(১) আখলাক শব্দের অর্থ কী?
আখলাক আরবি শব্দ। এটি বহুবচন। এক বচন খুলুকুন। এর আভিধানিক অর্থ- স্বভাব, চরিত্র, ইত্যাদি।
শব্দগত বিবেচনায় আখলাক বলতে সচ্চরিত্র ও দুশ্চরিত্র উভয়কেই বোঝায়। তবে প্রচলিত অর্থে আখলাক শুধু সচ্চরিত্রকেই বুঝায়। যেমন ভালো চরিত্রের মানুষকে আমরা চরিত্রবান বলি। আর মন্দ চরিত্রের মানুষকে বলি চরিত্রহীন। ব্যবহারিক বিবেচনায় আখলাক দ্বারা ভালো ও উত্তম চরিত্রকে বোঝানো হয়।
(২) আখলাক কাকে বলে?
মূলত আখলাক হলো মানুষের স্বভাবসমূহের সমন্বিত রূপ। মানুষের আচার-আচরণ, চিন্তা-ভাবনা, মানসিকতা, কর্মপন্থা সবকিছুকে একত্রে চরিত্র বা আখলাক বলা হয়। তা ভালো কিংবা মন্দ হতে পারে। এককথায়, মানুষের সকল কাজ ও নীতির সমষ্টিকেই আখলাক বলা হয়।
(৩) আখলাক এর গুরুত্ব
আখলাকে হামিদাহ মানবীয় মৌলিক গুণ ও জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এর দ্বারাই মানুষ পূর্ণমাত্রায় মনুষ্যত্বের স্তরে উপনীত হয়। মানবিকতা ও নৈতিকতার আদর্শ আখলাকে হামিদাহর মাধ্যমেই পরিপূর্ণতা লাভ করে। মানুষের ইহ ও পরকালীন সুখ, শান্তি উত্তম আখলাকের উপরই নির্ভরশীল।
সৎচরিত্রবান ব্যক্তি যেমন সমাজের চোখে ভালো তেমনি মহান আল্লাহর নিকটও প্রিয়।
মহানবি (সাঃ)-এর হাদিসে বলা হয়েছে,
“আল্লাহ তায়ালার নিকট সেই লোকই অধিক প্রিয়, চরিত্রের বিচারে যে উত্তম।”
(ইবনে হিব্বান)
এ জন্য মানুষকে আখলাক শিক্ষা দেওয়াও নবি-রাসুলগণের অন্যতম দায়িত্ব ছিল। আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। সব ধরনের সৎগুণ তাঁর চরিত্রে পাওয়া যায়।
স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রসঙ্গে বলেছেন,
“নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের ধারক।”
(সূরা আল কালাম, আয়াত ৪)
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ঘোষণা করেছেন,
“উত্তম চারিত্রিক গুণাবলিকে পূর্ণতা দানের জন্যই আমি প্রেরিত হয়েছি।”
(বায়হাকি)
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) নিজে যেমন উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন তেমনি মানবজাতিকে সচ্চরিত্র গঠনের শিক্ষা দিয়েছেন। পূর্ণাঙ্গ মুমিন হওয়ার জন্য তিনি সৎ ও নৈতিক স্বভাব অনুশীলনের নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন,
“মুমিনগণের মধ্যে সেই পূর্ণ ইমানের অধিকারী, যে তাদের মধ্যে চরিত্রের বিচারে সবচেয়ে উত্তম।”
(তিরমিযি)
প্রকৃতপক্ষে সৎচরিত্র পরকালীন জীবনেও মানুষের কল্যাণের হাতিয়ার, মুক্তির উপায় হবে। উত্তম আচার-আচরণ মানুষকে পুণ্য বা সাওয়াব দান করে।
মহানবি (সাঃ) বলেছেন,
“সুন্দর চরিত্রই পুণ্য।”
(মুসলিম)
প্রশংসনীয় আচরণ ও স্বভাব কিয়ামতের দিন মুমিনের পাল্লা ভারী করবে।
একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
“নিশ্চয়ই (কিয়ামতের দিন) মিযানে সুন্দর চরিত্র অপেক্ষা ভারী বস্তু আর কিছুই থাকবে না।”
(তিরমিযি)
দুনিয়ার জীবনেও আখলাকে হামিদাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সচ্চরিত্র ব্যক্তিকে সমাজের সবাই ভালোবাসে, বিশ্বাস করে। সবাই তাকে শ্রদ্ধা করে, সম্মান দেখায়। তাঁর বিপদে-আপদে এগিয়ে আসে। চরিত্রের কারণে তিনি সমাজে মর্যাদার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হন।
মহানবি (সাঃ) এ সম্পর্কে বলেছেন,
“তোমাদের মধ্যে উত্তম ঐ সকল ব্যক্তি, যারা তোমাদের মধ্যে চরিত্র বিচারে সুন্দরতম।”
(বুখারি)
সমাজের সকলে চরিত্রবান হলে সেখানে কোনোরূপ হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি, হানাহানি থাকে না। সমাজ সুখে-শান্তিতে ভরে ওঠে।
সৎচরিত্র আল্লাহ তায়ালার এক বিশেষ নিয়ামত। দুনিয়ায় আগত সকল নবি-রাসুলই উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। এ ছাড়াও পৃথিবীর স্মরণীয় ও বরণীয় মনীষীগণও উত্তম নৈতিক আদর্শ অনুশীলন করতেন। সৎচরিত্রের মাধ্যমেই ইসলামের যাবতীয় সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। এজন্য ইসলামে আখলাকে হামিদাহ অর্জনের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
(৪) আখলাক কত প্রকার?
আখলাক দু’প্রকার। যথা-
- আখলাকে হামিদাহ
- আখলাকে যামিমাহ
আখলাকে হামিদাহ হলো মানুষের প্রশংসনীয় গুণাবলি আর আখলাকে যামিমাহ মানব স্বভাবের মন্দ অভ্যাসগুলোর সামষ্টিক নাম।
যেমন: ওয়াদা পালন; সত্যবাদিতা; তাকওয়া অবলম্বন; আমানতদারিতা, মানবসেবা করা; ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা; নারীকে অসম্মান না করা; কর্তব্যপরায়ণতা; পরিচ্ছন্নতা; মিতব্যয়িতা; আত্মশুদ্ধি; সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ; ইত্যাদি আখলাকে হামিদাহ।
অপরদিকে, প্রতারণা; গিবত ও পরনিন্দা; হিংসা-বিদ্বেষে; ফিতনা-ফাসাদ; কর্মবিমুখতা ও অলসতার; সুদ ও ঘুষ; ইত্যাদি অসদাচারণ হলো আখলাকে যামিমাহ।
(৫) আখলাকে হামিদাহ
ক) আখলাকে হামিদাহ শব্দের অর্থ
আখলাক অর্থ চরিত্র, স্বভাব। আর হামিদাহ অর্থ প্রশংসনীয়। সুতরাং আখলাকে হামিদাহ অর্থ প্রশংসনীয় চরিত্র, সচ্চরিত্র।
খ) আখলাকে হামিদাহ কাকে বলে?
ইসলামি পরিভাষায়, যেসব স্বভাব বা চরিত্র সমাজে প্রশংসনীয় ও সমাদৃত, আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুল (সাঃ)-এর নিকট প্রিয় সেসব স্বভাব বা চরিত্রকে আখলাকে হামিদাহ বলা হয়।
এককথায়, মানব চরিত্রের সুন্দর, নির্মল ও মার্জিত গুণাবলিকে আখলাকে হামিদাহ বলা হয়। মানুষের সার্বিক আচার-আচরণ যখন শরিয়ত অনুসারে সুন্দর, সুষ্ঠু ও কল্যাণকর হয় তখন সে স্বভাব-চরিত্রকে বলা হয় আখলাকে হামিদাহ।
গ) আখলাকে হামিদাহ অপর নাম
আখলাকে হামিদাহ এর অপর নাম আখলাকে হাসানাহ বা হুসনুল খুল্ক।
আখলাকে হাসানাহ অর্থ সুন্দর চরিত্র। মানব চরিত্রের উত্তম ও নৈতিক গুণাবলি আখলাকে হামিদাহ এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন- সততা, সত্যবাদিতা, ওয়াদা পালন, মানব সেবা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, দয়া, ক্ষমা ইত্যাদি।
(৬) আখলাকে যামিমাহ
ক) আখলাকে যামিমাহ কী?
আখলাকে যামিমাহ অর্থ নিন্দনীয় স্বভাব। মানুষের সব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই ভালো নয়। বরং মানব চরিত্রে এমন কিছু দিক রয়েছে যা অপছন্দনীয় ও নিন্দনীয়। মানব চরিত্রের এসব নিন্দনীয় স্বভাবগুলোকে আখলাকে যামিমাহ বলা হয়।
আখলাকে যামিমাহ হলো আখলাকে হামিদাহ-র সম্পূর্ণ বিপরীত।
খ) আখলাকে যামিমাহ এর অপর নাম
আখলাকে যামিমাহ-র অপর নাম আখলাকে সায়্যিআহ। আখলাকে সায়্যিআহ অর্থ অসৎচরিত্র, মন্দ স্বভাব ইত্যাদি।
মানব চরিত্রে বহু নিন্দনীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন- মিথ্যা বলা, প্রতারণা, ঠাট্টা-বিদ্রূপ, বিশ্বাসঘাতকতা, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, পরনিন্দা, পরচর্চা, অপব্যয়-কৃপণতা, ক্রোধ, গর্ব-অহংকার ইত্যাদি। এসব স্বভাব আখলাকে যামিমাহ-র অন্তর্ভুক্ত।
গ) আখলাকে যামিমাহ এর কুফল বা অপকারিতা
মানব সমাজে আখলাকে যামিমাহর কুফল অত্যন্ত ভয়াবহ। এটি যেমন ব্যক্তি জীবনে অশান্তি ডেকে আনে তেমনি সমাজ জীবনেও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।
অসৎচরিত্র বা চরিত্রহীন ব্যক্তি পশুর চেয়েও অধম। তার মধ্যে নীতি, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের বিন্দুমাত্রও পাওয়া যায় না। সে শুধু গড়ন-আকৃতিতে মানুষ, কিন্তু তার স্বভাব-চরিত্র হয় পশুর ন্যায়। নিজ স্বার্থ রক্ষার জন্য সে মানবিক আদর্শসমূহকে বিসর্জন দেয়।
আখলাকে যামিমাহ-র ফলে সে সবরকমের অন্যায়, অত্যাচার ও অশালীন কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এমনকি হত্যা-রাহাজানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদিতেও জড়িয়ে পড়ে। ফলে শান্তি, নিরাপত্তা, সামাজিক ঐক্য, সংহতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। সমাজে অরাজকতা ও অশান্তি বিস্তার লাভ করে।
মন্দ চরিত্রের মানুষ সমাজে ঘৃণার পাত্র। কেউ তাকে ভালোবাসে না, বিশ্বাস করে না। সকলেই তাকে ঘৃণা করে, এড়িয়ে চলে। তার বিপদাপদেও কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না।
অসৎচরিত্র মানুষকে পরকালীন জীবনে শোচনীয় পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। চরিত্রহীন ব্যক্তি সকল প্রকার পাপাচারে লিপ্ত থাকে, সে আল্লাহ তায়ালার অবাধ্য হয়। আল্লাহ তায়ালা তাকে ভালোবাসেন না। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা এরূপ অসৎচরিত্র ব্যক্তিকে কঠিন শাস্তি প্রদান করবেন।
মহানবি (সাঃ) বলেছেন,
“দুশ্চরিত্র ও রূঢ় স্বভাবের মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।”
(আবু দাউদ)
বস্তুত আখলাকে যামিমাহ অত্যন্ত ঘৃণিত ও বর্জনীয় স্বভাব। এর ফলে দুনিয়া ও আখিরাতে মানুষ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সকলেরই এসব স্বভাব থেকে বেঁচে থাকা উচিত।
আমরা অসৎচরিত্র ত্যাগ করে সৎচরিত্র অবলম্বন করব। সত্যিকার মানুষ হিসেবে সকলের প্রিয়পাত্র হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করব।
পবিত্র ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট ইসলাম’ (inbangla.net/islam) এর সাথেই থাকুন।