(১) ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা এর ইংরেজি কী?
ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা এর ইংরেজি হলো: Islam and moral education, যার উচ্চারণ: ইসলাম এন্ড মোরাল এডুকেশন।
(২) ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা কাকে বলে, এটি বলতে কী বুঝায়?
ক) শিক্ষা
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষাহীন জাতি মেরুদণ্ডহীন প্রাণীর মতো।
সঞ্চিত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতাকে নিজের জীবনে সফলভাবে প্রয়োগ করাকেই শিক্ষা বলে। এই শিক্ষা মানুষকে প্রকৃত মানুষ হতে সাহায্য করে এবং মানব হৃদয়কে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্ত করে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করে।
শিক্ষা বলতে আমরা বুঝি মানুষের শরীর, মন ও আত্মার সমন্বিত বিকাশসাধন। এখানে শিক্ষা বলতে বিশেষভাবে ইসলামি শিক্ষাকেই বোঝানো হয়েছে।
যে শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণরূপে তুলে ধরা হয়েছে তাকে ইসলামি শিক্ষা বলে। এককথায় কুরআন ও হাদিসের আলোকে সমন্বিত শিক্ষাই হলো ইসলামি শিক্ষা।
ইসলাম শিক্ষার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সৎ, চরিত্রবান, খোদাভীরু, দেশপ্রেমিক, দায়িত্বশীল ও সুনাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবে।
খ) ইসলাম শিক্ষার উৎস
ইসলাম শিক্ষার মূল উৎস হলো দু’টি-
i) আল-কুরআন: এই কুরআনে মানবজাতির জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবকিছুই মহান আল্লাহ বর্ণনা করেছেন।
মহান আল্লাহ বলেন,
“কিতাবে (কুরআনে) কোনো কিছুই আমি বাদ দেইনি।”
(সূরা : আল-আনআম, আয়াত ৩৮)
অন্যত্র আল্লাহ আরও বলেন,
“আমি সকল বিষয়ের বর্ণনা দিয়ে আপনার উপর কিতাব (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি।”
(সূরা আন্-নাহল, আয়াত ৮৯)
ii) আল হাদিস: রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর বাণী, কাজ ও মৌন সম্মতি হলো হাদিস। এটি ইসলামি শিক্ষার দ্বিতীয় উৎস।
হাদিসের গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
“রাসুল (সাঃ) তোমাদের যা দেন তা তোমরা গ্রহণ কর। আর যা থেকে তোমাদের নিষেধ করেন তা থেকে তোমরা বিরত থাক।”
(সূরা আল-হাশর, আয়াত ৭)
কুরআন ও হাদিস ব্যতীত ইসলাম ধর্মবিশারদদের ঐকমত্য (ইজমা) এবং তাঁদের সাদৃশ্যমূলক অভিমত (কিয়াস) ইসলামি শিক্ষার যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ উৎস।
একজন মুসলমানের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে জীবনের সর্বস্তরে আল্লাহর বিধিবিধান মেনে নেওয়া ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করাই হলো ইসলামি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য।
মূলত ইসলামি শিক্ষার ভিত্তি: তাওহিদ (আল্লাহর একত্ববাদ), রিসালাত (আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত নবি ও রাসুলগণ (আঃ)-এর কার্যক্রম ও দাওয়াত) ও আখিরাত (মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের হিসাব-নিকাশ ও জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদি) এ তিনটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত।
আমরা এগুলোর আলোকে জীবন গড়ব এবং জীবনকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করতে চেষ্টা করব।
গ) নৈতিকতা
সততা, সদাচার, সৌজন্যমূলক আচরণ, সুন্দর স্বভাব, মিষ্টি কথা ও উন্নত চরিত্র- এ সবকিছুর সমন্বয় হলো নৈতিকতা।
একজন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চাল-চলন, উঠা-বসা, আচার-ব্যবহার, লেন-দেন সবকিছুই যখন প্রশংসনীয় ও গ্রহণযোগ্য হয় তখন তাকে নৈতিক গুণাবলি সম্পন্ন ব্যক্তি বলে। এই নৈতিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিকে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সর্বোত্তম লোক বলে অভিহিত করেছেন।
তিনি বলেছেন,
“নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম, যার চরিত্র উত্তম।”
(বুখারি ও মুসলিম)
নৈতিকতা হলো ব্যক্তির মৌলিক মানবীয় গুণ এবং জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, যা অর্জন করলে তার জীবন সুন্দর ও উন্নত হয়। এর মাধ্যমে সে অর্জন করে সম্মান ও মর্যাদা।
ইসলামি শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মানুষকে নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া। নীতিহীন ও চরিত্রহীন মানুষ চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও নিকৃষ্ট।
মহান আল্লাহ বলেন,
“তাদের হৃদয় আছে উপলব্ধি করে না, চোখ আছে দেখে না; কান আছে শুনে না; এরা হলো চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায়, বরং তার থেকেও নিকৃষ্ট। আর এরাই হলো গাফিল।”
(সূরা আল-আরাফ, আয়াত ১৭৯)
আমরা নৈতিকগুণে সমৃদ্ধ হব এবং তা চর্চা করে উত্তম মানুষ হব।
ঘ) নৈতিকতার গুরুত্ব
ইসলামি জীবন ব্যবস্থায় নৈতিকতার গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষকে ইমান ও নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়ার জন্য মহানবি (সাঃ) প্রেরিত হয়েছিলেন।
তিনি বলেন,
“আমি মহান নৈতিক গুণাবলিকে পরিপূর্ণতা দান করার জন্যই প্রেরিত হয়েছি।”
(বুখারি)
নৈতিকতার কথা শুধু মুখে বললে চলবে না। বরং বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আদর্শসমূহ জীবনে বাস্তবায়ন করে নৈতিকতার প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নীতিবান লোককে পরিপূর্ণ মুমিন হিসেবে অভিহিত করে বলেন,
“চরিত্রের বিচারে যে লোকটি উত্তম মুমিনদের মধ্যে সেই পূর্ণ ইমানের অধিকারী।”
(তিরমিযি)
মানুষের নৈতিকতা যত উন্নত হবে, সে তত উত্তম মানুষে পরিণত হবে। এভাবে সে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল (সাঃ)-এর প্রিয়পাত্র হয়ে যাবে।
মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আরও বলেছেন,
“তোমাদের মধ্যে সেই লোকটিই আমার নিকট অধিক প্রিয় যার আখলাক (নৈতিকতা) সবচাইতে সুন্দর।”
(বুখারি)
এমনিভাবে জনৈক ব্যক্তি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নিকট জানতে চাইলেন মহান আল্লাহ মানুষকে অনেক কিছু দান করেছেন; এর মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান দান কোনটি? নবি করিম (সাঃ) বললেন, “সবচেয়ে মূল্যবান দান সুন্দর চরিত্র।”
আমাদের উচিত সুন্দর চরিত্র ও নৈতিক আচরণ অর্জন করে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রিয়পাত্র হওয়া।
ইসলামি শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিকতা সম্পর্কে জানা ও তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা অধিকতর সহজ। ইসলামি শিক্ষার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি পরিপূর্ণ নৈতিকতা লাভ করতে পারে।
তাই বলা যায় যে, নৈতিক শিক্ষা ইসলামি শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
(৩) হাদিসের আলোকে নৈতিক শিক্ষা
মানুষের জীবন ও সমাজকে সুন্দর করতে হলে নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শ চরিত্রের অনুসরণ অপরিহার্য। উত্তম চরিত্র, নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ ব্যতীত কোন ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির উন্নতি হতে পারে না। আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন উন্নত ও মহান চরিত্রের অধিকারী। নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের জন্য তিনি সকলের নিকট প্রশংসিত ছিলেন। তাঁর নীতি-নৈতিকতা এবং আদর্শ চরিত্রের বিবরণ হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে।
উত্তম চরিত্র ও নৈতিকতা শিক্ষা দানের জন্য মহানবি (সাঃ)-এর আবির্ভাব।
মহানবি (সাঃ) বলেছেন,
“উত্তম চরিত্রের পরিপূর্ণতা দানের জন্যই আমি প্রেরিত হয়েছি।”
(বায়হাকি)
পবিত্র কুরআনে নৈতিকতা অর্জন সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ আছে। মহানবি (সাঃ)- এর হাদিসেও নৈতিকতা অর্জন সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। কী কী নৈতিক গুণ অর্জন করলে মানবজীবন সুন্দর ও সফল হবে মহানবি (সাঃ)-এর পবিত্র হাদিসে এ সম্পর্কে যেমন তার বিবরণ রয়েছে তেমনি অনৈতিক কার্যাবলি বর্জনেরও জোর তাগিদ রয়েছে।
সততা, সত্যবাদিতা, শালীনতাবোধ, সৃষ্টির সেবা, আমানত রক্ষা, ক্ষমা, দয়া, পরোপকারিতা, ধৈর্য, ভ্রাতৃত্ববোধ, সমাজসেবা, দেশপ্রেম, পরমতসহিষ্ণুতা, পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি কর্তব্য এবং শিক্ষক ও বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা, ছোটদের প্রতি স্নেহ, সহপাঠীদের প্রতি সুন্দর আচরণ ইত্যাদি নৈতিক গুণের বিবরণ হাদিস শরিফে রয়েছে। মহানবি (সাঃ) নিজ জীবনে এসব নৈতিক গুণ বাস্তবায়ন করে নিজেকে বিশ্ব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ নীতিবান ও আদর্শ মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
অন্যদিকে তিনি মহানবি (সাঃ) অনৈতিক আচার আচরণ যেমন- মিথ্যাচার, পরনিন্দা, গালি দেওয়া, হিংসা, ক্রোধ, লোভ, প্রতারণা, পিতা-মাতার অবাধ্যতা, অহংকার, অশ্লীলতা, পরশ্রীকাতরতা, ঘৃণা, চৌর্যবৃত্তি সন্ত্রাস ইত্যাদি বর্জন করার জোর তাগিদ দিয়েছেন এবং এসবের কুফল ও ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে তিনি তাঁর হাদিসে মূল্যবান দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
নৈতিকতা ও অনৈতিকতা সম্পর্কিত কয়েকটি হাদিস নিম্নে বর্ণিত হলো-
দয়া-মায়া ও সৃষ্টির সেবা সম্পর্কে মহানবি (সাঃ) বলেছেন,
“তোমরা জমিনের অধিবাসীদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করো, তাহলে আসমানের অধিপতি মহান আল্লাহ তোমাদের প্রতি সদয় হবেন।”
(তিরমিযি)
মহানবি (সাঃ) আরও বলেন-,
“সমগ্র সৃষ্টিজগৎ আল্লাহর পরিবার। আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই প্রিয়, যে তার পরিবারের প্রতি অনুগ্রহ করে।”
(বায়হাকি)
শালীনতা সম্পর্কে মহানবি (সাঃ) বলেন,
“নিঃসন্দেহে আল্লাহ অশালীন ও দুশ্চরিত্র ব্যক্তিকে ঘৃণা করেন।”
(তিরমিযি)
আমানত সম্পর্কে মহানবি (সাঃ) বলেন,
“যার আমানতদারি নেই তার ইমানও নেই।”
(মুসনাদে আহমাদ)
শ্রমিকের পারিশ্রমিক দ্রুত আদায়ের তাগিদ দিয়ে মহানবি (সাঃ) বলেন,
“শ্রমিকের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার পূর্বে তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।”
(ইবনে মাজাহ)
মহানবি (সাঃ) এভাবে অসংখ্য হাদিসের মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষাকে যেমন জগতবাসীর নিকট তুলে ধরেছেন তেমনি অনৈতিকতা ও অসচ্চরিত্র থেকেও বেঁচে থাকতে মানব জাতিকে নির্দেশ দিয়েছেন।
তাঁর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
“সেই ব্যক্তি প্রকৃত মুসলমান, যার জিহবা ও হাত থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ থাকে।”
(বুখারি ও মুসলিম)
মহানবি (সাঃ) বলেন,
“তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাক। কারণ, আগুন যেমন শুকনা কাঠকে জ্বালিয়ে ছাই করে দেয়, হিংসা তেমনি পুণ্যকে ধ্বংস করে দেয়।”
(আবু দাউদ)
মহানবি (সাঃ) বলেন,
“যে ব্যক্তি প্রতারণা করে সে আমার উম্মত নয়।”
(মুসলিম)
মহানবি (সাঃ) বলেন,
“মহান আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী সকল পাপই ক্ষমা করে দেন। কিন্তু পিতা-মাতার অবাধ্যতার পাপ তিনি ক্ষমা করেন না।”
(বায়হাকি)
মহানবি (সাঃ)-এর পবিত্র হাদিস আমরা অধ্যয়ন করে নৈতিকতা ও সচ্চরিত্র সম্পর্কে জানব এবং আমাদের জীবনে তা বাস্তবায়ন করব। আবার অনৈতিক কাজ ও অসচ্চরিত্রের দিকগুলো সম্পর্কে মহানবি (সাঃ)-এর হাদিস জানব। এসবের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানব এবং সেসব বর্জন করে চলব। এতে আমাদের জীবন সুন্দর হবে। সবাই আমাদের ভালোবাসবে। আমরা জীবনে সফল হব। পরকালে আমরা মুক্তি ও জান্নাত লাভ করব।
পবিত্র ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট ইসলাম’ (inbangla.net/islam) এর সাথেই থাকুন।