নিম্নে মহানবি (সাঃ)-এর ১০টি হাদিস এবং তার ব্যখ্যা ও শিক্ষা সমূহ তুলে ধরা হয়েছে-
(১) নিয়ত সম্পর্কিত হাদিস
“প্রকৃতপক্ষে সকল কাজ (এর ফলাফল) নিয়তের উপর নির্ভরশীল।”
(বুখারি)
ব্যাখ্যা:
- এই হাদিসটি সহিহ বুখারির সর্বপ্রথম হাদিস। এর তাৎপর্য অত্যন্ত ব্যাপক। মানুষের সকল কাজই নিয়তের সাথে সংশ্লিষ্ট। নিয়ত বা উদ্দেশ্য ছাড়া মানুষ কোনো কাজই করে না। কাজের উদ্দেশ্যের গুরুত্ব এ হাদিস দ্বারা বুঝতে পারা যায়। সাথে সাথে কোন কাজের উদ্দেশ্য কেমন হওয়া উচিত তাও এ হাদিসের তাৎপর্য বিশ্লেষণে জানা যায়।
- আল্লাহ তায়ালা পরকালে মানুষের সকল কৃতকর্মের হিসাব নেবেন। সেদিন তিনি মানুষের সকল কাজের নিয়ত বা উদ্দেশ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করবেন। মানুষ যদি সৎ উদ্দেশ্যে কোনো কাজ করে তবে সে তার পুরস্কার লাভ করবে। নেক নিয়তে কাজ করে ব্যর্থ হলেও সে তার জন্য পুরস্কার পাবে। আর যদি মন্দ উদ্দেশ্যে কোনো কাজ করে তবে সে শাস্তি ভোগ করবে। এমনকি খারাপ উদ্দেশ্যে ইবাদত করলে কিংবা ভালো কাজ করলেও তাতে কোনো সাওয়াব হয় না। বরং নিয়ত সঠিক না হওয়ায় সে ভালো কাজও মন্দ হিসেবে পরিগণিত হয়।
- উপরে বর্ণিত হাদিসটির শেষাংশ জানলে আমরা নিয়তের বিশুদ্ধতার বিষয়টি আরও সুস্পষ্টরূপে বুঝতে পারব। এ হাদিসের শেষাংশে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, কোনো ব্যক্তি যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নিয়তে (তাঁদের সন্তুষ্টি লাভের জন্য) হিজরত করে তবে সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সন্তুষ্টি লাভ করবে। আর যদি সে পার্থিব লাভ বা কোনো স্ত্রীলোককে বিয়ে করার জন্য হিজরত করে তবে সে শুধু তাই লাভ করবে, যে জন্য সে হিজরত করেছে।
- রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বিশেষ এক প্রেক্ষাপটে এ হাদিসটি বর্ণনা করেন। আর তা হলো- উম্মে কায়স নামক একজন মহিলা ইসলাম গ্রহণ করে মদিনায় হিজরত করেন। তখন জনৈক ব্যক্তি তাঁকে বিয়ে করার জন্য মদিনায় হিজরত করে চলে আসেন। ঐ ব্যক্তির উদ্দেশ্য জানতে পেরে নবি (সাঃ) এ হাদিসটি বর্ণনা করেন। যার মূল বক্তব্য হলো- আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য হিজরত করা অত্যন্ত পুণ্যময় কাজ। আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়ত না থাকায় লোকটি হিজরতের সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হলেন।
শিক্ষা:
- কাজের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যকে নিয়ত বলা হয়।
- নিয়তের উপরেই কাজের সফলতা নির্ভর করে। অর্থাৎ নিয়ত যদি ভালো হয় তবে ব্যক্তি উত্তম প্রতিদান লাভ করবে। আর নিয়ত যদি খারাপ হয় তবে ভালো কাজ করলেও ব্যক্তি সাওয়াব লাভ করবে না।
- আল্লাহ তায়ালা মানুষের বাহ্যিক আমলের সাথে সাথে অন্তরের অবস্থাও লক্ষ করেন।
সুতরাং সকল কাজেই আমরা নিয়তকে বিশুদ্ধ রাখব। লোক দেখানোর জন্য বা পার্থিব কোনো লাভের আশায় সৎকর্ম করব না, বরং আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুলের সন্তুষ্টির জন্য কাজ করব।
(২) ইসলামের ভিত্তি (ইমান, সালাত, সাওম, যাকাত ও হজ) সম্পর্কিত হাদিস
“ইসলাম পাঁচটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো মাবুদ নেই, মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর বান্দা ও রাসুল এবং সালাত কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, হজ করা এবং রমযানের রোযা রাখা।”
(বুখারি ও মুসলিম)
ব্যাখ্যা:
- এই হাদিসে মহানবি (সাঃ) ইসলামের পাঁচটি মূলভিত্তি একসাথে বর্ণনা করেছেন। এগুলো হলো ইমান, সালাত, যাকাত, হজ ও সাওম। এ পাঁচটি বিষয়ের উপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত। এর কোনো একটিকে বাদ দিলে ইসলাম পরিপূর্ণ হয় না।
- এই হাদিসে মহানবি (সাঃ) উপমার মাধ্যমে বিষয়টি সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। বলা হয়েছে, ইসলাম হলো একটা তাঁবু সদৃশ ঘর। ইমান হলো তাঁবুর মধ্যস্থিত মূল খুঁটি। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ মধ্যস্থিত খুঁটি ছাড়া তাঁবু দাঁড় করানো অসম্ভব। তাঁবুর বাকি চারটি খুঁটিও গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হলো সালাত, যাকাত, হজ ও সাওম। সবগুলো খুঁটি ঠিক থাকলে তাঁবু ঠিকভাবে দণ্ডায়মান থাকে। এর কোনো একটি খুঁটি না থাকলে তাঁবু ভূলুণ্ঠিত হয়। সুতরাং ইসলামের পূর্ণতার জন্য এ পাঁচটি ভিত্তির সবকটিই গুরুত্বপূর্ণ। একজন পূর্ণাঙ্গ মুসলিম ব্যক্তি এ পাঁচটি বিষয়ের প্রতি যথাযথ গুরুত্বারোপ করে থাকেন।
শিক্ষা:
- ইসলামের মূলভিত্তি পাঁচটি। এগুলো হলো- ইমান, সালাত, যাকাত, হজ ও সাওম।
- ইমান হলো সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।
- ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষ্য দেওয়ার মাধ্যমে ইমানের প্রকাশ ঘটাতে হবে।
- অতঃপর অন্যান্য ভিত্তি যথা- সালাত, যাকাত, হজ ও সাওমের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার পূর্ণ আনুগত্য করতে হবে।
- এ পাঁচটি ভিত্তির একটি ছাড়াও ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না।
(৩) দানশীলতা সম্পর্কিত হাদিস
“বান্দাগণ প্রতিদিন সকালে উপনীত হলেই দুজন ফেরেশতা অবতরণ করেন। এঁদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! দানকারীকে তুমি তার প্রতিদান দাও। আর অপরজন বলেন, হে আল্লাহ! সম্পদ আটককারীকে (কৃপণকে) ক্ষতিগ্রস্ত কর।”
(বুখারি ও মুসলিম)
ব্যাখ্যা:
- মানবজীবনে অর্থের ব্যবহার সংক্রান্ত বিষয়ে এ হাদিসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে দানশীলতার পুরস্কার ও কৃপণতার কুফল সম্পর্কে স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে।
- আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য খরচ করা ও দানশীলতা অত্যন্ত পুণ্যময় কাজ। নানাভাবে একাজ করা যায়। সন্তুষ্ট চিত্তে নিজ পিতা-মাতা, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের জন্য খরচ করাও একপ্রকার দানশীলতা। তা ছাড়া গরিব, অভাবী, ইয়াতীম, দুঃস্থ, ফকির-মিসকিনকে সাহায্য করাও সকলের কর্তব্য। দান করার মাধ্যমে মানুষের ইমানের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বাহ্যিকভাবে এতে দেখা যায় যে, সম্পদ কমে যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এতে সম্পদ কমে না। বরং আল্লাহ তায়ালা খুশি হয়ে দানশীলকে আরও প্রভূত পরিমাণে প্রতিদান দিয়ে থাকেন। তার অবশিষ্ট সম্পদে বরকত হয়। আসমানের ফেরেশতা প্রতিদিন সকালে তার পক্ষে আল্লাহ তায়ালার নিকট দোয়া করেন।
- পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি সম্পদ খরচ না করে জমা করে রাখে সে কৃপণ। তার সম্পদ কোনো কাজে আসে না। এতে কোনোরূপ কল্যাণ ও বরকত নেই। আসমানের ফেরেশতাগণও তার প্রতি বদদোয়া করেন। এভাবে দুনিয়া ও আখিরাতে কৃপণ ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
শিক্ষা:
- দানশীলতা মহৎ গুণ।
- দানশীল ব্যক্তির জন্য ফেরেশতাগণ দোয়া করে থাকেন। আল্লাহ তায়ালা মদানশীলকে উত্তম প্রতিদান দিয়ে থাকেন।
- কৃপণতা নিন্দনীয় কাজ ৷ কৃপণ ব্যক্তি সর্বাবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতএব, আমরা দানশীল হব। গরিব, দুঃখী, অভাবীদের সাহায্য করব। নিজ পিতা-মাতা, ভাইবোনদের জন্য খরচ করব। এতে আল্লাহ তায়ালা খুশি হবেন এবং আমাদের উত্তম প্রতিদান দেবেন।
(৪) বৃক্ষরোপণ সম্পর্কিত হাদিস
“কোনো মুসলমান যদি বৃক্ষ রোপণ করে কিংবা কোনো ফসল আবাদ করে, এরপর তা থেকে কোনো পাখি, মানুষ বা চতুষ্পদ জন্তু কিছু ভক্ষণ করে তবে তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে।”
(বুখারি ও মুসলিম)
ব্যাখ্যা:
- আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব বর্ণনায় হাদিসটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ হাদিসে মহানবি (সাঃ) আমাদের বৃক্ষরোপণ ও কৃষি কাজ সম্পর্কে উৎসাহ প্রদান করেছেন।
- বৃক্ষরোপণ ও কৃষিকাজ মানবজীবনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এর দ্বারা মানুষ নানাভাবে উপকৃত হয়। বেঁচে থাকার জন্য মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান প্রয়োজন। বৃক্ষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের সে প্রয়োজন পূরণ করে। বৃক্ষ থেকে আমরা খাদ্য, ঔষধ, পোশাক, কাঠ, ফল ইত্যাদি লাভ করি। বৃক্ষ আমাদের আর্থিক সচ্ছলতাও প্রদান করে। পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায়ও বৃক্ষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অক্সিজেনের সরবরাহ বৃদ্ধি, জলবায়ুর উষ্ণতা রোধ, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি রোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও বৃক্ষের অবদান অনস্বীকার্য। আলোচ্য হাদিসে বৃক্ষরোপণের নির্দেশ দানের মাধ্যমে মহানবি (সাঃ) আমাদের এসব নিয়ামত ও উপকার লাভের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন।
- আমরা অনেকেই বৃক্ষরোপণ বা কৃষিকাজকে ছোট কাজ বলে ঘৃণা করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোনো কাজই ছোট নয়। সৎভাবে করা সকল কাজই উত্তম। বৃক্ষরোপণেও কোনো লজ্জা নেই। বরং এটি অনেক নেকির কাজ। স্বয়ং মহানবি (সাঃ) আমাদের এ কাজে উৎসাহিত করেছেন।
- বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে মানুষ পার্থিব লাভের পাশাপাশি পরকালীন কল্যাণও লাভ করতে পারে। কেননা পশু-পাখি, জীব-জন্তু ও কীট-পতঙ্গ বৃক্ষের ফল, ক্ষেতের ফসল খেয়ে থাকে। এতে বৃক্ষরোপণকারী ও ফসল আবাদকারী সাওয়াব লাভ করে। ঐ ফল-ফসল সদকা করে দিলে যে সাওয়াব হতো, পশুপাখি বা মানুষের খাওয়ার ফলে আল্লাহ তায়ালা তার আমলনামায় সে পরিমাণ সাওয়াব লিখে দেন। ফলে সে নিজের অজান্তেই অনেক সাওয়াবের অধিকারী হয়ে যায়।
শিক্ষা:
- বৃক্ষরোপণ পুণ্যের কাজ।
- বৃক্ষরোপণের দ্বারা মানুষ আর্থিকভাবে লাভবান হয়। পরিবেশ সংরক্ষিত থাকে। পাশাপাশি আখিরাতেও প্রতিদান পাওয়া যাবে।
- মহানবি (সাঃ) আমাদের বৃক্ষরোপণের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন।
- মানুষের উৎপাদিত ফল, ফসলে পশু-পাখি ও অন্য মানুষেরও হক রয়েছে।
- উৎপাদিত ফল, ফসল থেকে কোনো প্রাণী কিছু ভক্ষণ করলে তা বিনষ্ট হয় না। বরং তা সদকা হিসেবে আবাদকারীর আমলনামায় লেখা হয়।
(৫) সর্বোত্তম মানুষ সম্পর্কিত হাদিস
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “আমি কী তোমাদের ভালো লোকদের সম্পর্কে অবহিত করব না? তাঁরা (সাহাবিগণ) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! হ্যাঁ, বলে দিন। তিনি বললেন- তোমাদের মধ্যে ভালো লোক তারা, যাদের দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়।”
(ইবনে মাজাহ)
ব্যাখ্যা:
- এ হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সবচেয়ে উত্তম মানুষের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। বস্তুত সর্বোত্তম মানুষ হলেন তাঁরা, যাঁদের দেখলে আল্লাহ তায়ালার কথা স্মরণ হয়। ঐসব ব্যক্তি চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, পোশাক-পরিচ্ছদে ইসলামের একান্ত অনুসারী। তাঁরা সদাসর্বদা আল্লাহ তায়ালার যিকির ও প্রশংসায় লিপ্ত থাকেন। এরূপ লোকদের দেখলেই আল্লাহর স্মরণ এসে যায়। মানুষের মধ্যে এসব লোকই সর্বোত্তম।
- সমাজে আমরা বহু লোকের সাথে চলাফেরা করি। তাদের সকলকে দেখলে আল্লাহ তায়ালার কথা স্মরণ হয় না। সুতরাং যাঁদের দেখলে আল্লাহ তায়ালার কথা স্মরণ হয়, তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা উচিত। এতে তাঁদের প্রভাব আমাদের উপরও পড়বে। আমরাও তাদের ভালো কাজ দ্বারা অনুপ্রাণিত হব। আমাদের চলাফেরা, উঠাবসা, আচার-আচরণ সুন্দর হবে। ফলে আমরাও উত্তম মানুষে পরিণত হতে পারব।
শিক্ষা:
- আল্লাহ তায়ালার স্মরণ সর্বোত্তম কাজ।
- মানুষের মর্যাদা ধন-দৌলত, শিক্ষা বা ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল নয়। বরং দীন পালনের মাধ্যমেই মানুষের মর্যাদা নিরূপিত হয়।
- যাঁদের দেখলে আল্লাহ তায়ালার স্মরণ হয় তাঁরা সর্বোত্তম ব্যক্তি। আমরা দীনদার লোকদের সাথে সম্পর্ক রাখব। তাঁদের মতো হতে চেষ্টা করব।
(৬) মানবপ্রেম ও সৃষ্টির সেবা সম্পর্কিত হাদিস
“সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিজন। সুতরাং আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় ঐ ব্যক্তি যে তাঁর পরিজনের প্রতি অনুগ্রহ করে।”
(বায়হাকি)
ব্যাখ্যা:
- আল্লাহ তায়ালা সকল কিছুর স্রষ্টা। তিনি হলেন খালিক। তিনি ব্যতীত যা কিছু আছে সবই তাঁরই সৃষ্টি বা মাখলুক। মানুষ যেমন তাঁর সৃষ্টি তেমনি কীটপতঙ্গও তাঁর মাখলুক। বস্তুত জিন-ইনসান, আসমান-জমিন, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, গাছপালা, তরুলতা, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র সবই আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি।
- আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তিনি সকল কিছুর লালনকর্তা, পালনকর্তা, রিযিকদাতা ও নিয়ন্ত্রক। তিনি সকল সৃষ্টিকে এক রকম করে সৃষ্টি করেননি। এটা তাঁর পরীক্ষা। তিনি সৃষ্টিকুলকে নানাভাবে ভাগ করেছেন এবং সকল কিছুকে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত রেখেছেন। মানুষ হলো আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। সুতরাং মানুষের উচিত আল্লাহ তায়ালার সকল সৃষ্টির প্রতি সদাচরণ করা, সকল মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করা। পশু-পাখি, জীব-জন্তুর প্রতি অনুগ্রহ করা। এদের প্রতি অনুগ্রহ করলে আল্লাহ তায়ালা খুশি হন। যাঁরা আল্লাহ তায়ালার এসব সৃষ্টির প্রতি সদয় আচরণ করেন তাঁরা মহান আল্লাহর প্রিয় বান্দা। আল্লাহ তায়ালা তাঁদের ভালোবাসেন।
শিক্ষা:
- সকল সৃষ্টি আল্লাহ তায়ালার পরিজন স্বরূপ।
- এদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন ও সদাচরণ করা ইসলামের আদর্শ।
- জীবজন্তু, পশু-পাখির প্রতি দয়া প্রদর্শন করলে আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট হন।
- সৃষ্টির প্রতি অনুগ্রহ করার দ্বারা মানুষ আল্লাহ তায়ালার প্রিয় বান্দা হতে পারে।
(৭) পরোপকার সম্পর্কিত হাদিস
“এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সে তার ভাইয়ের উপর অত্যাচার করে না, তাকে শত্রুর হাতে সোপর্দ করে না। যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণে সচেষ্ট হয়, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করে দেন।”
(বুখারি ও মুসলিম)
ব্যাখ্যা:
- মুসলমানগণ পরস্পর ভাই ভাই। তারা সকলে একই আদর্শে বিশ্বাসী, একই জীবনাদর্শের অনুসারী। ফলে পৃথিবীর যে স্থানেই কোনো মুসলমান থাকুক না কেন সকলেই ইসলামি ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। এতে দেশ, কাল, জাতি, বর্ণ ইত্যাদির কোনো ভেদাভেদ নেই। ধনী-গরিব, সাদা-কালো, আরব-অনারব সকল মুসলমানই পরস্পর ভাই-ভাই। সুতরাং এক মুসলমানকে অন্য মুসলমানের প্রতি বেশকিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। যেমন- কোনো মুসলমান ভাইয়ের প্রতি কোনোরূপ অন্যায়-অত্যাচার করা যাবে না ও -নির্যাতন করা যাবে না। বরং সর্বাবস্থায় তার সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। তার জান, মাল, ইজ্জত- জুলুম- সম্মান রক্ষা করতে হবে। শত্রুর মোকাবিলায় তাকে সাহায্য করতে হবে। তার শত্রুকে সাহায্য করা যাবে না। ছোট-বড় যেকোনো প্রয়োজনে অপর মুসলমান ভাইকে সাধ্যমতো সাহায্য করতে হবে। সামর্থ্য থাকলে ধন-সম্পদ ব্যয় করে তার সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় বুদ্ধি পরামর্শ ও সৎ উপদেশের মাধ্যমে সাহায্য করতে হবে। এমনকি প্রয়োজনে দৈহিক পরিশ্রমের মাধ্যমেও তাকে সাহায্য করতে হবে।
- বস্তুত নিজের সামর্থ্যানুযায়ী আন্তরিকভাবে অপর মুসলমান ভাইয়ের বিপদে এগিয়ে আসতে হবে। এতে আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট হন। তিনি স্বয়ং সাহায্যকারীকে সাহায্য করেন। তার সকল প্রয়োজন পূরণ করে দেন।
শিক্ষা:
- মুসলমানগণ পরস্পর ভাই-ভাই।
- তারা পরস্পর অন্যায় অত্যাচার করবে না।
- শত্রুর মোকাবিলায় সকলে একত্রে এগিয়ে আসবে।
- বিপদে আপদে পরস্পরকে সাহায্য-সহযোগিতা করবে।
- সাহায্যকারী মুসলিম আল্লাহ তায়ালার নিকট প্রিয়। আল্লাহ তায়ালা তার প্রয়োজন পূরণ করে দেন।
(৮) ব্যবসায়ে সততা সম্পর্কিত হাদিস
“বিশ্বস্ত, সত্যবাদী মুসলিম ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন শহিদগণের সঙ্গে থাকবেন।”
(ইবনে মাজাহ)
ব্যাখ্যা:
- ব্যবসায়-বাণিজ্য একটি পবিত্র পেশা। আমাদের প্রিয়নবি (সাঃ)ও ব্যবসা করেছেন। সৎ ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী দুনিয়া ও আখিরাতে অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, কিয়ামতের দিন বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী মুসলিম ব্যবসায়ীগণ শহিদগণের সঙ্গে অবস্থান করবেন। সেদিন তাঁদের কোনো ভয় ও চিন্তা থাকবে না। বরং তাঁরা সেদিন আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ লাভ করে ধন্য হবেন।
- শহিদগণ হলেন ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গকারী ব্যক্তি। আল-কুরআনে আল্লাহ তায়ালা তাঁদের জন্য জান্নাতের ঘোষণা প্রদান করেছেন। সৎ ব্যবসায়ীগণও কিয়ামতের দিন শহিদগণের সঙ্গী হবেন।
- ব্যবসায়ীরাও শহিদগণের ন্যায় জান্নাতে প্রবেশ করবেন। তবে এজন্য ব্যবসায়ীদের দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে- প্রথমত, সততা ও সত্যবাদিতার সাথে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাদেরকে বিশ্বস্ত ও আমানতদার হতে হবে।
- অর্থাৎ সততা ও বিশ্বস্ততার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করলে কিয়ামতের দিন মহাপুরস্কার লাভ করা যাবে। অন্যদিকে, ব্যবসায় প্রতারণা করলে, মিথ্যা বললে এ কল্যাণ লাভ করা যাবে না। সুতরাং ব্যবসা ক্ষেত্রে সকল প্রকার অন্যায় ও খারাপ কাজ ত্যাগ করতে হবে। লোভ-লালসা পরিত্যাগ করতে হবে। ওজনে কম দেওয়া, খারাপ দ্রব্য ভালো বলে বিক্রি করা, ভেজাল মেশানো, পণ্যের দোষত্রুটি গোপন করা, মওজুতদারি, কালোবাজারি প্রভৃতি অনৈতিক কাজ করা যাবে না। বরং সর্বাবস্থায় সততা ও বিশ্বস্ততার সাথে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। তাহলেই কিয়ামতে শহিদগণের সঙ্গী হওয়ার মহান মর্যাদা লাভ করা যাবে।
শিক্ষা:
- ব্যবসায়-বাণিজ্য হালাল পেশা। তবে তা ইসলামি নীতি আদর্শের অনুসরণে করতে হবে।
- ব্যবসায়ে সততা ও বিশ্বস্ততা মহৎ গুণ। সকলকেই এগুলোর অনুশীলন করতে হবে।
- বিশ্বস্ত ও সৎ ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন শহিদগণের সঙ্গী হবেন।
(৯) ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা সম্পর্কিত হাদিস
“মুমিনের সকল কাজ বিস্ময়কর। আর প্রতিটি কাজই তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। আর এ কল্যাণ মুমিন ছাড়া আর কেউ লাভ করতে পারে না। যদি সে সুখ-শান্তি লাভ করে, তবে সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এটা তার জন্য কল্যাণকর। আর যদি সে দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হয় তবে সে ধৈর্যধারণ করে। এটাও তার জন্য কল্যাণকর।”
(মুসলিম)
ব্যাখ্যা:
- এ হাদিসে মানবজীবনের নানা অবস্থায় কীরূপ আচরণ করতে হবে সে সম্পর্কে সুন্দর দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। মানবজীবনে সুখ-শান্তির পাশাপাশি দুঃখ-কষ্টও বিদ্যমান। এগুলো আল্লাহ তায়ালার পরীক্ষা স্বরূপ।
- আল্লাহ তায়ালা সুখ ও দুঃখের মাধ্যমে মানুষের পরীক্ষা করে থাকেন। মানুষের উচিত সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর হুকুম পালন করা। প্রকৃত মুমিন ব্যক্তি এরূপ করে থাকেন। ফলে সকল অবস্থাই তার জন্য কল্যাণকর। কেননা দুঃখ কষ্টে নিপতিত হলে মুমিন ব্যক্তি হতাশ হয়ে পড়েন না। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য অন্যায় কাজ করেন না। বরং এ অবস্থাতেও তিনি আল্লাহ তায়ালার আদেশ পালন করেন ও ধৈর্যসহকারে মহান আল্লাহর উপর ভরসা করেন। এতে আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি সন্তুষ্ট হন। তাকে সাওয়াব দান করেন এবং দুঃখ-কষ্ট থেকে উদ্ধার করেন। ফলে দুঃখ-কষ্টের অবস্থাও মুমিন ব্যক্তির জন্য কল্যাণকর হয়ে যায়।
- আর সুখ-শান্তির অবস্থাতেও মুমিন ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে ভুলে যান না। বরং তিনি সুখ-শান্তি ও নিয়ামতের জন্য আল্লাহ তায়ালার শোকর করেন। তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায় করেন। ফলে আল্লাহ তায়ালা তার উপর খুশি হন ও তাঁর নিয়ামতসমূহ আরও বাড়িয়ে দেন। ফলে এ অবস্থায় মুমিন ব্যক্তি সর্বাধিক কল্যাণ লাভ করেন।
শিক্ষা:
- সুখ-দুঃখ মানবজীবনের স্বাভাবিক বিষয়।
- দুঃখ-কষ্টের সময় হতাশ হওয়া চলবে না। বরং ধৈর্যসহকারে আল্লাহ তায়ালার আদেশ পালন করতে হবে।
- আনন্দের সময়ও আল্লাহ তায়ালার আদেশ ভুলে গেলে চলবে না। বরং তাঁর শুকরিয়া আদায় করতে হবে।
- এভাবে সুখ-দুঃখ সর্বাবস্থায় শোকর ও সবরের মাধ্যমে কল্যাণ লাভ করা যায়।
- মুমিন ব্যক্তির সকল কাজই কল্যাণজনক। কেননা, মুমিন ব্যক্তি সর্বাবস্থায় আল্লাহ তায়ালার আদেশ পালন করেন। কোনো অবস্থাতেই আল্লাহ বিমুখ হন না। ফলে সবর ও শোকরের মাধ্যমে তিনি সর্বোচ্চ কল্যাণ লাভ করেন। প্রকৃত মুমিন হতে হলে আমাদেরকে সদা সর্বদা আল্লাহ তায়ালার আদেশ পালনে সচেষ্ট হতে হবে।
(১০) যিকির সম্পর্কিত হাদিস
“দুটি বাক্য এমন রয়েছে যা দয়াময় আল্লাহর নিকট খুবই প্রিয়, উচ্চারণ করতে সহজ ও দাঁড়িপাল্লায় খুবই ভারী। বাক্য দুটি হলো “সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আযিম” (আল্লাহ মহাপবিত্র, সকল প্রশংসা তাঁর জন্যই। মহাপবিত্র আল্লাহ, তিনি মহামহিম)।”
(বুখারি)
ব্যাখ্যা:
- এ হাদিসে মহানবি (সাঃ) উম্মতকে দুটি অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ বাক্য শিক্ষা দিয়েছেন। এগুলো হলো, প্রথম বাক্য- সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি, এবং দ্বিতীয় বাক্য- সুবহানাল্লাহিল আযিম।
- রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ছিলেন উম্মতের জন্য সর্বাধিক কল্যাণকামী। এজন্য তিনি আমাদের অতীব বরকতময় এ দুটি যিকির শিক্ষা দিয়েছেন এবং এর ফজিলতও বর্ণনা করেছেন।
- প্রথমত- এ বাক্যদ্বয় আল্লাহ তায়ালার নিকট অত্যন্ত প্রিয়। কেননা এতে মহান আল্লাহর পবিত্রতা, মহিমা ও প্রশংসা বর্ণনা করা হয়েছে।
- দ্বিতীয়ত- আমরা বাংলাভাষী। আরবি আমাদের মাতৃভাষা নয়। তথাপি এ বাক্যদ্বয় খুবই সুন্দর ও সাবলীল। আমরা খুব সহজেই এগুলো উচ্চারণ করতে পারি, মুখস্থ করতে পারি। এগুলো উচ্চারণে কোনোরূপ জিহ্বার আড়ষ্টতা সৃষ্টি হয় না, কোনোরূপ কষ্ট হয় না। বস্তুত এ দুটো সহজ সরল ও সুন্দর বাক্য।
- তৃতীয়ত- এ বাক্যদ্বয় মিযানে বা দাঁড়িপাল্লায় খুবই ভারী হবে। কিয়ামতের দিন মানুষের সকল কৃতকর্ম দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা হবে। নেকির পাল্লা ভারী হলে মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর নেকির পাল্লা হালকা হলে তার স্থান হবে জাহান্নাম। এ বাক্যদ্বয়ের সাওয়াব ওজনে খুবই ভারী। মিযানে এগুলো নেকির ওজনকে ভারী করে তুলবে।
- অতএব, আমরা এ বাক্য দুটো মুখস্থ করব এবং সব সময় পাঠ করব। ফলে মহামহিম ও মহাপবিত্র আল্লাহ তায়ালা আমাদের উপর সন্তুষ্ট হবেন এবং অধিক পরিমাণ প্রতিদান দেবেন।
শিক্ষা:
- আল্লাহ তায়ালা মহাপবিত্র, মহামহিম। তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করলে তিনি খুশি হন।
- সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আযিম- আল্লাহ তায়ালার প্রিয় দুটি বাক্য। আমরা সদা সর্বদা এ বাক্যদ্বয়ের যিকির করব।
- হাশরের দিন মিযানে এ বাক্যদ্বয় খুবই ভারী হবে। ফলে এর পাঠকারী সফলতা লাভ করবে।
পবিত্র ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট ইসলাম’ (inbangla.net/islam) এর সাথেই থাকুন।