(১) পরকাল কী, কাকে বলে, কখন হবে?
আখিরাত হলো মৃত্যুর পরবর্তী জীবন, বাংলা ভাষায় একে পরকাল বলা হয়।
পরকাল হলো দুনিয়ার জীবনের মৃত্যুর পরে এমন একটি জীবন যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। এটি অনন্ত ও চিরস্থায়ী জীবন।
ইসলামি পরিভাষায়, মৃত্যুর সাথে সাথে মানুষের যে নতুন জীবন শুরু হয় তাকে পরকাল বা আখিরাত বলে।
(২) পরকালের পর্যায়
আখিরাত বা পরকালের দুটি পর্যায় রয়েছে। যথা-
- বারযাখ
- কিয়ামত।
ক) বারযাখের পরিচয়
দুটি বস্তুর মধ্যবর্তী পর্যায়কে বারযাখ বলে। মানুষের মৃত্যু থেকে কিয়ামত বা পুনরুত্থান পর্যন্ত সময়কে বারযাখ বলে। এটি কিয়ামত ও দুনিয়ার জীবনের মধ্যবর্তী পর্দা স্বরূপ। মানুষের মৃত্যুর পর এ জীবনের শুরু হয়।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“আর তাদের সামনে রয়েছে বারযাখ যা পুনরুত্থান পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে।”
(সূরা আল-মু’মিনূন, আয়াত ১০০)
বারযাখ হলো কবরের জীবন। এটি আখিরাতের সর্বপ্রথম পর্যায়। বারযাখ জীবনে মানুষ দুনিয়ার ভালো আমলের কারণে শান্তি ভোগ করবে আর খারাপ আমলের জন্য শাস্তি ভোগ করবে।
খ) কিয়ামতের পরিচয়
কিয়ামত অর্থ দণ্ডায়মান হওয়া, উঠা।
ইসলামি পরিভাষায় কবর থেকে মানুষ উঠে সেদিন আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হবে, তাই একে বলা হয় কিয়ামত।
কিয়ামতে মানুষকে পুনরায় জীবিত করা হবে। এরপর নেককারদের জান্নাতে এবং পাপীদের জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে।
(২) জান্নাত
ক) জান্নাতের পরিচয়
জান্নাত শব্দের অর্থ বাগান, উদ্যান, আবৃত স্থান। ফারসি ভাষায় একে বলা হয় বেহেশত। বাংলায় একে বলা হয় স্বর্গ।
ইসলামি পরিভাষায়, আখিরাতে ইমানদার ও নেককার বান্দাদের জন্য যে চিরশান্তির আবাসস্থল তৈরি করে রাখা হয়েছে তাকে জান্নাত বলা হয়।
জান্নাত হলো চিরশান্তির স্থান। সেখানে সবকিছুই সুন্দর ও আকর্ষণীয় বস্তু দ্বারা সুসজ্জিত। জান্নাতের ঘর-বাড়ি, আসন, আসবাবপত্রসহ সবকিছু স্বর্ণ-রৌপ্য, মণি-মুক্তা দ্বারা নির্মিত। জান্নাতে থাকবে রেশমের গালিচা, দুধ ও মধুর নহর। মিষ্টি পানির স্রোতধারা। বস্তুত আনন্দ উপভোগের সব রকমের জিনিসই জান্নাতে বিদ্যমান থাকবে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“সেখানে (জান্নাতে) তোমাদের মন যা চাইবে তা-ই তোমাদের জন্য রয়েছে আর তোমরা যা দাবি করবে তাও তোমাদের দেওয়া হবে।”
(সূরা হা-মীম আস্ সাজদাহ, আয়াত ৩১)
জান্নাতের বিবরণ দিয়ে রাসুল (সাঃ) বলেন,
“আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আমি আমার পুণ্যবান বান্দাদের জন্য জান্নাতে এমন সব বস্তু তৈরি করে রেখেছি যা কোনো চোখ কোনোদিন দেখে নি, কোনো কান কোনোদিন শোনে নি, আর মানুষের অন্তরও যা কোনোদিন কল্পনা করতে পারে নি।”
(মিশকাত)
খ) জান্নাতের নাম
জান্নাত মোট আটটি। এগুলো হলো-
- জান্নাতুল ফিরদাউস
- জান্নাতুল মাওয়া
- দারুল মাকাম
- দারুল কারার
- দারুন নাইম
- দারুল খুলদ
- দারুস সালাম
- জান্নাতু আদন।
এ আটটি জান্নাতের মধ্যে জান্নাতুল ফিরদাউস হলো সর্বশ্রেষ্ঠ।
গ) জান্নাত লাভের আমল ও উপায়
জান্নাত হলো মুমিনদের ও পুণ্যবানদের বাসস্থান।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“(হে নবি!) যারা ইমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে আপনি তাদেরকে সুসংবাদ দিন যে, তাদের জন্যই রয়েছে জান্নাত। যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত।”
(সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৫)
সুতরাং জান্নাত লাভের জন্য দুনিয়াতে সর্বপ্রথম ইমান আনতে হবে। আকাইদের সব বিষয়ের উপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে। অতঃপর নেক কাজ করতে হবে। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায সুন্দরভাবে আদায় করতে হবে।
মহানবি (সা.) বলেছেন,
“সালাত হলো জান্নাতের চাবি।”
(আল-হাদিস)
নামাযের পাশাপাশি রমযানের রোযা পালন, যাকাত আদায় ও হজ করতে হবে। তাছাড়া অন্যান্য সৎকাজ, উত্তম চরিত্র ও নৈতিকতার অনুশীলন করতে হবে। জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুলের আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হবে। সকল প্রকার অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“আর যে ব্যক্তি তার রবের সামনে দণ্ডায়মান হওয়াকে ভয় করবে এবং নিজকে কুপ্রবৃত্তি থেকে বিরত রাখবে, নিঃসন্দেহে জান্নাতই হবে তার আবাসস্থল।”
(সূরা আন-নাযিআত, আয়াত ৪০-৪১)
(৩) জাহান্নাম
ক) জাহান্নামের পরিচয়
জাহান্নাম হলো আগুনের গর্ত, শাস্তির স্থান। একে দোযখ বা নরকও বলা হয়। ইসলামি পরিভাষায় আখিরাতে কাফির, মুশরিক, মুনাফিক ও পাপীদের শাস্তির জন্য যে স্থান নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে তাকে জাহান্নাম বলা হয়।
জাহান্নাম খুবই ভয়ংকর স্থান। সেখানে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। সেখানে পাপীরা আগুনে দগ্ধ হবে। বড় বড় সাপ, বিচ্ছু, কীটপতঙ্গ মানুষকে দংশন করবে।
জাহান্নামের আগুন হবে আমাদের দুনিয়ার আগুন থেকে সত্তর গুণ বেশি উত্তপ্ত। জাহান্নামিদের খাদ্য হবে যাক্কুম নামক বড় বড় কাঁটাযুক্ত বৃক্ষ। যা তারা খেতে পারবে না, বরং গলায় আটকে যাবে। তাদের পানীয় হবে দোযখিদের উত্তপ্ত রক্ত ও পুঁজ। সেখানে মানুষের কোনো মৃত্যু হবে না, বরং শাস্তি পেতে থাকবে এবং চিরকাল ধরে কষ্ট ভোগ করতে থাকবে।
জাহান্নামের বিবরণ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“যারা আমার আয়াতকে প্রত্যাখ্যান করবে অচিরেই আমি তাদেরকে (জাহান্নামের) আগুনে প্রবেশ করাব। সেখানে যখনই তাদের চামড়া জ্বলে যাবে তখনই এর স্থলে নতুন চামড়া সৃষ্টি করব, যাতে তারা শাস্তি ভোগ করতে পারে।”
(সূরা আন-নিসা, আয়াত ৫৬)
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
“যারা কুফুরি করে তাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে আগুনের পোশাক। তাদের মাথায় ঢেলে দেওয়া হবে ফুটন্ত পানি। এর দ্বারা তাদের পেটে যা আছে তা এবং তাদের চামড়া বিগলিত করা হবে। আর তাদের জন্য থাকবে লোহার মুগুর। যখনই তারা যন্ত্রণায় কাতর হয়ে জাহান্নাম থেকে বের হতে চাইবে তখনই তাদের পুনরায় তাতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। আর তাদের বলা হবে- স্বাদ গ্রহণ কর দহন-যন্ত্রণার।”
(সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত ১৯-২২)
খ) জাহান্নামের নাম
জাহান্নাম মোট সাতটি। এগুলো হলো-
- জাহান্নাম
- হাবিয়া
- জাহিম
- সাকার
- সাইর
- হুতামাহ
- লাযা।
গ) জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের উপায়
আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুলের প্রতি যারা ইমান আনে না তারাই জাহান্নামের অধিবাসী। তাছাড়া যেসব লোক দুনিয়ায় অন্যায় ও পাপ কাজ করবে তারাও জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। অশ্লীল ও অনৈতিক কাজ করলেও জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে।
সুতরাং আমরা এসব কাজ থেকে বিরত থাকব। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশিত পথে জীবনযাপন করব। তাহলে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে রেহাই পাব।
(৪) গুরুত্ব
আখিরাত আকাইদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আখিরাতের প্রতি ইমান আনা অপরিহার্য। আখিরাতে বিশ্বাস না করলে মানুষ ইমানদার হতে পারে না।
মুমিনদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“আর তাঁরা (মুত্তাকিগণ) আখিরাতের প্রতি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে।”
(সূরা আল-বাকারা, আয়াত ৪)
আখিরাতে বিশ্বাস মানুষকে সৎকর্মশীল করে তোলে। এর ফলে মানুষ উত্তম চরিত্র ও নৈতিকতার গুণাবলি অনুশীলন করে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“আর যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না তাদের অন্তর সত্যবিমুখ এবং তারা অহংকারী।”
(সূরা আন-নাহল, আয়াত ২২)
আখিরাতে বিশ্বাস না করলে মানুষ দুনিয়াকেই সবকিছু মনে করে। ফলে যেকোনো উপায়ে দুনিয়ার স্বার্থ হাসিল করতে চায়। অন্যায়, অত্যাচার, অনৈতিক কার্যকলাপ সবকিছুই তার দ্বারা সংঘটিত হয়। যেকোনো পাপ করতে সে দ্বিধাবোধ করে না। আখিরাতে বিশ্বাস মানুষকে এরূপ কাজ থেকে বিরত রাখে এবং পবিত্র করে তোলে।
সুতরাং আমরা আখিরাতে বিশ্বাস করব এবং নৈতিক ও পূত-পবিত্র জীবনযাপন করব।
পবিত্র ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট ইসলাম’ (inbangla.net/islam) এর সাথেই থাকুন।