
(২) সুইস ব্যাংক কোন দেশে অবস্থিত?
সুইস ব্যাংক কোন দেশে অবস্থিত: ব্যাংক সুইস সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত। সুইজারল্যান্ড পশ্চিম-মধ্য ইউরোপ একটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র, এদশের সাথে সমুদ্রের সরাসারি সংযোগ নেই। এই দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য নয়, তাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতিমালা ও সংবিধান এখানে প্রযোজ্য নয়। সুইজারল্যান্ড এর মুদ্রার নাম সুইস ফ্রাংক।
১৯৩৪ সালের একটি সুইস আইন অনুযায়ী সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো আমানতকারের তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চিত করে। সুইস ব্যাংকগুলোর সাথে আমানতকারীদের সম্পর্ক একজন আইনজীবী ও তার মক্কেলের মত, আইনজীবী যেমন মক্কেলের তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখে সুইস ব্যাংকগুলো ঠিক তেমনিভাবে সকল আমানত কারীর তথ্য গোপন রাখতে বাধ্য, এমনকি এসব ব্যাংকে কার কার একাউন্ট আছে সে বিষয়টিও তারা জানায় না।
কোন ব্যাংক যদি আমানতকারীর গোপনীয়তা ভঙ্গ করে নেই সেই ব্যক্তি এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। গোপনীয়তা ভঙ্গের দায়ে একজন সুইস ব্যাংকারের সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদন্ড এবং ৪৫ লক্ষ টাকা জরিমানা হতে পারে।
সুইস ব্যাংকের কঠোর গোপনীয়তা নীতিমালার কারণেই সারা বিশ্বের অবৈধ অর্থ পাচারের প্রধান গন্তব্যে পরিণত হয়েছে সুইস ব্যাংক।
গোপনীয়তা ছাড়াও সুইস ব্যাংকের আরও বেশকিছু সুবিধা আছে যে কারণে পৃথিবীর শীর্ষ ধনকুবেররা এখানে তাদের অর্থ জমা করে।
সুইজারল্যান্ডের মুদ্রার নাম সুইচ ফ্রাঙ্ক এটি পৃথিবীর অন্যতম স্থিতিশীল মুদ্রা। সুইস ফ্রাঙ্ক এর মুদ্রাস্ফীতি নেই বললেই চলে বরং দিন দিন এই মুদ্রার মান বেড়েই চলেছে।
বিগত শতকের তিরিশের দশকে ঘটা মহামন্দার ফলে সারা বিশ্বের মতো সুইজারল্যান্ডের অর্থনীতিও ২০ শতাংশ হ্রাস পায়। এর পর থেকেই তারা কঠোর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সুইজারল্যান্ডের অর্থনীতি ও প্রশাসনিক কাঠামো সর্বোচ্চ স্থিতিশীল রাখার চেষ্টায় সফল।
এছাড়া সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকাররাও বেশ দক্ষ, তারা জানে ব্যাংকের টাকা কোথায় বিনিয়োগ করে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হবে।
অনেক দেশেই মানুষ অধিক সুদের আশায় ব্যাংকে টাকা রাখে কিন্তু সুইস ব্যাংকের সুদের হার মাত্র ০.৭৫%, এখানে সুদের হার শুধু কমই নয় বরং অনেক ক্ষেত্রে মাইনাসে পর্যন্ত যেতে পারে অর্থাৎ আপনার টাকা জমা রাখার জন্য উল্টো ব্যাংকেই সুদ দিতে হবে।
(৩) সুইস ব্যাংকে একাউন্ট খুলতে কত টাকা লাগে?
সুইস ব্যাংকে একাউন্ট খুলতে কত টাকা লাগে: সুইস ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলাটাও সহজ নয়, সাধারণত ব্যাংক একাউন্ট খুলতে হলে আপনাকে অবশ্যই সশরীরে কোন সুইচ ব্যাংকে যেতে হবে, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য নূন্যতম ১ লক্ষ ইউএস ডলার জমা রাখতে হয়।
আমরা যদি ১ ডলার = ১৩০ টাকা ধরি, তবে ১ লক্ষ ডলার = বাংলাদেশী টাকায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকার সমান। এছাড়াও অ্যাকাউন্ট রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাৎসরিক ২৬ হাজার টাকা চার্জ কাটা হয়।
একজন আমানতকারীর সকল সম্পদ এবং অর্থের উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর একাউন্ট খোলার অনুমতি দেওয়া হয়, তবে সত্যিকার অর্থে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া ব্যবসায়ী, দুর্নীতি পরায়ণ রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা এবং অসাধারণ লোকেরা তাদের সম্পদের পাহাড় গড়েছে সুইস ব্যাংকগুলোতে।
বিদেশি অপরাধীদের শনাক্ত করতে কিছু ক্ষেত্রে সুইস ব্যাংকগুলো তাদের গোপনীয়তা শিথিল করে, যেমন কারো বিরুদ্ধে অর্থ পাচার, কর ফাঁকি বা দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলা থাকলে ব্যাংকগুলোর তথ্য প্রকাশ করতে পারে।
(৪) সুইজারল্যান্ডের এক টাকা বাংলাদেশের কত টাকা?
২০১৯ সালে, সুইজারল্যান্ডের এক টাকা বাংলাদেশের ৮৭ টাকা।
২০২০ সালে, সুইজারল্যান্ডের এক টাকা বাংলাদেশের ৯৬ টাকা।
২০২১ সালে, সুইজারল্যান্ডের এক টাকা বাংলাদেশের ৯৬ টাকা।
২০২২ সালে, সুইজারল্যান্ডের এক টাকা বাংলাদেশের ১১২ টাকা।
২০২৩ সালে, সুইজারল্যান্ডের এক টাকা বাংলাদেশের ১৩০ টাকা।
(৫) সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের টাকার পাহাড়
শুধুমাত্র ২০১৯ সালে বাংলাদেশীরা ৫৫০০ কোটি টাকা সুইস ব্যাংকে জমা করেছে। এ সময় বিভিন্ন দেশ থেকে সুইস ব্যাংকে জমাকৃত অর্থের বিচারে ভারতের অবস্থান ৭৭ তম বাংলাদেশের অবস্থান ৮৫ তম এবং পাকিস্তানের অবস্থান ৯৯ তম।
২০২৩ সালে দাড়িয়ে বলা যায় যে, স্বল্পউন্নোত দেশেরগুলো থেকে পাচার হওয়া টাকার বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম দিকে। বিগত ১ যুগ সময়ে বাংলাদেশের কয়েক বছরের জাতীয় বাজেটের সমপরিমাণ অর্থ শুধুমাত্র সুইজারল্যান্ডে পাচার করা হয়েছে, এত বিপুল পরিমাণ টাকার যদি কর দেওয়া হত তাহলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের বাজেট কয়েক গুণ বাড়ানো যেত।
সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো কালো টাকা নিরাপদে রাখার জন্য কুখ্যাত হলেও তথাকথিত উন্নত জীবনযাত্রার কারণে দেশটি বিশ্ব বিখ্যাত। পৃথিবীর শীর্ষ ১০ টি বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় সুইজারল্যান্ডেরই আছে তিনটি শহর। এছাড়া অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ হলো সুইজারল্যান্ড।