Skip to content

(১৪টি) মনের রোগ সারানোর উপায় বা মনের রোগের চিকিৎসা

(১৪টি) মনের রোগ সারানোর উপায় বা মনের রোগের চিকিৎসা

নিম্নে ইসলামের আলোকে ১৪টি মনের রোগ সারানোর উপায় বা মনের রোগের চিকিৎসা তুলে ধরা হলো-

ইসলামের আলোকে ১৪টি মনের রোগ সারানোর উপায় ও মনের রোগের চিকিৎসা

(১) রিয়া বা লোক দেখানোর মনোভাব

ইবাদত ও আল্লাহর আনুগত্যের কাজে এই উদ্দেশ্য রাখা যে, এতে মানুষের চোখে আমার সম্মান বৃদ্ধি পাবে- একে বলে রিয়া বা লোক দেখানো। এটা মহাপাপ।

রিয়া নানা ভাবে হয়ে থাকে- কখনও মুখে বলে, কখনও অঙ্গ- প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে, কখনও হাটা, চলা, ভাব-ভঙ্গি, আওয়াজ ইত্যাদির মাধ্যমে, কখনও পোশাক-পরিচ্ছদের মাধ্যমে, কখনও ইবাদত সুন্দর ও দীর্ঘভাবে আদায়ের মাধ্যমে ইত্যাদি।

মোটকথা- ইবাদত ও আনুগত্যের কাজে যে কোন ভাবে মাখলূকের প্রতি নজর রাখা হল রিয়া।

এমনকি লোকে দেখবে- এজন্য ইবাদত গোপনে করার প্রতি জোর দেয়াও রিয়া। কেননা গোপনে ইবাদত করার প্রতি জোর সে-ই দিবে যার নজর মাখলূকের প্রতি রয়েছে। কেউ দেখবে কি দেখবে না এই চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়াই হচ্ছে পূর্ণ রিয়া থেকে মুক্তি এবং এটাই হল পূর্ণ এখলাস।

এখানে উল্লেখ্য যে, আমার নেক কাজ দেখে অন্য কেউ তা করতে উদ্বুদ্ধ হবে- এরূপ চেতনা থেকে নেক কাজ প্রকাশ্যে করলে তা রিয়া বলে গণ্য হবে না। এমনিভাবে আমাকে কেউ নেক কাজ করতে দেখলে স্বভাবতঃ আমার মন যে খুশি হয় এই ভেবে যে, আলহামদু লিল্লাহ লোকটা আমাকে ভাল অবস্থায় দেখেছে- এটাও রিয়া নয় বরং রিয়া হল এই চিন্তা এবং এই খুশি যে, প্রকাশ্যে ইবাদত করলে মানুষের কাছে আমার সুনাম হবে, আমার প্রতি লোকদের ভক্তি বৃদ্ধি পাবে ইত্যাদি।

এই রিয়া অত্যন্ত সাংঘাতিক রোগ, এতে আল্লাহর সন্তুষ্টির স্থলে মানুষের সন্তুষ্টিকে স্থান দেয়া হয়। তাই রিয়াকে এক ধরনের শিক (শিরকে আছগর বা ছোট শির্ক) বলা হয়।

রিয়া বা লোক দেখানোর মনোভাব থেকে মুক্তির উপায় হলো-

  1. সম্মান-প্রীতি অন্তর থেকে বের করতে হবে।
  2. রিয়ার চেতনা এসে গেলেও তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করবে না বরং সহীহ নিয়ত অন্তরে উপস্থিত করে কাজ করে যেতে থাকবে, এভাবে আস্তে আস্তে সেটা আদত বা অভ্যাসে পরিণত হবে এবং আদত থেকে ইবাদত ও এখলাসে পরিণত হবে।
  3. যে ইবাদত প্রকাশ্যে করার বিধান, তাতো প্রকাশ্যেই করতে হবে, এ ছাড়া অন্যান্য ইবাদত প্রকাশ করারও নিয়ত রাখবে না, গোপন করারও উদ্যোগ নিবে না ৷

(২) হুব্বে জাহ্ (প্রশংসা ও যশ-প্রীতি)

প্রশংসা, সুনাম ও সম্মানের লোভকে বলা হয় হুব্বে জাহ। এ লোভ মনে এলে অন্যের প্রশংসা, সুখ্যাতি ও সম্মান দেখে মনে আগুন জ্বলে উঠে এবং হিংসা লাগে আর অন্যের অপমান বা পরাজয়ের কথা শুনে মনে আনন্দ জন্মে। এমনি ভাবে অনেক খারাবী এ রোগের কারণে দেখা দেয়।

প্রশংসা ও যশ-প্রীতি রোগের প্রতিকার হলো-

  1. এই চিন্তা করা যে, আমি যাদের নিকট ভাল হতে চাই তারাও থাকবে না আমিও থাকব না। অতএব, এমন অসার জিনিসের প্রতি মন লাগানো নির্বুদ্ধিতা বৈ কি?
  2. এমন কোন কাজ করা, যা শরী’আতের খেলাফ নয় কিন্তু লোক চোখে সেটা লজ্জাজনক, যেমন বাড়ির কোন নগন্য জিনিস বিক্রি করা ইত্যাদি।

(৩) দুনিয়া এবং মালের মহব্বত

টাকা-পয়সার লোভ এত বড় খারাপ জিনিস যে, একবার তা মনে ঢুকলে সেখানে আল্লাহর মহব্বত ও আল্লাহর স্মরণ থাকতে পারে না। এমনি ভাবে ঘর-বাড়ি, বাগ-বাগিচা, আসবাব-পত্র, কাপড়-চোপড়, ইত্যাদির মহব্বত এক কথায় দুনিয়ার মহব্বত তথা আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য সব কিছুর মহব্বত এমন এক জঞ্জাল, যার মধ্যে আল্লাহর মহব্বত থাকতে পারে না।

এই দুনিয়ার মহব্বতের কারণে মানুষ হক-নাহক, হালাল-হারাম ও সত্য-মিথ্যার বিচার হারিয়ে ফেলে। এমনকি মৃত্যুর সময় আল্লাহর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে ঈমান হারা অবস্থায়ও মৃত্যুবরণ করতে পারে। নাউযুবিল্লাহি মিন যালিকা।

তবে উল্লেখ্য যে, ধন-সম্পদ, মাল-আসবাব ইত্যাদির প্রতি স্বভাবগত ভাবে মানুষের কিছু আকর্ষণ থাকে। এটা শরী’আতে নিন্দনীয় নয়। এমনিভাবে শরী’আত সম্মত পদ্ধতিতে সম্পদ উপার্জন করাও নিন্দনীয় নয় বরং নিন্দনীয় হল যদি কেউ সম্পদের প্রতি মনের আকর্ষণকে এতটা বল্গাহীন ছেড়ে দেয় বা এমন ভাবে সম্পদ উপার্জনে মত্ত হয় যে, আল্লাহর হুকুম-আহকামের পরোয়া থাকে না এবং আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের আদর্শের চেয়ে সেটাকে প্রাধান্য দেয়া হয়।

দুনিয়া এবং মালের মহব্বত রোগের প্রতিকার হলো-

  1. এ সব কিছু একদিন ছেড়ে যেতে হবে এবং মৃত্যুবরণ করতে হবে- একথা বেশী বেশী স্মরণ করা।
  2. ব্যবসা-বাণিজ্য, জায়গা-জমি, আসবাবপত্র, মানুষের সঙ্গে দুস্তী-মহব্বত, আলাপ-পরিচয় জরূরতের চেয়ে বেশী না করা।
  3. অপব্যয় না করা। কেননা অপব্যয় থেকে আয় বৃদ্ধির লোভ জন্মে।
  4. সাধারণ খাওয়া পরার অভ্যাস করা।
  5. দরিদ্রদের সংসর্গ গ্রহণ ও ধনীদের সংসর্গ বর্জন করা।
  6. দুনিয়াত্যাগী বুযুর্গদের জীবনী পাঠ করা।
  7. যে জিনিসের প্রতি মন বেশী লেগে যায়, তা হয় কাউকে দিয়ে দেয়া (দান স্বরূপ দিতে মনে না চাইলে অন্ততঃ যাকাত সদকা স্বরূপ হলেও দিয়ে দেয়া) কিংবা বিক্রি করে দেয়া।

(৪) বুখ্‌ল বা কৃপণতা

শরী’আতের আলোকে যেখানে ব্যয় করা জরুরী বা মানবিক কারণে যেখানে ব্যয় করা জরুরী, সেখানে ব্যয় করতে সংকীর্ণতা করাকে বলা হয় বুল বা কার্পণ্য। প্রথম স্থানে ব্যয় না করা গোনাহ আর শেষোক্ত স্থানে ব্যয় না করা গোনাহ নয় তবে খেলাফে আওলা বা অনুত্তম।

এই কৃপণতা এত খারাপ জিনিস যে, এর কারণে অনেক ফরয ওয়াজিব পর্যন্ত আদায় হয় না। যেমন- যাকাত দেয়া, কুরবানী করা, অভাবীকে সাহায্য করা, গরীব আত্মীয়-স্বজনের উপকার করা ইত্যাদি আদায় না হওয়া। এগুলো হল দ্বীনী ক্ষতি। আর কৃপণকে সকলে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে এটা হল পার্থিব একটা বড় ক্ষতি।

কৃপণতা রোগের প্রতিকার হলো-

  1. দুনিয়ার মহব্বত ও মালের মহব্বত অন্তর থেকে বের করতে হবে। (দেখুন এই পোষ্টের উপরিভাগ)
  2. প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস মনে না চাইলেও মনের উপর জোর দিয়ে সেটা কাউকে দিয়ে দেয়া। কৃপণতা দূর না হওয়া পর্যন্ত এরূপ করতে থাকা।

(৫) হির্ছ বা লোভ-লালসা

অর্থ-সম্পদ, মান-সম্মান ইত্যাদির প্রতি মনের লোভকে বলা হয় হিছ। প্রশংসা ও যশ-প্রীতি এবং দুনিয়া ও মালের মহব্বত পরিচ্ছেদে বর্ণিত চিকিৎসাই এ রোগের চিকিৎসা।

এছাড়া এই চিন্তা করতে হবে যে, লোভী ব্যক্তি সর্বদা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে থাকে।

এখানে উল্লেখ্য যে, শরী’আতের দৃষ্টিতে পছন্দনীয় জিনিসের প্রতি লোভ বা আগ্রহ নিন্দনীয় নয় বরং তা পছন্দনীয়।

(৬) এশ্রাফে নফছ

কারও থেকে কিছু পাওয়ার আশায় এমনভাবে অপেক্ষায় থাকা যে, তা না পেলে মন খারাপ হয়ে যায় এবং যার থেকে পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল তার প্রতি রাগ জন্মে, এটাকে বলা হয় এশ্রাফে নফ্‌ছ। এ-ও এক প্রকারের হিছ বা লোভ এবং এটা তাওয়াক্কুল পরিপন্থী হওয়ার কারণে নিন্দনীয়।

তবে শুধু যদি পাওয়ার চিন্তা মনে উদয় হয় কিন্তু না পেলে মনে কষ্ট আসে না বা তার প্রতি রাগ জন্মে না, তাহলে এতটুকু গর্হিত নয়। এমনিভাবে কোন পেশাদার যে গ্রাহকের অপেক্ষায় থাকে তাও এশ্রাফে নক্‌ছের অন্তর্ভুক্ত নয়। যেমন- ডাক্তার রোগীর অপেক্ষায় থাকে ইত্যাদি।

হিছ বা লোভ-লালসার প্রতিকার যা, এ রোগের প্রতিকারও তাই।

(৭) তাকাব্বুর বা অহংকার

জ্ঞান-বুদ্ধি, ইবাদত-বন্দেগী, মান-সম্মান, ধন-দৌলত ইত্যাদি যে কোন দ্বীনী বা দুনিয়াবী গুণে নিজেকে বড় মনে করা এবং সেই সাথে অন্যকে সে ক্ষেত্রে তুচ্ছ মনে করাকে বলে তাকাব্বুর বা অহংকার।

অহংকার গোনাহে কবীরা। কেউ এ রোগে আক্রান্ত হলে সে কারও উপদেশ গ্রহণ করে না, কারও সৎপরামর্শও গ্রহণ করে না। এ রোগ হক ও সত্য গ্রহণের পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা। এ হল দ্বীনী ক্ষতি।

আর অহংকারীকে মনে প্রাণে সকলে ঘৃণা করে এবং সময় সুযোগে তার থেকে প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করে, এভাবে দুনিয়াতেও সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।

এ সব কিছুর প্রেক্ষিতে তাকাব্বুর বা অহংকারকে সর্বরোগের মূল বলা হয় এবং তাকাব্বুর হারাম ও বড় গোনাহ।

অহংকার রোগ থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো-

নিজের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা যে, আমি তুচ্ছ পানি থেকে তৈরী এবং বর্তমানেও আমার পেটে নাপাক ভরা, চোখে মুখে ও নাকের ভিতর ময়লা ভরা। আর মৃত্যুর পর আমার সব কিছু পঢ়ে গলে দুর্গন্ধময় হয়ে যাবে। ইত্যাদি।

এ কথা চিন্তা করা যে, সমস্ত গুণ মূলতঃ আল্লাহই একান্ত দান, আমার বুদ্ধি বা বাহু বলে তা অর্জিত হয়নি, নতুবা আমার চেয়ে কত বুদ্ধিমান বা শক্তিশালী ব্যক্তি এ গুণ অর্জন করতে পারেনি। অতএব আল্লাহর অনুগ্রহে যা অর্জিত হয়েছে তার জন্য আমার অহংকার বা বড়ত্ববোধ করা বোকামী বৈ কি? বরং এর জন্য আল্লাহর সামনে আমার বিনয়ী হওয়া উচিত।

এছাড়াও-

  1. যাকে ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ মনে হবে, মনে না চাইলেও জোর জবরদস্তী তার সাথে নম্র ব্যবহার করতে হবে।
  2. অভাবী ও গরীব শ্রেণীর লোকদের সঙ্গে বেশী উঠা-বসা রাখবে।
  3. মৃত্যুকে বেশী বেশী স্মরণ করবে।
  4. নিজের দোষ-ত্রুটি, নিন্দা-অপবাদ শুনেও প্রতিবাদ না করা।
  5. ক্রোধ প্রকাশ পেলে ক্ষমা চেয়ে নেয়া (ছোটদের থেকে হলেও)।
  6. একান্ত প্রয়োজন ছাড়া নিজের ছোট খাট কাজ নিজেই করা, মজদুর বা চাকর-নওকর না লাগানো।
  7. সকলকে আগে সালাম দেয়া।
  8. তাকাব্বুর দুর করার সবচেয়ে উত্তম পন্থা হল তাকাব্বুরের ধরন ও বিবরণ জানিয়ে হক্কানী পীর ও শায়খে তরীকত থেকে উপযুক্ত ব্যবস্থা জেনে সে অনুযায়ী আমল করা।

(৮) উজ্জ্ব বা আত্মগর্ব

“অহংকার”-এর সংজ্ঞায় নিজেকে বড় মনে করার সাথে সাথে অন্যকে ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ মনে করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কেউ যদি কোন বিষয়ে অন্যকে তুচ্ছ মনে না করে শুধু নিজেকে বড় মনে করে গর্ববোধ করে, তাহলে সেটাকে বলা হয় উজ্জ্ব বা আত্মগর্ব। আত্মগর্ব করাও গোনাহে কবীরা।

উজ্জ্ব বা আত্মগর্ব রোগের প্রতিকার হলো-

  1. নিজের দোষ-ত্রুটি চিন্তা করে দেখা।
  2. গুণকে আল্লাহর দান মনে করা।
  3. উক্ত দানের জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করা।
  4. এই আশংকা রাখা যে, আল্লাহর শক্তি আছে যে কোন সময় তিনি এটা ছিনিয়ে নিতে পারেন।
  5. দু’আ করা যেন আল্লাহ উক্ত দান থেকে মাহরূম না করেন, সেটা যেন ছিনিয়ে না নেন।

(৯) রাগ বা গোস্বা

প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য রক্তের মধ্যে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় তাকে বলে রাগ বা গোস্বা। এই রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মানুষের বুদ্ধি ঠিক থাকে না, তখন মুখ দিয়েও অনেক অন্যায় কথা বের হয়ে যায়। আবার অনেক অন্যায় কাজও করে ফেলে এবং পরিণামে অনেক ক্ষতি ও লজ্জার

সম্মুখীন হতে হয়। রাগ স্বভাবগত বিষয়, এর জন্য মানুষ দায়ী নয়। তবে রাগ চরিতার্থ করা না করা মানুষের ইচ্ছার অধীন, তাই এর জন্য সে দায়ী।

রাগ দমনের পন্থা হলো-

  1. রাগ হলেই আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রজীম পড়ে নেয়া।
  2. চিন্তা করা।
  3. যার উপর রাগ হয় তাকে সম্মুখ থেকে সরিয়ে দেয়া বা নিজে অন্যত্র সরে যাওয়া।
  4. তারপর এ চিন্তা করা যে, সে আমার নিকট যতটুকু অপরাধী, আমি আল্লাহর নিকট তার চেয়ে বেশী অপরাধী। আমি যেমন চাই আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন আমারও তেমন উচিত তাকে ক্ষমা করা।
  5. এতেও রাগ না গেলে দাঁড়ানো থাকলে বসে পড়বে, বসে থাকলে শুয়ে পড়বে।
  6. তাতেও রাগ না গেলে ঠাণ্ডা পানি পান করবে বা উযূ কিংবা গোসল করে নিবে।
  7. স্বভাবগতভাবে যিনি বেশী রাগী, তার রাগ দমনের পন্থা হল- যার উপর রাগ হয় রাগ ঠাণ্ডা হওয়ার পর জনসমক্ষে তার হাত পা ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, তার জুতা সোজা করে দিবে। দু একবার এরূপ করলেই রাগের হুশ ফিরে আসবে।
  8. এই চিন্তা করবে যে, ল্লাহ্র ইচ্ছা ব্যতীত কিছুই আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সংঘর্ষ করার কে?

বিঃদ্রঃ রাগ সব স্থানেই নিন্দনীয় নয় বরং কোন কোন ক্ষেত্রে জায়েয বরং জরুরী হয়ে পড়ে। অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে রাগ শক্তির ব্যবহার করা অনেক সময় ওয়াজিব হয়ে দাঁড়ায়। আর রাগ দমন করার গুণটি যখন স্বভাবে পরিণত হয় এবং স্থায়িত্ব লাভ করে তখন সেটাকে বলা হয় সহনশীলতা। আল্লাহর নিকট এই সহনশীলতার গুণ অনেক পছন্দনীয়।

(১০) বুগ্য (বিদ্বেষ/মনোমালিন্য) ও স্বভাব সংকোচন

রাগ চরিতার্থ করতে না পারলে রাগ দমনের দ্বারা মনের মধ্যে ক্ষোভ, মনস্তাপ ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয় এবং অন্য ভাবে তার প্রতিশোধ নেয়ার চিন্তা-ভাবনা ও অন্য ভাবে তাকে কষ্ট দেয়ার প্রয়াস জাগে। এই প্রয়াস বা মনোভাবকে বলা হয় বুগ্য বা কীনা।

আর অন্য ভাবে প্রতিশোধ গ্রহণের মনোভাব যদি জাগ্রত না হয় কিংবা সেরূপ উদ্যোগ গ্রহণের চিন্তা ভাবনা না আসে বরং রাগের কারণে মনের মধ্যে শুধু একটা সংকীর্ণতা সৃষ্টি হয় এবং যার উপর রাগ হয় তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতে মন চায় না, তাহলে সেটাকে বলে ইন্‌কিবাযে তব্‌য়ী বা ‘স্বভাব সংকোচন’, সেটা নিন্দনীয় নয়। কারণ সেটা স্বভাবগত বিষয়, যা ইচ্ছার অধীন নয়।

তবে কারও ব্যাপারে স্বভাবের মধ্যে সংকোচন ভাব আসলে সেটা দূর করার জন্য কখনও কখনও এই ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে যে, তাকে বলে দিবে আপনার এই কথা বা আচরণে আমার কষ্ট লেগেছে। এতে অন্তর পরিস্কার হযে যাবে।

উল্লেখ্য যে, বিদ্বেষ ও শত্রুতা যদি পার্থিব কোন বিষয়ের কারণে হয় তবেই তা নিন্দনীয় ও গর্হিত। পক্ষান্তরে কোন মুসলমান দ্বীনের কারণে আল্লাহর ওয়াস্তে যদি কারও সাথে বিদ্বেষ বা শত্রুতা রাখে তবে তা নিন্দনীয় নয় বরং প্রশংসনীয় ও উত্তম।

বুগ্য/কীনা বা বিদ্বেষ/মনোমালিন্য রোগের প্রতিকার হলো-

  1. যার প্রতি বিদ্বেষ হয় তাকে ক্ষমা করে দেয়া।
  2. মনে না চাইলেও তার সাথে মেলামেশা অব্যাহত রাখা।

(১১) হাছাদ (হিংসা বা পরশ্রীকাতরতা) ও গেবতা

কারও জ্ঞান, বুদ্ধি, সম্পদ, মান-ইজ্জত, সুখ-স্বাচ্ছন্দ ইত্যাদি ভাল কিছু দেখে মনে কষ্ট লাগা এবং আকাংখা হওয়া যে, সেটা না থাকুক বা ধ্বংস হয়ে যাক এবং তা হলেই মনে আনন্দ লাগা- এই মনোবৃত্তিকে বলা হয় হাছাদ (হিংসা বা পরশ্রীকাতরতা)।

সাধারণতঃ তাকাব্বুর (নিজের বড়ত্ববোধ) বা শত্রুতা থেকে এই মনোভাব সৃষ্টি হয় কিংবা কারও মন যদি খবীছ হয় তাহলেও এই মনোবৃত্তি জাগতে পারে।

হাছাদের কারণে নেক আমল নষ্ট হয়ে যায় এবং আল্লাহর ক্রোধের পাত্র হতে হয়। হিংসুক ব্যক্তি চিরকাল মনের কষ্টে কাল যাপন করতে থাকে, জীবনে কখনও মনে শান্তি পায় না।

এখানে উল্লেখ্য যে, কারও ভাল কিছু দেখে সেটা ধ্বংসের কামনা না করে শুধু নিজের জন্য অনুরূপ হয়ে যাওয়ার কামনা করা গর্হিত নয় বরং এরূপ কামনা করার ক্ষেত্রে মাসআলা হল সেটা ওয়াজিব পর্যায়ের বিষয় হলে এরূপ কামনা করা ওয়াজিব, মোস্তাহাব পর্যায়ের হলে মোস্তাহাব আর মোবাহ পর্যায়ের হলে মোবাহ ৷ এটাকে হাছাদ নয় বরং গেবতা বলা হয়।

হিংসা বা পরশ্রীকাতরতা রোগের প্রতিকার হলো-

  1. যার প্রতি হাছাদ বা হিংসা হয়, মনে না চাইলেও লোক সমাজে তার প্রশংসা করা।
  2. যার যে নেয়ামতের কারণে হাছাদ হয়, সেটা তার জন্য আরও বৃদ্ধি পাক আল্লাহর কাছে এই দুআ করতে থাকা।
  3. মনে না চাইলেও দেখা হলে তাকে সালাম করা, তার প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা দেখানো এবং নম্র ব্যবহার করা।
  4. মাঝে মধ্যে তাকে হাদিয়া প্রদান করা।

বিঃদ্রঃ কোন কাফের, মুরতাদ, ফাসেক ও বেদআতী লোকের কোন বিষয় সম্পদ ও নেয়ামত অর্জিত হলে এবং সে তা দ্বারা ফেতনা ফাসাদ ও দ্বীনের ক্ষতি করতে থাকলে তার সে সম্পদ ও নেয়ামত ধ্বংস হওয়ার কামনা করা নিন্দনীয় নয় বরং কোন কোন অবস্থায় তা উত্তম ইবাদত বলে গণ্য হবে।

(১২) বদগোমানী বা কু-ধারণা রোগ

যে সব মুসলমান বাহ্যিক অবস্থার দিক দিয়ে সৎকর্মপরায়ণ ও নেককার বলে মনে হয়, তার সম্পর্কে কোন প্রমাণ ব্যতীত কুধারণা পোষণ করা হারাম ও গোনাহে কবীরা।

বদগোমানী রোগের প্রতিকার হলো-

  1. নির্জনে বসে এই চিন্তা করা যে, কু-ধারণা পোষণ করতে আল্লাহ পাক নিষেধ করেছেন। এটা করলে আল্লাহর আযাবের আশংকা রয়েছে। হে আমার নফস, তুমি কিভাবে আযাব বরদাশ্ত করবে?
  2. তওবা করবে।
  3. আল্লাহর নিকট অন্তর সাফ হয়ে যাওয়ার জন্য দু’আ করবে।
  4. যার প্রতি কু-ধারণা হয়েছে তার উভয় জগতের কামিয়াবী ও সুখ-শান্তির জন্য দু’আ করবে।
  5. প্রতিদিন তিনবার উপরোক্ত আমল সমূহ একাধারে তিন দিন করার পরও যদি মন থেকে কু-ধারণা না যায়, তাহলে যার প্রতি কু-ধারণা হয়েছে তাকে যেয়ে বলবে যে, অহেতুক আপনার প্রতি আমার বদগোমানী হয়েছে, আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার জন্য দু’আ করুন যেন আমার মন থেকে এটা দূর হয়ে যায়।

(১৩) গোনাহের প্রতি আকর্ষণ

তাকওয়া বা পরহেযগারীর স্বাদ এবং নূর ভেতরে না থাকার কারণে গোনাহের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়- বিকর্ষণ সৃষ্টি হয় না। তাকওয়ার স্বাদ অর্জিত হলে গোনাহের প্রতি বিকর্ষণবোধ সৃষ্টি হবে এবং গোনাহ করতে তখন খারাপ লাগবে। অতএব গোনাহের প্রতি আকর্ষণ-রোগের চিকিৎসা হল তাকওয়া অর্জনের পন্থা গ্রহণ করা।

গান বাদ্যের প্রতি আকর্ষণ থাকলে, অশ্লীল নভেল নাটক, খেলাধূলা ইত্যাদির প্রতি আকর্ষণ থাকলে তার জন্য ইুতপূর্বে ‘কয়েকটি বদ অভ্যাস ও পাপ এবং তা বর্জনের উপায়’ শীর্ষক পোষ্টে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

(১৪) অবৈধ প্রেম

কোন নারী বা বালকের অবৈধ প্রেমে পড়লে তা থেকে পরিত্রাণের জন্য যা যা করতে হবে

  • প্রথমতঃ বুঝতে হবে যে, সাহস কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করা ব্যতীত কোন সহজ কাজও হয় না। শরীরের সামান্য রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে গেলেও তিক্ত ঔষধ সেবন করতে হয়। জাহিরী রোগের যখন এই অবস্থা, তখন অভ্যন্তরীণ রোগের ক্ষেত্রেতো আরও বেশী ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকারের জন্য মনকে প্রস্তুত করতে হবে।
  • তার সাথে কথা-বার্তা, দেখা-শুনা, আসা-যাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে হবে। অন্য কেউ তার আলোচনা করলে তাকে বাধা দিতে হবে এবং লৌকিকভাবে হলেও যার প্রেমে পড়েছে পরিকল্পিতভাবে এক এক বাহানায় তার সমালোচনা করতে থাকবে।
  • একটা নির্জন সময়ে গোসল করে পরিষ্কার কাপড় পরিধান করে আতর ও সুগন্ধি মেখে দুই রাকআত তওবার নামায পড়বে এবং কেবলামুখী অবস্থায় বসে খুব তওবা এস্তেগফার করে এই বিপদ থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর নিকট দু’আ করবে এবং পাঁচশত থেকে এক হাজার বার লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ এর যিকির করবে। লা-ইলাহা বলার সময় ঘাড় ডান দিকে ঘুরাবে এবং এই ধ্যান করবে যে, আল্লাহ ব্যতীত সবকিছুকে অন্তর থেকে বের করে দিলাম। অতঃপর ইল্লাল্লাহ বলার সময় বাম স্তনের সামান্য নীচের দিকে খেয়াল করে মাথা সেদিকে স্বজোরে ঝুকাবে আর ধ্যান করবে যে, আল্লাহর মহব্বত অন্তরে গেঁথে দিলাম।
  • যে বুযুর্গের প্রতি ভক্তি আছে তাঁর সম্পর্কে এই কল্পনা করবে যে, তিনি আমার অন্তরের মধ্যে বসে আমার অন্তর থেকে সব জঞ্জাল ধীরে ধীরে বাইরে নিক্ষেপ করছেন।
  • দোযখের বর্ণনা এবং আল্লাহর নাফরমানীর কারণে আল্লাহ কিরূপ অসন্তুষ্ট হন-এ জাতীয় বর্ণনা যে কিতাবে আছে এমন কোন কিতাব বা হাদীছের গ্রন্থ পাঠ করবে।
  • একটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্জনে বসে এ চিন্তা করবে যে, আমি কিয়ামতের ময়দানের আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান রয়েছি আর আল্লাহ আমাকে ধমক দিয়ে বলছেন, “হে বেহায়া, বেশরম! তোমার লজ্জা হয় না, আমাকে ছেড়ে একটা মুরদার দিকে ঝুঁকে পড়লে? এর জন্য তোমাকে আমি পয়দা করে ছিলাম? বেহায়া, আমার দেয়া চোখ আমার দেয়া অন্তরকে তুমি আমার নাফরমানীর কাজে ব্যবহার করলে? তোমার শরম হয় না? ইত্যাদি ইত্যাদি।

বিঃদ্রঃ এ সব আমল করতে থাকবে, ফল পেতে দেরী হলেও পেরেশান হবে না। চেষ্টাতেও তো ছওয়াব পাওয়া যাবে।

Tags:

Leave a Reply

nv-author-image

শাহরিয়ার হোসেন

আমি শাহরিয়ার হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি। বর্তমানে আমি একজন ফুল-টাইম ব্লগার এবং ডিজিটাল কনটেন্ট ক্রিয়েটর। আমি প্রতিনিয়ত মানুষের জন্য উপকারী নতুন কিছু লেখার চেষ্টা করি। আশা করি, সবাই আমাকে আপনাদের দোয়ায় রাখবেন। ধন্যবাদ।View Author posts