আকাইদের বিষয়সমূহের মধ্যে রিসালাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাওহিদের পরই আসে রিসালাত। রিসালাত অর্থ সংবাদ বহন, খবর বা চিঠি পৌছানো।
ইসলামি পরিভাষায়, আল্লাহ তায়ালার বাণী, আদেশ- নিষেধ মানুষের নিকট পৌঁছানোকে রিসালাত বলে। যাঁরা এ সংবাদ পৌঁছানোর কাজ করেন তাঁরা হলেন নবি-রাসুল। রিসালাত ও নবি-রাসুলের উপর বিশ্বাস করা ফরজ বা আবশ্যক।
(১) নবি-রাসুলের সংখ্যা
আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির হিদায়াতের জন্য বহু নবি-রাসুল এ দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। পৃথিবীতে এমন কোনো জাতি ছিল না যেখানে আল্লাহ তায়ালা নবি-রাসুল প্রেরণ করেন নি।
আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
“আর প্রত্যেক জাতির জন্য পথপ্রদর্শক রয়েছে।”
(সূরা আর-রা’দ, আয়াত ৭)
আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য নবি-রাসুল এর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম নবি ছিলেন হযরত আদম (আঃ), আর সর্বশেষ নবি ও রাসুল হলেন আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)।
কুরআন মজিদে ২৫ জন নবি-রাসুলের নামের উল্লেখ রয়েছে।
মোট নবি-রাসুলগণের কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা বা পরিমাণ কুরআন ও সহীহ হাদীস প্রমাণিত নয়।
(২) নবি-রাসুলের পার্থক্য
অর্থগত দিক থেকে এ দুটি শব্দের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা যাঁদের প্রতি আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন কিংবা নতুন শরিয়ত প্রদান করেছেন, তাঁরা হলেন রাসুল। আর যার প্রতি কোনো কিতাব অবতীর্ণ হয় নি কিংবা যাঁকে কোনো নতুন শরিয়ত দেওয়া হয় নি তিনি হলেন নবি। তিনি তাঁর পূর্ববর্তী রাসুলের শরিয়ত প্রচার করতেন।
এ হিসেবে সকল রাসুলই নবি ছিলেন। কিন্তু সকল নবি রাসুল ছিলেন না।
যেমন— আমাদের মহানবি (সাঃ) ছিলেন একাধারে নবি ও রাসুল। হযরত নূহ (আঃ) এর উপরে কোন কিতাব নাজিল হয় নি কিন্তু তাঁর দ্বারা শরিয়তের বিধি-বিধান প্রচার ও প্রবর্তন হয়েছে। তিনিও রাসুল ছিলেন। অপরদিকে হযরত হারুন (আঃ) ছিলেন মাত্র নবি। তাঁর প্রতি কোনো কিতাব নাজিল হয় নি। তিনি হযরত মুসা (আঃ)-এর শরিয়ত প্রচার করতেন।
রিসালাতের তাৎপর্য নবি-রাসুলগণ ছিলেন মানুষের প্রতি আল্লাহ তায়ালার বিশেষ নিয়ামত স্বরূপ। তাঁরা সকলকে তাওহিদের পথে ডাকতেন। কুফর, শিরক, নিফাক থেকে সতর্ক করতেন। উত্তম চরিত্র ও নৈতিক শিক্ষা প্রদান করতেন।
নবিগণের দাওয়াতের মূল কথা আল্লাহর একত্ববাদ এবং তাঁর বিধি-বিধান প্রচার করা।
এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
“হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোনো ইলাহ নেই।”
(সূরা আল-আ’রাফ, আয়াত ৭৩)
নবি-রাসুলগণের দায়িত্বকেই বলা হয় রিসালাত।
এ রিসালাতের মর্ম বর্ণনা করে মহান আল্লাহ বলেন,
“আল্লাহর ইবাদত করার ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেয়ার জন্য আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসুল পাঠিয়েছি।”
(সূরা আন-নাহল, আয়াত ৩৬)
নবি রাসুলগণ আল্লাহ তায়ালার দেওয়া এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন। যারা তাঁদের আনুগত্য ও অনুসরণ করেছে তারা সফলকাম হয়েছে।
আমরা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রিয়নবি (সাঃ) এর আনীত বিধান অনুসরণ করব, তাহলে আমরাও সফলকাম হব।
(৩) নবি-রাসুলের সমাপ্তি বা খতমে নবুয়ত
ক) পরিচয়
খতম শব্দের অর্থ শেষ, সমাপ্ত। আর নবুয়ত অর্থ পয়গম্বারি, নবিগণের দায়িত্ব ইত্যাদি। সুতরাং খতমে নবুয়ত অর্থ নবিগণের দায়িত্বের পরিসমাপ্তি বা নবুয়তের সমাপ্তি।
মানবজাতির হিদায়াতের জন্য আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে বহু নবি-রাসুল প্রেরণ করেন। এ ক্রমধারা শুরু হয় হযরত আদম (আঃ)-এর মাধ্যমে, আর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আগমনের মাধ্যমে শেষ হয়। নবুয়ত তথা নবি-রাসুল আগমনের এ ক্রমধারাটির সমাপ্তিকেই খতমে নবুয়ত বলা হয়।
যাঁর মাধ্যমে এ ক্রমধারা শেষ হয় তিনি হলেন খাতামুন নাবিয়্যিন বা নবিগণের শেষজন। আর তিনি হলেন মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)।
খ) তাৎপর্য
আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবি। তিনি হলেন খাতামুন নাবিয়্যিন। তাঁর পর আজ পর্যন্ত কোনো নবি আসেন নি আর কিয়ামত পর্যন্ত আসবেনও না। তাঁর মাধ্যমে নবি-রাসুলের আগমনের ধারা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। খতমে নবুয়তের উপর বিশ্বাস করা অপরিহার্য। এতে বিশ্বাস না করলে মানুষ ইমানদার হতে পারে না।
গ) খতমে নবুয়তের প্রমাণ
মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন সর্বশেষ নবি। তাঁর মাধ্যমে নবুয়তের ক্রমধারা পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। কুরআন-হাদিসের বহু স্থানে এ বিষয়টি স্পষ্ট করে বর্ণনা করা হয়েছে। নিম্নে আমরা খতমে নবুয়ত এর কিছু প্রমাণ স্পষ্টভাবে জানব।
i) আল কুরআনের দলিল
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা সরাসরি মহানবি (সাঃ)-কে খাতামুন নাবিয়্যিন বলেছেন।
মহান আল্লাহ বলেন,
“মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নন। বরং তিনি তো আল্লাহর রাসুল ও সর্বশেষ নবি।”
(সূরা আল-আহযাব, আয়াত ৪০)
ii) হাদিস শরিফের দলিল
বহু হাদিসে খতমে নবুয়তের প্রমাণ রয়েছে।
নিম্নে আমরা এ সম্পর্কে কতিপয় হাদিস জানব,
মহানবি (সাঃ) বলেন,
“আমিই শেষ নবি। আমার পর আর কোনো নবি আসবেন না।”
(সহিহ্ মুসলিম)
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
“রিসালাত ও নবুয়তের ধারা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমার পর আর কোনো নবি ও রাসুল আসবেন না।”
(জামি তিরমিযি)
নবি করিম (সাঃ) বলেন,
“বনি ইসরাইলে নবিগণই নেতৃত্ব দিতেন। যখনই কোনো নবি ইন্তিকাল করতেন তখনই পরবর্তী নবি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতেন। কিন্তু আমার পর আর কোনো নবি আসবেন না।”
(সহিহ্ বুখারি)
একটি হাদিসে মহানবি (সাঃ) উপমার মাধ্যমে খতমে নবুয়ত ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন,
“আমি ও আমার পূর্ববর্তী নবিগণের দৃষ্টান্ত হলো এরূপ যে, এক লোক একটি দালান নির্মাণ করল। খুব সুন্দর ও লোভনীয় করে তা সজ্জিত করল। কিন্তু তার এক কোণে একটি ইটের স্থান ফাঁকা ছিল। লোকজন দালানটির চারদিকে ঘুরে এর সৌন্দর্য দেখছিল আর বিস্ময় প্রকাশ করছিল এবং বলছিল- এ কোণে একটি ইট রাখা হয় নি কেন? বস্তুত আমিই সে ইট এবং আমি শেষ নবি।”
(সহিহ্ বুখারি)
পুরো দালানে একটি ইট লাগানো বাকি ছিল। ইট লাগাতেই সে দালান পরিপূর্ণ হয়ে গেল। নবুয়তও তেমনি একটি দালানের সদৃশ। সেই দালানের সর্বশেষ ইট মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। তাঁর মাধ্যমেই দালানের সর্বশেষ ইট লাগানো হয়। পরিপূর্ণ হয়ে গেল নির্মাণকাজ। ফলে নতুন করে দালানের আর কোথাও ইট লাগানোর প্রয়োজন পড়বে না। অর্থাৎ নবি আসারও দরকার পড়বে না।
iii) যৌক্তিক প্রমাণ
যুক্তির মাধ্যমেও আমরা খতমে নবুয়তের প্রমাণ লাভ করতে পারি। যেমন- যুক্তির আলোকে দেখা যায় এক নবির পর অন্য নবি সাধারণত তিনটি কারণে আসতেন।
যথা-
- পূর্ববর্তী নবির শিক্ষা বিলুপ্ত বা বিকৃত হয়ে গেলে;
- পূর্ববর্তী নবির শিক্ষা অসম্পূর্ণ হয়ে পড়লে কিংবা তাতে নতুন কিছু সংযোজন-বিয়োজনের প্রয়োজন হলে;
- পূর্ববর্তী নবির শিক্ষা কোনো বিশেষ স্থান বা কালের জন্য নির্দিষ্ট হলে।
উপরিউক্ত কারণগুলোর কোনোটিই বর্তমানকালে প্রযোজ্য নয়। কেননা-
- হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর শিক্ষা ও আদর্শ আজ পর্যন্ত বিদ্যমান। এটি বিন্দুমাত্র বিলুপ্ত বা বিকৃত হয় নি। সুতরাং নতুন কোনো নবি আসার প্রয়োজন নেই।
- রাসুল (সাঃ)-এর শিক্ষা এবং দীন ইসলাম পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ। এতে কোনো অসম্পূর্ণতা নেই। এতে কোনোরূপ সংযোজন ও বিয়োজনেরও প্রয়োজন নেই।
আল্লাহ তায়ালাই বলেছেন,
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের উপর আমার নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন হিসেবে মনোনীত করলাম।”
(সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ৩)
নবি করিম (সাঃ) কোনো বিশেষ স্থান বা কালের জন্য আসেন নি। বরং তিনি সর্বকালের সকলের নবি। কিয়ামত পর্যন্ত সকল স্থানের মানুষের নবি।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“আমি তো আপনাকে সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে প্রেরণ করেছি।”
(সূরা সাবা, আয়াত ২৮)
“বলুন, হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রাসুল।”
(সূরা আল-আরাফ, আয়াত ১৫৮)
নবি আগমনের তিনটি কারণের একটিও বর্তমানে প্রযোজ্য নয়। সুতরাং নতুন কোনো নবি আগমনেরও প্রয়োজন নেই। আমাদের নবিই শেষ নবি। তিনিই খাতামুন নাবিয়্যিন।
পবিত্র ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট ইসলাম’ (inbangla.net/islam) এর সাথেই থাকুন।