মহান আল্লাহ মানব জীবন পরিচালনার জন্য মানব প্রকৃতির সাথে সংগতিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা প্রদান করেছেন। আর তা হল ইসলাম। ফিকাহ শাস্ত্র বা ইসলামি আইন বিজ্ঞান কালোত্তীর্ণ বিধান। এর সকল বিধি-বিধান কুরআন ও সুন্নাহ থেকে উৎসারিত। মহানবীর (স) জীবদ্দশায়ই এর মৌল কাঠামো পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। পরবর্তীতে যুগ জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম মনীষীদের গবেষণায় এটা ইলমে ফিকাহ বা ইসলামি আইন বিজ্ঞান রূপে পরিচিতি লাভ করে।
এই আর্টিকেলটি শেষ অবধি অধ্যয়ন করলে আপনি- ফিকাহ শব্দের অর্থ কি, ফিকাহ কাকে বলে, ফকিহ কাকে বলে, তা জানতে পারবেন। ফিকাহ শাস্ত্রে ব্যবহৃত পরিভাষাগুলোর সংজ্ঞা বলতে পারবেন। ফিকাহ শাস্ত্রে ব্যবহৃত পরিভাষাগুলোর সাথে পরিচিত হতে পারবেন। ফিকাহ শাস্ত্র সংকলনের প্রেক্ষাপট বুঝতে পারবেন; ফিকাহ শাস্ত্র সংকলনের সময়কাল সম্পর্কে ধারণা পারবে। ফিকাহ সংকলনের যুগ ও প্রতিটি যুগের কার্যক্রমের বর্ণনা জানতে পারবেন; ফিকাহ-এর প্রধান ইমামগণের নাম পরিচয় সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন।
(১) ফিকাহ শব্দের অর্থ কি? ফিকাহ কাকে বলে? ফকিহ কাকে বলে?
ফিকাহ শব্দের অর্থ কি: ফিকহ একটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো উপলব্ধি করা, গভীরভাবে কিছু বুঝতে পারা,উন্মোচন করা, অনুধাবন করা, সূক্ষ্মদর্শিতা ইত্যাদি। ইসলামের পরিভাষায় ফিকহ হলো এমন শাস্ত্র, যার মাধ্যমে ইসলামের উৎসসমূহ তথা কুরআন ও হাদীস থেকে বিস্তারিত প্রমাণসহ ব্যবহারিক জীবনের বিভিন্ন বিধি-বিধান ও ইসলামি সমাধান জানা যায়।
ফিকাহ কাকে বলে: ফিকাহ হচ্ছে আহকামে শরীআত সম্পর্কে ইসতিম্বাত (আবিষ্কার) করার জ্ঞান। ইসলামি শরী‘আর বিধানাবলি যে শাস্ত্রে আলোচিত হয় তাকে ফিকাহ শাস্ত্র বলা হয়।
ফকিহ কাকে বলে: দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে বাস্তব কাজকর্ম বিষয়ে শরীআতের হুকুম-আহকাম সম্পর্কে যিনি অভিজ্ঞ তাকে বলা হয় ‘ফকিহ’।
ফিকাহ শাস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ফিকাহের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মহানবী (স) বলেন- “প্রত্যেক বস্তুর কতকগুলো স্তম্ভ আছে। আর ইসলামের স্তম্ভ হচ্ছে আল-ফিকাহ।” ফকীহগণের মতে- দৈনন্দিন জীবনে জরুরি মাসআলা শিক্ষা করা ফরযে আইন এবং এর চেয়ে বেশি শিক্ষা করা ‘ফরযে কিফায়া’। ফিকাহ শাস্ত্রের প্রধান উৎস- কুরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াস। এ ইউনিটে ইজমা ও কিয়াস এবং ফিকাহ শাস্ত্রের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
(২) ফিকাহ শাস্ত্রে ব্যবহৃত ২০টি পরিভাষার সংজ্ঞা
ফিকাহ শাস্ত্র মূলত কুরআন-হাদিসের নির্যাস। মানুষের দৈনন্দিন কাজ-কর্ম সুষ্ঠু পরিচালনার ক্ষেত্রে এ শাস্ত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। এ শাস্ত্রের কতিপয় পরিভাষা রয়েছে।
▣ ‘ফরয’ কাকে বলে: ফরয অর্থ-অবশ্য পালনীয়। এটি মহান আল্লাহর অলঙ্ঘনীয় আদেশ, যা অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তা‘আলা সকল মুসলমানের ওপর তা অপরিহার্য ও অবশ্য কর্তব্য বলে ঘোষণা করেছেন। এর অস্বীকারকারী কাফির। এর পরিত্যাগকারীর জন্য কঠিন শাস্তির বিধান রয়েছে।
ফরয দু প্রকার। যথা- ১. ফরযে আইন ও ২. ফরযে কিফায়া।
▣ ‘ফরযে আইন’ কাকে বলে: এমন ফরয যা প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবেই পালন করতে হয়। এ ধরনের ফরয কাজ এককভাবে অথবা সমষ্টিগতভাবে আদায় করতে হয়। যেমন- সালাত ও সাওম ইত্যাদি। এজন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকতে হয়।
▣ ‘ফরযে কিফায়া’ কাকে বলে: এমন ফরয যা সমাজের কিছু সংখ্যক লোক আদায় করলে সকলের পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যায়। কিন্তু যদি কেউ আদায় না করে, তবে সকলেই এর জন্য গুনাহগার হবে। যেমন- জানাযার সালাত ইত্যাদি।
▣ ‘ওয়াজিব’ কাকে বলে: হাদিস দ্বারা যে সব অবশ্য পালনীয় সাব্যস্ত হয়েছে তাকে ওয়াজিব বলে। ওয়াজিবও ফরযের ন্যায় অবশ্যই পালনীয়। তবে গুরুত্বের দিক থেকে ফরযের পরে এর স্থান। ওয়াজিব অস্বীকার করলে কাফির হয় না। বিনা কারণে তা ত্যাগ করলে ফাসিক হবে এবং তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
▣ ‘সুন্নাত’ কাকে বলে: ফরয এবং ওয়াজিব ছাড়া শরীআতের যে সকল কাজ নবী করীম (স) নিজে করেছেন এবং যা করার নির্দেশ প্রদান করেছেন বা অনুমোদন করেছেন তাকে সুন্নাত বলা হয়।
এছাড়াও খুলাফায়ে রাশেদীন শরীআতের যে সকল কাজ প্রবর্তন করেছেন সেগুলোকেও মহানবী (স)-এর সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং তা অনুসরণ করার নির্দেশ প্রদান করেছেন।
হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে,
“তোমাদের ওপর অবশ্য কর্তব্য-আমার সুন্নাত এবং হিদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের অনুসরণ করা।”
(রেওয়াতে মুহাম্মাদ ইবনে হাসান, আল-মুয়াত্তা-৩/৮০)
সুন্নাত দু প্রকার। যথা- ১. সুন্নাতে মুওয়াক্কাদা ও ২. সুন্নাতে গাইরে-মুওয়াক্কাদা বা সুন্নাতে যায়িদাহ।
▣ ‘মুস্তাহাব’ কাকে বলে: নবী করীম (স) যে সব কাজ কখনো কখনো অন্যদেরকে করার জন্য উৎসাহিত করেছেন তাকে মুস্তাহাব বলা হয়। মুস্তাহাব কাজ আদায় করলে সাওয়াব হয়, তবে না করলে গুনাহ হয় না। পরিভাষায় মুস্তাহাবকে ‘নফল’ ও মানদুব বলা হয়ে থাকে। ঙ. মুস্তাহসান যে সব কাজ উলামা মুতাকাদ্দিমীন ও মুতাআখ্খিরীন (পূর্ববর্তী ও পরবর্তী আলিমগণ) কুরআন, হাদিস ও সুন্নাতের আলোকে ভালো বলে গ্রহণ করেছেন তাকে মুস্তাহসান বলা হয়। মুস্তাহসান পালনে সাওয়াব আছে, তবে বাদ দিলে গুনাহ হয় না।
▣ ‘মুবাহ’ কাকে বলে: যে কাজ করাতে কোন সাওয়াব নেই এবং না করাতে কোন গুনাহ নেই, শরীআতের পরিভাষায় সেসব কাজকে মুবাহ বলা হয়। ইচ্ছা করলে তা করতে পারে, আবার ইচ্ছা করলে তা নাও করতে পারে।
▣ ‘হালাল’ কাকে বলে: শরীআতের দৃষ্টিকোণ থেকে যে সকল বস্তু ব্যবহার করা বৈধ তাকে হালাল বলা হয়।
▣ ‘মাকরূহ তাহরীমী’ কাকে বলে: যে সকল কাজ নিষিদ্ধ হওয়া অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত নয় ; বিনা কারণে এ সব কাজ করা গুনাহ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
▣ ‘মাকরূহ তানযীহ’ কাকে বলে: যে সকল কাজ পরিত্যাগ করাতে সাওয়াব লাভ হয় না এবং করলে গুনাহগার হয় না। তবে শরীআতের দৃষ্টিতে অপছন্দনীয় এরূপ কাজ মাকরূহে তানযীহ।
▣ ‘হারাম’ কাকে বলে: যে সকল কাজ নিষিদ্ধ হওয়া অকাট্য দলিল দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত তাকে হারাম বলা হয়। বিনা কারণে যে এমন কাজ করে সে ফাসিক। তার জন্য কঠিন আযাব নির্ধারিত। হারামের অস্বীকারকারী কাফির। ফরয এবং হারাম প্রমাণের বিষয়টি একই পর্যায়ের। ফরয কাজ করা ফরয আর হারাম কাজ বর্জন করাও ফরয।
▣ ‘মুফতি’ কাকে বলে: যিনি ফাতাওয়া দান করেন। যে ফিকাহ তত্ত্ববিদ বিভিন্ন ঘটনা ও বিভিন্ন সমস্যা সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দান করেন তাকে মুফতি বলা হয়। মুফতির জন্য উসূলে শরীআত হতে মাসআলা উদ্ভাবনের যোগ্যতা থাকা অবশ্যই প্রয়োজনীয়।
আল্লামা শামী (র) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুজতাহিদ নন সে ব্যক্তি মুফতি হতে পারেন না। এমন ব্যক্তির নিকট যখন কোন প্রশ্ন করা হয়, তখন তার উচিত তার ঐ কথাটি কোন মুজতাহিদের উক্তি তা উল্লেখ করা। এমন ব্যক্তি মূলত ফাতাওয়া নকলকারী হিসেবে গণ্য হন।’
▣ ‘আল ইমামুল-আযম’ কাকে বলে: হানাফি ফিকহের কিতাবে ‘আল-ইমাম’ কিংবা ‘আল-ইমামুল আযম’ শব্দের প্রয়োগ হলে এর মাধ্যমে হানাফি মাযহাবের ইমাম আবু হানিফা (র) কে বুঝানো হয়ে থাকে।
রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের ক্ষেত্রে দ্বীনী ও দুনিয়াবী সকল বিষয়ে যাঁর সঠিক কর্তৃত্ব থাকে, তাঁকেও ইমাম বলা হয়।
▣ ‘সাহিবাইন’, ‘শায়খাইন’, ‘তারফাইন’ কাকে বলে: হানাফি মাযহাবে সাহিবাইন শব্দ দ্বারা ইমাম আবু হানিফা (র)-এর শিষ্যদ্বয় যথাক্রমে ইমাম আবু ইউসুফ (র) ও ইমাম মুহাম্মদ (র) কে একসঙ্গে বুঝানো হয়। অনুরূপভাবে শায়খাইন শব্দ দ্বারা স্বয়ং ইমাম আবু হানিফা ও তাঁর প্রধান শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ (র) কে একত্রে বুঝানো হয়ে থাকে। তারফাইন শব্দের মাধ্যমে একত্রে ইমাম আবু হানিফা ও তাঁর অন্যতম শিষ্য ইমাম মুহাম্মদ (র)-কে বুঝানো হয়ে থাকে।
▣ ‘আয়িম্মায়ে ছালাছা’ কাকে বলে: হানাফি মাযহাবে আয়িম্মায়ে ছালাছা বলতে তিন ইমাম অর্থাৎ হযরত আবু হানিফা (র), ইমাম আবু ইউসুফ (র) ও ইমাম মুহাম্মদ (র) কে বলা হয়। আর সাধারণভাবে ইমাম আযম আবু হানিফা ছাড়া ইমাম মালিক, ইমাম শাফিঈ ও ইমাম আহমদ (র) কে বুঝানো হয়।
▣ ‘আয়িম্মায়ে আরবাআ’ কাকে বলে: ফিকাহর কিতাবে আয়িম্মায়ে আরবাআ বলতে চার ইমামকে বুঝানো হয়। ইমাম চার জন হলেন- ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফিঈ, ইমাম মালিক ও ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (র)।
▣ ‘মুতাকাদ্দিমীন’ ও ‘মুতাআখ্খিরীন’ কাকে বলে: ফিকহের কিতাবে মুতাকাদ্দিমীন অর্থাৎ পূর্ব কালের উলামা বলতে সাধারণত তাঁদেরকে বুঝানো হয়ে থাকে, যাঁরা তিন ইমাম অর্থাৎ, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ (র)-এর সাহচর্য লাভে ধন্য হয়েছেন। আর তাঁদের পরবর্তীগণকে মুতাআখখিরীন অর্থাৎ পরবর্তী কালের উলামা বলা হয়।
▣ ‘ইস্তিহ্সান’ কাকে বলে: ইসতিহসান শব্দের অর্থ কোন কিছুকে ভালো মনে করা। পরিভাষায় ইস্তিহসান শব্দটি এমন দলিলের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, যা কিয়াসে জলীর মোকাবিলায় আসে।
▣ ‘ইজতিহাদ’ ও ‘মুজতাহিদ’ কাকে বলে: ইজতিহাদ শব্দের অর্থ চেষ্টা সাধনা করা। পরিভাষায় কোন ফকিহ আলিমের কোন শরয়ী হুকুম সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভের নিমিত্তে চিন্তা ও গবেষণা করাকে ইজতিহাদ বলা হয়। শরয়ী হুকুম গবেষণাকারীকে বলা হয় মুজতাহিদ।
▣ ‘আল মাযাহিবুল আরবাআ’ কাকে বলে: প্রসিদ্ধ ফিকাহী চার মাযহাবকে এক সাথে আল-মাযাহিবুল আরবাআ বলা হয়ে থাকে। মাযহাব চারটি হল-হানাফি, শাফিঈ, মালিকি ও হাম্বলী।
(৩) ফিকাহ শাস্ত্রের সংকলনের পরিপ্রেক্ষিত ও সময়কাল
ক) ফিকাহ শাস্ত্র সংকলনের পরিপ্রেক্ষিত
ইলমে ফিকাহ বিশাল ও বিস্তৃত এক বিজ্ঞান। মানবজীবনের দৈনন্দিন কর্মকা- শরীআতের নিক্তিতে পরিমাপ করে সঠিক পথের নির্দেশনা দেয় ফিকাহ শাস্ত্র। ইসলামি বিধানের অনিবার্য প্রয়োজনে ফিকাহ শাস্ত্র সংকলন শুরু হয়।
খুলাফায়ে রাশিদীন এবং পর্যায়ক্রমে সাহাবীদের ইন্তিকালের ফলে ইসলামি বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শরীআতের হুকুম আহকাম পালন ও চর্চার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। তাছাড়া হযরত আলী (রা)-এর শাহাদাত; হযরত আমীরে মুয়াবিয়া (রা) কর্তৃক উমাইয়া বংশের প্রতিষ্ঠা, তাঁর পুত্র ইয়াযিদ-এর সময়ে রাসূল (স)-এর দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (রা)- এর হৃদয় বিদারক শাহাদাতবরণ, এসব কারণে ইসলামে নানা ফেরকা ও মতবাদের সৃষ্টি হয়। মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে ‘খারিজী’ ও ‘শীআ’ নামে মতাবলম্বী দুটি পৃথক উপদল গড়ে উঠে। খারেজীরা শুধু কুরআন মাজীদ ও প্রধানত প্রথম দুই খলীফার শাসনামলের প্রমাণিত হাদিসমূহকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করে। শীআরাও চরমপন্থী উপদল, তারা নতুন নতুন ধ্যান-ধারণা অবলম্বন করতে থাকে।
উমাইয়া শাসনামলের মাঝামাঝি সময়ে হকপন্থী উলামা-ই কিরাম দু’ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েন।
একটি ধারার পরিচিত নাম ‘আহলুল হাদিস’, যাঁরা হাদিসের অর্থ অনুসারে আমল করা জরুরি মনে করেন। কিয়াসের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান প্রক্রিয়া তারা অপছন্দ করতেন।
দ্বিতীয় ধারার তৎকালীন পরিচিত নাম ছিল ‘আহলুর রায়’। যাঁরা কুরআন মাজীদ ও হাদিসের আলোকে বুদ্ধিমত্তা ও যুক্তি তর্কের প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতায় ছিলেন বিশ্বাসী। তাঁরা কুরআন ও হাদিসের সুস্পষ্ট ও মৌলিক বিধানের কারণ-উপকারণ ও যুক্তিধারা নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে ইসলামি অনুশাসনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
ইসলামের ব্যাপক প্রসার ও বিভিন্ন সভ্যতা সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার কারণে নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হতে থাকে। আর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এ সকল সমস্যার ইসলামি সমাধান সম্বলিত সুস্পষ্ট ও বিধিবদ্ধ আইন-কানুন তথা ফিকাহ ও উসূলে ফিকাহ প্রণয়নের। আবু হানিফা (র) প্রথমে এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। উমাইয়া যুগের পতনের পর পর তিনি তাঁর সঙ্গী-সাথীদের সমন্বয়ে একটি পর্ষদ গঠন করেন। এরই মাধ্যমে তিনি ফিকাহ সংকলন ও সম্পাদনার গুরুদায়িত্ব পালনে আত্মনিয়োগ করেন। এভাবে তিনি মুসলিম উম্মাহর জন্য এক বিরাট অবদান রেখে যান।
খ) ফিকাহ সংকলনের সময়কাল
হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথম থেকেই ইসলামি জগতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক নব জোয়ার শুরু হয়। এ সময় ব্যাপকভাবে হাদিস সংগ্রহ, সংকলন এবং ফিকাহ-এর মাসআলা সম্পাদনা ও ফাতাওয়া সংকলন শুরু হয়। তবে হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর তৃতীয় দশক হতে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ফিকাহ সংকলন ও সম্পাদনা শুরু হয়। সে সময় হতে আজ পর্যন্ত সময়কালকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- ১. গবেষণা ও সংকলনের যুগ; ২. পূর্ণতা ও তাকলিদের যুগ; ৩. তাকলিদের যুগ।
এ তিনটি যুগের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো।
i) প্রথম যুগ: গবেষণা ও সংকলন
এ যুগে ইমাম আবু হানিফা (র) নিয়মতান্ত্রিকভাবে সর্বপ্রথম ইসলামি ফিকাহ সংকলন ও সম্পাদনা শুরু করেন। তিনি তাঁর জীবনকালে ইসলামি ফিকাহ-এর ওপর মূল্যবান গ্রন্থ রচনায় অবদান রাখেন।
তাঁর এ পথ ধরে এ যুগে আরো অসংখ্য মুজতাহিদ ফিকাহ সম্পাদনা ও সে বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেন। এ যুগেই চার মাযহাবের আলোকে ফিকাহ গ্রন্থ সংকলিত ও সম্পাদিত হয়। এ যুগেই ফিকাহ শাস্ত্রের নীতি নির্ধারণী ‘উসূলুল ফিকাহ’ নামক আরেকটি শাস্ত্রের উদ্ভব হয়। এ সময় মুসলিম উম্মাহ তাঁদের সম্পাদিত ফিকাহ’র অনুসরণ করতে থাকেন। হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর তৃতীয় দশক হতে তৃতীয় শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত এ যুগ অব্যাহত থাকে। এ যুগকে বলা হয়, ইজাতিহাদ তথা গবেষণার যুগ।
ii) দ্বিতীয় যুগ: পূর্ণতা ও তাকলিদ
ফিকাহ সংকলনের দ্বিতীয় যুগকে তাকলিদের যুগ বলা হয়। হিজরি চতুর্থ শতাব্দীর শুরু হতে সপ্তম শতাব্দীতে আব্বাসীয় রাজবংশের পতন পর্যন্ত এ যুগ অব্যাহত ছিল। এ যুগে তাকলিদ ব্যাপকতা লাভ করে। প্রথম যুগের ইমামগণের উদ্ভাবিত নিয়ম নীতির সমর্থনে অনেক গ্রন্থ রচিত হয়। এ সময়ে মানবজীবনের নতুন নতুন সমস্যা দেখা দিলে তার ধর্মীয় সমাধান অনুসন্ধান করা হয়। প্রথম যুগের নির্ধারিত মূলনীতিসমূহের আলোকে মাসআলা উদ্ভাবনই ছিল এ যুগের ব্যাপক কাজ। এ যুগের লোকেরা বিশেষত চার ইমামের অনুসরণ করতে থাকেন।
এ যুগের বিশেষ দিক হল-
- এ পর্বে নতুন কোন ইমামের উদ্ভব হয়নি।
- এ যুগে পূর্ববর্তী ইমামদের পূর্ণ অনুসরণ করা হতে থাকে।
- এ যুগে পূর্ববর্তী ইমামদের প্রদত্ত ফাতওয়াসমূহের ব্যাখ্যা এবং তার সমর্থনে যুক্তিতর্ক তুলে ধরেন।
- যুুক্তিভিত্তিক গ্রন্থ রচনা হতে থাকে।
iii) তৃতীয় যুগ: তাকলিদ
হিজরি ৭ম শতাব্দীর মাঝামাঝি আব্বাসীয় শাসনের সমাপ্তির পর আজ পর্যন্ত তৃতীয় ও সর্বশেষ যুগ যা এখনো চলমান। এ যুগে আলিম ও সাধারণ মানুষ তাকলিদ করতে থাকে। পূর্ববর্তী মুজতাহিদদের ফাতাওয়ার পূর্ণ অনুসরণ করা হচ্ছে। এ জন্য এ যুগকে বলা হয় একান্ত তাকলিদের যুগ। তবে এ যুগে অনেক ফাতওয়ার কিতাব রচিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
ফিকাহ-এর ইমাম যে সকল মুজতাহিদ ও ফিকাহবিদের অক্লান্ত সাধনার ফলে ফিকাহ শাস্ত্রাকারে সংকলিত হয় তাঁদের মধ্যে প্রধান হচ্ছেন চারজন-
- ইমাম আবু হানিফা (র) (ইরাক: মৃত্যু ১৫০ হি.)
- ইমাম মালিক (র) (মদিনা: মৃত্যু ১৭৯ হি.)
- ইমাম শাফিঈ (র) (মক্কা: মৃত্যু ২০৪ হি.)
- ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (র) (ইরাক: ২৪১ হি.)
ইমাম আবু হানিফার (র) দু’জন শিষ্য- ইমাম আবু ইউসুফ (র) ও ইমাম মুহাম্মদ (র) ফিকাহ শাস্ত্রবিদ হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন।
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলেচনাটি থেকে আমরা ফিকাহ শব্দের অর্থ কি? ফিকাহ ও ফকিহ কাকে বলে? ফিকাহ শাস্ত্রে ব্যবহৃত ২০টি পরিভাষার সংজ্ঞা এবং ফিকাহ শাস্ত্রের সংকলনের পরিপ্রেক্ষিত ও সময়কাল সম্পর্কে জানলাম।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রাশাখার বিশেষ বিষয়কে নির্দেশ করার জন্য কিছু ভাষা-পরিভাষা থাকে। সে সব পরিভাষা জানা থাকলে উক্ত জ্ঞানের কথা সহজে বুঝা যায়। ফিকাহ শাস্ত্রেরও পরিভাষা রয়েছে যা আমরা এ আর্টিকেল থেকে জানতে পারলাম।
মূলত ইসলামের ব্যাপক প্রসার ও বিভিন্ন সভ্যতা সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার কারণে নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হতে থাকে। আর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এ সকল সমস্যার ইসলামি সমাধান সম্বলিত সুস্পষ্ট ও বিধিবদ্ধ আইন-কানুন তথা ফিকাহ ও উসূলে ফিকাহ প্রণয়নের। আবু হানিফা (র) প্রথমে এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। উমাইয়া যুগের পতনের পর পর তিনি তাঁর সঙ্গী-সাথীদের সমন্বয়ে একটি পর্ষদ গঠন করেন। এরই মাধ্যমে তিনি ফিকাহ সংকলন ও সম্পাদনার গুরু দায়িত্ব পালনে আত্মনিয়োগ করেন। এভাবে তিনি মুসলিম উম্মাহর জন্য এক বিরাট অবদান রেখে যান।
[সূত্র: ওপেন স্কুল]