প্রিয় পাঠক বন্ধু, আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন সবাই? আশা করি আল্লাহর দয়ায় সবাই ভালোই আছেন। আজকে এই পোষ্টটিতে আমরা সংকলনের ইতিহাস সম্পর্কে জানার চেষ্টে করব।
তো চলুন আজকের এই আলোচনাটির মাধ্যমে আমরা আল-কুরআনের অবতরণ, সংরক্ষণ ও গ্রন্থাবদ্ধকরণের ইতিহাস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি।
নিম্নে সংক্ষিপ্তভাবে তিনটি ধাপে কুরআন সংকলনের ইতিহাস তুলে ধরা হলো-
(১) আল-কুরআনের অবতরণের ইতিহাস
আলোচনার শুরুতেই আমরা- কুরআন অবতরণের বিবরণ, কুরআন নাযিলের সময় ও স্থান এবং সর্বপ্রথম কুরআন নাযিলের ইতিবৃত্ত সম্পর্কে জেনে নিই।
ক) কুরআনের অবতরণ
মহান আল্লাহ মানুষের হিদায়াতের জন্য তাঁর মনোনীত সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর প্রতি আল-কুরআন নাযিল করেন। প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে নবী জীবনের সুদীর্ঘ ২৩ বছর ব্যাপী তা নাযিল হয়েছিল। এটি লাওহে মাহফুযে সুরক্ষিত ছিল।
কুরআন মাজীদ ‘লাওহে মাহফুয’ থেকে মহানবীর (স) কাছে দুই পর্বে নাযিল হয়।
i) ‘লাওহে মাহফুয’ থেকে ‘বায়তুল ইয্যাতে’
কুরআন মাজীদ মহারঅঅল্লাহ তায়ালার নিকট ‘লাওহে মাহফুজে’ সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ।
অর্থাৎ, ‘লাউহে মাহ্ফূযে’ লিপিবদ্ধ আছে। যেখানে ফিরিশতাগণ তার সংরক্ষণের জন্য নিযুক্ত আছেন। আল্লাহ তাআলা প্রয়োজন ও চাহিদানুযায়ী তা অবতীর্ণ করে থাকেন।
‘লাওহে মাহফুযে’ আল-কুরআন রক্ষিত ছিল। সেখান থেকে পরিপূর্ণ কুরআন একই সাথে রমযান মাসের কদর রাতে পৃথিবী সংলগ্ন ‘বায়তুল ইয্যাতে’ নাযিল হয়।
মহান আল্লাহ বলেন,
“রামাযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে।”
(সূরা বাকারা ২:১৮৫)
“নিশ্চয় আমি কদর রাতে কুরআনকে নাযিল করেছি।
(সূরা কদর ৯৭:১)
মহানবী (স) বলেন,
“লাওহে মাহফুয হতে কুরআনকে পৃথিবীর আকাশে বায়তুল ইয্যাতে রাখা হয়। তারপর জিবরাঈল (আ) ক্রমশ তা আমার প্রতি নাযিল করতে থাকেন।”
(বায়হাকী)
ii) ‘বায়তুল ইয্যাত’ হতে মহানবীর (স) প্রতি
এর পর বায়তুল ইযযাত থেকে মহানবীর (স) প্রতি আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতা জিবরাঈলের (আ) মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ওহীযোগে কুরআন নাযিল হতে থাকে। তা একসাথে নাযিল হয়নি; বরং প্রয়োজনের আলোকে কুরআনের কোন কোন আয়াত ও খন্ড খন্ড সূরা ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘ তেইশ বছর ব্যাপী নাযিল হয়।
মহান আল্লাহ বলেন,
“আমি কুরআন নাযিল করেছি খন্ড খন্ডভাবে যাতে তুমি তা মানুষের নিকট পাঠ করতে পার ক্রমে ক্রমে এবং তা ক্রমশ নাযিল করেছি।”
(সূরা বনী ইসরাইল ১৭: ১০৬)
খ) কুরআন অবতরণের সময় ও স্থান
৬০৯ খ্রিষ্টাব্দে মহানবী (স)-এর ৪০ বছর বয়সে রামাযান মাসের কদরের রাতে হেরা গুহায় সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত নাযিল হয়।
গ) কুরআন নাযিলের ইতিবৃত্ত
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীগণকে কথার মাধ্যমে বা ফেরেশতা পাঠিয়ে কিংবা স্বপ্নযোগে অথবা ইলহামের সাহায্যে কোন বিষয় জানিয়ে দেওয়াকে ওহী বলা হয়।
পবিত্র কুরআন ওহী হিসেবে অবতীর্ণের সূচনা সম্পর্কে সহীহ বুখারীতে উল্লেখ আছে,
ইয়াহইয়া ইব্ন বুকায়র (রঃ) ……… ‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি সর্বপ্রথম যে ওহী আসে, তা ছিল ঘুমের মধ্যে সত্য স্বপ্নরূপে। যে স্বপ্নই তিনি দেখতেন তা একেবারে ভোরের আলোর ন্যায় প্রকাশ পেত। তারপর তাঁর কাছে নির্জনতা প্রিয় হয়ে পড়ে এবং তিনি ‘হেরা’ গুহায় নির্জনে থাকতেন। আপন পরিবারের কাছে ফিরে আসা এবং কিছু খাদ্যসামগ্রী সঙ্গে নিয়ে যাওয়া—- এইভাবে সেখানে তিনি একাধারে বেশ কয়েক রাত ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। তারপর খাদীজা (রাঃ)-র কাছে ফিরে এসে আবার অনুরূপ সময়ের জন্য কিছু খাদ্যসামগ্রী নিয়ে যেতেন। এমনিভাবে ‘হেরা’ গুহায় অবস্থানকালে একদিন তাঁর কাছে ওহী এলো। তাঁর কাছে ফিরিশতা এসে বললেন, ‘পড়ুন’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ “আমি বললাম, ‘আমি পড়িনা।’ তিনি বলেনঃ তারপর তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে এমন ভাবে চাপ দিলেন যে, আমার অত্যন্ত কষ্ট হলো। তারপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘পড়ুন’। আমি বললামঃ আমিতো পড়ি না।’ তিনি দ্বিতীয়বার আমাকে জড়িয়ে ধরে এমন ভাবে চাপ দিলেন যে, আমার অত্যন্ত কষ্ট হলো। এরপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেনঃ ‘পড়ুন’। আমি জবাব দিলাম, ‘আমিতো পড়িন।’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, তারপর তৃতীয়বার তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে চাপ দিলেন। এরপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, “পড়ুন আপনার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে আলাক থেকে। পড়ুন আর আপনার রব মহামহিমান্বিত।” (৯৬: ১-৩)
তারপর এ আয়াত নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ফিরে এলেন। তাঁর অন্তর তখন কাঁপছিল। তিনি খাদীজা বিন্ত খুওয়ালিদের কাছে এসে বললেন, ‘আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও, আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও।’ তাঁরা তাঁকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। অবশেষে তাঁর ভয় দূর হলো। তখন তিনি খাদীজা (রাঃ) এর কাছে সকল ঘটনা জানিয়ে তাঁকে বললেন, আমি নিজের উপর আশংকা বোধ করছি। খাদীজা (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম, কখনো না। আল্লাহ আপনাকে কখনো অপমানিত করবেন না। আপনিতো আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করেন, অসহায় দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সাহায্য করেন, মেহমানের মেহমানদারী করেন এবং দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন। এরপর তাঁকে নিয়ে খাদীজা (রাঃ) তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইব্ন নাওফিল ইব্ন ‘আবদুল আসাদ ইব্ন ‘আবদুল ‘উযযার কাছে গেলেন, যিনি জাহিলী যুগে ‘ঈসায় ’ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ইবরানী ভাষা লিখতে জানতেন এবং আল্লাহ তওফীক অনুযায়ী ইবরানী ভাষায় ইনজীল থেকে অনুবাদ করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ এবং অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাদীজা (রাঃ) তাঁকে বললেন, ‘হে চাচাতো ভাই! আপনার ভাতিজার কথা শুনুন।’ ওয়ারাকা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাতিজা! তুমি কী দেখ?’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যা দেখেছিলেন, সবই খুলে বললেন। তখন ওয়ারাকা তাঁকে বললেন, ‘ইনি সে দূত যাঁকে আল্লাহ মূসা (আঃ) এর কাছে পাঠিয়েছিলেন। আফসোস! আমি যদি সেদিন যুবক থাকতাম। আফসোস! আমি যদি সেদিন জীবিত থাকতাম, যেদিন তোমার কাওম তোমাকে বের করে দেবে।’ তিনি বললেন, ‘হাঁ, অতীতে যিনিই তোমার মত কিছু নিয়ে এসেছেন তাঁর সঙ্গেই শত্রুতা করা হয়েছে। সেদিন যদি আমি থাকি, তবে তোমাকে প্রবলভাবে সাহায্য করব।’ এর কিছুদিন পর ওয়ারাকা (রাঃ) ইন্তিকাল করেন। আর ওহী স্থগিত থাকে।
ইব্ন শিহাব (রাঃ) ………. জাবির ইব্ন আবদুল্লাহ্ আনসারী (রাঃ) ওহী স্থগিত হওয়া প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ একদা আমি হেঁটে চলেছি, হঠাৎ আকাশ থেকে একটি আওয়ায শুনতে পেয়ে চোখ তুলে তাকালাম। দেখলাম, সেই ফিরিশতা, যিনি হেরায় আমার কাছে এসেছিলেন, আসমান ও যমীনের মাঝখানে একটি কুরসীতে বসে আছেন। এতে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তৎক্ষণাৎ আমি ফিরে এসে বললাম, ‘আমাকে বস্ত্রাবৃত কর।’ তারপর আল্লাহ তা’আলা নাযিল করলেন, “হে বস্ত্রাচ্ছাদিত! উঠুন, সতর্কবাণী প্রচার করুন এবং আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন। আপনার পোশাক পবিত্র রাখুন। অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকুন।” (৭৪: ১-৪) এরপর ব্যপকভাবে পর পর ওহী নাযিল হতে লাগল।
আবদুল্লাহ্ ইব্ন ইউসুফ (র) ও আবূ সালেহ্ (র) অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। হেলাল ইব্ন রাদ্দাদ (র) যুহরী (র) থেকেও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইউনুস ও মা’মার ….. স্থলে …… শব্দ উল্লেখ করেছেন।
(সহীহ বুখারী)
অর্থ্যাৎ, প্রথম ওহি হিসেবে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম পবিত্র কুরআনের সুরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত নিয়ে নিয়ে আসেন। এখান থেকেই কুরআর অবতীর্ণ বা ওহি নাযিলের সূচনা হয়েছিল।
ঘ) ওহী বিরতি পর্ব
এরপর তিন বছরের মধ্যে আর কোন ওহী নাযিল হয়নি। তিন বছর বা কারো মতে আড়াই বছর পর আবার ওহী অবতীর্ণ শুরু হয়। এভাবে সুদীর্ঘ তেইশ বছরে পরিপূর্ণ কুরআন নাযিল সম্পন্ন হয়।
ওহী বিরতি কালকে ফাতরাত বলা হয়। দীর্ঘকাল ধরে ওহী নাযিল হচ্ছিল না। এমতাবস্থায় প্রিয় নবী (স.) মেন ওহীর বাহক জিরাঈল (আ)-কে আবার দেখার আগ্রহ জাগ্রত হয়। কিছু কাল ওহী আসা বন্ধ থাকলে মহানবী (স) চিন্তুযুক্ত হয়ে পড়লেন। তিনি কখনও কখনও পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করে আকাশের দিকে তাকাতেন এজন্য যে, কোথাও জিবরাঈল (আ) কে দেখতে পাবেন অথবা কোন প্রকার আওয়াজ শুনতে পাবেন।
একদিন এমন ঘটনা ঘটে, তিনি পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করলেন আর জিবরাঈল (আ) তাঁর সামনে এসে বললেন,
“হে মুহাম্মাদ! আপনি সত্যিই আল্লাহর রাসূল।”
(সহীহ বুখারী)
এ কথা শুনে মহানবী (স)-এর মন শান্ত হয় এবং তিনি ফিরে এলেন। এর কিছু দিন পর আবার তিনি হেরা পর্বতের কাছে গিয়ে দেখতে পান হযরত জিবরাঈল (আ) আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী স্থানে একটি আসনে বসে আছেন।
মহানবী (স) তাঁকে ঐ অবস্থায় দেখে নিজ গৃহে ফিরে আসেন এবং বললেন, ‘কম্বল দিয়ে আমাকে আচ্ছাদিত করে দাও।’
এ সময় সূরা মুদ্দাছ্ছিরের প্রথম আয়াতগুলো নাযিল হয়,
“হে বস্ত্রাচ্ছাদিত! উঠুন, আর সতর্ক করুন এবং আপনার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন।”
(সূরা মুদ্দাছ্ছির ৭৪:১-৩)
এরপর থেকে নিয়মিতভাবে ওহী নাযিল হতে থাকে। মহানবী (স)-এর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে।
ঙ) সর্বশেষ ওহী
পবিত্র কুরআন ও ইসলামের পূর্ণাঙ্গতার ঘোষণা দিয়ে বিদায় হজের সময় আল্লাহ তাআলা সর্বশেষ অবতীর্ণ করেন,
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) মনোনীত করলাম।” (সূরা মায়িদা ৫:৩)
বস্তুত মহান আল্লাহ জিবরাইল (আ.) এর মাধ্যমে মহানবী (স) -এর প্রতি আল-কুরআন নাযিল করেন।
আল-কুরআন মহান আল্লাহর বাণী। এটি লাওহে মাহফুযে সুরক্ষিত গ্রন্থ, যা হযরত মুহাম্মাদ (স) -এর নবী জীবনের সুদীর্ঘ ২৩ বছরে নাযিল হয়। ৬০৯ খ্রিষ্টাব্দে মহানবী (স) -এর বয়স যখন ৪০ বছর পূর্ণ হয়, তখন রমযান মসের কদর রাতে সূরা আলাকের পাঁচটি আয়াত নাযিল হয়। এভাবে কুরআন নাযিলের ধারা শুরু হয়।
(২) আল-কুরআনের সংরক্ষণের ইতিহাস
আলোচনার এই অংটিতে আমরা- দুনিয়াতে কুরআন অবতীর্ণ হবার পর আল-কুরআন সংরক্ষণের পদ্ধতি ও যুগে যুগে কুরআন সংরক্ষণের ইতিহাস সম্পর্কে জানব।
ক) কুরআন সংরক্ষণ পদ্ধতি
মানবজাতির প্রতি মহান আল্লাহর অমূল্য দান হচ্ছে আল-কুরআন। মহান আল্লাহ স্বয়ং এ কিতাবের হিফাযতকারী বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তাছাড়া মহানবীর (স) আমলে তথা কুরআন নাযিল হওয়ার সময় এবং সকল যুগেই এর সুরক্ষার নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা অবলম্বিত হয়ে আসছে। আল-কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ যা সম্পূর্ণ অবিকৃত ও রক্ষিত আসমানি কিতাব হিসেবে চির অম্লান।
কুরআন মাজীদ দু’টি পদ্ধতিতে সংরক্ষিত হয়-
i) স্মৃতি ভান্ডার
পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবের তুলনায় একমাত্র কুরআনই এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যে, এর সুরক্ষার জন্যে কলম ও কাগজের তুলনায় অধিক নির্ভর করা হয় স্মৃতিভান্ডার তথা হাফিযদের স্মরণ শক্তির উপর।
হাদিসে কুদসীতে বলা হয়েছে,
“আপনার প্রতি আমি এমন একটি কিতাব নাযিল করেছি যাকে পানি মুছে ফেলতে পারে না।”
(সহীহ্ মুসলিম)
ii) লিখন পদ্ধতির মাধ্যমে
পবিত্র কুরআন নাযিল হওয়ার সাথে সাথে ওহী লেখক দ্বারা লিখে রাখা হতো। এ ধারা পরবর্তী যুগে লিপিবদ্ধ ও মুদ্রণের মাধ্যমে পবিত্র কুরআন অবিকল লিখিত আকারে সুরক্ষিত হয়ে আসছে।
খ) কুরআন সংরক্ষণের ইতিহাস
মহানবীর (স) যুগে কুরআন সংরক্ষণ: মহানবীর (স) যুগে কুরআন সংরক্ষণের ব্যবস্থাসমূহ ছিল-
i) কুরআন মুখস্তকরণ
কুরআন মাজীদ নাযিল হওয়ার সাথে সাথে মহানবী (স) মুখস্থ করে নিতেন এবং তা জিবরাঈল (আ)-কে শুনাতেন। সাথে সাথে সাহাবীগণকেও কণ্ঠস্থ করে স্মৃতিভান্ডারে সি ত করে রাখার নির্দেশ দিতেন।
ii) পারস্পরিক পঠন-পাঠন ও শ্রবণ
অধিকতর সতর্কতার জন্য মহানবী (স) প্রতি বছর রামাযান মাসে জিবরাঈলের (আ) সাথে কুরআন পারস্পরিক পঠন-পাঠন ও শ্রবণ করতেন। তেমনিভাবে তিনি সাহাবীগণকে শুনাতেন আর সাহাবীগণও তাঁকে শুনাতেন।
iii) ব্যাপক চর্চা, শিক্ষাদান
সাহাবীগণের মধ্যে কুরআন মুখস্থ করা, স্মরণ রাখা এবং শিক্ষাদানের অদম্য আগ্রহ বিদ্যমান ছিল। পবিত্র কুরআনকে স্বীয় স্মৃতির মণিকোঠায় সুরক্ষিত রাখার নিমিত্তে হাজার হাজার সাহাবী সকল মগ্নতা ত্যাগ করে এ সাধনায় জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন। নিয়মিত রাত জেগে তারা নফল নামাযেও তিলাওয়াত করতেন।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহর ঘোষণা,
“তারা রাতে আল্লাহর (কুরআনের) আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে থাকেন।”
(আলে-ইমরান ৩:১১৩)
মহানবীর (স) সময় মদীনায় আরো বেশ কয়েকটি মসজিদ কায়েম হয়েছিল। সেগুলোতে কুরআন শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল। বহু সাহাবী মানুষকে কুরআন শিক্ষাদানে ব্যস্ত ছিলেন। অনেক মহিলা বিয়ের মোহরানা স্বরূপ স্বামীর নিকট কুরআন শিক্ষা গ্রহণ করতেন। এভাবে ব্যাপক চর্চা ও শিক্ষাদানের বিপুল আগ্রহ ও তৎপরতার দ্বারা কুরআনের বাণী ছিল সকলের মুখে মুখে।
iv) কুরআনের বাস্তব আমল
মহানবী (স) এবং সাহাবীগণ কুরআনের প্রতিটি আয়াতের মর্ম বাস্তব জীবনে রূপায়িত করার চেষ্টা করতেন।
v) কুরআন লিখন, উপকরণ ও বিন্যাস
মহানবী (স) এর যুগে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সুচারুরূপে ওহী লিখন দফতর-এর মাধ্যমে কুরআনের লিখনের কাজটি করানো হয়। তবে এ সময় কুরআন মাজীদ একই নুসখা বা পান্ডুলিপিতে একত্র করা হয়নি।
মহানবীর (স) যুগে কুরআন লিখনের উপকরণ ছিল গাছের বাকল, হাড়, চামড়া, পাথর, কাপড়, মিশরীয় ফোম বস্ত্র এবং তখনকার মতো আবিষ্কৃত এক প্রকার কাগজ।
কুরআনের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময় নাযিল হয় এবং তা সুচারুরূপে লিখিত হয়। সূরার নামকরণ, ধারাবাহিকতা এবং কোন আয়াত কোন সূরার কোথায় লিখিত হবে তার সবকিছুই আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক সুবিন্যস্ত ছিল।
গ) কুরআন সংরক্ষণ প্রথম খলীফার যুগে
মহানবী (স)-এর যুগে কুরআনের যেসব পান্ডুলিপি প্রস্তুত হয়েছিল তা একই গ্রন্থে ছিল না বরং বিভিন্ন বস্তুর উপর বিক্ষিপ্তভাবে ছিল।
এদিকে মহানবীর (স) তিরোধানের পর হযরত আবু বকরের খিলাফতের প্রথম দিকে ইসলাম বিরোধী চক্র ও ভন্ড নবীর বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধে কুরআনের বহু হাফিয শাহাদাতবরণ করেন হযরত উমর (রা) কুরআন একত্রে গ্রন্থাবদ্ধ করে সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্বারোপ করলে প্রথম খলিফা আবু বকর (রা) তা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধে কুরআনের বহু হাফিয শাহাদাতবরণ করেন। সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্বারোপ করলে প্রথম খলিফা করেন।
ঘ) কুরআন সংরক্ষণ তৃতীয় খলীফার আমলে
তৃতীয় খলিফা হযরত উসমানের (রা) আমলে আরব সীমান্ত পেরিয়ে পারস্য ও রোমের বিস্তৃর্ণ অঞ্চলে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে। ফলে কুরআনের পঠনে আঞ্চলিক ভাষা ও উচ্চারণের প্রভাব কুরআনের বিশুদ্ধ পাঠে বিঘ্ন দেখা দেয়। এ অবস্থা দেখে হযরত উসমান (রা) উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি নেতৃস্থানীয় সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে যায়িদ ইবনে সাবিত (র)-এর নেতৃত্বে একটি সংস্থা গঠন করেন। এ সংস্থা মূল পান্ডুলিপির অনুকরণে একই পঠন রীতিতে কুরআনের মাসহাফ তৈরি করেন। এবং তার অনুলিপি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেন। আর সতর্কতার জন্য পূর্বের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আঞ্চলিক উচ্চারণের কুরআনের সমস্ত অংশ বা কপি তলব করে নেওয়া হয়। আর তা আগুনে পুড়িয়ে বিনষ্ট করে দেওয়া হয়। এভাবেই কুরআন মাজীদ সংরক্ষিত হয়।
ঙ) পরবর্তীকালে কুরআন সংরক্ষণ
কুরআনের পাঠ সহজতর করার জন্য হরকত সংযোজন করেন হাজ্জাজ ইবনে ইবনে ইউসুফ। পবিত্র কুরআন এমন একটি গ্রন্থ যাতে কোন কিছু অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়নি। তখন থেকে আজ পর্যন্ত কুরআন হাফিযদের স্মৃতিভান্ডার ও মুদ্রণ শিল্পের মাধ্যমে বা লিখিত আকারে নির্ভুলভাবে সংরক্ষিত রয়েছে এবং তা কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে।
আল-কুরআন সুদীর্ঘ ২৩ বছরব্যাপী নাযিল হয়। নাযিল হওয়ার সাথে সাথে তা রাসূলুল্লাহ করতেন। ওহীর লেখকগণের দ্বারা লিখিয়ে রাখতেন। তা পঠন পাঠন হতো। প্রথম খলিফার আমলে পঠনরীতি চালু করা হয়। এভাবে কুরআন সংরক্ষিত আছে তা সংরক্ষণ করে রাখবেন।
(৩) আল-কুরআন গ্রন্থাবদ্ধকরণের ইতিহাস
আলোচনার এ অংশে আমার- কুরআন গ্রন্থাবদ্ধকরণের ইতিহাস এবং
কুরআন একত্রকরণে গঠিত কমিশনের ভূমিকা সম্পর্কে জেনে নিব।
ক) মহানবীর (স) যুগে
মহানবী (স)-এর উপর ওহী নাযিল হওয়ার সময়ে পবিত্র কুরআনকে একখানি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থে রূপাদান করা সম্ভব হয়নি। কারণ তখনও কুরআন নাযিল হচ্ছিল। এ সময় কুরআন নাযিল হওয়ার সাথে সাথে তা লিখে রাখা হতো। ওহী লেখকদের সংখ্যা ছিল ৪২ জন। ওহী লেখকগণ রাসূলের (স) কাছে থাকতেন এবং যখন যা নাযিল হতো তা লিখে রাখতেন।
খ) প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রা)-এর যুগে
মহানবীর (স) ইন্তিকালের পর ইসলাম জাহানের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রা)-এর খিলাফত আমলে ভন্ড নবীর বিরুদ্ধে পরিচালিত জিহাদে বিশেষত ইয়ামামার যুদ্ধে কুরআনের অনেক হাফিয সাহাবী শাহাদাতবরণ করেন। এভাবে হাফিযগণ শাহাদাতবরণ করতে থাকলে কুরআন মাজীদ সংরক্ষণ করা দুরূহ হয়ে পড়তে পারে। তাছাড়া কুরআনের অংশবিশেষ হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দূরদর্শী হযরত উমর (রা) খলীফা হযরত আবু বকর (রা)-কে কুরআন সংগ্রহ করে একই গ্রন্থে গ্রন্থাবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। হযরত উমরের (রা) পরামর্শ বিবেচনায় নিয়ে সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করেন। হযরত আবু বকর (রা) মহানবী (স) যে কাজটি করে যেতে পারেননি, তা করার সীমাহীন গুরুত্ব ও কল্যাণের দিক বিবেচনা করে এ প্রস্তাবে সম্মত হন এবং কুরআন গ্রন্থাবদ্ধ করার মহতী কাজে হাত দেন।
মহানবীর (স) ওহী লিখন দফতরের কমিশন গঠন করেন। মুসলিম জাহানের সর্বত্র ফরমান জারি করেন যে, যার কাছে কুরআনের যে অংশ রয়েছে, তা কমিশনের নিকট জমা দিতে। কমিশন মহানবীর (স) সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে হাফিযদের স্মৃতিতে কুরআনের সূরা ও আয়াতসমূহ সংগ্রহ করে একখানি পূর্ণাঙ্গ প্রামাণ্য পান্ডুলিপি গ্রন্থাকারে রূপদান করেন। একে রাষ্ট্রীয়ভাবে হিফাযত করা হয়। পরে দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমরের (রা) ইনতিকালের পর নবীপত্নী উম্মুল মুমিনীন হযরত হাফসা (রা) নিকট তা সংরক্ষিত থাকে।
গ) অভিন্ন পাঠরীতিতে কুরআন গ্রন্থাবদ্ধকরণ
তৃতীয় খলীফা হযরত উসমানের (রা) খিলাফতকালে ইসলাম আরব সীমান্ত পেরিয়ে পারস্য ও রোমের বিস্তীর্ণ এলাকায় বিস্তার লাভ করে। ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ফলে বিভিন্ন জাতি ও ভাষা-ভাষীর লোক ইসলাম গ্রহণ করে। অনারব লোকেরা কুরাইশদের ভঙ্গিতে কোন কোন আরবি শব্দের উচ্চারণ করতে পারত না। আঞ্চলিক উচ্চারণের প্রভাবে কুরআনের বিশুদ্ধ পাঠে পার্থক্য দেখা দেয়। হযরত উসমান (রা) ব্যাপারটির গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। তিনি নেতৃস্থানীয় সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে ওহী লিখন ও গ্রন্থাবদ্ধ করার কাজটি যারা করেছেন, তাদের সমন্বয়ে যায়িদ বিন সাবিতের (রা) নেতৃত্বে একটি সংস্থা গঠন করেন। এ সংস্থাকে কতকগুলো মূলনীতির আলোকে একই পাঠরীতির কুরআনের পান্ডুলিপি প্রস্তুত করতে বলেন।
এ সংস্থার কাজ ছিল-
- প্রথম খলিফা হযরত আবু বকরের (রা) আমলের মূল পান্ডুলিপি অনুকরণে সূররি ক্রমানুসারে একই মাসহাফে সন্নিবেশ করা।
- মহানবীর (স) যুগে এমন পদ্ধতিতে কুরআন লেখা হত, যাতে প্রসিদ্ধ সকল কিরআন পদ্ধতিতে কুরআন পাঠ করা যেত। কিন্তু পরে এতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। তাই এ সংস্থা কেবল একই পঠন পদ্ধতিতে কুরআনের মাসহাফ প্রস্তুত করেন।
- এ সংস্থা কুরআনের সর্বসম্মত ও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ্য পান্ডুলিপির অনুলিপি তৈরি করে প্রাদেশিক গভর্নরদের কাছে প্রেরণ করে সরকারিভাবে তারই অনুসরণ করার নির্দেশ জারি করে।
- এ সংস্থা আবু বকরের (রা) সময়ের মূল পান্ডুলিপিটিও পুনঃপরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং যাচাই-বাছাই করে দেখেন।
- মূল পান্ডুলিপি রেখে কুরআনের অন্য সব অংশ বা পান্ডুলিপি তলব করে নেওয়া হয়। অধিকতর সতর্কতার জন্য তা আগুনে পুড়িয়ে বিনষ্ট করে দেওয়া হয়। এভাবেই কুরআন মাজীদ তৃতীয় খলীফা হযরত উসমানের (রা) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে একই পঠনরীতিতে গ্রন্থাবদ্ধ করা হয়।
মহান আল্লাহ স্বয়ং কুরআনের হিফাযতকারী বলে ঘোষণা দিয়েছেন। পবিত্র কুরআন নাযিল হওয়ার সময় হতেই এর লেখার কাজ চলতে থাকে। খুলাফায়ে রাশিদীনের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) ও তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান (রা)-এর আমলে কুরআন গ্রন্থাবদ্ধকরণের কাজ চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।
পবিত্র ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট ইসলাম’ (inbangla.net/islam) এর সাথেই থাকুন।