Skip to content

কুরবানি ও আকিকা কি, কেন, কিভাবে?

কুরবানি ও আকিকা কি, কেন, কিভাবে নিয়মনীতি

(১) কুরবানি অর্থ কি?

কুরবানির সমার্থক শব্দ ‘উযহিয়্যাহ্’। এর আভিধানিক অর্থ ত্যাগ, উৎসর্গ ইত্যাদি।

(২) কুরবানি কাকে বলে?

শরিয়তের পরিভাষায় জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য যে পশু জবাই করা হয় তাকে কুরবানি বলে।

বর্তমানে যে কুরবানি প্রথা প্রচলিত আছে, তা হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর সময় থেকে চলে আসছে। এটি আত্মত্যাগ ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক অন্যতম মাধ্যম। এটি একটি উত্তম ইবাদত।

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,

“কুরবানির দিনে রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কাজ আল্লাহর নিকট আর কিছুই নেই। ঐ ব্যক্তি কিয়ামতের দিন কুরবানির পশুর শিং, ক্ষুর ও লোমসমূহ নিয়ে হাজির হবে ৷ কুরবানির রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর নিকট বিশেষ মর্যাদার স্থানে পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা কুরবানির দ্বারা নিজেদেরকে পবিত্র কর।”

(তিরমিযি)

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আরও বলেন,

“সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানি করল না সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।”

(ইবনে মাজাহ)

(৩) কুরবানী আমাদের কি শিক্ষা দেয়?

কুরবানি বলতে শুধু গরু, ছাগল, মহিষ, দুম্বা ইত্যাদি জবাই করা বোঝায় না। বরং এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন বোঝায়। কুরবানি আল্লাহর নবি হযরত ইবরাহিম (আঃ) ও হযরত ইসমাইল (আঃ) এর অতুলনীয় ত্যাগের স্মৃতি বহন করে। এর মাধ্যমে মুসলমানগণ ঘোষণা করেন যে, তাদের কাছে নিজ জানমাল অপেক্ষা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মূল্য অনেক বেশি। তারা পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে এর রক্ত প্রবাহিত করে আল্লাহর কাছে শপথ করে বলে, “হে আল্লাহ! তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যেভাবে পশুর রক্ত প্রবাহিত করছি, প্রয়োজনে আমাদের শরীরের রক্ত প্রবাহিত করতেও কুণ্ঠিত হব না।” কে কত টাকা খরচ করে পশু ক্রয় করেছে, কার পশু কত মোটা তাজা, কত সুন্দর আল্লাহ তা দেখতে চান না। তিনি দেখতে চান কার অন্তরে কতটুকু আল্লাহর ভালোবাসা ও তাকওয়া আছে।

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন,

“কখনো আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না এগুলোর গোশত এবং রক্ত বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।”

(সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত ৩৭)

আত্মত্যাগ ও আত্মসমর্পণের মূর্ত প্রতীক ছিলেন হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও হযরত ইসমাইল (আঃ)। মানুষের জীবনে এ শিক্ষা গ্রহণ করলে তারা হয়ে উঠবে একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল, পরোপকারী ও আত্মত্যাগী। আত্মত্যাগী মানুষই সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। নিজের সুখ শান্তির বাইরে যারা সমাজের মানুষের সুখকে বড় করে দেখে, তারাই প্রকৃত মানুষ। কুরবানির ত্যাগের শিক্ষা আমাদেরকে পরোপকারে উৎসাহিত করবে ও মানবতাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটাবে।

(৪) কুরবানির ইতিহাস

হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-কে আল্লাহ তায়ালা বহুবার বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করেছেন। সকল পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন। এবার তিনি এক অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হলেন।

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এক রাতে স্বপ্নে দেখলেন, পুত্র ইসমাইলকে কুরবানি করতে আল্লাহ তাঁকে আদেশ করেছেন। বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র সন্তান ইসমাইল অপেক্ষা দুনিয়াতে অধিকতর প্রিয় আর কী হতে পারে? অনেক চিন্তা-ভাবনা করে তিনি শেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন, আল্লাহ যাতে খুশি হন তাই তিনি করবেন।

পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে, তখন তিনি পুত্র ইসমাইলকে বললেন,

“তিনি (ইব্রাহিম) বললেন: হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে আমি জবাই করছি। এখন তোমার অভিমত কী? তিনি (ইসমাইল) বললেন: হে আমার আব্বা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তা-ই করুন। আল্লাহ ইচ্ছা করলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।”

(সূরা আস্-সাফ্ফাত: ১০২)

ছেলের এ সাহসিকতাপূর্ণ উত্তর পেয়ে নবি ইব্রাহিম (আঃ) খুশি হলেন। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য তিনি পুত্র ইসমাইলের গলায় ছুরি চালালেন। এবারের পরীক্ষাতেও ইব্রাহিম (আঃ) উত্তীর্ণ হলেন।

পবিত্র কুরআনে আছে,

“তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম: হে ইব্রাহিম! তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যিই পালন করলে।”

(সূরা আস্-সাফ্ফাত, আয়াত ১০৪-১০৫)

আল্লাহ তায়ালা খুশি হয়ে বেহেশত থেকে একটি দুম্বা এনে ইসমাইলের জায়গায় ছুরির নিচে শুইয়ে দিলেন। হযরত ইসমাইল (আঃ) এর পরিবর্তে দুম্বা কুরবানি হয়ে গেল। এ অপূর্ব ত্যাগের ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য তখন হতেই কুরবানি প্রথা চালু হয়েছে। এটি আজ মুসলিম সমাজে একটি পবিত্র ধর্মানুষ্ঠানরূপে স্বীকৃত।

কুরবানি অর্থ কি, কাকে বলে, কুরবানী আমাদের কি শিক্ষা দেয়, কুরবানির ইতিহাস, নিয়মাবলি ও বিধিবিধান

(৫) কুরবানির নিয়মাবলি ও বিধিবিধান

কুরবানির কতিপয় বিশেষ নিয়মাবলি ও বিধিবিধান নিম্নে বর্ণনা করা হলো-

  1. জিলহজ মাসের ১০ তারিখ ফজর হতে ১২ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত যদি কেউ নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক (সাহিবে নিসাব) হয়, তবে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব। মুসাফিরের উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়। 
  2. জিলহজ মাসের ১০, ১১ এবং ১২ তারিখ তিন দিন কুরবানির সময়। এ তিন দিনের যেকোনো দিন কুরবানি করা যায়। তবে প্রথম দিন কুরবানি করা উত্তম।
  3. ঈদুল আযহার নামাযের আগে কুরবানি করা সঠিক নয়। নামায আদায়ের পর কুরবানি করতে হয়।
  4. সুস্থ সবল ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, গরু, মহিষ, উট ইত্যাদি গৃহপালিত পশু দ্বারা কুরবানি করতে হয় গরু, মহিষ এবং উটে এক হতে সাত জন পর্যন্ত শরিক হয়ে কুরবানি করা যায়।
  5. কুরবানির ছাগলের বয়স কমপক্ষে এক বছর হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে দুই বছরের হতে হবে। উটের বয়স কমপক্ষে পাঁচ বছর হতে হবে। দুম্বা ও ভেড়ার বয়স ছাগলের মতো। তবে ছয় মাসের বেশি বয়সের দুম্বার বাচ্চা যদি এরূপ মোটাতাজা হয় যে, এক বছরের অনেকগুলো দুম্বার মধ্যে ছেড়ে দিলে চেনা যায় না, তবে সেরূপ বাচ্চা দিয়ে কুরবানি জায়েয। কিন্তু ছাগলের বাচ্চার বয়স এক বছর না হলে কুরবানি জায়েয হবে না।
  6. কুরবানির গোশত সাধারণত তিন ভাগ করে এক ভাগ গরিব মিসকিনকে, একভাগ আত্মীয় স্বজনকে দিতে হয় এবং একভাগ নিজের জন্য রাখা উত্তম।
  7. নিজ হাতে কুরবানি করা উত্তম।
  8. কুরবানির প্রাণী দক্ষিণ দিকে মাথা রেখে কিবলামুখী করে, ধারালো অস্ত্র দ্বারা ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করতে হয়।

প্রত্যেক মুসলমানের উচিত কুরবানির সময় একাগ্রতার সাথে উত্তম পশু কুরবানি করা। তাতে তাঁরা অনেক সাওয়াব পাবে। পরস্পরের মধ্যে আন্তরিকতা বাড়বে এবং হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

(৬) আকিকা শব্দের অর্থ কি?

‘আকিকা’ আরবি শব্দ। এর অর্থ ভাঙা, কেটে ফেলা ইত্যাদি।

(৭) আকিকি কি/কাকে বলে?

ইসলামি পরিভাষায় সন্তান জন্মের পর সপ্তম দিনে তার কল্যাণ কামনা করে আল্লাহর নামে কোনো হালাল গৃহপালিত পশু জবাই করাকে আকিকা বলা হয়।

(৮) আকিকা করা কি ফরজ/বাধ্যতামূলক?

না আকিকা করা ফরজ নয়, আকিকা করা সুন্নাত। এর মাধ্যমে আল্লাহর রহমত পাওয়া যায়। সন্তানের বিপদাপদ দূর হয়। সন্তান জন্মের সপ্তম দিনে আকিকা করতে হয়। কাজেই প্রত্যেক পিতামাতার উচিত নবজাত সন্তানের নামে যথাসময়ে আকিকা করা।

হাদিসে আছে,

“প্রতিটি নবজাত সন্তান আকিকার সাথে সম্পৃক্ত। তার জন্মের সপ্তম দিনে তার নামে পশু জবাই করতে হবে। তার নাম রাখা হবে, তার মাথার চুল মুণ্ডন করা হবে।”

(নাসায়ি)

নবি করিম (সাঃ)-এর আগেও আকিকার প্রচলন ছিল। আল্লাহ তায়ালার অনুমতিতে তিনি তা চালু রাখেন। মহানবি (সাঃ) নিজে আকিকা করেছেন, অন্যকে এ ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছেন। পিতামাতা আকিকা না করলে নিজের আকিকা নিজেও করা যায়। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) নবি হওয়ার পর নিজের আকিকা নিজেই করেছিলেন।

আকিকা সন্তান জন্মের সপ্তম দিনে করা মুস্তাহাব।

মাতাপিতার কাছে সবচেয়ে প্রিয় হলো সন্তান। সন্তান জন্মের সপ্তম দিনে চারটি কাজ করা উত্তম-

  1. সন্তানের ইসলামি নাম রাখা।
  2. মাথা মুণ্ডন করা।
  3. মাথার চুলের ওজন পরিমাণ সোনা বা রুপা দান করা।
  4. আকিকা করা।
আকিকি শব্দের অর্থ, কি, কাকে বলে আকিকা করা কি ফরজ বা বাধ্যতামূলক আকিকা দেওয়ার নিয়ম

(৯) আকিকা দেওয়ার নিয়ম

মুসলমানের প্রত্যেকটি বৈধ কাজই ইবাদত। ইবাদত আদায়ের সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। আর নিয়মমতো কাজটি সমাধা করলে অবশ্যই আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া যায়। তাই আকিকা করাও একটি ইবাদত এবং তা আদায়ের সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে।

এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,

“ছেলে সন্তানের জন্য দুটি ছাগল ও মেয়ে সন্তানের জন্য একটি ছাগল জবাই করাই যথেষ্ট।”

(নাসায়ি)

আকিকার জন্য ছেলে হলে দুটি আর মেয়ে হলে একটি ছাগল বা ভেড়া জবাই করতে হয় কিংবা কুরবানির গরুর মধ্যে ছেলের জন্য দুই আর মেয়ের জন্য এক অংশ নেওয়া যায়।

যে সকল পশু দ্বারা কুরবানি করা যায় ঐ সকল পশু দ্বারা আকিকাও চলে। আকিকার পশুর বয়স কুরবানির পশুর বয়সের অনুরূপ হতে হবে।

আকিকার পশুর গোশত কুরবানির পশুর গোশতের ন্যায় তিন ভাগ করে একই নিয়মে বণ্টন করতে হয়। এ গোশত সন্তানের পিতামাতা, ভাইবোন সকলেই খেতে পারে। এ গোশত রান্না করে আত্মীয় স্বজন ও গরিব মিসকিনকে খাওয়ানো যায়। চামড়া গরিব-মিসকিনকে দান করে দিতে হয়। আকিকার পশু সন্তানের পিতার নিজ হাতে জবাই করা উত্তম। নিজে অপারগ হলে অন্যের সাহায্যে জবাই করানো যায়।

পবিত্র ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট ইসলাম’ (inbangla.net/islam) এর সাথেই থাকুন।

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/islam

Islamic information to the point!View Author posts