Skip to content

 

আদর্শ সমাজ গঠন ও অনাচার প্রতিরোধে ইসলাম

আদর্শ সমাজ গঠন ও অনাচার প্রতিরোধে ইসলাম

আলোচ্য বিষয়:

আদর্শ সমাজ গঠনে ইসলামের নীতি ও আদর্শ অনিবার্য, ইসলাম মানব সমাজকে সুষ্ঠু সুন্দর ও শান্তিময় করতে চায়। মানব সমাজের সকল প্রকার অন্যায় অবিচার, সমাজবিরোধী, কার্যকলাপ ও নৈতিকতাবিরোধী কর্মকান্ড প্রতিরোধ ও বন্ধের জন্য ইসলাম আপসহীন নীতিমালা প্রদান করে।

সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার দূর করার জন্য প্রয়োজন কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ বা সরকার। এ জন্য ইসলামি কর্তৃপক্ষ বা সরকার প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্বারোপ করে।

ইসলাম সমাজ থেকে অনাচার অবিচার ও নৈতিকতাবিরোধী কার্যকলাপ বন্ধের জন্য দু’ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তা হচ্ছে অপরাধ যাতে সংঘটিত হতে না পারে সে রকম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কোনো অপরাধ যদি সংঘটিত হয়েই পড়ে সেক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির বিধান।

সমাজ থেকে যাবতীয় অনাচার অবিচার দূর করে অপরাধ মুক্ত আদর্শ সমাজ উপহার দিতে পারে একমাত্র ইসলাম।

(১) সমাজে ন্যায়বিচার (আদল) প্রতিষ্ঠা

ক) আদল বা ন্যায়বিচার কী?

আদল আরবি শব্দ। যার অর্থ হলো- ন্যায় বিচার করা, ভারাসাম্য রক্ষা করা, সমান সমান ভাগে ভাগ করা, মানুষের সাথে সঙ্গত আচরণ করা, Right Judgement ইত্যাদি।

ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়, আদল বলা হয়- কোনো বস্তুকে সমান অংশের অধিকারীদের মধ্যে এমনভাবে ভাগ করে দেয়া, যাতে কারো অংশ বিন্দু পরিমাণও কম বা বেশি না হয়। অর্থাৎ যার যতটুকু প্রাপ্য আছে, তা আদায়ের জন্য সুব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার নাম ‘আদল’।

খ) আদলের গুরুত্ব

  • মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে একে অপরের সাথে চলাফেরার ক্ষেত্রে ন্যায়নীতি ও সুবিচারের গুরুত্ব অপরিাসূীম। পার্থিব জীবনের সর্বত্র ইনসাফ বা ন্যায়নীতি বাস্তবায়ন ও প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। ইসলাম ন্যায়বিচার করার বিশেষ তাগিদ দিয়েছে, তাই আদল-ই হলো ন্যায়বিচারের একমাত্র উপায়।
  • অত্যাচারের প্রতিরোধকল্পে এবং বিচারে ন্যায়ের মানদ- প্রতিষ্ঠাসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কথাবার্তা, কাজকর্ম, আচার-আচরণ, বিচার-ফয়সালা, লেনদেন, ক্রয়-বিক্রয়, যুদ্ধ-সন্ধি, ভোগব্যবহারে সততা, ন্যায়-নীতি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করাই আদল।
  • সুষ্ঠু সমাজ বিকাশে তথা ইনসাফ ও ন্যায়-নীতিভিত্তিক আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে আদলের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আদল বা ন্যায়বিচারই হচ্ছে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, সামাজিক শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠুশাসন ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। সমাজ সংরক্ষণ, শাসন পরিচালনা ও পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষা ও উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ‘আদলের’ প্রয়োজন অনস্বীকার্য।

গ) সমাজে আদল প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা

সমাজে ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে প্রত্যেক মানুষের জান-মাল, মান-সম্মান ও অধিকার নিরাপদ থাকে। কেউ অন্যায় বা অপরাধ করলে তাকে উপযুক্ত শাস্তি পেতে হয়।

ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠায় মহান আল্লাহ বলেন,

“আর যখন তোমরা মানুষের মধ্যে বিচার ফয়সালা কর, তখন আদলের সাথে কর।”

(সূরা নিসা ৪ : ৫৮)

সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলাবিরোধী তৎপরতা যেমন-চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুন-খারাবী, হত্যা-লুণ্ঠন, যুলুম, অত্যাচার, অনাচার, অবিচার-ব্যভিচার, শোষণ-নিপীড়ন ইত্যাদি কার্যকলাপ সমাজকে কলুষিত ও বিপর্যস্ত করে তোলে। এসব অপরাধমূলক কার্যাবলী নির্মূল ও নিয়ন্ত্রণে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য।

অর্থনৈতিক জীবনে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে ও লেনদেনে সুষ্ঠু অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায়ও আদলের গুরুত্ব সীমাহীন। দ্রব্যসামগ্রীতে ভেজাল, ওজনে কম-বেশি করা, পণ্যের ত্রুটি গোপন করে বাজারজাত করা ইত্যাকার ব্যবসায়িক অসাধুতা সুষ্ঠু অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অন্তরায়।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“তোমরা আদলের সাথে মাপ ও ওজন পরিপূর্ণভাবে দাও।”

(সূরা আনআম ৬: ১৫২)

সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রশাসন ব্যবস্থাকে মজবুত ও সুসংহত রাখতে অবশ্যই আদলের প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য।

আদলের পরিপন্থী প্রশাসন ব্যবস্থা বেশি দিন টিকতে পারে না। প্রশাসনের প্রতি জনগণ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ফলে প্রশাসনিক অবকাঠামো ভেঙে যায়। তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আদল বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অপরিাসীম।

সমাজের সকল কর্মকান্ড যদি আদল মাফিক হয়, তবে সমাজের প্রতিটি লোকের মধ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগরিত হয়। এমনকি আদল বা ন্যায়দন্ডের ছায়াতলে সবাই ভ্রাতৃত্বের নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

অপরপক্ষে আদলের অভাবে প্রতিহিংসা দানা বাঁধতে থাকে এবং ভ্রাতৃত্ববোধ বিনষ্ট হয়। ফলে একটা চরম পরিণতি অনিবার্য হয়ে ওঠে।

মহান আল্লাহ বলেন,

“নিশ্চয়ই আল্লাহ আদল ও ইহসানের সাথে কাজ করার হুকুম করেছেন।”

(সূরা নাহল ১৬:৯০)

আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হলো মানুষের একান্ত কাম্য। আদল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের ভালোবাসা এবং আল্লাহর সন্তোষ লাভ করা যায়।

মহান আল্লাহ বলেন,

“নিশ্চয়ই আল্লাহ আদল প্রতিষ্ঠাকারীদের ভালোবাসেন।”

(সূরা মায়িদা : ৪২)

ঘ) সার সংক্ষেপ

  • সামাজিক জীবনে ‘আদল’ বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মহান আল্লাহ যেরূপ ন্যায়বিচারক তেমনি মানব জাতিকে তাদের সামগ্রিক জীবনে ‘আদল’ প্রতিষ্ঠা করার তাগিদ করেছেন। মহানবি (সাঃ) এর জীবনাদর্শে এবং সাহাবাদের মধ্যে ‘আদল’ প্রতিষ্ঠার সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়।
  • ইসলাম আদল বা ন্যায়বিচার করার বিশেষ তাগিদ দিয়েছে। সুষ্ঠুু সমাজ বিকাশে তথা ইনসাফ ও ন্যায় নীতিভিত্তিক আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে আদলের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

(২) সন্ত্রাস প্রতিরোধে ইসলামের ভূমিকা

ক) সন্ত্রাস কী?

সন্ত্রাস শব্দটির অর্থ হলো অতিশয় ভয়, ভীতি সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা। ইংরেজিতে সন্ত্রাস অর্থ বোঝাতে terrorism শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এর আরবি প্রতিশব্দ হলো ‘ইরহাব’ ও ‘ফাসাদুন ফিল আরদি’।

ইসলামি পরিভাষায়, সন্ত্রাস হলো অন্যায়ভাবে নির্দোষ মানুষকে ভয় দেখানো ও শঙ্কিত করা, হত্যা করা, সুরক্ষিত সম্পদ বিনষ্ট বা লুট, নারীর সম্ভ্রমহানি করা ইত্যাদি।’ কুরআন ও হাদিসে ফিৎনা-ফাসাদ শব্দ দ্বারা সন্ত্রাসমূলক কার্য-কলাপকেও বুঝানো হয়।

খ) সন্ত্রাসের কুফল

সমাজ জীবনে ফিৎনা-ফাসাদ, ঝগড়া-বিবাদ ও সন্ত্রাস-বিশৃঙ্খলা চরম অশান্তি ডেকে আনে। সমাজের শান্তি বিনষ্ট হয়। তখন সমাজ বাসোপযোগী থাকে না। সমাজজীবন হয়ে ওঠে দুর্বিসহ।

ফিৎনা-ফাসাদ মানব সমাজ ও সভ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ। ফিৎনা মানব সমাজে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করে। সমাজে শান্তি ও সুখ থাকে না।

সমাজ জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা মেনে চলার জন্য আল্লাহ বলেন,

“শান্তি প্রতিষ্ঠার পর পৃথিবীতে তোমরা ফাসাদ সৃষ্টি করো না।”

(সূরা আরাফ ৭ : ৫৬)

গ) সন্ত্রাস প্রতিরোধে ইসলামের ভূমিকা

সন্ত্রাসের মোকাবিলা সন্ত্রাস দিয়ে নয়, বরং আদর্শ দিয়ে, এ নীতি ছিল রাসূল (সাঃ)-এর। ইসলাম প্রচারের সূচনালগ্ন থেকে রাসূল (সাঃ) ও তাঁর প্রিয় সাথীরা মক্কার কাফির-মুশরিক কর্তৃক সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু রাসূল (সাঃ) তার জবাব দিয়েছিলেন এমন ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে, যার দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় বিরল।

মক্কাবাসীর অমানুষিক নির্যাতনের কারণে রাসূল (সাঃ) তাঁর সহযোগিদের নিয়ে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হন। সেখানে গিয়ে তিনি একটি আদর্শ রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মদিনাবাসীকে নিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে একই জাতি গঠন করেন, যা মদিনা সনদ নামে প্রসিদ্ধ। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে মদিনা শান্তির নগরে পরিণত হয়। আজকের অশান্ত পৃথিবীতেও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সন্ধি স্থাপনের মাধ্যমে সন্ত্রাস মোকাবিলা সম্ভব।

সন্ত্রাস দমনের ক্ষেত্রে রাসূল (সাঃ)-এর আদর্শের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো সন্ত্রাসীদের সমাজ থেকে বয়কট বা বহিষ্কার করা। হিজরতের পর রাসূল (সাঃ) সনদ স্বাক্ষরের মাধ্যমে মদিনার ইয়াহুদিসহ সকলের সাথে শান্তি চুক্তি সম্পাদন করেন। মদিনা রাষ্ট্রের শান্তি বিনষ্ট করায় রাসূল (সাঃ) ইয়াহুদি বনূ নজির গোত্রকে মদিনা থেকে বহিষ্কার করেন।

সবযুগে কিছু সন্ত্রাসী দেখা যায়। সন্ত্রাসই যাদের পেশা, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই তাদের প্রাপ্য। রাসূল (সাঃ)-এর শিক্ষাও তাই। আর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানই হবে সন্ত্রাস মোকাবিলায় কার্যকর প্রদক্ষেপ।

আল্লাহ তায়াল বলেন,

“যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টির চেষ্টা করে, তাদের জন্য নির্দিষ্ট শাস্তি হচ্ছে যে, তাদের হত্যা করা হবে, কিংবা তাদের শূলবিদ্ধ করা হবে, অথবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত পা কেটে ফেলা হবে , কিংবা দেশ থেকে তাদের নির্বাসিত করবে।”

(সূরা মায়িদা ৫:৩৩)

এ বিধান ইসলামি রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় কার্যকর করা যাবে। ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ব্যতিত বেসরকারি কোন ব্যক্তি বা সংস্থা-সংগঠন এটা করার কর্তৃপক্ষ নয়।

ঘ) সার সংক্ষেপ

ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম ফেৎনা-ফাসাদ বা কোনো ধরণের সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কর্মকা-কে চরম ভাবে ঘৃণা করে। ফেৎনা-ফাসাদ, সন্ত্রাস, জঙ্গি কর্মকা- সমাজ জীবনে চরম অশান্তি ও বিপর্যয় ডেকে আনে। সন্ত্রাস নির্মূলে কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশ পালন খুবি জরুরি।

(৩) সামাজিক অনাচার প্রতিরোধে ইসলামের নীতি

সামাজিক অনাচার, নৈতিক চরিত্র, চরিত্র সংশোধন, অন্যায় প্রতিরোধ, সদুপদেশ, গিবত, প্রতারণা সমাজে মানুষের মধ্যে অনেক অন্যায়-অনাচার ব্যক্তিগত পর্যায়ে দেখা যায়। আবার কিছু অন্যায়-অনাচার আছে যা ব্যক্তিকে ছাপিয়ে সমাজে বিস্তার লাব করেন। আমরা রন্দ্রে রন্দ্রে সামাজিক অনাচার দেখতে পাই।

এ অনাচার গুলো আমাদের সমাজকে কলুষিত করে। ইসলামি বিধি-বিধান পালনের মাধ্যমে এ অনাচার প্রতিরোধ করা যায়।

সামাজিক অনাচার প্রতিরোধে ইসলামের ভূমিকা নিম্নরূপ-

i) ব্যক্তির সংশোধন

মানুষ প্রয়োজনীয় জ্ঞান বা মৌলিক চাহিদা পূরণের অভাবে অপরাধপ্রবণ হয়। তাই জ্ঞানার্জন ও মৌলিক চাহিদা পূরণে কর্ম প্রচেষ্টা করা মানুষের জন্য ফরয। মানুষের নৈতিক চরিত্র ভালো রাখা এবং চরিত্র সংশোধন করার উপর ইসলাম সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থেকে। ব্যক্তি ভালো হলে সমাজও ভালো থাকে।

ii) ইসলামি আইন প্রণয়ন

সামাজিক অনাচার দূর করার জন্য ইসলামে পর্যাপ্ত আইন ও বিধি-বিধান রয়েছে। যথা- চুরির শাস্তি, ব্যভিচারের শাস্তি, মানুষ হত্যার শাস্তি। এ মহান ও কঠিন দায়িত্ব মুসলিম উম্মাহর ওপর অর্পিত হলেও মহান আল্লাহ এটা পালন করার জন্য এমন সহজ ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করার নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে মুসলিম উম্মাহ কর্তব্য সচেতন থাকতে পারে।

iii) অন্যায় কাজের প্রতিরোধ

সমাজে যেকোনো অন্যায়-অবিচার ও গর্হিত কাজ হতে দেখলে তার প্রতিরোধ প্রসঙ্গে মহানবি (সাঃ) বলেন,

“তোমাদের মধ্যে কেউ সমাজবিরোধী অন্যায় ও গর্হিত কাজ করতে দেখলে সে যেন তা শক্তি প্রয়োগে প্রতিহত করে। শক্তি প্রয়োগে সক্ষম না হলে যেন সদুপদেশ দ্বারা প্রতিবিধান করে এবং তাতেও সক্ষম না হলে যেন আন্তরিকভাবে ঘৃণা করে। আর এটা হলো দুর্বলতম ইমানের লক্ষণ।”

(সহীহ মুসলিম)

iv) সদুপদেশ দান

যাবতীয় সামাজিক অনাচার ও অবিচার প্রতিহত করে সমাজকে কলুষমুক্ত করার কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হলে প্রথমেই দরকার মানুষকে সদুপদেশ ও সৎ কাজে উদ্বুদ্ধ করা।

মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন,

“তোমরা প্রতিপালকের রাস্তায় প্রজ্ঞার সাথে এবং উত্তম উপদেশের মাধ্যমে (মানুষদেরকে) আহ্বান কর, আর উৎকৃষ্ট যুক্তি প্রয়োগে তাদের মোকাবিলা কর।”

(সূরা নাহল ১৬:১২৫)

v) সামাজিক অপরাধমূলক কার্যক্রম নিষিদ্ধ

ইসলাম সামাজিক অনাচার হতে পারে, এমন সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ইসলাম সামাজিক অনাচার দূর করণের জন্য শুধু আইন প্রণয়ন করেনি; বরং তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছে।

যেমন-

এক. সমাজের অনিষ্টের মূল কারণ হিসেবে মদ, জুয়া নিষিদ্ধ।

দুই. সুবিচার প্রতিষ্ঠার অন্তরায় হিসেবে ঘুষ নিষিদ্ধ।

তিন. কারো অসাক্ষাতে সমালোচনা তথা গিবত নিষিদ্ধ।

মিথ্যা যাবতীয় অন্যায়ের মূল। যেমন- হাদিসে আছে, মিথ্যা যাবতীয় গুণাহর আসল বা মূল।

কুরআনে বলা হয়েছে,

“তোমরা মিথ্যা হতে দূরে থাক।”

(সূরা হজ্জ ২২: ৩০)

তাছাড়া প্রতারণা নিষিদ্ধ, অর্থনৈতিক অনাচার হিসেবে সুদ, চুরি-ডাকাতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সার সংক্ষেপ:

  • মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য হচ্ছে এ পৃথিবীতে মহান আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব কায়েম করা। তাই তাদের চরিত্র হতে হবে নিষ্কলুষ, ত্রুটিমুক্ত ও পাক-পবিত্র। কিন্তু মানুষ পার্থিব মোহ, স্বার্থ ও লোভ-লালসায় আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন সামাজিক অনাচারে লিপ্ত হয়। যেমন : জুয়া, মদ, মিথ্যাচার, সুদ, ঘুষ, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি। ইসলাম এগুলোর কুফল বর্ণনাপূর্বক সমাজ থেকে এগুলোর উচ্ছেদ ও প্রতিরোধের বিধান দিয়েছে।
  • ইসলাম সামাজিক অনাচার প্রতিরোধের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ও কার্যকর বিধান দিয়েছে। এ বিষণ বাস্তবায়নের ফলেই এককালের অন্ধকারময় সমাজ সোনালী সমাজে পরিণত হয়েছিল।

(৪) সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তিময় সমাজ গঠনে ইসলামের ভূমিকা

ক) সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিচয়

পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি অ লেই বিভিন্ন ধর্মীয় জাতি, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করে। প্রতিটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় রীতি-নীতি, আচার-আচরণ, সংস্কৃতি ভিন্ন ভিন্ন হলেও এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের সাথে বিরোধ করে না, সমাজের লোকদের মাঝে এমন ভাবনাই হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।

খ) সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তিময় সমাজ গঠনে ইসলাম

ইসলাম অন্য সব ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীদের প্রতি উদার। পারস্পরিক সম্প্রীতি রক্ষায় ইসলাম শান্তিময় আন্তঃধর্মীয় নীতিমালা নির্ধারণ করেছেন।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ইসলামের ভূমিকা অনুপম। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ইসলামের নীতি হলো-

i) সামাজিক সাম্য

ইসলামি রাষ্ট্রে যে কোন ধর্মীয় বা জাতিগত সম্প্রদায়ের লোকেরা মানুষ হিসেবে মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত মর্যাদায় সমান। মহান আল্লাহ মানব জাতিকে সম্মানিত করেছেন এবং তাঁর অন্যান্য অনেক সৃষ্টির ওপরে মানুষকে স্থান দিয়েছেন। ধর্মীয়, গোত্র, বর্ণ ইত্যাদি বিবেচনায় কারো মানবিক মর্যাদা বিনষ্ট করা নিষিদ্ধ। সবার সাথে সম্প্রীতির সাথে বসবাস করতে হবে।

কুরআনের ঘোষণা,

“হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার।”

(সূরা হুজুরাত ৪৯:১৩)

ii) মানবতার মাঝে ঐক্য স্থাপন

ইসলাম মানবতার মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আমাদের সমাজে অমুসলিম সম্প্রদায়ের বহু লোকজন বসবাস করেন। এদের কেউ আমাদের সহপাঠী, কেউ সহকর্মী, কেউ খেলার সাথী, কেউবা প্রতিবেশি আবার কেউ শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতজন। তাদের সকলের সাথেই ভালো ব্যবহার করতে হবে। ইসলাম সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করতে চায় না। তাই ধর্মীয়, গোত্র, বর্ণ ইত্যাদি বিবেচনায় কারো সাথে বিভেদ করা যাবে না।

মহান আল্লাহ বলেন,

“সমস্ত মানুষ এক জাতি।”

(সূরা বাকারা ২:২১৩)

iii) ধর্মীয় সম্প্রীতি

ইসলাম সবার ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দিয়ে থাকে। তাই তাদের ধর্মগ্রন্থ, উপাসনালয়, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে ঠাট্টাবিদ্রুপ করা যাবে না। ধর্ম পালনে তাদের বাধা দেওয়া যাবে না।

মহান আল্লাহ বলেন,

“দীনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।”

(সূরা বাকারা ২:২৫৬)

ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলার প্রেক্ষাপটে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হওয়ার ঘটনা লক্ষ করা যায়। কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আসে এমন কোনো মন্তব্য না করা এবং সবার ধর্মীয় উপাসনালয়সমূহের রক্ষণাবেক্ষণ করা ইসলামের শিক্ষা।

iv) সুবিচার প্রতিষ্ঠা

বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে সব সম্প্রদায়ের লোক সমান সুযোগ প্রাপ্ত হবে। ধর্মীয়, গোত্র, বর্ণ বিবেচনায় কারো উপর কোনো ধরনের অবিচার করা যাবে না।

মহান আল্লাহ বলেন,

“কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে কখনও সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে, সুবিচার করবে, এটি তাকওয়ার অধিক নিকটবর্তী।”

(সূরা মায়িদা ৫:৮)

v) জীবন-সম্পদ ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা প্রদান

ইসলাম সব মানুষের জীবন, রক্ত, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা প্রদান করে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে কারো প্রতি কোনোরূপ অত্যাচার করা যাবে না। অন্য ধর্মাবলম্বীর সম্পদ দখল করা যাবে না। সকলের জান-মাল-ইজ্জত আবরু সংরক্ষণ করতে হবে।

রাসূলূল্লাহ (সাঃ) এ বিষয়ে মুসলিমগণকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়ে বলেন,

“যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমকে হত্যা করল সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না।”

(বুখারি)

vi) উত্তম আচরণ

কথায় বলে, ব্যবহার বা আচরণে বংশের পরিচয়। ধর্মের পরিচয়ও অনেকটা নির্ভর করে আচরণের ওপর। ইসলামের অনিন্দ্য সুন্দর আচরণে অভিভূত হয়ে যুগে যুগে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে।

ইসলাম সবার সাথে উত্তম আচরণ করতে নির্দেশ দেয়। অমুসলিমদের সাথেও উত্তম আচরণ করতে নিষেধ করে না। তাদের পক্ষ থেকে স্পষ্ট শত্রুতামূলক কর্মকান্ডের নিদর্শন না পাওয়া পর্যন্ত তাদের সাথে উত্তম আচরণ করা আল-কুরআনের ঘোষিত ইসলামের অন্যতম মূলনীতি।

গ) সার সংক্ষেপ

  • ইসলাম একটি সর্বজনীন ধর্ম। বিশ্বের সব ধর্মের, অ লের, গোত্রের, বর্ণের, সংস্কৃতির সব মানুষের ব্যক্তিগত, পরিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক স্বাধীনতা ও অধিকারকে ইসলাম অনেক বেশি সম্মান, মর্যাদা উদারতা ও মহানুভবতার দৃষ্টিতে দেখেছে।
  • ইসলামের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। আমরা যদি ইসলামের অনুশাসনকে অনুশীলন করি, তাহলে আমাদের মাঝে বসবাসকারী সকল সম্প্রদায়ের লোকেরা সব অধিকার ও মর্যাদা সঠিকভাবে পাবেন এবং দেশ ও সমাজ হবে শান্তিময়।

(৫) মিথ্যাচার

ক) পরিচয়

মিথ্যাচার শব্দের আরবি প্রতিশব্দ হলো- কিযব। এর অর্থ মিথ্যা, প্রকৃত অবস্থা বা বাস্তবতাকে অস্বীকার করা, কিংবা সত্য ঘটনাকে বিকৃত করাকেও কিযব বা মিথ্যা বলা হয়। যে ব্যক্তি মিথ্যা বলে, তাকে ‘কাযিব’ তথা মিথ্যাবাদী বলে। চরম মিথ্যাবাদীকে কাযযাব বলে। এটি মুনাফিকের অন্যতম লক্ষণ এবং অত্যন্ত নিন্দনীয় আচরণ।

মিথ্যা সর্বপ্রকার পাপের মূল। মিথ্যা মানুষকে ধ্বংস করে। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে মিথ্যার পরিণাম খুবই ভয়াবহ। তাই এ থেকে বেঁচে থাকার জন্য চেষ্টা করা কর্তব্য।

খ) মিথ্যার কুফল

সত্যবাদীকে সকলে ভালোবাসে এবং তার যাবতীয় বিপদে আপদে সকলে এগিয়ে আসে। সর্বত্র সে সম্মানিত ও আদরণীয় হন। সত্যবাদিতার গুণে মানুষ বিপদ থেকে মুক্তি পায়।

মিথ্যা জঘন্যতম অপরাধ ও সমস্ত অপকর্মের উৎস। মিথ্যাবাদীকে কেউ কখনও বিশ্বাস করে না। তাকে কেউ সহায়তা করে না। সবাই তাকে ঘৃণা করে। পরিণামে তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, এর পরিণাম মানব জীবনে ধ্বংস ডেকে আনে।

মহানবি (সাঃ) বলেন,

“সত্যবাদিতা মানুষকে মুক্তি দেয় এবং মিথ্যা ধ্বংস করে।”

(আল-হাদিস)

মহানবি (সাঃ) মিথ্যার ভয়াবহতা বুঝাতে গিয়ে বলেন,

“যখন কোনো বান্দা মিথ্যা বলে, তখন তার দুর্গন্ধের কারণে ফেরেশতারা পর্যন্ত তার থেকে এক মাইল দূরে চলে যায়।”

(আল-হাদিস)

মিথ্যা ঘৃণ্যতম অপরাধ

কিযব তথা মিথ্যার পরিণাম খুবই ভয়াবহ।

মহানবি (সাঃ) বলেছেন,

“তোমরা মিথ্যা থেকে বেঁচে থাক। কেননা, মিথ্যা পাপের দিকে নিয়ে যায়, আর পাপ নিয়ে যায় জাহান্নামের দিকে।”

(সুনানে আবু দাউদ)

মহানবি (সাঃ) সর্বদা মিথ্যাকে ঘৃণা করতেন এবং সাহাবিদের অন্তরে মিথ্যার প্রতি ঘৃণার ভাব জাগিয়ে দিতেন।

একদা এক ব্যক্তি মহানবির (সাঃ) কাছে এসে বলল- “হুজুর! আমি চুরি করি, মিথ্যা বলি এবং আরও বহু অন্যায় কাজ করি, এমতাবস্থায় আমি কেমন করে এসব পাপ কাজ থেকে মুক্তি পাব?” তিনি বললেন- “তুমি শুধু মিথ্যা কথা বলা ছেড়ে দাও।” লোকটি তাই করল এবং দেখা গেল যে, উক্ত ত্যাগের ফলে লোকটি ক্রমে অন্যান্য সব পাপ কাজও ত্যাগ করতে সক্ষম হল। তার জীবন পাপমুক্ত হলো এবং পরিণামে সে মহৎ ব্যক্তিরূপে পরিচিত হলো।

মিথ্যা বলা ও মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা সবচেয়ে বড় কবিরা গুনাহ।

মহানবি (সাঃ) বলেন,

“আমি তোমাদেরকে তিনটি বড় কবিরাহ গুনাহের কথা বলছি- এক. আল্লাহর সাথে শরীক করো না। দুই. পিতা-মাতার অবাধ্য হয়ো না। তিন. মিথ্যা বলো না এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দিও না।”

(বুখারি-মুসলিম)

মিথ্যা বলা ও মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা সবচেয়ে বড় কবিরা গুনাহ। মিথ্যা বলা মহাপাপ। মিথ্যাবাদীদের ওপর মহান আল্লাহ অভিশাপ দেন।

কুরআনে ঘোষিত হয়েছে,

“মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর লা’নত বা অভিশাপ।”

(সূরা আলে ইমরান ৩:৬১)

মিথ্যার পরিণাম খুবই ভয়াবহ। মিথ্যাবাদীর পরিণাম হরো জাহান্নাম।

আল কুরআনে এসেছে,

“যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে এবং অহংকার বশত মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারাই জাহান্নামবাসী এবং তারা সেখানেই চিরকাল থাকবে।”

(সূরা আরাফ ৭:৩৬)

গ) সার সংক্ষেপ

মিথ্যা একটি মারাত্মক অপরাধ। মিথ্যার প্রভাবে সমাজে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মিথ্যা মানবচরিত্রের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম দোষ। মিথ্যা সর্বপ্রকার পাপের মূল। মিথ্যা মানুষকে ধ্বংস করে। ব্যক্তি ও সমাজজীবনে মিথ্যার পরিণাম খুবই ভয়াবহ। তাই মিথ্যাচার থেকে বেঁচে থাকার জন্য চেষ্টা করা কর্তব্য।

(৬) প্রতারণা

ক) পরিচয়

প্রতারণা মানে ঠকানো বা ফাঁকি দেওয়া, বিশ্বাস ভঙ্গ করা, ভেজাল দেয়া, পণ্যদ্রব্যের দোষ গোপন করা, জাল মুদ্রা চালিয়ে দেয়া, মাপে-ওজনে কম দেয়া। ব্যবসায়-বাণিজ্য ছাড়াও মানুষ অন্যান্য আর্থ-সামাজিক কাজেও প্রতারণা করে থাকে।

খ) প্রতারণার কুফল

প্রতারণা একটি মারাত্মক চারিত্রিক দোষ। প্রতারণা ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই ঘৃণিত ও গর্হিত কাজ।

এটি একটি সমাজদ্রোহী পাপ। প্রতারণার প্রভাবে সমাজ-সভ্যতা ধ্বংসের মুখোমুখি হয়। ইসলাম ধোঁকা প্রতারণার উপায় ও পন্থাকে হারাম করে দিয়েছে। তা ক্রয় বিক্রয় সম্পর্কেই হোক কিংবা অন্যান্য মানবীয় ব্যাপারেই হোক, কোনোক্রমেই জায়েজ নয়।

ইসলামের দাবি হচ্ছে সব ব্যাপারেই মুসলমান সততা ও ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন করবে। ইসলামের দৃষ্টিতে সর্বপ্রকার বৈষয়িক কামাই-রোজগারের তুলনায় দ্বীনের মধ্যে নসিহত খুবই মূল্যবান ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই ধোঁকা ও প্রতারণার স্থান ইসলামে নেই।

মহানবি (সাঃ) ঘোষণা করেছেন,

“যে ব্যক্তি প্রতারণা করে, সে আমাদের মুসলমানদের সমাজভুক্ত নয়।”

(সহিহ মুসলিম)

ইসলাম সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে জীবনে যা কিছু করবে, তার মধ্যে ফাঁকি ও প্রতারণার স্থান নেই। ইসলাম সত্যের সাথে মিথ্যার মিশ্রণকে সমর্থন দেয় না।

পণ্যের দোষ গোপন করে বিক্রি করা তথা ব্যবসায়-বাণিজ্যে প্রতারণা করলে আল্লাহর অবিরাম ঘৃণা ও ফেরেশতাদের অবিরাম অভিশাপ বর্ষিত হতে থাকবে।

এ সম্বন্ধে মহানবি (সাঃ) বলেছেন,

“যে ব্যক্তি দোষযুক্ত পণ্য বিক্রি করে, ক্রেতাকে দোষের কথা জানায় না, এমন ব্যক্তি সর্বদা আল্লাহর ঘৃণার মধ্যে থাকবে এবং ফেরেশতারা সর্বদা তাকে অভিশাপ দিতে থাকবে।”

(আল-হাদিস)

প্রতারণা দ্বারা অর্জিত জীবিকা হারাম। আর যে দেহ হারাম রুজি দ্বারা পরিপুষ্ট, তার স্থান জাহান্নামে। অপরদিকে সৎভাবে ব্যবসায়-বাণিজ্য করলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। জান্নাতে স্থান পাওয়া যায়।

যে ধরনের ক্রয়-বিক্রয়ে অজ্ঞাত বা ধোঁকা খাওয়ার কিংবা এক পক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষকে ক্ষতি সাধনের সুযোগ থাকে, এমন ক্রয়-বিক্রয় হারাম।

মহানবি (সাঃ) বলেন,

“পণ্যের দোষ-ত্রুটি না জানিয়ে বিক্রয় করা অবৈধ। দোষ-ত্রুটি জানা থাকা সত্ত্বেও তা বলে না দেয়া বা গোপন করা অবৈধ।”

(মুনতাকা)

প্রতারক সমাজের ঘৃণিত জীব বিশেষ। প্রতারকের প্রতি যেমন আল্লাহর অভিশাপ, তেমনি সমাজেও তার কোনো স্থান নেই। তাকে কেউ বিশ্বাস করে না, ভালোবাসে না। তার জীবন হয় দুর্বিষহ। যেকোনো ধরনের প্রতারণা ও ধোঁকাবাজির আপাতফল শুভ মনে হলেও এতে ধ্বংস অনিবার্য।

মিথ্যার মাধ্যমে যেমন প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল ও গোপন করা হয়, প্রতারণার মাধ্যমেও বাস্তব ও প্রকৃত অবস্থাকে গোপন ও আড়াল করা হয়। কাজেই মিথ্যা ও প্রতারণা উভয়ই জঘন্যতম পাপ। অনেক সময় মিথ্যার চেয়ে প্রতারণায় ক্ষতি বেশি হয়। কাজেই এ থেকে বেঁচে থাকা জরুরি।

ইসলামে প্রতারণা জঘন্যতম পাপ। এটা আখলাকে জামিমা বা নিকৃষ্ট আচরণের মধ্যে জঘন্যতম স্বভাব। তাকওয়াপূর্ণ জীবনের পরিপন্থী। মুমিন ব্যক্তি কখনও প্রতারণার আশ্রয় নিতে পারে না; বরং মুমিন ও পরহেযগার লোকেরা সামান্যতম প্রতারণা থেকেও বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে।

গ) সার সংক্ষেপ

  • ইসলাম ধোঁকা ও প্রতারণার সকল রূপ ও পন্থাকে হারাম করে দিয়েছে। তা ক্রয়-বিক্রয় সম্পর্কে হোক কিংবা অন্যান্য মানবীয় ব্যাপারে হোক। ধোঁকা ও প্রতারণা কোনো ক্রমেই জায়েজ নয়।
  • ইসলামের দাবি হচ্ছে সব ব্যাপারেই মুসলমান সততা ও ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন করবে। কাজেই প্রতারণা থেকে সর্বতোভাবে বেঁচে থাকা মুসলিম হিসেবে অপরিহার্য কর্তব্য। কেননা, প্রতারণা তাকওয়াপূর্ণ জীবনযাপনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। মুসলিম কখনও প্রতারণার আশ্রয় নিতে পারে না।

(৭) গিবত

ক) গিবতের কী?

গিবত আরবি শব্দ। এর অর্থ পরনিন্দা, পরচর্চা, অসাক্ষাতে দুর্নাম করা, নিন্দা করা, সমালোচনা করা, অপরের দোষ প্রকাশ করা, কুৎসা রটনা করা ইত্যাদি।

ইসলামি পরিভাষায়, কারো অনুপস্থিতিতে অন্যের নিকট এমন কোনো কথা বলা যা শুনলে সে কষ্ট পায় তাকে গিবত বলে। প্রচলিত অর্থে অসাক্ষাতে কারো দোষ বলাকে গিবত বলা হয়।

ইমাম গাযালি বলেন, গিবত হচ্ছে তুমি তোমার ভাইয়ের দোষ-ত্রুটি এমনভাবে উল্লেখ করলে তা যদি তার কানে পৌঁছে তবে সে তা অপছন্দ করবে।

গিবত বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন- প্রকাশ্যে কারো দোষ-ত্রুটি বর্ণনা, গোপনে আলোচনা, লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে প্রকাশ করা ইত্যাদি। এছাড়াও শারীরিক দোষ-ত্রুটি, পোশাক-পরিচ্ছদের সমালোচনা, জাত-বংশ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা, কারো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও অভ্যাস নিয়ে সমালোচনা করা ইত্যাদি গিবতের অন্তর্ভুক্ত।

খ) গিবতের কুফল

গিবত করাকে আল-কুরআনে নিজ মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। সুতরাং গিবত খুবই অপছন্দনীয় কাজ। সুস্থ বিবেকবান কোনো মানুষই এরূপ কাজ পছন্দ করতে পারে না।

মহান আল্লাহও গিবত করা পছন্দ করেন না। ইসলামি শরিয়তে গিবত বা পরনিন্দা করা হারাম ও কবীরাহ গুনাহ।

মহান আল্লাহ বলেন,

“আর তোমরা একে অপরের গিবত করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে ভালোবাসবে? বস্তুত তোমরা নিজেরাই তা অপছন্দ করে থাকো।”

(সূরা আল-হুজুরাত ৪৯:১২)

গিবত ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্বক পাপ। পবিত্র হাদিসে মহানবি (সাঃ) আমাদের গিবতের পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন।

রাসূুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,

“গিবত ব্যভিচারের চাইতেও মারাত্মক।”

(বায়হাকি শুআবুল ইমান)

গিবতের দ্বারা মানুষের সম্মান বিনষ্ট করা হয়। গিবত করলে মানুষের সামনে যার গিবত করা হলো তার সম্মান বিনষ্ট হয়। তাই কারো কোনো দোষ দেখলে পিছনে গিবত না করে তাকে সরাসরি বলবে যাতে সে সংশোধন হতে পারে।

যেসব কারণে সমাজের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ বিনষ্ট হয়, সমাজ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হয়, সামাজিক মূল্যবোধ বিনষ্ট হয়, পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হয়, তার মধ্যে অন্যতম কারণ হলো গিবত করা।

মহাগ্রন্থ আল কুরআনে গিবতকে দুর্ভোগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনের বাণী,

“দুর্ভোগ প্রত্যেকের যে সামনে নিন্দাকারী ও পেছনে গিবতকারী।”

(সূরা হুমাযাহ ১০৪:১)

গিবত করলে যে গুনাহ হয়, তাওবা করলেও তা মাফ হয় না। যতক্ষণ পর্যন্ত না যার গিবত করা হয়েছে, সে ক্ষমা না করে।

রাসূূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,

“গিবতকারীকে ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ মাফ করেন না, যতক্ষণ না যার গিবত করা হয়েছে সে ব্যক্তি মাফ করবে।”

(বায়হাকি)

অতএব এমন জগন্য পাপ থেকে আমাদেরকে মুক্ত রাখতে হবে।

গ) সার সংক্ষেপ

  • সমাজের সুখ-শান্তি বিনষ্টের কারণের মধ্যে গিবত অন্যতম। গিবত মানব চরিত্রের একটি খারাপ দিক। সামাজিক শান্তি বিনষ্টকারী এ ঘৃণ্য অভ্যাস অনেকের মধ্যে দেখা যায়।
  • ইসলামি শরিয়তে গিবত সম্পূর্ণরূপে হারাম। কারো গিবত করা যেমন হারাম তেমনি গিবত শোনাও হারাম। গিবত না করার পাশাপাশি গিবত শোনা থেকেও বেঁচে থাকতে হবে। গিবতকারীকে গিবত বলা থেকে বিরত থাকার জন্য বলতে হবে। নতুবা যেসব স্থানে গিবতের আলোচনা হবে সেসব স্থান এড়িয়ে চলতে হবে।

(৮) অসৎসঙ্গ

ক) পরিচয়

অসৎ হলো অন্যায়কারী, মন্দস্বভাবের ব্যক্তি, পাপাচারী। অসৎ ব্যক্তির সাথী হওয়াই হলো অসৎ সঙ্গ। এজন্য একজন মানুষ যদি পাপাচারী হয়, তাহলে তার সান্নিধ্যকে বলা হয় অসৎসঙ্গ।

সুতরাং কোনো ব্যক্তি ইসলামি শরিয়ত বিরোধী কোনো কার্যকলাপ, যেমন- শিরক, কুফর, চুরি, ডাকাতি, নিফাক, মিথ্যা ইত্যাদিতে লিপ্ত থাকলে তার সঙ্গী হওয়াকে অসৎ সঙ্গ বলা হবে।

খ) অসৎ সঙ্গের কুপ্রভাব

মানুষ সামাজিক জীব। সে একাকী বাস করতে পারে না। মানুষের স্বভাব-প্রকৃতিই এমন যে, কোনো মানুষ একাকী থাকতে চায় না। সঙ্গীর জীবনাচার সঙ্গীর ওপর প্রভাব বিস্তার করে। তাই অসৎ সঙ্গী ব্যক্তির উপর খারাপ প্রভাব বিস্তার করে।

‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’ খুবই পরিচিত একটি প্রবাদ। খুব সহজ এবং ছোট বাক্য হলেও এর বেশ গুরুত্ব প্রদান করেছে ইসলাম।

সৎ বন্ধু, মুমিন ও ভালো সঙ্গী নির্বাচন করার ব্যাপারে রাসূল (সাঃ) সাহাবাদেরকে ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করতেন। সুতরাং সঙ্গী গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,

“মানুষ তার বন্ধুর ধর্ম (স্বভাব-চরিত্র) দ্বারা প্রভাবিত; সুতরাং কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছ, তা যাচাই করে নিবে।”

(তিরমিযি)

কারও সঙ্গে মেশার ক্ষেত্রে একটু চিন্তাভাবনা করা চাই। যদি আপন দ্বীন ও চরিত্রের ব্যাপারে সে সন্তুষ্ট হয় তাহলে তাকে গ্রহণ করবে, অন্যথায় তাকে পরিত্যাগ করবে। কেননা সঙ্গীর মাধ্যমে মত ও পথ পরিবর্তন হয়। আর অসৎ সঙ্গী পথভ্রষ্ট করে। মহান আল্লাহ অসৎসঙ্গকে নিকৃষ্ট সাথী বলে অভিহিত করেছেন। কেননা অসৎসঙ্গ তাকে ন্যায় থেকে অন্যায় এবং ভালো থেকে মন্দের দিকে ধাবিত করে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“শয়তান যার সাথী হয়, সে হলো নিকৃষ্টতর সাথী।”

(সূরা নিসা ৪:৩৮)

অসৎ বন্ধুত্ব ও অসৎ সংশ্রব মানুষকে ক্রমেই দুনিয়ার লোভ-লালসার প্রতি আকণ্ঠ নিমজ্জিত করে দেয়। ফলে তার আখিরাত বিনষ্ট হয়। দুনিয়ার সঙ্গীগণ তাদের কর্মফলের ভিত্তিতে একই সাথে উঠবে এবং সকলে একে অপরের দোষে সম্পৃক্ত ও দোষী সাব্যস্ত হয়ে পড়বে। এজন্য আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর সাহাবাগণ সর্বদা সৎ লোকদের সাথে ওঠা-বসার সুযোগ খুঁজতেন এবং অসৎ সঙ্গী মুনাফিক, কপট ও ভন্ডদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতেন।

সঙ্গ মানুষের জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। মূল্যবোধ গঠনে সঙ্গীর প্রভাব দেখা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায় অসৎসঙ্গের প্রভাবে কন্যা ও পুত্র নিজ মাতা-পিতাকেও হত্যা করতে কুন্ঠিত হয় না। অসৎ সঙ্গের প্রভাবে মাদকাসক্তির প্রতি ধাবিত হয়। এভাবে সমাজে অসৎ সঙ্গের প্রভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয় সৃষ্টি হয়। তাই নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রতিরোধে অসৎসঙ্গ ত্যাগ করতে হবে।

গ) অসৎ সঙ্গ প্রতিরোধে ইসলামের বিধান

আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূল (সাঃ) ও মুমিনদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। বন্ধু বা সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বলে দিয়েছেন।

“মুমিনগণ যেন মুমিন ছাড়া কোনো কাফেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করে।”

(সূরা আলে-ইমরান ৩:২৮)

মুমিনদের জন্য আল্লাহর শত্রুদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা নিষেধ।

সঙ্গী নির্বাচনে সতর্ক করে মহান আল্লাহ বলেন,

“হে মুমিনগণ, আমার এবং তোমাদের শত্রুকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না।”

(সূরা মুমতাহিনা ৬০:১)

সঙ্গী ছাড়া মানুষের জীবন চলতে পারে না। সৎ সঙ্গীর সাথে চললে সৎ হওয়া যায়। আর অসৎ সঙ্গীর সাথে চলাফেরা করলে অসৎ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি পার্থিব জীবনে কোনো মানুষই সঙ্গীর সাহচর্য বা প্রভাব থেকে মুক্ত নয়।

তাই অসৎ সঙ্গ প্রতিরোধে ইসলামের নির্দেশনা হলো সৎসঙ্গ গ্রহণ করতে হবে। অসৎসঙ্গী গ্রহণ করা যাবে না।

মহানবি (সাঃ) বলেন,

“মানুষ তার বন্ধুর ধর্ম (স্বভাব-চরিত্র) দ্বারা প্রভাবিত, সুতরাং কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছ, তা যাচাই করে নিবে।”

(আহমদ ও তিরমিজি)

ঘ) সার সংক্ষেপ

  • মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ জীবন ছাড়া মানুষের পক্ষে বাস করা কঠিন। সঙ্গ ছাড়া শত আরাম-আয়েশও বিবর্ণ মনে হয়। সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ সঙ্গবদ্ধ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। মানুষ পারিবারিক পরিম-লে এক ধরনের সঙ্গ পায়, সামাজিক পরিমন্ডলে আরেক ধরনের সঙ্গ থাকে।
  • আবার বৈশ্বিক পর্যায়ে সঙ্গ ছাড়া মানুষ চলতে পারে না। সঙ্গী ভালো হলে মানুষের জীবন হয় সার্থক। আর সঙ্গী খারাপ হলে মানুষের জীবনে নেমে আসে অধঃপতন। এ জন্য ইসলাম সৎ সঙ্গ গ্রহণ ও অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করার নির্দেশনা দিয়েছে।

(৯) সুদ ও ঘুষ

ক) সুদের পরিচয়

সুদ-এর আরবি শব্দ ‘রিবা’। এর অর্থ বৃদ্ধি, বাড়তি, অতিরিক্ত, বহুগুণ হওয়া, ছাড়িয়ে যাওয়া প্রভৃতি। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়, প্রদত্ত পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত আদায় করাকে সুদ বলে।

খ) ইসলামে সুদ নিষিদ্ধ

সুদ হচ্ছে জুলুম ও শোষণের একটি হাতিয়ার। এ জন্য ইসলাম সুদকে চিরতরে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। সুদের অনিষ্ট শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, বরং নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

ইসলাম সুদের ব্যাপারে খুবই কঠোরতা অবলম্বন করেছে। এবং অকাট্যভাবে হারাম করে দিয়েছে। এতে করে সামগ্রিকভাবে মানুষের কল্যাণ সাধন হয়েছে। সমাজে নৈতিকতা ও অর্থনীতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছে।

হাদিসে বলা হয়েছে,

“যে সুদ খায়, সুদ খাওয়ায়, তার সাক্ষী হয় এবং তার দলিল লেখে তাদের সবার ওপর মহান আল্লাহ অভিশাপ করেন।”

(মুসনাদে আহমাদ)

গ) সুদের কুফল

  1. সুদী লেন-দেন মানুষের ইমান ও নীতি-নৈতিকতাকে ধ্বংস করে দেয়। সমাজের লোকদের প্রতি যে আর্থ সামাজিক দায়িত্ব রয়েছে, সুদখোর লোক তা উপলব্ধিও করতে পারে না। যারা সুদের লেনদেন করে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে তাদের জন্য রয়েছে সুস্পষ্ট যুদ্ধ ঘোষণা।
  2. সুদের প্রবর্তন আর্থিক ও নৈতিক দিক থেকে একটি জাতিকে মহাবিপর্যয়ে ঠেলে দিতে পারে। নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার দৃষ্টিতে দেখলে পরিষ্কার বুঝতে পারা যায় যে, সুদ মূলত স্বার্থপরতা, কৃপণতা, সংকীর্ণতা ও নির্মমতা প্রভৃতি মন্দ চরিত্রের ফল। সুদ মানুষের মধ্যে এগুলোরই ক্রমবিকাশ ঘটায়।
  3. সুদ সমাজ শোষণের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম বা উপায়। একদল লোক বিনাশ্রমে অন্যের উপার্জনে ভাগ বসায় সুদের সাহায্যে। ঋণগ্রহীতা যে কারণে টাকা ঋণ নেয়, সে কাজে তার লাভ হোক বা না হোক তাকে সুদের অর্থ দিতেই হবে। এর ফলে বহু সময়ে ঋণগ্রহীতাকে স্থাবর-অবস্থাবর সম্পদ বিক্রি করে হলেও সুদসহ আসল টাকা পরিশোধ করতে হয়।
  4. সুদ শ্রমবিমুখতা ও অলসতা সৃষ্টি করে। সুদভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাংকে অর্থ জমা রাখলে কোনো পরিশ্রম ও ঝুঁকি ছাড়াই সুদের মাধ্যমে নির্ধারিত হারে অর্থ পাওয়া যায়। এই ব্যবস্থা যোগ্যতাসম্পন্ন, প্রতিভাবান ও কর্মী লোককেও অর্কমণ্য ও অলস বানিয়ে দেয়। সুদের সঠিক কুফল বিবেচনায় সুদকে ইসলাম নিষিদ্ধ করে।

ঘ) ঘুষ

স্বাভাবিক প্রাপ্যের পরও অসদুপায়ে অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করাকে ঘুষ বা উৎকোচ বলে।

কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী অর্পিত কাজের জন্য নিয়মিত বেতন ভাতা পায়। কিন্তু সে কাজের জন্য বাড়তি কিছু গ্রহণ করাকে উৎকোচ বা ঘুষ বলে।

ঘুষদাতা কোনো অসৎ উদ্দেশ্য বা স্বার্থ হাসিলের জন্য ঘুষ দিয়ে থাকে। তাছাড়া টাকা-পয়সা ছাড়াও উপহারের নামে নানা সামগ্রী প্রদান করা হয়। যে নামেই দেয়া হোক না কেন এসবই ঘুষ-এর অন্তর্ভুক্ত।

ঙ) ঘুষের কুফল

ঘুষ বা উৎকোচের একটি জঘন্য সামাজিক অপরাধ। ঘুষের প্রতিক্রিয়া ও বিষক্রিয়া সমাজকে কুরে কুরে খেয়ে ফেলে এবং সমাজকে কলুষিত ও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।

ঘুষ আদান-প্রদানের মাধ্যমে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে, অবৈধ উপায়ে আত্মসাৎ করা হয়। ঘুষের মাধ্যমে অন্যায়ভাবে কাউকে সহায়তা অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ আত্মসাতের শামিল।

ঘুষ যেহেতু জঘন্য অপরাধ এত দাতা গ্রহীতা সমানভাবে অপরাধী। তাই এদের জীবন অভিশপ্ত।

হাদিসে আছে,

“রাসূলু (সাঃ) ঘুষ গ্রহণকারী এবং ঘুষদাতা এবং উভয়ের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনকারীদেরকে অভিশম্পাত করেন।”

(আবু দাউদ, ইবন মাজাহ, আহমদ ও হাকিম, মুসান্নেফে আবি শাইবা)

ঘুষ দেয়া ও গ্রহণের মাধ্যমে একজনের হক অন্যায়ভাবে অন্যজনকে প্রদান করা হয়। এ ধরনের কাজ জঘন্য পাপ, অমার্জনীয় অপরাধ।

ঘুষের কারণে সমাজে নানা রকম আর্থিক ও সামাজিক দুর্নীতির বিস্তার ঘটে। ঘুষ বা উৎকোচের কারণে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কাজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বরাদ্দ অর্থের সিংহ ভাগই ঘুষ বাবদ চলে যায়। ফলে উন্নয়ন কাজের পরিমাণ ও গুণগতমান হ্রাস পায়।

ঘুষ ছাড়া কোনো ‘ফাইল’ এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে যায় না। ফলে প্রশাসনিক কাজে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি হয়। এ জন্য ঘুষ নিষিদ্ধ।

চ) সার সংক্ষেপ

  • সুদ ও ঘুষ আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় একটি অনৈতিক ব্যবস্থা। ইসলাম আর্থ-সামাজিক স্ষ্ঠুু ব্যবস্থাপনায় সুদ ও ঘুষ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। অর্থব্যবস্থায় সুদ একটি কালো থাবা।
  • সুদের প্রভাবে মানুষ সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়ে। উৎপাদন ব্যাহত হয়। ঘুষ বা উৎকোচ এক মারাত্মক সামাজিক অনাচার ও দুরারোগ্য ব্যাধি। এর ফলে সমাজে নানা কুকর্ম ও পাপাচার বিস্তার লাভ করে।
  • সুদ ও ঘুষের প্রভাবে সমাজের আর্থ-সামাজিক প্রশাসনিক উন্নয়ন ও সচ্ছলতা ব্যহত হয়। এজন্য ইসলামে সুদ ও ঘুষকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

(১০) জুয়া ও লটারি

ক) জুয়া ও লটারী কী?

জুয়া জঘন্যতম সামাজিক অনাচার। জুয়াকে কুরআন মাজিদের ভাষায় মাইসির বলা হয়েছে। মাইসির অর্থ সহজ উপার্জন। অন্যায়ভাবে প্রতারণার মাধ্যমে অপরকে বঞ্চিত করে যে অর্থ উপার্জিত হয় তাকে জুয়া বলা হয়।

জুয়ায় মালিকানা বা লাভ ঘটনাক্রমের ওপর নির্ভরশীল। এক ব্যক্তির সম্পদ অন্য ব্যক্তির হস্তগত হওয়ার ভাগ্যক্রমে বা দৈব চক্রের সব কাজই জুয়ার অন্তর্ভুক্ত। এটি শয়তানি কাজ। অত্যন্ত ঘৃণ্য ও প্রতারণামূলক কাজ।

মহান আল্লাহ বলেন,

“হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী এবং ভাগ্যনির্ধারক শর, ঘৃণ্যবস্তু শয়তানের কাজ। অতএব এগুলো থেকে বেঁচে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও।”

(সূরা মায়িদা ৫:৯০)

চরিত্র ও প্রকৃতিগত দিক দিয়ে জুয়া ও লটারি অভিন্ন। তাই জুয়ার যে কুফল লটারিরও তাই। এ জন্য জুয়া ও লটারিকে একই ভাবে দেখা হয়।

জুয়া ও লটারি সামাজিক অনাচার ও অপরাধের মধ্যে একটি মারাত্মক অপরাধ। সমাজের বহু অন্যায় এ জুয়ার পাপাচার থেকে ছড়িয়ে পড়ে। ইসলাম তাই জুয়াকে চিরতরে নিষিদ্ধ ও হারাম ঘোষণা করেছে।

খ) জুয়া ও লটারির কুফল

জুয়া একটি শয়তানি কাজ। এর ফলে জুয়ারি ব্যক্তি শয়তানের প্ররোচনায় নানা ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হয়।

মহান আল্লাহ বলেন,

“এটি ঘৃণ্য শয়তানের কাজ।”

(সূরা মায়িদা ৫:৯০)

জুয়া ও মদ ইত্যাদির মাধ্যমে শয়তান মানুষের পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সপ্রসারিত করে। জুয়ার দ্বারা একজন লাভবান হয়। অন্যজন হয় নিঃস্ব। ফলে একে অপরের মধ্যে ভীষণ শত্রুতা শুরু হয়।

জুয়া হচ্ছে অন্যকে ঠকিয়ে লাভবান হওয়া। আর এতে আসল হকদার তার হক বা অংশ থেকে বঞ্চিত হয়।

জুয়া সম্পদ অর্জনের কোনো মাধ্যম নয়। এটা বিনা শ্রমে অন্যকে বঞ্চিত করে সম্পদ অর্জনের অপকৌশল। কাজেই বণ্টনের এ ব্যবস্থাটি ন্যায়নীতি বিহীন, নির্যাতনমূলক ও প্রব নামূলক।

জুয়া সকলের জন্যই খারাপ। এতে কারোরই কল্যাণ নেই। এজন্য যে সব বস্তু বা কাজ আমাদের জন্য কল্যাণকর আল্লাহ তায়ালা তা আমাদের জন্য হালাল করেছেন। আর যা অকল্যাণকর তা হারাম করে দিয়েছেন।

জুয়াড়ি ব্যক্তি বিনাশ্রমে টাকা উপার্জনের নেশায় কর্মবিমুখ হয়ে বসে থাকে। সে মনে করতে থাকে কাজ না করে কীভাবে জুয়া খেলে অধিক উপার্জন করা যায়। এভাবে কাজের প্রতি তার অনীহা তৈরি হয়। জুয়ার দ্বারা আপাতত লাভ হলেও এর দীর্ঘ মেয়াদি ফল হচ্ছে এক সময় জুয়াড়ি সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে।

বিনা শ্রমে জুয়ার মাধ্যমে অর্জিত টাকা পেয়ে তা খরচ করার জন্য জুয়াড়ি নানা পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে। জুয়ার টাকা সংগ্রহের জন্য জুয়াড়ি নানা ফন্দি-ফিকির করে। নিজের সম্পদ নষ্ট করে। অপরের টাকা লুট করে, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাইরাহাজানি ও সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ে।

জুয়া অনেক অপকর্মের জন্ম দেয়। সমাজকে কলুষিত করে। জুয়ার সংক্রমণে সংক্রমিত ব্যক্তি ও সমাজ মানবতার ঘৃণ্য শত্রু। এজন্য কুরআনে একে শয়তানি কাজ বলে অখ্যায়িত করেছে।

সর্বোপরি জুয়া একটি সামাজিক অনাচার। অনেক পাপাচারের উৎসাহদাতা। জুয়া সংক্রমণ ব্যাধির মত। এ ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে ব্যক্তি-সমাজ সভ্যতা কলুষিত হয় এবং নিঃশেষে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এ কারণে ইসলাম জুয়াকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

গ) সার সংক্ষেপ

  • জুয়া জঘন্যতম সামাজিক অনাচার। জুয়া হচ্ছে অন্যকে ঠকিয়ে লাভবান হওয়া। আর এতে আসল হকদার তার হক বা অংশ থেকে বঞ্চিত হয়। জুয়া সম্পদ অর্জনের কোনো মাধ্যম নয়। এটা বিনা শ্রমে অন্যকে বি ত করে সম্পদ অর্জনের অপকৌশল।
  • কাজেই বণ্টনের এ ব্যবস্থাটি ন্যায়নীতিবিহীন, নির্যাতনমূলক ও প্রবঞ্চনা মূলক। এছাড়াও জুয়ার ফলে সমাজে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এজন্য মহান আল্লাহ জুয়া ও লটারি হারাম করে দিয়েছেন।

(১১) মাদকাসক্তি ও ধূমপান

ক) মাদকাসক্তি

মাদকাসক্তি একটি যুগল শব্দ, যার একটি হলো মাদক, অপরটি হলো আসক্তি। অর্থাৎ মাদক+আসক্তি=মাদকাসক্তি। মাদক অর্থ মত্ততা জন্মায় এমন (মাদক দ্রব্য), আর আসক্তি অর্থ গভীর অনুরাগ, লিপ্সা, পাওয়ার দুর্দমনীয় প্রত্যাশা।

সাধারণত যে সকল দ্রব্যসামগ্রী পান বা ব্যবহার করলে নেশা সৃষ্টি হয় তা গ্রহণ করাকে মাদকাসক্তি বলে।

মাদকাসক্তির পরিচয় প্রসঙ্গে মহানবি (সাঃ) বলেন,

“নেশাজাতীয় যেকোনো দ্রব্য মাদক, আর যাবতীয় মাদকই হারাম।”

(মুসলিম)

খ) মাদক দ্রব্যসমূহ

নেশা সৃষ্টিকারী বা চিত্তবিভ্রমকারী দ্রব্যসমূহ মাদকদ্রব্য হিসেবে পরিচিত। এগুলোকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা যায়।

i) প্রাকৃতিক

প্রাকৃতিক উপায়ে যে সব মাদকদ্রব্য উৎপন্ন হয়, তাই প্রাকৃতিক মাদকদ্রব্য। যেমন- তাড়ি, আফিম, গাঁজা, ভাঙ, চরাসূ, হাশিশ, মারিজুয়ানা ইত্যাদি।

ii) রাসায়নিক

পরীক্ষাগারে রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার মাধ্যমে যে মাদকদ্রব্য হয়, তা-ই রাসায়নিক মাদকদ্রব্য। যেমন- হেরোইন, মরফিন, কোকেন, প্যাথেডিন, সঞ্জীবনী সুরা, বিভিন্ন প্রকার অ্যালকোহল প্রভৃতি।

গ) মাদকাসক্তির কুফল

মাদকাসক্তির কুফল মানবজীবনে খুবই বিপজ্জনক। মাদকাসক্তি যদিও কৃত্রিম ও সাময়িক আনন্দ দেয়, শক্তি বৃদ্ধি করে। কিন্তু তার ক্ষতি ও ধ্বংসের দিকটা সুদূর বিস্তৃত ও সর্বগ্রাসী।

মাদকাসক্তি মানুষকে নামায-রোজা ও অন্যান্য ইবাদত সর্বোপরি আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে রাখে এবং পাপাচারে লিপ্ত করে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে বিরত রাখতে।”

(সূরা মায়িদা ৫:৯১)

মাদকাসক্তি মানবদেহে অত্যন্ত মারাত্মক প্রভাব ফেলে। মাদকাসক্তির ফলে হজমশক্তি লোপ পায়, ক্ষুধা মন্দা, পাকস্থলীতে ঘা, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, হৃদপেশির দুর্বলতা, লিভার ও কিডনি বিনষ্ট হওয়া, শিরা ও ধমনী শক্তি ক্ষয়ে যাওয়া এবং অকালে বার্ধক্য আসে। গলাদেশ ও শ্বাসনালীর প্রচুর ক্ষতি হয়। যক্ষ্মা, জন্ডিস, হৃদভাল্বের বৈকল্য প্রভৃতি রোগে প্রায়ই ত্রিশ বছর বয়সের মধ্যেই আসক্ত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে।

মাদক নিশ্চিতভাবে বিবেকশূন্য করে ও মাতালে পরিণত করে। মদখোর পাগলের মত জীবনযাপন করে আর পশুর মত আচরণ করে। গৃহে, পরিবারে ও সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ভর্ৎসনা, গঞ্জনা, ভাংচুর, মারামারি এমনকি তার সামনে কেউ মুখোমুখি হলে তাকে হত্যা করে।

মানুষের বিবেক-বৃদ্ধি ও মস্তিষ্কের ওপর মাদকাসক্তির প্রতিক্রিয়া আরো মারাত্মক ও ক্ষতিকর। মস্তিষ্কের কারটেক্স বা উচ্চতর বুদ্ধিবৃত্তির স্তর নিস্তেজ হয়ে যায় ও মাতাল হয়ে পড়ে। লজ্জা-সংকোচ কমে যায়, কথাবার্তা বেশি বলে, এমনকি অনেক গোপন কথাও বের হয়ে পড়ে। কথাবার্তা এলোমেলো হয়ে যায়, এমনকি এক পর্যায়ে চেতনাও হারায়।

মাদকাসক্তি মানুষকে শুধু মানবতা ও নৈতিকতাবিরোধী কার্যকলাপের দিকেই উদ্বুদ্ধ করে না, এটা মানুষকে যাবতীয় মন্দ ও ঘৃণ্যতম পাপ কাজের দিকেও ধাবিত করে। এটা মানুষের চিত্তবিভ্রম ঘটায়। অস্থির ও উচ্ছৃঙ্খল করে তোলে। ব্যভিচার, নরহত্যা, ছিনতাই, রাহাজানি, সড়ক দুর্ঘটনা ও নারী নির্যাতনের মত জঘন্যতম অপরাধের অধিকাংশই এই মরণ নেশা মাদকাসক্তিরই পরিণাম।

ঘ) ধূমপান

ধূমপানের প্রতিশব্দ হলো তামাক গ্রহণ অর্থাৎ নিকোটিন শ্রেণিভুক্ত উদ্ভিদের কোনো পাতা, ফল, শেকড়, ডাল বা এর কোনো অংশবিশেষ।

পরিভাষায়, ধূমপান হলো তামাকদ্রব্য দ্বারা প্রস্তুত দ্রব্য চোষণ, চিবানো অথবা শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা।

ধূমপান ইসলামি দৃষ্টিকোণে নিষিদ্ধ এ ব্যপারে ওলামায়ে কেরামের সকলে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও হাদিসের বাণী দ্বারা ধূমপানের অবৈধতা প্রমাণিত।

মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এবং হাদিসে ধূমপান নামে কোনো বিধান নেই। কিন্তু ইসলাম নানাবিধ যৌক্তিতার ভিত্তিতে ধূমপান নিষিদ্ধ করছে। ধূমপান একটি অপবিত্র জিনিস বিধায় এটা হারাম।

মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বলা হয়েছ,

“আল্লাহ তাদের ওপর অপবিত্র জিনিসকে হারাম করেছেন”

(সূরা আরাফ ৭:১৫৭)

ঙ) ধূমপানের কুফল

ধূমপান, মাদকাসক্তি মারাত্মক ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক এবং মানবজীবনের করুণ পরিণতি ডেকে আনে। ইসলামি শরিয়ত ধূমপানের মত আত্মঘাতি বদভ্যাস বর্জন করার তাগিদ দিচ্ছে।

ধূমপানের মারাত্মক কুফলগুলো হলো-

i) অনর্থক অপব্যয়

ধূমপান অনর্থক অপব্যয়। ইসলামে সব রকম অপব্যয় ও অপচয় অবশ্য বর্জনীয়।

অপব্যয়ীদের আল্লাহ পাক শয়তানের ভাই বলে আখ্যায়িত করেছেন,

“নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।”

(সূরা বনি ইসরাইল ১৭:২৭)

ii) উৎকট গন্ধ ছড়ায়

ধূমপান শুধু অপব্যয় নয়, মারাত্মক ক্ষতিকর। সিগারেট, বিড়ি, হুক্কা ইত্যাদির পোড়া তামাকের উগ্র- গন্ধ যে কত বিরক্তিকর তা সর্বজনবিদিত। দুর্গন্ধ নিয়ে আল্লাহ পাকের ইবাদত করা যায় না।

মহানবি (সাঃ) বলেছেন,

“যে ব্যক্তি দূর্গন্ধযুক্ত দ্রব্য খায়, সে যেন (ঐ অবস্থায়) মসজিদের নিকট না আসে।”

(আল-হাদিস)

iii) শারীরিক ক্ষতি

ধূমপানে মারাত্মক রোগ-ব্যধি, জীবনঘাতি যক্ষ্মা, ব্রঙ্কাইটিস, দন্তক্ষয়, ক্ষুধামন্দা, গ্যাস্ট্রিক, আলসার, ফুসফুসের ক্যান্সার ও হৃদরোগ হয়ে থাকে। এছাড়াও ধূমপানের ফলে গলায় এবং ফুসফুসে ক্যান্সারের সৃষ্টি হয়, প্যারালাইসিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি এবং যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়। কারণ এতে নিকোটিন জাতীয় এক প্রকার বিষ রয়েছে।

iv) পরিবেশদূষণ

পুড়ে যাওয়া তামাকের বিরক্তিকর ও বিশ্রী ধোঁয়া বায়ু দূষিত করে, পানিও দূষিত করে এবং গোটা পরিবেশকেই দূষিত করে তোলে। এতে আশ-পাশের নারী, শিশু রোগী, সুস্ত ব্যক্তি ও বৃদ্ধের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে।

চ) মাদকাসক্তি ও ধূমপানের প্রতিকার

মাদকাসক্তি ও ধূমপানের করাল গ্রাস থেকে সমাজকে মুক্ত করতে হলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির পক্ষ হতে যে সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে তা নিম্নরুপ-

  • প্রথমত, দায়িত্ব বর্তায় তাদের ওপর, যারা মাদকদ্রব্য ও ধূমপানের বস্তু প্রস্তুত ও সরবরাহের কাজে জড়িত, তাদেরকে জাতীয় স্বার্থে এ ঘৃণ্য কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • দ্বিতীয়ত, প্রতিটি পরিবার প্রধানের উচিত তারা যেন নিজেদের সন্তান-সন্ততিদের মাদক দ্রব্য ও ধূমপানের ক্ষতি সম্পর্কে উত্তম প্রশিক্ষণ দান করেন। নিজেদের সন্তানদের মধ্যে এ কুঅভ্যাস কোনো মতেই গড়ে উঠতে না পারে সে সম্পর্কে সদা সতর্ক থাকুন। অসৎ সঙ্গ ও দুশ্চরিত্রবান বন্ধু-বান্ধবদের সাহচর্যে যেন না যেতে পারে সে ব্যাপারে অতি সতর্ক হবেন। সর্বোপরি সন্তানদের যথাযথ ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে, ধূমপান, মাদকাসক্তির ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
  • তৃতীয়ত, মাদকাসক্তি রোধে শিক্ষক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। শিক্ষকদের ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণ, চিন্তাবিশ্বাস, নির্দেশনা ও উপদেশ এবং অভ্যাসের একটি কার্যকরী প্রভাব ছাত্রদের ওপরে পড়ে থাকে। শিক্ষকগণ যদি ছাত্রদের মধ্যে এ বদ অভ্যাস গড়ে ওঠার ব্যাপারে সতর্ক থাকেন। আর এ মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ ও উপদেশ দিতে থাকেন; তাহলে ছাত্ররা এ পথে পা বাড়াতে সহজে সাহস করবে না।
  • চতুর্থত, মসজিদের ইমামগণ জুমার খুতবায় মাদকাসক্তির ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে ওয়াজ-নসিহত করার মাধ্যমেও এর বিস্তৃতি রোধ করতে পারেন।
  • পঞ্চমত, মাদকদ্রব্য ও ধূমপানের প্রসার রোধকল্পে সমাজ নেতাদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। কোনো পাড়ার সর্দার বা সমাজনেতা যদি মাদকাসক্তির প্রসার রোধের দৃঢ় সংকল্প নিয়ে প্রচেষ্টা চালান, সে পাড়া বা সমাজে কখনো মাদকাসক্তির বিস্তার ও প্রসার ঘটতে পারে না।
  • সর্বশেষ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগকারী সংস্থা তথা সরকারের। দেশে মাদকাসক্তি ও ধূমপানবিরোধী আইন রয়েছে। শক্ত হাতে এ সব আইন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলেই মাদক ও ধূমপান প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

ছ) সার সংক্ষেপ

মাদকাসক্তি (Drug Addication) বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সমস্যা। মাদকদ্রব্য বা মাদকাসক্তি তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে যে মনস্তাত্ত্বিক সামাজিক বিচ্ছিন্নতাবোধ, নৈতিক স্খলন, মূল্যবোধের অবক্ষয় ও অপরাধপ্রবণতার জন্ম দিচ্ছে, তা সমাজজীবনের গতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে এবং এর বিরুদ্ধে কার্যকর সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা অপরিহার্য।

(১২) অধিকারহরণ, চুরি, ডাকাতি, অপহরণ, ছিনতাই

ক) অপরের অধিকার হরণ

সামাজিক অপরাধপ্রবণতার মধ্যে অপরের অধিকারহরণ, চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই খুবই মারাত্মক অপরাধ। এগুলো বিস্তার লাভ করলে সমাজ-সভ্যতা ও শান্তি-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে।

অধিকার শব্দটি বেশ ব্যাপক অর্থবোধক। জান, মাল এবং সম্মানের অধিকার, ভালো ব্যবহার ও সদয় আচরণ পাওয়ার অধিকার। এসব অধিকারের লংঘঙন হয় এমন কাজ করাকে অধিকারহরণ বলা হয়।

খ) চুরি

চুরির আরবি প্রতিশব্দ ছারাকাতুন এর অর্থ গোপনে ছিদ্র করা, গোপনে কোনো কিছু নিয়ে যাওয়া।

ইবনে হুম্মাম বলেন, ইসলামি আইনের পরিভাষায়, চুরি বলা হয় প্রাপ্তবয়স্ক লোকের অপরের সম্পদকে গোপনে হরণ করা, যার পরিমাণ দশ দিরহাম, যা কোনো স্থানে সংরক্ষক দ্বারা সুরক্ষিত।

চুরি করা মহাপাপ। ইসলামে চুরির জন্য নির্ধারিত শাস্তি রয়েছে।

কুরআন মাজিদে ঘোষণা করা হয়েছে,

“পুরুষ চোর ও নারী চোর উভয়ের হাত কেটে দাও। তারই শাস্তি স্বরূপ যা তারা করেছে।”

(সূরা মায়িদা ৫:৩৮)

গ) ইসলামে চুরির শাস্তি

ইসলামে চুরির শাস্তির বিধান হল- (প্রথম) চুরিতে এক হাত, (দ্বিতীয়) চুরিতে অন্য হাত কাটা, (তৃতীয়) চুরিতে এক পা, চতুর্থ চুরিতে অপর পা কাটা যাবে। কী পারিমাণ সম্পদ চুরির জন্য হাত কাটা যাবে এ সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, এক দিনারের এক চতুর্থাংশের কমে চোরের হাত কাটা যাবে না।

চুরির শাস্তি কেবল ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ প্রয়োগ করবে। অন্য কেউ নয়।

ঘ) ডাকাতি

সশস্ত্র ডাকাতি ও লুণ্ঠনের আরবি প্রতিশব্দ হলো আল-হিরাবা, যাকে ইংরেজিতে Robbery বলে।

পরিভাষায়, ডাকাতি বলা হয়, সম্পদ দখলের উদ্দেশ্যে এমন ত্রাস সৃষ্টি করা, সাধারণভাবে যার প্রতিকার করা সম্ভব হয় না।

ডাকাতির ৪টি শাস্তির কথা কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। যথা- (এক) হত্যা করা হবে; (দুই) শূলিবিদ্ধ করা হবে; (তিন) দুই হাত ও দুই পা কর্তন করা হবে; (চার) নির্বাসনে দেয়া হবে।

এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

“যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে লড়াই করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে, তাদের হত্যা করা হবে অথবা শূলিতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্তপদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া হবে, অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটি হলো তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্ছনা, আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি। কিন্তু যারা তোমাদের গ্রেফতারের পূর্বে তওবা করে; জেনে রাখ, আল্লাহ ক্ষমাকারী, দয়ালু।”

(সূরা মায়িদাহ ৫:৩৩-৩৪)

ডাকাতির ধরন বুঝে ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত শাস্তি প্রয়োগ করতে হবে-

  1. যদি ডাকাত ত্রাসের মাধ্যমে শুধু মাল নিয়ে নেয়, তবে তার হাত ও পা বিপরীত দিক থেকে কর্তন করা হবে।
  2. আর যদি হত্যা করে, তবে হত্যা করা হবে। ডাকাত যদি মালও নিয়ে নেয় আর হত্যাযজ্ঞও চালায়, তবে রাষ্ট্রপ্রধান তার ইচ্ছে অনুযায়ী শাস্তি দিবেন। তিনি চাইলে তার হাত ও পা বিপরীত দিক থেকে কর্তন করবেন অতঃপর তাকে হত্যা করবেন অথবা শূলে চড়িয়ে মারবেন। আর যদি তিনি ইচ্ছে করেন, হাত-পা না কেটে হত্যা করবেন কিংবা শূলে চড়াবেন। আর যদি ডাকাত মালও না নেয় আর হত্যাও না করে, শুধু ভয়ভীতি দেখায়, তবে নির্বাসনে দিবেন। অথবা জেলখানায় বন্দী রাখবেন।

ঙ) অপহরণ

অপহরণ অর্থ লুণ্ঠন। এর আরবি প্রতিশব্দ ইখতিতাফ, ইংরেজি প্রতিশব্দ Kidnap। অপহরণ মানে লুণ্ঠন করা, চুরি করে নিয়ে যাওয়া, জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি।

অপহরণ কবিরা গুনাহ। এর কুফল সুদূরপ্রসারী। জনগণ অপহরণকারীদের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে। গুমের ভয়ে মানুষ রাস্তায় চলাফেরা করতে নিরাপদ বোধ করে না। অভিভাবকগণ স্কুলগামী ছোট ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাতে ভরাসূা পায় না। ব্যবসায়ীরা পণ্য নিয়ে অবাধ ও নিশ্চিন্তে গমনাগমন করতে সাহস পায় না। এটি একটি অমানবিক ও ঘৃণিত কাজ। ইসলামে এ ধরনের কাজকে অত্যন্ত ঘৃণিত ও পাপ বলে গণ্য করা হয়েছে।

চ) ছিনতাই

ছিনতাইয়ের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Hijack, ছিনতাই মানে কারও কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া, হরণ করা। অপরের জিনিস, অন্যের সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া বা জোরপূর্বক হরণ করাকে ছিনতাই বলে।

ছিনতাই একটি জঘন্য অপরাধ। ছিনতাইয়ের ফলে ঘরে, বাইরে, রাস্তাঘাটে, ট্রেনে, বিমানে সর্বত্র নিরাপত্তাহীনতা চরম আকার ধারণ করে। ছিনতাইয়ের ভয়ে মানুষের নিরাপদে চলাফেরা দুষ্কর হয়ে পড়ে। ইসলাম ছিনতাইকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

হাদিসে এসেছে,

“যখন কোনো ব্যক্তি বিশেষ মর্যাদাশীল কোনো বস্তু ছিনিয়ে নেয়। আর তার এ (বিপদের সময়) সময় অন্য লোকেরা তার দিকে চোখ তুলে দেখতে থাকে, তখন সে ব্যক্তি (প্রকৃত) মুমিন থাকে না।”

(মুসলিম)

ছ) সার সংক্ষেপ

অধিকার হরণ, চুরি, ডাকাতি, অপহরণ, ছিনতাই মারাত্বক ফৌজদারি অপরাধ ও কবীরাহ গুনাহ। এ সব অপরাধ সমাজজীবনের গতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করে। এর বিরুদ্ধে কার্যকর সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা অপরিহার্য। নৈতিক আদর্শের উৎকর্ষ এবং ইসলামি বিধি-নিষেদ প্রয়োগ করে এ সব অপরাধ প্রেিরাধ করা যায়।

(১৩) হত্যা, আত্মহত্যা

ক) হত্যা

আরবি ভাষায় হত্যার প্রতিশব্দ হলো- কাতলু। যার শাব্দিক অর্থ হলো কর্তন করা, মার্ডার (Murder) বা হত্যা করা।

পরিভাষায়, হত্যা এমন একটি কর্ম, যা মানুষের পক্ষ থেকে সংঘটিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ একজন মানুষের প্রাণ অন্য মানুষের কর্ম দ্বারা চলে যাওয়াকে হত্যা বলা হয়।

হত্যা অমার্জনীয় অপরাধ। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা লাভ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণে কোনোরূপ কারণ ব্যতীত এবং আইনে চূড়ান্ত বিচার ও সে বিচারে দ্বণ্ডস্বরূপ প্রাণ সংহার ব্যতীত অন্য কোনোভাবে মানুষকে হত্য করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ অর্থাৎ হারাম।

মানুষের অপরাধের মধ্যে মানুষ হত্যার অপরাধ সবচেয়ে বড় ও মারাত্মক গুনাহ। মানুষ যখন এ অপরাধ করে তারই এক মানুষ ভাইয়ের বিরুদ্ধে, তখন সে গোটা মানবতার সাথেই শত্রুতা করে। তাই ইসলাম এ অপরাধের ন্যায়বিচারভিত্তিক কঠিন শাস্তির বিধান প্রবর্তন করেছে।

মহান আল্লাহ বলেন,

“হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের জন্য হত্যাকার্যে কিসাস ফরজ করে দেয়া হয়েছে।”

(সূরা বাকারা ২:১৭৮)

কিসাসের বিধান সামাজিক নিরাপত্তা, রক্তপাত কমানো, অন্যায় হত্যা বন্ধ, দৃষ্টান্ত ও উপদেশ গ্রহণের মাধ্যমে হত্যার প্রতি মানুষের ভয়-ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে ইসলাম হত্যার বিনিময়ে হত্যার বিধান প্রবর্তন করেছে।

খ) আত্মহত্যা

আত্মহত্যা বা আত্মহনন এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো- Suicide, আরবিতে বলা হয়ে থাকে ইনতিহার। এর শাব্দিক অর্থ হলো- নিজেকে হত্যা করা, স্বেচ্ছায় নিজের দ্বারা নিজের জীবন নাশ, স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশ করাকে আত্মহত্যা বলে।

আত্মহত্যা একটি ব্যক্তিগত ও সামাজিক ব্যাধি। মহান আল্লাহ মানুষের মৃত্যু ঘটান। কিন্তু আত্মহত্যার ক্ষেত্রে বান্দা স্বাভাবিক মৃত্যুকে উপেক্ষা করে নিজেই নিজেকে হত্যা করে। এ কারণে এটি ইসলাম সমর্থন করে না।

ইসলামি দৃষ্টিকোণে আত্মহত্যা কবিরা গুনাহ বা মহাপাপ। ফিকহবিদের দৃষ্টিতেই আত্মহত্যা হারাম এবং আত্মহত্যার শাস্তি হলো জাহান্নাম।

কুরআনে আত্মহত্যাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, َ

“তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না।”

(সূরা নিসা ৪:২৯)

খ) আত্মহত্যা প্রতিরোধে করণীয়

আত্মহত্যা প্রতিরোধে ইসলাম নির্দেশিত করণীয় বিষয়াদি নিম্নরূপ-

i) ধৈর্যধারণ

মূলত ধৈর্যের অভাবেই মানুষের মাঝে এমন একটি মহাপাপের বিস্তার ঘটছে। এছাড়া শয়তানের কু-প্ররোচনা তো আছেই। সব বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করে শয়তানের ধোঁকা থেকে বেঁচে ইসলামের আইন ও অনুশাসন মেনে চলার মাধ্যমেই কেবল এই মহাব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

ii) মানসিকভাবে আঘাত না করা

মানসিক হতাশা আত্মহত্যার অন্যতম কারন। এমন কোনো মানসিক কষ্ট না দেয়া, যা তাদেরকে আত্মহত্যার মতো চরম পদক্ষেপ দিতে বাধ্য করে। যেমন- পরীক্ষায় ফলাফল ভালো না করায় পিতা-মাতার উচিত হবে ছেলেমেয়েকে ধমক না দিয়ে ভালোভাবে পড়াশুনা করতে উদ্বুদ্ধ করা।

iii) আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়া

হতাশা থেকে আত্মহত্যার উদ্ভব হয়। ইসলাম মানুষকে হতাশ না হয়ে আল্লাহর রহমত লাভের আশা করতে উৎসাহিত করে। তাই মুমিন কখনো হতাশ হবে না; বরং সর্বদা আল্লাহর রহমতের আশা করবে।

মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে নিরাশ না হতে ঘোষণা দিয়ে বলেন,

 “তোমরা আমার রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।”

(সূরা যুমার ৩৯:৫৩)

iv) ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা

মানুষের জীবনের প্রতিটি দিন এক রকম কাটে না। ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন সর্বত্রই পরিবর্তন হতে থাকে। এখানে সুখ-দুঃখ, সচ্ছলতা-দরিদ্রতা, অভাব-অনটন, বিপদ- আপদ, কষ্ট-শোক মানুষের জীবনের নিত্যসঙ্গী। তাই সমাজ থেকে আত্মহত্যা নির্মূলে প্রথমত দরকার আল্লাহর রহমতের কমনা এবং সমাজ ব্যবস্থায়ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের বাস্তব অনুশীলন।

গ) সার সংক্ষেপ

  • হত্যা একটি জঘন্যতম অপরাধ। বিশেষত নর হত্যা মারাত্মক মানবতাবিধ্বংসী অপরাধগুলোর অন্যতম। যে ব্যক্তি একজন মানুষকে হত্যা করে, সে গোটা মানব জাতিকে হত্যা করার দায়ে দায়ী। মহান আল্লাহ হত্যার শাস্তি সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
  • হত্যার আরেক ধরণ হলো আত্মহত্যা। হতাশা, অইমান, বিপদ-আপদ, অমানবিক কষ্ট ইত্যাদির কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে। ইসলাম আত্মহত্যাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, এরই সাথে আত্মহত্যা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা দিয়েছে। আল্লাহর রহমত কামনা, বিপদে ধৈর্যধারণ সর্বোপরি ইসলামি অনুশাসন মেনে চলাই আত্মহত্যা প্রতিরোধ করবে।

(১৪) যৌতুক ও নারী নির্যাতন, ইভটিজিং

ক) যৌতুকের পরিচয়

যৌতুক বাংলা শব্দ। এর প্রতিশব্দ পণ। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে “Dowry”। প্রচলিত অর্থে বরপক্ষ কনেপক্ষ থেকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যা কিছু আদায় করে থাকে তার নাম যৌতুক।

বাংলাপিডিয়ায় বলা হচ্ছে, বিবাহের চুক্তি অনুসারে কন্যাপক্ষ বরপক্ষকে বা বরপক্ষ কন্যাপক্ষকে যে সম্পত্তি বা অর্থ দেয় তাকে যৌতুক বা পণ বলে।

যৌতুক আমাদের জাতীয় জীবনে একটি নিমর্ম ও কলঙ্কজনক অভিশাপ। এটি সামাজিক ব্যাধি হিসেবে বিস্তার লাভ করেছে। প্রতিনিয়ত অসংখ্য নারী এ ঘৃণ্য ব্যাধির শিকার হচ্ছে। এমনকি এর চরম পরিণতিতে অনেকে মৃত্যুর শিকার হচ্ছে বা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। ইসলাম যৌতুকের মতো অসামাজিক লেন-দেন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

নারী নির্যাতনের একটি অমানবিক মাধ্যম হলো যৌতুক। অনেক নারী যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়। অনেক ক্ষেত্রে যৌতুকের টাকা না দিতে পেরে তারা আত্মহত্যা করে। ইসলাম যৌতুকের স্থলে মোহরের বিধান করে নারী নির্যাতন বন্ধে নির্দেশনা দিয়েছে।

খ) যৌতুক প্রতিরোধে করণীয়

যৌতুক প্রতিরোধে ইসলাম নির্দেশিত করণীয় দিকসমূহ নিম্নরূপ-

i) ইসলামি মূল্যবোধের চর্চা

ইসলাম কোনোভাবেই যৌতুক সমর্থন করে না। ইসলাম এটাকে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ ও অবৈধ উপায়ে অর্থ লেন-দেন হিসেবে গণ্য করে। ইসলামের এই মূল্যবোধ সম্পর্কে সমাজের প্রতিটি মানুষকে সচেতন করতে পারলে যৌতুক অনেকাংশে কমে যাবে।

ii) যৌতুকের স্থলে দেনমোহর

ইসলামে যৌতুকের আদৌ স্থান নেই। মোহর আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত স্ত্রীর জন্য একটি বিশেষ উপঢৌকন। মোহর প্রদান স্বামীর জন্য বাধ্যতামূলক। এটা স্ত্রীর আবশ্যকীয় প্রাপ্য, একটি বিশেষ অধিকার।

নারীদের মোহরানা যথাযথভাবে আদায়ের নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন,

“আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিয়ে দাও।”

(সূরা নিসা ৪:৪)

iii) গণসচেতনতা

শিক্ষিত পরিবারের চেয়ে অশিক্ষিত পরিবারে যৌতুকের চর্চা বেশি হতে দেখা যায়। তাই শিক্ষা ব্যবস্থায় যৌতুক বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করলে যৌতুক কমে যাবে। এ লক্ষ্যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌতুক যে অত্যন্ত জঘন্য, অভিশপ্ত ও অনৈসলামিক প্রথা এ বিষয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষাদান করতে হবে।

গ) নারী নির্যাতন

সমাজে যতো রকম অনাচার আছে তার মধ্যে জঘন্য হলো নারী নির্যাতন। নারীর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টি বিভিন্ন অজুহাতে নারীর ওপর দৈহিক ও মানসিকভাবে নিপীড়ন চালানো অথবা নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক কিছু করতে বাধ্য করাই নারী নির্যাতন।

ঘ) নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ইসলামের শিক্ষা

ইসলাম নারীকে মানবিক মর্যাদা ও মানবাধিকারের পূর্ণাঙ্গ নিশ্চয়তা প্রদান করেছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ইসলামের নির্দেশনা হলো-

i) নারীর নিরাপত্তা রক্ষায় পর্দার বিধান

ইসলাম নারীর সার্বিক নিরাপত্তা বিধান করেছে। রাস্তায়, কর্মস্থলে ও যত্রতত্র নারীদেরকে হয়রানি করা তো দূরের কথা, বরং ইসলাম নারীদের সৌন্দর্যের প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে অবনত রাখার নির্দেশ দিয়েছে।

মহান আল্লাহ বলেন,

‘‘মুমিনদেরকে বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থান হেফাজত করে। এটা তাদের জন্য পবিত্রতম।’’

(সুরা আন-নূর ২৪:৩০)

ii) যিনা-ব্যভিচার নিষিদ্ধ

ইসলাম নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ব্যভিচার, দেহব্যবসায়, নগ্নতা, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা ও দেহপ্রদর্শনীকে নিষিদ্ধ করেছে।

মহান আল্লাহ বলেন,

‘‘আর তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। নিশ্চয়ই তা অ শ্লীলতা ও খারাপ পথ।’’

(সূরা বনী ইসরাঈল ১৭:৩২)

ঙ) কাজের মেয়ের সাথে ভালো ব্যবহার

অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাজের মেয়েরা নির্যাতনের শিকার হয়। বাসা-বাড়িতে কর্মরত কাজের মেয়ে ক্রীতদাসী নয়।

কাজের মেয়ের সাথে ভালো ব্যবহার সম্পর্কে মহানবি বলেন,

‘‘তোমরা যা খাবে তাদেরকে তা খেতে দেবে এবং তোমরা যা পরবে তাদেরকে তা পরতে দেবে।’’

(মুসনাদ আহমাদ)

চ) তালাকের অপব্যবহার নিষিদ্ধ

ইসলাম নারীকে তালাক প্রদান করে নির্যাতন করা নিষিদ্ধ করেছে।

ইসলাম স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন অস্বস্তিকর হলেই কেবল সুন্দর সমাধানের জন্য তালাকের বিধান রেখেছে। কারো প্রতি তালাকের উদ্দেশ্যে নির্যাতন করা নিষিদ্ধ।

সাংসারিক অশান্তি দেখা দিলে উভয়ের মধ্যে দুপক্ষের সালিস বসিয়ে ব্যাপক আলোচনার ভিত্তিতেই একমত হয়ে তালাকের সিদ্ধান্ত নিবে।

সালিসের পর করণীয় সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

“অতঃপর বিধি মোতাবেক রেখে দেবে কিংবা সুন্দরভাবে ছেড়ে দেবে।”

(সূরা বাকারা ২:২২৯)

ছ) সারসংক্ষেপ

  • আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা হিসেবে মর্যাদা দান করেছেন। মানব সমাজের অর্ধাংশ নর অর্ধাংশ নারী। নর-নারী পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। এদের যেকোনো একজনকে বাদ দিয়ে মানব সমাজ শুধু অসম্পূর্ণই নয়, এর অস্তিত্বই অসম্ভব।
  • ইসলাম নারীকে হীনতার নিম্নতম স্থান থেকে অনেক ঊর্ধ্বে তুলে এনে তাদেরকে বিভিন্নভাবে অধিকার প্রদান করে। ইসলামি সভ্যতা সর্বপ্রথম নারীকে মা হিসাবে, স্ত্রী হিসেবে কন্যা হিসেবে এবং বোন হিসেবে মহান মর্যাদায় ভূষিত করে। তাই আজকের দিনেও যৌতুক ও নারী নির্যাতন মোকাবিলায় প্রয়োজন ইসলামি অনুশাসন মেনে চলা।

(১৫) খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল

ক) খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল

ভেজাল শব্দটি বহুল প্রচলিত। এর আভিধানিক অর্থ মিশ্রিত, মেকি, খাঁটি নয় এমন, Cheat, Fraud ইত্যাদি। এর আরবি প্রতিশব্দ গাশ্শাহ।

পরিভাষায়, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল বলতে, উৎকৃষ্ট দ্রব্যের সঙ্গে নিকৃষ্ট দ্রব্যের মিশ্রণ যেমন খাদ্যে কৃত্রিম, মেকি, ক্ষতিকর পদার্থ মিশানো, মাত্রাতিরিক্ত প্রিজারভেটিভ মিশ্রিত কোমল পানীয়, ফরমালিন মিশ্রিত মাছ, কীটনাশক মিশ্রিত শুঁটকি এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্যকে বুঝায়।

খ) খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল ভয়াবহ অপরাধ

খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে না পারলে জনগণের খাদ্য অধিকার লঙ্ঘিত হয়। নিরাপদ খাদ্য আবার খাদ্য নিরাপত্তার অপরিহার্য অংশও বটে। তাই এটি নিশ্চিত করতে না পারলে সার্বিকভাবে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।

বর্তমানে শাকসবজি, মাছ-মাংস, ফলমূল এমনকি শিশুখাদ্য ও ঔষধে ভেজাল এবং রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার মানবস্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখীন। এমনকি মানুষের জীবন হুমকিতে পতিত হচ্ছে, ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে নানাবিধ দুরারোগ্য ব্যাধি ও জীবনহানির ঘটনা ঘটে।

ইসলাম মালের দোষ গোপন করা, ধোঁকা, পণ্যের মান নিয়ে প্রতারণা ও ভালো পণ্যের সাথে মন্দ পণ্যমিশ্রণসহ যেকোনো ধরণের ভেজাল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

হাদিসে এসেছে,

“আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একদিন খাদ্যের স্তূপের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি এর মধ্যে হাত প্রবেশ করিয়ে দেখেন যে, খাদ্যদ্রব্যটি ভেজাল। তিনি বললেন, হে খাদ্যের মালিক, এটা কী? সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। তিনি বললেন, তুমি কেন এটাকে উপরে রাখলে না, যাতে মানুষ এটি দেখতে পায়? যে ধোঁকা দেয়, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।”

(সহিহ মুসলিম)

গ) খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে ইসলাম

মানুষের খাদ্য হতে হবে পাক-পবিত্র এবং শরীর স্বাস্থ্যের জন্য কল্যাণকর। কাজেই মানুষের খাদ্যদ্রব্য ভেজাল মিশ্রিত করে মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনের জন্য হুমকি তৈরি করা কোনোভাবেই সমর্থন যোগ্য নয়। এটা হারাম, কবিরা গুনাহ। এটা ধোঁকার শামিল।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,

“যে ধোঁকা দেয়, সে আমার উম্মাত নয়।”

(মুসলিম)

খাদ্যদ্রব্য ভেজাল দিয়ে বিক্রি করা ব্যবসায় নীতির বিপরীত কাজ। যা ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম।

মহান আল্লাহ বলেন,

“হে মুমিনগণ, তোমরা অপরের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না।”

(সূরা আন নিসা ৪:২৯)

ইসলাম খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে হালাল পন্থায় ব্যবসায় করতে উৎসাহিত করেছে। শুধু খাদ্যে ভেজাল নয়, যেকোনো পণ্যদ্রব্যে ভেজাল দিয়ে বিক্রি করা প্রতারণা এবং তা হারাম। পক্ষান্তরে, সততা ও বিশ্বস্ততার সাথে ব্যবসায় করলে তার মর্যাদা অতি উচ্চে।

মহানবি (সাঃ) বলেন,

“সৎ বিশ্বস্ত মুসলিম ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন শহীদদের সঙ্গী হবেন।”

(মুস্তাদরাক-হাকেম)

খাদ্যে ভেজাল দিয়ে অর্থোপার্জনকারীর পরিণাম হবে জাহান্নাম।

মহানবি (সাঃ) বলেন,

“কিয়ামতের দিন মানুষের পা একটুও সামনে অগ্রসর হতে পারবে না পাঁচটি প্রশ্নের ব্যাপারে মীমাংসা হওয়া ব্যতীত। (এক) জীবন কীভাবে কাটিয়েছে? (দুই) যৌবন কীভাবে কাটিয়েছে? (তিন) কোন পন্থায় সম্পদ উপার্জন করেছে? (চার) কোন পন্থায় সম্পদ ব্যয় করেছে? (পাঁচ) ইলম অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে?

(জামে তিরমিযি)

সুতরাং আমরা খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলবো।

ঘ) সার সংক্ষেপ

  • মানুষ বেঁচে থাকার জন্যই খাবার গ্রহণ ও পান করে। আল কুরআন ও হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা হলো- যে রিজিক দেওয়া হয়েছে, তা থেকে খাও, পান কর কিন্তু অপচয় করবে না।
  • মহান আল্লাহ এ পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণির জীবিকার দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনিই সবার রিজিক দান করেন। তাই খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে স্রষ্টার পবিত্র রিজিককে অপবিত্র করা নিষিদ্ধ।

(১৬) দুর্নীতি

ক) দুর্নীতি

দুর্নীতি (দুঃ+নীতি) শব্দের আভিধানিক অর্থ কু-নীতি, কু-রীতি, খারাপনীতি, অপনীতি, নীতি বিরুদ্ধ, নীতিবহির্ভুত কাজ। ইংরেজি প্রতিশব্দ Corruption।

ট্রান্সপ্যারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতির সংজ্ঞা এভাবে বলেছে, Corruption is the abuse of public office for private gain. অর্থাৎ ব্যক্তিগত লাভের জন্য গণপ্রশাসনের অপব্যবহারই দুর্নীতি।

দুর্নীতি একটি সামাজিক অভিশাপ। কোনো জাতির ধ্বংসের পূর্বে তাদের মধ্যে দুর্নীতি মহামারির মত বিস্তার লাভ করে থাকে। এটা এমন এক ধরনের অপরাধ, যা গোপনীয়ভাবে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে সম্পাদিত হয়।

দুর্নীতির মূল মাধ্যম হলো ঘুষ। তারপর ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থ আত্মসাৎ, প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে গাফলতি, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি। ইসলামে এটি হারাম।

খ) দুর্নীতি দমনে ইসলাম

দুর্নীতি দমনে ইসলামের নির্দেশনা হলো-

i) আল্লাহভীতি

আল্লাহর প্রতি অনুরাগ ও ভীতি মানুষের হৃদয়ে সর্বদা জাগ্রত থাকলে দুর্নীতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। পরকালের ভয় থাকা আবশ্যক। কেননা এ দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী। পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ও ভয় যার মনে কাজ করবে সে কখনো অন্যায় ও দুর্নীতির মতো গর্হিত কাজ করতে পারে না।

মহান আল্লাহ বলেন,

“ওহে বিশ্বাসীগণ, আল্লাহকে ভয় করো, ঠিক যতটুকু ভয় তাকে করা উচিত।”

(সূরা আলে-ইমরান ৩:১০২)

ii) জবাবদিহিতার ব্যবস্থা

সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নিম্ন পর্যায় পর্যন্ত জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কাজে ফাঁকি বা বিনা পরিশ্রমে অর্থোপার্জনের চিন্তা-চেতনা থেকে সবাই মুক্ত থাকতে পারে। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আয় ও ব্যয়ের মাঝে সামঞ্জস্য আছে কীনা খতিয়ে দেখতে হবে।

বিশ্বনবি (সাঃ) বলেন,

“আর তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, আর তোমরা প্রত্যেকেই স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।”

(মুসলিম)

iii) সৎকর্মচারী নিয়োগ

দুর্নীতির অন্যতম কারণ হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে ঘুষ ও উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে অদক্ষ, অনভিজ্ঞ ও অসৎ কর্মচারী নিয়োগ দান করা। অথচ প্রশাসনিক দুর্নীতির কবল থেকে রক্ষা করার জন্য ইসলামের নির্দেশনা হচ্ছে সৎ, বিশ্বস্ত, দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মচারী নিয়োগ করা।

iv) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা

দুর্নীতি প্রতিরোধের অপরিহার্য শর্ত হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। আর ন্যায়বিচারের পূর্বশর্ত হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রদান। বিচার বিভাগে যদি সরকারের হস্তক্ষেপ থাকে, তাহলে দুর্নীতি উচ্ছেদ করা অসম্ভব কাজ।

v) ঘুষ নিষিদ্ধ

দুর্নীতিও এক ধরনের ধোঁকাবাজি, যা মানুষের হক নষ্ট করে এবং প্রকৃত হকদার প্রতারিত হয়ে থাকে। তাই দুর্নীতি করা জাহান্নামি লোকদের কাজ। দুর্নীতির সবচেয়ে ঘৃণিত পন্থা হলো ঘুষ। ঘুষ গ্রহণ ও প্রদান ইসলামে নিষিদ্ধ।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,

“ঘুষ প্রদানকারী ও গ্রহণকারী উভয়ই জাহান্নামে যাবে।”

(আল-হাদিস)

দুর্নীতি দমনে ইসলামের নির্দেশনা মোতাবেক আমাদের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন সাজাতে হবে। তা হলে দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে আমরা মুক্তি পাবো।

ঘ) সার সংক্ষেপ

  • দুর্নীতি একটি ভয়াবহ সামাজিক সমস্যা। আজ দুর্নীতিই যেন একটা নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজের প্রত্যেক শ্রেণি- পেশার মানুষের মধ্যে ‘দুর্নীতি’ ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে গেছে। সমাজ ও রাষ্ট্রে সবখানেই দুর্নীতির রাহু গ্রাস বিস্তার লাভ করেছে।
  • সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির পেশার মানুষের দুর্নীতির মূল উৎস হচ্ছে অলসতা, লোভ ও হিংসা। দুর্নীতির কারণে সমাজ-সভ্যতা ধ্বংসের সম্মুখীন হচ্ছে। এই দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রয়োজন ইসলামি নৈতিকতার সঠিক প্রয়োগ।

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/islam

Islamic information to the point!View Author posts

You cannot copy content of this page