Skip to content

 

ইসলাম ও সমাজ জীবন

ইসলাম ও সমাজ জীবন

মানুষ সামাজিক জীব। পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকা মানুষের জন্মগত স্বভাব। সমাজ বাদ দিয়ে মানুষের জীবন যাপন কল্পনা করা যায় না।

ইসলাম একটি সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল সামাজিক ও সামষ্টিক ব্যবস্থা উপস্থাপন করেছে। এ সামাজিক ও সামষ্টিক ব্যবস্থা ইসলামি জীবন দর্শনের নির্দেশনা এবং ঐক্য, সংহতি, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্য, সাহায্য, সহযোগিতা ও পরামর্শের ওপর ভিত্তি করে স্থাপিত।

ইসলামি সমাজ অত্যন্ত সুদৃঢ়ও ভারসাম্যপূর্ণ ভিত্তির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত। যেখানে প্রগতিশীলতার ওপর গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে গোঁড়ামী ও রক্ষণশীলতা বা প্রতিক্রিয়াশীলতার কোন স্থান নেই। ইসলামি সমাজে মানুষের জীবন-সম্পদ, ইজ্জত-আবরুর নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। মানুষের স্বাধীনতা এখানে স্বীকৃত। সমাজে একে অপরের অধিকার ও দায়িত্ব-কর্তব্য সুনির্ধারিত। তাই ইসলামি সমাজ একটি আদর্শ সমাজ।

(১) ইসলামি সমাজ ব্যবস্থা: পরিচয়, বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব

ক) ইসলামি সমাজের পরিচয়

সমাজ ব্যবস্থা বলতে বুঝায় কোন বিশেষ রীতি-নীতি ও আইন-কানুন যা দ্বারা বিদ্যমান বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংস্থার মধ্যে আন্ত:সম্পর্ক পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। ইসলামি রীতি-নীতি, আইন-কাঠামো ও বিধি-বিধান দ্বারা যে সমাজ পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় তাই ইসলামি সমাজব্যবস্থা।

অথবা বলা যায়, যে সমাজের প্রতিটি মানুষের অধিকার, চাহিদা, দায়-দায়িত্ব ইসলামের অনুশাসন দ্বারা নির্ধারিত হয়, সেটাই ইসলামি সমাজব্যবস্থা। উল্লেখ্য যে, ইসলামি সমাজব্যবস্থাই একমাত্র সর্বোত্তম আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা যা মানব জীবনকে সার্বিকভাবে সৎ,সুন্দর, সুশৃঙ্খল, নিরাপদ ও সুখময় করার সামর্থ রাখে।

খ) ইসলামি সমাজ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

i) আল্লাহর একত্ববাদ ভিত্তিক

ইসলামি সমাজের যাবতীয় কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে আল্লাহর একত্ববাদ। ইসলামি সমাজ তাওহিদ বিশ্বাসে উজ্জীবিত। সকল ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্বের অধিকারি একমাত্র আল্লাহকে মেনে নিয়ে সমাজের সমস্ত কর্মকা- পরিচালিত হয়।

ii) রিসালাত ভিত্তিক

ইসলামি সমাজের দ্বিতীয় ভিত্তি হলো রাসূলুল্লাহ্ সা.-এর আদর্শ। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)বিশ্বনবী এবং সর্বশেষ নবী। সকল কাজে তাঁরই আদর্শ ও নেতৃত্ব গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসিত। তিনি ব্যতিত আর কারও নেতৃত্ব ও আদর্শ গ্রহণযোগ্য নয়।

আল্লাহ তা’আলা বলেন,

“অবশ্যই রাসূলের জীবনে রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ।”

(সূরা আল-আহযাব ৩৩:২১)

আল-কুরআনে আরও ঘোষিত হয়েছে,

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, আর রাসূলের অনুকরণ কর।”

(সূরা আন-নিসা ৪:৫৯)

ইসলামি সমাজে সকল কাজে কুরআন ও রাসূলের সুন্নাহর অনুসরণ করা হয়। এ দু’য়ের বিপরীত সব কিছুকে বর্জন করা হয়।

বিদায় হজ্জের ভাষণে মহানবী (সাঃ)বলেছেন, আমি তোমাদের কাছে দু’টো বিষয় রেখে যাচ্ছি এগুলোর অনুসরণ করলে তোমারা কখনও পথভ্রষ্ট হবে না। তা হল আল্লাহর বাণী কুরআন এবং আমার সুন্নাহ।

মহান আল্লাহ বলেন,

“আর রাসূল যা তোমাদের জন্যে এনেছেন তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে নিষেধ করেন তা বর্জন কর।”

(সূরা আল-হাশর ৫৯:৭)

iii) বিশ্বাস ও সৎকর্মের সমন্বয়

ইসলামি সমাজ বিশ্বাস ও কর্ম তথা ঈমান ও আমলের সমন্বয়ে গঠিত। এ সমাজ তাওহিদ ও রিসালাতে বিশ্বাস স্থাপন করে সে অনুসারে জীবন যাপন করে। বিশ্বাস ও কর্মকে আলাদা করে দেখে না। ইসলামে কর্মই ধর্মের পরিচায়ক।

আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,

“মহাকালের শপথ, অবশ্যই সকল মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু তাঁরা নয়, যারা ঈমান এনেছে এব সৎকর্ম করেছে”

(সূরা আলআসর ১০৩:১-৩)

iv) ভ্রাতৃত্ব ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা

ইসলামি সমাজ ব্যবস্থা সামাজিক সাম্য, অকৃত্রিম ভ্রাতৃত্ব এবং বিশ্বমানবতার ভিত্তিতে উন্নত আদর্শ সমাজব্যবস্থার পরিচায়ক। মানুষে মানুষে সকল প্রকার অসাম্য ও ভেদাভেদ দূর করে মানবতার আদর্শে ইসলামি সমাজ গঠিত।

ইসলামি সমাজে নিছক জন্মগত, বংশগত কিংবা ভাষাগত বা আঞ্চলিকতার বিচারে কোন মানুষের মর্যাদা ও প্রাধান্য স্বীকার করা হয় না। আল্লাহ তাআলাকে যারা বেশি ভয় করে, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে সফলতা রয়েছে।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

“যে কেউ আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার পথ করে দিবেন।”

(সূরা আত-তালাক ৬৫:২)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,

“তোমরা কি জানো কোন্ জিনিস মানুষকে সবচেয়ে বেশি জান্নাতে প্রবেশ করায়? তা হচ্ছে তাকওয়া ও উত্তম চরিত্র। তোমরা কি জানো মানুষকে সবচেয়ে বেশি জাহান্নামে প্রবেশ করায় কোন্ জিনিস? একটি জিহ্বা এবং অপরটি লজ্জাস্থান।”

(তিরমিযি)

এ হাদিসে আদর্শ মানুষের চারটি গুণ তুলে ধরা হয়েছে : i) তাকওয়া বা আল্লাহভীতি ii) উত্তম চরিত্র iii) জিহ্বা নিয়ন্ত্রণ এবং iv) লজ্জাস্থানের হেফাযত

কেউ এগুলো আমল করলে সে আদর্শ মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে। তার দ্বারা দেশ ও সমাজ উপকৃত হবে। মুত্তাকির দ্বারা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। বরং সবাই শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করে। আল-কুরআনে মুত্তাকি ব্যক্তিকে সর্বাপেক্ষা মর্যাদাবান উল্লেখ করা হয়েছে।

মহান আল্লাহ বলেন,

“নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে সে আমার কাছে সম্মানিত, যে বেশি মুত্তাকি।”

(সূরা আল-হুজুরাত ৪৯:১৩)

v) দায়িত্ব ও অধিকার নির্ধারিত

ইসলামি সমাজে পরস্পরের প্রতি পরস্পরের অধিকার ও দায়িত্ব নির্ধারিত রয়েছে। সমাজের কোন সদস্যই দায়িত্ব মুক্ত নয়। আল্লাহ তাআলা মানুষকে যে দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পাদনের নির্দেশ দিয়েছেন সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে বান্দার নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করা। কেননা এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করবেন।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,

“তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। একজন নেতা দায়িত্বশীল এবং তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। ব্যক্তি তার পরিবারের দায়িত্বশীল, তাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীর ঘরের দায়িত্বশীল, তাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। খাদেম তার মনিবের সম্পদের দায়িত্বশীল এবং তাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদেরকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।”

(সহিহ বুখারি)

vi) ন্যায়ের পতাকাবাহী

ইসলামি সমাজের আর্থ-সামাজিকব্যবস্থা ন্যায়নীতি ভিত্তিক। সামাজিক বা অর্থনৈতিক কোন ব্যাপারেই কেউ কারও ওপর যুলম বা অত্যাচার করতে পারে না। ইসলামি সমাজ তাই ন্যায়ের পতাকাবাহী। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যই ইসলাম সমাজ।

vii) শ্রেষ্ঠ সমাজ

ইসলামি সমাজ, গোত্র, বর্ণ, ভাষা-জাতি নির্বিশেষে একটি ব্যাপক ও সর্বজনীন সমাজ ব্যবস্থার কথা বলে। যারাই ইসলামে বিশ্বাস করেন এবং ইসলামের বিধি-বিধান মেনে চলতে চান তারাই এ সমাজের সদস্য।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

“সকল মানুষ একই সমাজভুক্ত।”

(সূরা বাকারা ২:২১৩)

viii) সুদৃঢ় সেতু বন্ধন

ইসলামি সমাজের সামাজিক বন্ধন অত্যন্ত সুদৃঢ়।

রাসূল (সাঃ)বলেছেন,

“সমস্ত মুসলিম একটি দেহের মত।”

(সহিহ বুখারি)

ix) ইসলামের সামগ্রিক রূপায়ন

ইসলামি সমাজ না হলে, ইসলামের পূর্ণ রূপায়ন এবং ইসলামি আদর্শের বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এ গুরুত্ব অনুধাবন করেই মহানবী (সাঃ)জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় গিয়ে আনসার ও মুহাজিরদের সমন্বয়ে একটি আদর্শ-ইসলামি রাষ্ট্র গঠন করেন।

জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামের সামগ্রিক রূপায়নের জন্য ইসলামি সমাজের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, ইসলামের পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সুন্দও নীতিমালা ও আদর্শ রয়েছে। ইসলামি সমাজেই ইসলামের আর্থ-সামাজিক নীতিমালা ও আদর্শ বাস্তবায়ন সম্ভব।

গ) সারসংক্ষেপ

  • ইসলামি সমাজব্যবস্থা ইসলামের মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলামি সমাজব্যবস্থা ইসলামের মৌলিক আকিদা-বিশ্বাসের ভিত্তিতে গঠিত। ইসলামি সমাজব্যবস্থায় সামগ্রিক ও সার্বিক কর্তৃত্ব থাকে ইসলামের।
  • ইসলামি সমাজের যাবতীয় ইবাদত, আইন-কানুন সবকিছুই ইসলাম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নৈতিকমান, নৈতিক চরিত্র এবং যাবতীয় আচার-আচরণ ইসলামের বিধান দ্বারা পরিচালিত। ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় পারস্পরিক যাবতীয় লেনদেন, ব্যবসায়-বাণিজ্য, আয়-উপার্জন, ভোগ-ব্যবহার ইত্যাদি সবকিছুতেই ইসলামের নিয়ন্ত্রণ দৃশ্যমান।

(২) জীবনের নিরাপত্তায় ইসলামি সমাজ

মানুষের জীবনের নিরাপত্তার গ্যারান্টি রয়েছে ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায়। কেননা, ইসলাম এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেখানে শান্তি, সুখ ও কল্যাণ এবং অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানসহ যাবতীয় মৌলিক অধিকার পূরণের নিশ্চয়তা থাকবে।

জীবনের নিরাপত্তার জন্য ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় যে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তা হলো-

i) মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা

ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় সমাজের প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করেছে। ইসলামি সমাজ ব্যবস্থা মানুষকে তার মন ও মতের স্বাধীনতা, জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা, ইজ্জত ও সম্মানের নিরাপত্তা, ভাত-কাপড়, বাসসস্থান ও বেঁচে থাকার অধিকার প্রদান করেছে।

ii) জীবনের নিরাপত্তা

মানুষের জীবনের সর্বপথম অধিকার বাঁচার অধিকার; জীবন যাপনের অধিকার। ইসলামি সমাজে যে কোন ব্যক্তি তার জীবনের পূর্ণ নিরাপত্তা পেয়ে থাকে। অন্যায়ভাবে কেউ কাউকে হত্যা করলে বিনিময়ে কিসাস স্বরূপ হত্যাকারীকে হত্যা অথবা দিয়ত বা রক্তপণ দেয়ার বিধান দিয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করো না। কেউ অন্যায়ভাবে নিহত হলে তার উত্তরাধিকারীকে তো আমি তা প্রতিকারের অধিকার দিয়েছি ; কিন্তু হত্যার ব্যাপারে সে যেন বাড়াবাড়ি না করে ; সে তো সাহায্যপ্রাপ্ত হয়েছেই।”

(সূরা বনি ইসরাইল ১৭:৩৩)

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“নরহত্যা অথবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করা ব্যতীত কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষকেই হত্যা করল।”

(সূরা মায়িদা ৫:৩২)

iii) নিরাপত্তামূলক বাসস্থান

সমাজে মানুষ নিরাপত্তা ও শান্তির সাথে নিজ গৃহে বসবাস করতে চায়। কোন উৎপীড়ন ও অশান্তি যেন ঘিরে না বসে এ জন্য ইসলাম এক প্রতিবেশির প্রতি অপর প্রতিবেশির দায়িত্ব নির্ধারণ করে দিয়েছে।

বিনা অনুমতিতে কারো বাড়িতে প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। পর্দা প্রথা মেনে চলার আদেশ করেছে। কোন বাড়িতে আলো-বাতাস প্রতিরোধমূলক কোন কাজ করতে নিষেধ করেছে।

iv) সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা

আইনের শাসন ও সুবিচার না থাকলে সে সমাজের মানুষের জীবনে নেমে আসে অশান্তির অমানিশা এবং মানুষের জীবন হয়ে পড়ে বিপন্ন। সমাজ জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলার পূর্বশর্ত হচ্ছে আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা।

ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় ন্যায় বিচারের সুব্যবস্থা রয়েছে। এখানে আইনের চোখে আপন-পর, ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা, বিদ্যান-মুর্খ, সবল-দুর্বল এবং স্বজাতি-বিজাতি সকলেই সমান।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“আল্লাহ তোমাদেরকে ন্যায় বিচার ও সদাচরণ করার নির্দেশ প্রদান করেছেন।”

(সূরা নহল ১৬:৯০)

v) মান-সম্মানের নিরাপত্তা

সমাজে মানুষ তার আত্ম-সম্মান, ইজ্জত-আবরু ইত্যাদি নিয়ে গৌঁরবের সাথে বসবাস করতে চায়। ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় মানুষকে আত্ম-সম্মান নিয়ে গৌরবের সাথে জীবন যাপনের নিরাপত্তা বিধান করে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“হে মুমিনগণ! কোন পুরুষ যেন অপর কোন পুরুষকে উপহাস না করে; কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর কোন নারীকেও যেন উপহাস না করে; কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না; ঈমানের পর মন্দ নাম অতি মন্দ। যারা তাওবা না করে তারাই জালিম।”

(সূরা হুজরাত ৪৯:১১)

vi) মত ও ধর্মের স্বাধীনতা

ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় মানুষকে তার মতামত ও ধর্মীয় জীবনের স্বাধীনতা দিয়েছে। যে যার ধর্ম পালন করবে। ধর্মের ব্যাপারে মানুষের ওপর কোন জোর-জবরদস্তি নেই। কিন্তু স্বেচ্ছায় ধর্ম গ্রহণ করার পর তার কোন বিধান লংঘন করার অধিকার ইসলাম কাউকে দেয় না।

বাক-স্বাধীনতার ব্যাপারে মহানবি (সাঃ) বলেছেন,

“অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য কথা বলা শ্রেষ্ঠতম জিহাদ।”

(তিরমিযি)

vii) অধিকার প্রদানে সাম্য

ইসলামের চোখে সমাজের সকল মানুষই সমান। মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে ইসলাম সকলের প্রতি সমান ব্যবহার করে থাকে। তাই ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় কোন লোক তার অধিকারে থেকে বি ত হয় না, কেউ কোনভাবে নিগ্রহের শিকার হয় না। ফলে সমাজ জীবন শান্তিময় হয়ে ওঠে।

viii) অপরাধমূলক কার্যকলাপ দমন

ইসলাম মানব সমাজকে সর্বপ্রকার নৈতিক অধঃপতন, অবক্ষয়, পাপ ও অপবিত্রতার পংকিলতা হতে সম্পূর্ণ নিষ্কলুষ ও পবিত্র করতে চায়। সেজন্য মদ্য পান হারাম করা হয়েছে। চুরি-ডাকাতি, ব্যভিচার, জুয়া, মিথ্যাচার, হত্যা, নির্যাতনকে অপরাধ ও কঠিন পাপ বলে ঘোষণা করেছে।

তেমনিভাবে দূর্নীতি, উচ্ছৃংখলতা ও অশ্লীলতা ইসলামি সমাজে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং এ সমস্ত কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ix) নৈতিক শিক্ষা

অপরদিকে নৈতিক মান উন্নত করার জন্য সুশিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মানুষ যাতে তাদের নৈতিক মান উন্নত ও উৎকর্ষ সাধন করতে পারে, সে জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা ইসলামি সমাজে রয়েছে। আর এর মাধ্যমেই ইসলামি সমাজে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে।

কেননা, একজন উন্নত নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ দ্বারা কখনো অপরের অনিষ্ট হতে পারে না। তাই ইসলাম মানুষের নৈতিক চরিত্র উন্নত করার মাধ্যমে আদর্শ সমাজ জীবন গড়ে তুলতে চায়।

মানুষের জীবনের নিরাপত্তার গ্যারান্টি রয়েছে ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায়। কেননা, ইসলাম এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেখানে শান্তি, সুখ ও কল্যাণ এবং অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানসহ যাবতীয় মৌলিক অধিকার পূরণের নিশ্চয়তা থাকবে।

(৩) সম্পদের নিরাপত্তায় ইসলামি সমাজ

ক) ইসলামি সমাজে সম্পদ

জীবনের সাথে সম্পদের সম্পর্ক সুনিবিড়। এ কারণেই ইসলামি জীবন দর্শন সম্পদকে মূল্যহীন মনে করে না, বরং সম্পদকে মহান আল্লাহর নিয়ামত ও জীবন ধারণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হিসেবে গণ্য করে।

মহানবী (সাঃ) বলেছেন, অভাব মানুষকে কুফরি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।

আর সে জন্য ইসলাম সম্পদ উপার্জন, আহরণ, উৎপাদন, সংরক্ষণ ও সুষম বণ্টনের ওপর গুরুত্বারোপ করে থাকে।

খ) জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তায় ইসলাম

জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানকল্পে বিদায় হজ্জের ভাষণে মহানবি (সাঃ) দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন :

আল্লাহর বার্তাবাহক বলেন,

“মনে রেখো! তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের ইজ্জত সম্মানকে আল্লাহ তাআলা পবিত্র ঘোষণা করেছেন। যেমন পবিত্র আজকের এ দিন, এ শহর এবং এ মাস।”

(বিদায় হজ্জের ভাষণ)

সম্পদের নিরাপত্তা বিধানে ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তা হচ্ছে-

i) আল্লাহ সকলের রিযিক দাতা

মহান আল্লাহ সকল জীবের পালনকর্তা। সূরা আল-ফাতেহাতে তিনি নিজকে ‘রাব্বুল আলামীন’ বা জগত সমূহের প্রতিপালক বলে অভিহিত করেছেন।

মহান আল্লাহ্ বলেন,

“ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণকারী সকলের জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহরই।”

(সূরা হুদ ১১:৬)

এ দায়িত্ব পালন করার উদ্দেশ্যে তিনি মানুষের জীবন ধারণের পক্ষে যা যা আবশ্যক তা যথাস্থানে সৃষ্টি করে রেখেছেন।

ii) অন্যায়ভাবে সম্পদ অর্জন নিষিদ্ধ

ইসলাম মানুষকে সম্পদ অর্জনের অনুমতি দেয়ার সাথে সাথে অপরের অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে নিশ্চিৎ করতে অন্যায়ভাবে সম্পদ অর্জনকে হারাম করে দিয়েছে।

মহান আল্লাহ বলেন,

“তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।”

(সূরা বাকারা ২:১৮৮)

iii) সম্পদের সুষম বণ্টন

ইসলামের দৃষ্টিতে পূর্ণ-অর্থনৈতিক সাম্য বাস্তবে সম্ভবপর নয় এবং সমাজ-ব্যবস্থা পরিচালনের পক্ষে তা অনুকূলও নয়। তাই ইসলাম অর্থের ন্যায় সঙ্গত তথা সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা করেছে।

ইসলাম প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ উপার্জনের অনুমতি দেয়। কিন্তু সাথে সাথে যারা জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণে অক্ষম তাদের সে প্রয়োজন পূরণ করতে তাকে বাধ্য করেছে।

ইসলামি-ব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে সমাজের সমগ্র সম্পদ যাতে পুঞ্জিভূত না হয় সে জন্য সম্পদ দুঃস্থ ও অসহায়দের মধ্যে বণ্টন করে দিতে নির্দেশ দিয়েছে।

iv) যাকাত ও উত্তরাধিকার আইন

যাকাত ও উত্তরাধিকার আইন ইসলামি সমাজে ন্যায়পরায়ণতা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার গ্যাারান্টি। ইসলাম সমাজ হতে ক্ষুধা ও দারিদ্রের উচ্ছেদ সাধনের উদ্দেশ্যে যাকাত প্রতিষ্ঠা করেছে।

উত্তরাধিকারীদের মধ্যে নির্দিষ্ট হারে সম্পদ বণ্টনের সুব্যবস্থার মাধ্যমে ইসলাম এক অভূতপূর্ব বণ্টন ব্যবস্থার উন্মেষ ঘটিয়েছে এবং মানুষের সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করা হয়েছে।

v) মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর দায়িত্ব সরকারের

ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় সমাজের প্রতিটি মানুষের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য সমাজ তথা রাষ্ট্র দায়ী। মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, পরিবার ও শিক্ষার নিশ্চয়তা দেয়া ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় সরকারের অপরিহার্য কর্তব্য বা ফরয হিসেবে গণ্য। যখন সরকার এ ব্যাপারে অসমর্থ হয়, তখন তাদের এসব কিছুর ব্যবস্থা করে দেয়া সমাজের ধনী ব্যক্তিদের ওপর ফরয।

vi) আর্থিক অনাচার প্রতিরোধ

ইসলামি ব্যবস্থায় যাবতীয় আর্থিক অনাচার তথা সুদ, ঘুষ, জুয়া, প্রতারণা, অশ্লীলতা হারাম। নাপাক বস্তু, চুরি, ডাকাতি, লুণ্ঠন, ছিনতাই, জবরদখল প্রভৃতির মাধ্যমে অর্থোপার্জন করাকে হারাম ঘোষণা করেছে। এর জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।

ইসলামি ব্যবস্থায় কর্মচারীদের পক্ষে সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য উপহার গ্রহণ, মূল্যবৃদ্ধির জন্য মজুদদারি, কালোবাজারি, চোরাচালানি, অপচয়, অপব্যয়, বিলাসিতা ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

গ) সারসংক্ষেপ

ইসলামি সমাজ ব্যবস্থা বিশ্ব মানবতার জন্য এক কল্যাণকর ও আশীর্বাদ স্বরূপ। ইসলাম মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার জন্য যে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তা আধুনিক পৃথিবীর যে কোন ব্যবস্থার তুলনায় এক স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক ব্যবস্থা। আর ইসলামের এ সমাজ ব্যবস্থাই বর্তমান বিশ্বেও অশান্ত সমাজকে শান্তি ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে সক্ষম।

(৪) আত্মীয় স্বজনের অধিকার ও কর্তব্য

ক) আত্মীয় স্বজনের পরিচয়

আত্মীয় শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে আত্ম থেকে। আত্ম বা নিজ সত্তার সাথে যারা সম্পর্কিত তারাই আত্মীয়-স্বজন।

এরূপ সম্পর্কিত মানুষ যেমন রক্তের সম্পর্কের কারণে গড়ে উঠতে পারে তেমনি গড়ে উঠতে পারে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার দিক দিয়ে। আবার অনেক সময় জীবনে চলার পথে অনেক বন্ধু-বান্ধবদের সাথে গড়ে ওঠতে পারে আত্মীয়তা। এরাই স্বজন।

সাধারণ অর্থে রক্ত সম্পর্কিত ব্যক্তিগণকেই আত্মীয়-স্বজন বলা হয়।

ইসলামি শরীআতের দৃষ্টিতে, পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং স্বামী-স্বামীর পরেই এ রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়-স্বজনের স্থান।

আত্মীয়-স্বজন বলতে তিন শ্রেনির মানুষকে বোঝায়-

এক. রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়-স্বজন: যথা-পুত্র-কন্যা, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, চাচা-চাচী, মামা, খালা-খালু, দাদা-দাদী, নানা-নানী প্রমুখ।

দুই. বৈবাহিক সম্পর্কিত আত্মীয়-স্বজন: যথা-শ্বশুর-শাশুড়ি এবং এ সম্পর্কিত অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন।

তিন. বন্ধুত্বের সম্পর্কে সম্পর্কিত আত্মীয়-স্বজন: নিকটস্থ বন্ধু-বান্ধবকে বোঝায়।

খ) আত্মীয়-স্বজনের অধিকার ও কর্তব্যের গুরুত্ব

আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) আত্মীয়-স্বজনের অধিকার পালনে বার বার তাগিদ দিয়েছেন। যারা আত্মীয়-স্বজনের অধিকার ও কর্তব্য পালন করে না অথবা তাদের সাথে সম্পর্ক রাখে না কিংবা এ সম্পর্ক যে কোনভাবে ছিন্ন করে, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সাঃ)তাদেরকে পছন্দ করেন না।

কারণ, আত্মীয়-স্বজনকে উপেক্ষা করলে মানুষের জীবন এক অসহায় যান্ত্রিক জীবনে পরিণত হবে এবং পারস্পরিক সহানুভূতি, সমবেদনা, ইত্যাদি মানসিক ও মানবিক গুণগুলোর অস্তিত্ব রহিত হবে। এতে মানুষের মনে তার নিকটতম আত্মীয়ের জন্যও কোন হৃদয়ের অনুভূতি উৎসারিত হবে না; বরং মানব জাতির সামাজিক বৈশিষ্ট্য চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ফলে যে সমাজ অবশিষ্ট থাকবে এবং তাতে যারা বাস করবে তারা নিষ্প্রাণ উষর মরুতে বাসকারীর মতই অসহায়ত্ব বোধ করবে।

কেননা, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও মমতাবোধ আল্লাহ্র অসীম দয়া ও রহমত। আর আত্মীয়তা সম্পর্কের মত এক বিরাট ও ব্যাপক সম্পর্ক সমাজে না থাকলে সে সমাজ আল্লাহর দয়া ও রহমত থেকেও বিরত হয়। ফলে সে সমাজে কখনো কারো কল্যাণ বা শান্তি হতে পারে না।

নবী করীম (সাঃ) ইরশাদ করেন,

“যে কাওমের মধ্যে আত্মীয়তা ছিন্নকারী লোক অবস্থান করে, সে কাওম বা সমাজের ওপর আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হয় না।”

(আদাবুল মুফরাদ)

ইসলামি শরীয়তে পিতা-মাতার পরেই আত্মীয়ের স্থান। অতএব পিতা-মাতার পর ক্রমশ আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় করবে। তাই অর্থ সাহায্যের বেলায় সর্বপ্রথম অধিকার হলো পিতা-মাতার, তার পরই আত্মীয়-স্বজনের।

এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,

“(হে রাসূল!) আপনি বলুন, কল্যাণকর যে জিনিস তোমরা ব্যয় কর, তা তোমাদের পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও দারিদ্র্যের জন্য ব্যয় করবে।”

(সূরা বাকারা ২:২১৫)

হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন,

“আমিই স্বয়ং আল্লাহ এবং আমিই ‘রহমান’ করুণাময়। আমিই ‘রাহিম’ (আত্মীয়তাকে) সৃষ্টি করেছি এবং আমার নিজ নামের সাথে এর নামকরণ করেছি। অতএব, যে ব্যক্তি এর সাথে সম্পর্ক রাখে, আমি তার সাথে সম্পর্ক রাখি। আর যে ব্যক্তি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলে, আমিও তার সাথে আমার সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলি।”

(আল-হাদিস)

অপর এক হাদিসে বলেছেন,

“যে ভাল মনে করে যে, তার মৃত্যু বিলম্বিত হোক ও জীবিকা বৃদ্ধি পাক, সে যেন আত্মীয়তা বজায় রাখে।”

(সহিহ বুখারি ও মুসলিম)

রাসূল (সাঃ) বলেন-

“আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।” (বুখারি-মুসলিম) আত্মীয়-স্বজনের অধিকারসমূহ

গ) আত্মীয়ের প্রাপ্য আদায় করা

আত্মীয়-স্বজনের অধিকার ও হকসমূহ যথাযথভাবে আদায় করার জন্য ইসলাম নির্দেশ দেয়।

কুরআনের ঘোষণা,

“তোমরা আত্মীয়-স্বজনের প্রাপ্য দিয়ে দাও।” (সূরা বনী ইসরাঈল ১৭ : ২৬)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে কেউ জিজ্ঞেস করল যে কোন্ ব্যক্তি উত্তম? তিনি বললেন : “যে আল্লাহকে বেশি ভয় করে ও আত্মীয়তাকে বজায় রাখে।”

i) সদ্ব্যবহার করা

ইসলাম আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দান করেছে।

মহান আল্লাহর বাণী,

“আল্লাহ পাক ন্যায় বিচার কায়েম করতে, পরস্পরের প্রতি ইহসান করতে ও আত্মীয়-স্বজনের অধিকার আদায় করতে নির্দেশ দিচ্ছেন।”

(সূরা নাহ্ল ১৬:৯০)

ii) সু-সম্পর্ক বজায় রাখা

আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সর্বদা সু-সম্পর্ক বজায় রাখা উচিত। তাদের সাথে কখনো ঝগড়া-ফাসাদ করা উচিত নয়।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)বলেন, অন্তরে শত্রুতা পোষণ করে, এমন আত্মীয়কে দান করা উত্তম।

তিনি আরও বলেন, তার সাথে মিলেমিশে চল যেন তোমার নিকট হতে আলাদা থাকে; তাকে দাও যে তোমাকে বিরত করে এবং তাকে মার্জনা কর যে তোমার উপর যুলম করে।

iii) কোন প্রকার বিরক্ত না করা

আত্মীয়-স্বজনকে কোন ক্রমেই কষ্ট দেয়া ও বিরক্ত করা উচিত নয়। তারা যদি কষ্টও দেয় তবুও তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন না করে সদ্ভাব বজায় রাখা কর্তব্য।

যদি কোন আত্মীয়-সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং দুর্ব্যবহার করে, তবুও তার সাথে ভালো ব্যবহার করা উচিত। অত্যাচার করলে তাকে বাধা দান করা উচিত, এটাই প্রকৃত আত্মীয়তার দাবি। কেননা, যারা সদ্ভাব বজায় রাখে, তাদের সাথে তো ভাল সম্পর্ক বজায় রাখা স্বাভাবিক কিন্তু যারা কষ্ট দেয়, তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করার মধ্যেই কৃতিত্ব।

হযরত আবূ যর (রা) বলেন,

“প্রিয়নবী (সাঃ)আমাকে আদেশ করেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখ, যদিও তোমাকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করা হয় এবং সত্যি কথা বল যদিও তিক্ত হয়।”

(আল-হাদিস)

iv) আত্মীয়-স্বজনের সেবা-যত্ন করা

আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে যারা পীড়িত, রোগাক্রান্ত, দুঃস্থ তাদের সেবা-শুশ্রুষা করা একান্ত কর্তব্য। বিপদে-আপদে তাদের সাহায্য-সহানুভূতি প্রর্শন করা জরুরি। অভাব-অনটনে পড়লে তাদেরকে আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা দান করা কর্তব্য।

হযরত আসমা বিনতে আবু বকর (রা) বলেন,

“আমার কাছে আমার জননী আগমন করলে আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)এর কাছে আরয করলাম: আমার মা এসেছেন। তিনি এখনও মুশরিক। আমি তার সাথে দেখা করব কী? তিনি বললেন, হ্যাঁ! আমি তাকে কিছু দিব কী? তিনি বললেন, হ্যাঁ! আত্মীয়তা বজায় রাখ।”

(আল-হাদিস)

অপর এক হাদিসে আছে,

“ফকির-মিসকিনকে দান করলে একটি সদকাহ হয়। কিন্তু আত্মীয়কে কিছু দান করলে তা দু’সাদকা হয়।”

(আল-হাদিস)

ঘ) সারসংক্ষেপ

কুরআন ও হাদিসের নির্দেশ ও ভাষ্যগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, আত্মীয়-স্বজনের সাথে উত্তম সম্পর্ক ও সদ্ভাব বজায় থাকলে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবন সুখী ও শান্তিময় হয়। আত্মীয়-স্বজনদের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভালোবাসার মাধ্যমে এক মনোরম ও আনন্দময় পরিবেশ গড়ে ওঠে।

(৫) প্রতিবেশির অধিকার ও কর্তব্য

ক) প্রতিবেশির পরিচয়

সাধারণ অর্থে প্রতিবেশি বলতে আশপাশে বসবাসকারীকে বুঝায়।

ইসলামি সমাজ দর্শনে প্রতিবেশির সংজ্ঞা আরো ব্যাপক। মহানবি (সাঃ) এর সংজ্ঞায় বলেন, আশপাশে চল্লিশ বাড়ি পর্যন্ত সকলেই প্রতিবেশি।

এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম যুহরী বলেন, নিজ ঘরের সামনে-পেছনে, ডান ও বাম দিকের চল্লিশ বাড়ি পর্যন্ত প্রতিবেশি বলে বিবেচিত হবে।

স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে পাশাপাশি বসবাসকারী কিংবা সাময়িকভাবে আশপাশে অবস্থানকারী তথা চলার পথের সহযাত্রীরাও প্রতিবেশি বলে গণ্য হবে। যেমন, যারা একত্রে লেখাপড়া করে, চাকরি করে, বাস-রিক্সা, জাহাজ-লঞ্চ, স্টিমার, বিমান- রেলওয়েতে যাতায়াতের সময় পাশাপাশি অবস্থান করে, যারা যে কোন উপায়ে একই সঙ্গে পথ চলে, একত্রে ব্যবসায়বাণিজ্য করে, একই মিল-কারখানায় কিংবা প্রতিষ্ঠানে পাশাপাশি কাজ করে, তারা সকলেই একে অপরের প্রতিবেশি। ইসলামি সমাজ দর্শনে তাই প্রতিবেশির ব্যাপকতা বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত।

খ) প্রতিবেশির প্রকারভেদ

অধিকার হিসেবে প্রতিবেশিকে মহানবী (সাঃ) তিন শ্রেণিতে ভাগ করেছেন-

এক. অমুসলিম প্রতিবেশি: হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা অন্য ধর্মের লোক, অর্থাৎ যারা অমুসলিম। প্রতিবেশি হিসেবে তাদের মাত্র একটি হক আছে।

দুই. অনাত্মীয় মুসলিম প্রতিবেশি: এ শ্রেণির প্রতিবেশির মধ্যে সকল মুসলিম অন্তর্ভুক্ত। এদের হক তথা অধিকার দু’টি। যথা- মুসলিম হিসেবে একটি ও প্রতিবেশি হিসেবে একটি।

তিন. আত্মীয় মুসলিম প্রতিবেশি: এরা নিকটতম প্রতিবেশি। এ শ্রেণির প্রতিবেশির মধ্যে শুধু সে সব মুসলমান অন্তর্ভুক্ত যারা আত্মীয়। এদের অধিকার তিনটি। মুসলিম হিসেবে একটি, আত্মীয় হিসেবে একটি এবং প্রতিবেশি হিসেবে একটি।

চারাঃ পার্শ্ব সাথী: আরো এক শ্রেণীর প্রতিবেশির অস্তিত্বও ইসলামে স্বীকৃত। এ পর্যায়ে রয়েছে সে সব লোক, যারা সফরসঙ্গী কিংবা রাস্তা-ঘাটে চলার পথের সাথী। মসজিদে পাশাপাশি দাঁড়াল বা কোন মজলিসে পাশাপাশি বসল সেও প্রতিবেশি হিসেবে গণ্য এবং তারও একটি হক রয়েছে, যা আদায় করতে হবে।

নিম্নের আয়াতে এর প্রমাণ মেলে,

“সদাচারণ কর নিকটাত্মীয় প্রতিবেশি, পার্শ্বে অবস্থানকারী প্রতিবেশি ও পার্শ্ববর্তী সহচরের সাথে।”

(সূরা নিসা ৪:৩৬)

গ) প্রতিবেশির অধিকার ও কর্তব্য

প্রতিবেশির অধিকার ও কর্তব্য ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় অত্যন্ত ব্যাপক। যেমন-

i) সদাচরণ পাওয়ার অধিকার

প্রতিবেশির সাথে সদাচরণ ও ভাল ব্যবহার করা একজন মুসলিমের অন্যতম কর্তব্য। কখনও প্রতিবেশির মনে আঘাত বা কোন প্রকার কষ্ট দেয়া যাবে না। ইসলামে পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পরেই প্রতিবেশির এ হক স্বীকৃত।

মহান আল্লাহর ঘোষণা,

“তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর সাথে কোন শিরক করো না। পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন, অনাথ-দরিদ্র, প্রতিবেশি, অনাত্মীয় প্রতিবেশি ও পার্শ্ববর্তী সহচরদের সাথে সদাচরণ কর।”

(সূরা নিসা ৪:৩৬)

ii) প্রতিবেশির অধিকার আমানতস্বরূপ

প্রতিবেশিদের পরস্পরের হক আমানতস্বরূপ। তারা এ আমানত রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা করবে এবং কোন অবস্থাতেই কেউ কারো অনিষ্টের কারণ হবে না, বরং প্রাণপণে একে অপরের কল্যাণে আসবে এবং পরস্পরের আমানত হিফাযত করবে।

প্রতিবেশি যে কেউই হোক কিংবা যেমনই হোক জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও শ্রেণি নির্বিশেষে সকলেই প্রতিবেশির সমমর্যাদা পাবে এবং তাদের সাথে মানবিক ও ইসলাম আরোপিত কর্তব্য পালন করতে হবে। কোন অবস্থাতেই কাউকে কোনরূপ উত্যক্ত করা, উৎপীড়ন বা কষ্ট দেয়া ইমানের পরিপন্থী কাজ। অর্থাৎ তাদের হক এ আমানত নষ্ট করা ঈমান বিনষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াবে এবং রাসূলের বাণী অনুযায়ী, যে প্রতিবেশির হক নষ্ট করবে, সে “জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।

iii) নিরাপত্তাদান

এক প্রতিবেশি অন্য প্রতিবেশির জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা দান করবে। প্রতিবেশি যাতে সব সময় নিরাপদে ও নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারে, কোনরূপ কষ্ট না পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

এ প্রসংগে মহানবী (সাঃ)ঘোষণা করেন,

“যে ব্যক্তির প্রতিবেশি তার অন্যায় আচরণ ও অত্যাচার হতে নিরাপদ থাকে না, সে ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না।”

(মুসলিম)

মহানবী (সাঃ) তিনবার শপথ করে ঘোষণা দেন,

“যে ব্যক্তির অত্যাচার হতে তার প্রতিবেশি নিরাপদ থাকে না সে মু’মিন নয়।”

(সহিহ বুখারি ও মুসলিম)

iv) বিপদে-আপদে এগিয়ে আসা

প্রতিবেশির বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে, অভাব-অনটনে খোঁজ-খবর নেয়া এবং যথাসম্ভব তার প্রতিবিধান করা ইসলামের নির্দেশ।

মহানবী (সাঃ) ঘোষণা করেন,

“যে ব্যক্তি নিজে পেট পুরে খায় অথচ তার প্রতিবেশি তারই পাশে অভূক্ত থাকে, সে ব্যক্তি মু’মিন নয়।”

(আল-হাদিস)

মহানবি (সাঃ)আরো বলেন,

“যে লোক পেট ভরে খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে রাত্রি যাপন করল এবং জানলো যে, তার প্রতিবেশি ক্ষুধার্ত অবস্থায় রয়েছে, সে আমার প্রতি ইমান আনেনি।”

(বাযযার)

v) প্রতিবেশির প্রতি সামগ্রিক দায়িত্ব

প্রতিবেশিদের পারস্পরিক কী কী হক বা দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে তার ব্যাখ্যাও নবি করিম (সাঃ) দিয়েছেন বিভিন্ন হাদিসে।

একটি হাদিসে তিনি বলেছেন,

“প্রতিবেশি তার শুফাআ পাওয়ার অধিকারী।”

(আল-হাদিস)

‘শুফ্’আ’ হলো কেউ যদি তার জমি-খেত বিক্রয় করার সিদ্ধান্ত করে, তা হলে তা ক্রয় করার ব্যাপারে তার প্রতিবেশিই তুলনামূলকভাবে বেশি অধিকারসম্পন্ন। কেননা, সে জমি কোন দূরবর্তী লোক ক্রয় করলে নিকট প্রতিবেশির জন্য তা অনেক কষ্টের কারণ হতে পারে।

অপর এক হাদিসে প্রতিবেশির প্রতি সামগ্রিক কর্তব্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে নবি করিম (সাঃ)বলেন,

“প্রতিবেশির হক হল, সে যদি রোগাক্রান্ত হয় তাহলে তুমি তার সেবাযত্ন করবে, সে মরে গেলে তার লাশের সঙ্গে কবরস্থান পর্যন্ত যাবে, কাফন-দাফনে অংশগ্রহণ করবে। সে যদি অর্থাভাবে পড়ে, তাহলে তুমি তাকে ঋণ দেবে। সে যদি নগ্নতা উলংগতায় পড়ে, তাহলে তুমি তার লজ্জা আবৃত করবে। তার যদি কোন কল্যাণ হয় তাহলে তুমি তাকে মুবারকবাদ দেবে। সে যদি কোন বিপদে পতিত হয় তাহলে তুমি তার দুঃখের ভাগ নেবে, সহানুভূতি জানাবে। তোমার ঘর তার ঘর থেকে উঁচু বানিয়ে তাকে মুক্ত বায়ু থেকে বণ্টিত করবে না। তোমার রান্নার পাত্রের বাতাস দিয়েও তাকে কষ্ট দেবে না। যদি তেমন অবস্থা হয়-ই তাহলে তাকে এক চামচ খাবার পাঠিয়ে দেবে।”

(তিবরানি)

এমনকি প্রতিবেশিকে প্রথমে সালাম দেয়া এবং খানাপিনায় শরিক করাও প্রতিবেশির কর্তব্যের আওতাভুক্ত। পরস্পর পরস্পরকে উপহার-উপঢৌকন দিয়ে পারস্পরিক হৃদ্যতা বাড়ানোর কথাও ইসলাম বলেছে। মুসলিম মহিলারাও প্রতিবেশির প্রতি কর্তব্য পালনে বাধ্য।

মহিলাদের সম্বোধন করে বলা হয়েছে,

“হে মুসলিম নারী সমাজ! কোন মেয়ে প্রতিবেশি যেন অপর মেয়ে প্রতিবেশিকে হীন ও নগণ্য মনে না করে, যেন ঘৃণা না করে।”

(সহিহ বুখারি ও মুসলিম)

ঘ) সারসংক্ষেপ

ইসলামি সমাজের নিয়ম হলো-

  • প্রতিবেশিকে সালাম-কালাম করা ও কুশলাদি জানা।
  • কোন অবস্থাতেই প্রতিবেশিকে কষ্ট না দেয়া।
  • প্রতিবেশির সাথে কোন প্রকার অন্যায় ব্যবহার না করা।
  • যথাসম্ভব সদয় ব্যবহার করা।
  • সাধ্যমত প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা করা।
  • ধার চাইলে দেয়া।
  • প্রয়োজনে গৃহস্থালীর ছোট-খাট জিনিস দেয়া।
  • বিরক্ত না করা।
  • আর্থিক অনটনে সাহায্য করা।
  • রোগাক্রান্ত হলে দেখতে যাওয়া, সেবা-শুশ্রুষা করা।
  • প্রতিবেশির মান-ইজ্জত ও জান-মালের হিফাযত করা।
  • প্রতিবেশিকে হীন না জানা এবং ঘৃণা না করা।

ইত্যাদি।

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/islam

Islamic information to the point!View Author posts

You cannot copy content of this page