(১) ভ্রাতৃত্ববোধ কী?
ভ্রাতৃত্ববোধ হলো ভ্রাতৃত্বসুলভ অনুভূতি প্রকাশ। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির অপর ব্যক্তিকে ভাইয়ের ন্যায় মনে করা, ভ্রাতৃসুলভ আচার-আচরণ করা।
সহোদর ভাইয়ের সাথে আমরা ভালো ব্যবহার করি, সবসময় তাদের কল্যাণ কামনা করি, তাদের জন্য নিজেদের নানা স্বার্থ ত্যাগ করি, তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসি। তেমনিভাবে দুনিয়ার সকল মানুষের প্রতি এরূপ মনোভাব পোষণ ও নিজ কর্মের মাধ্যমে এর প্রমাণ উপস্থাপনই হলো ভ্রাতৃত্ববোধ।
(২) সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কী?
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি হলো নানা সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যকার সম্প্রীতি ও ভালোবাসা। আমাদের সমাজে বহু ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও জাতির লোক বাস করে। তারা এক একটি সম্প্রদায়। সমাজে বসবাসরত এসব সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পর ঐক্য, সংহতি ও সহযোগিতার মনোভাবই হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।
(৩) ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এর প্রয়োজনীয়তা
- মানবসমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ নিজ জীবনে যথাযথভাবে এগুলোর অনুশীলন করে থাকেন।
- ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি না থাকলে কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। এতদুভয়ের অনুপস্থিতিতে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়, জাতির উন্নতি বাধাগ্রস্ত হয়, এমনকি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়।
- ভ্রাতৃত্ববোধ মানুষকে ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত করে, মানুষের মধ্যে সহযোগিতা, সহমর্মিতা ইত্যাদি গুণের বিকাশ ঘটায়। ফলে মানব সমাজে ঐক্য ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়।
- অন্যদিকে ভ্রাতৃত্ববোধ না থাকলে মানুষ একে অন্যকে ভালোবাসে না, অন্যের কল্যাণ কামনা করে না। বরং নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য অন্যের প্রতি অন্যায়, অত্যাচার ও নির্যাতন করতেও দ্বিধাবোধ করে না।
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মানুষের মধ্যে ধৈর্য, সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা ইত্যাদি গুণের বিকাশ ঘটায়। মানুষ একে অন্যকে শ্রদ্ধা করতে শিখে। বিভিন্ন ধর্মের, জাতির ও সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রে বসবাসের ফলে দেশীয় সভ্যতাও উন্নততর হয়। সকলের প্রচেষ্টায় দেশ ও জাতি উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করে।
- পক্ষান্তরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি না থাকলে দেশে মারামারি হানাহানির সূত্রপাত ঘটে। অনেক সময় গৃহযুদ্ধও শুরু হয়। নিজ সম্প্রদায়ের স্বার্থের জন্য দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতেও মানুষ কুণ্ঠিত হয় না। বস্তুত দেশের শান্তি ও উন্নতির জন্য ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অপরিহার্য উপাদান।
(৪) ইসলাম ধর্মে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
ইসলাম কল্যাণের ধর্ম। এর সকল শিক্ষা ও আদর্শ মানবজাতির জন্য চির কল্যাণকর। এজন্য ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রেও ইসলাম সুস্পষ্ট ঘোষণা প্রদান করেছে। ইসলামে এতদুভয় বৈশিষ্ট্য ও গুণ অনুশীলনের জন্য সকলকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
ইসলামে সকল মুসলমান ভাই ভাই। মুসলমানগণ বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক, সে কালো হোক বা সাদা, ধনী হোক কিংবা গরিব সকলেই ভাই-ভাই।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“মুমিনগণতো পরস্পর ভাই ভাই।”
(সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত ১০)
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
“এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই।”
(বুখারি)
বিশ্বের সকল মুসলমান ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। তারা পরস্পরের প্রতি ভ্রাতৃত্বসুলভ আচরণ করবে। এটাই ইসলামের শিক্ষা। একটি হাদিসে মহানবি (সাঃ) মুসলমানদের এ ভ্রাতৃত্বের স্বরূপ তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেন,
“তুমি মুমিনগণকে পারস্পরিক করুণা প্রদর্শন, সম্প্রীতি, ভালোবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শনের ব্যাপারে একটি দেহের মতো দেখতে পাবে। যখন দেহের একটি অঙ্গ কষ্ট পায় তখন গোটা দেহই জ্বর ও নিদ্রাহীনতার মাধ্যমে এর প্রতি সাড়া দেয়।”
(বুখারি ও মুসলিম)
মুসলমানদের এ পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব হলো ইসলামি ভ্রাতৃত্ব। ফলে দুনিয়ার দূরতম প্রান্তে কোনো মুসলমান কষ্টে পতিত হলে অন্য মুসলমানও তার সমব্যথী হয়, তার সাহায্যে এগিয়ে আসে।
মুসলমানগণের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের পাশাপাশি ইসলাম আরও এক প্রকার ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা প্রচার করেছে। এটি হলো বিশ্বভ্রাতৃত্ব। অর্থাৎ ইসলামের মতে, বিশ্বের সকল মানুষ পরস্পর ভাই-ভাই। এতে দেশ, জাতি, ভাষা ও বর্ণের কোনো পার্থক্য নেই। বরং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। এ ভ্রাতৃত্ব হলো মানুষের মৌলিক ভ্রাতৃত্ব। সৃষ্টিগতভাবে মানুষ এ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। কোনো মানুষই এ ভ্রাতৃত্ববোধ লঙ্ঘন করতে পারে না।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার।”
(সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত ১৩)
মহানবি (সাঃ) বলেছেন,
“সকল মানুষই আদম (আঃ)-এর বংশধর, আর আদম মাটি থেকে সৃষ্ট।”
(তিরমিযি)
প্রকৃতপক্ষে, পৃথিবীতে সব মানুষ আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) ও আদি মাতা হযরত হাওয়া (আঃ)-এর সন্তান। এ হিসেবে সকল মানুষই একই বংশের, একই মর্যাদার ও পরস্পর ভাই-ভাই।
সুতরাং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রতি ভ্রাতৃত্বসুলভ আচরণ করতে হবে। সকলকে ভাইয়ের মমতায় দেখতে হবে, বিপদে আপদে এগিয়ে আসতে হবে, অন্য ধর্ম বা অন্য জাতি বলে কোনো মানুষের প্রতি অবিচার করা যাবে না। বরং সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, সকল মানুষের মূলই এক এবং সৃষ্টিগতভাবে সকলেই ভাই-ভাই।
ইহকালীন শান্তির জন্য ভ্রাতৃত্ববোধের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও বজায় রাখা অপরিহার্য। সমাজে বসবাসরত সকল সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে। নিজ সম্প্রদায়ের বাইরের অন্য সম্প্রদায়ের লোকদের সাথেও সদাচরণ করতে হবে। তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে। তাদের বিপদে আপদে এগিয়ে আসতে হবে। পারস্পরিক মারামারি হানাহানির পরিবর্তে শান্তি স্থাপনে এগিয়ে আসতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“তাদের অধিকাংশ গোপন পরামর্শে কোনো কল্যাণ নেই। বরং কল্যাণ আছে যে দান-খয়রাত, সৎকাজ ও মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের নির্দেশ দেয় তাতে। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় যে এরূপ করবে আমি অবশ্যই তাকে মহাপুরস্কার দান করব।”
(সূরা আন-নিসা, আয়াত ১১৪)
মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপন করা অত্যন্ত পুণ্যের কাজ। এতে আল্লাহ তায়ালা খুশি হন।
আমরা মুসলমান। আমাদের সমাজে অমুসলিম সম্প্রদায়ের বহু লোক বসবাস করেন। এদের কেউ আমাদের সহপাঠী, কেউ সহকর্মী, কেউ খেলার সাথি, কেউবা প্রতিবেশী আবার কেউ শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতজন। তাদের সকলের সাথেই ভালো ব্যবহার করতে হবে। কেননা তারা সকলেই আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি।
মহানবি (সাঃ) বলেছেন,
“সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিজন। সুতরাং আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় ঐ ব্যক্তি যে তাঁর পরিজনের প্রতি অনুগ্রহ করে।”
(বায়হাকি)
অমুসলিম সম্প্রদায়কে তাদের ধর্ম পালনে স্বাধীনতা দিতে হবে। তাদের ধর্মগ্রন্থ, উপাসনালয়, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা যাবে না। ধর্ম পালনে তাদের বাধা দেওয়া যাবে না।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“তোমাদের দীন তোমাদের, আমার দীন আমার।”
(সূরা আল-কাফিরুন, আয়াত ৬)
অন্য আয়াতে এসেছে,
“দীনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।”
(সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৫৬)
ধর্মীয় স্বাধীনতা দানের পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষেত্রেও সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে। এ জন্য তাদের প্রতি কোনোরূপ অন্যায়, অত্যাচার করা যাবে না, তাদের সম্পদ দখল করা যাবে না। বরং তাদের জান-মাল- ইজ্জত সংরক্ষণ করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এ বিষয়ে মুসলিমগণকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন,
“যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমকে হত্যা করল সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ চল্লিশ বছরের দূরত্বে থেকেও জান্নাতের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়।”
(বুখারি)
অন্য হাদিসে তিনি বলেন,
“সাবধান! যে ব্যক্তি, কোনো চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিকের প্রতি অত্যাচার করে অথবা তাকে তার অধিকার থেকে কম দেয় কিংবা ক্ষমতা বহির্ভূতভাবে কোনো কাজ চাপিয়ে দেয় বা জোরপূর্বক তার কোনো সম্পদ নিয়ে যায় তবে কিয়ামতের দিন আমি সে ব্যক্তির প্রতিবাদকারী হব।” (অর্থাৎ অমুসলিমের পক্ষ অবলম্বন করব)।
(আবু দাউদ)
ইসলাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য নানা বিষয়ে নির্দেশ প্রদান করেছে। আমাদের উচিত জীবনের সকল অবস্থায় এসব নির্দেশ অনুশীলন করা। ভ্রাতৃত্ববোধ ও সামাজিক সম্প্রীতির আদর্শে সকলে পরিচালিত হলে এ গোটা বিশ্ব শান্তিময় হয়ে উঠবে।
পবিত্র ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট ইসলাম’ (inbangla.net/islam) এর সাথেই থাকুন।