Skip to content

শ্বশুর শাশুড়ির সাথে সম্পর্ক

শ্বশুর শাশুড়ির সাথে সম্পর্ক

নিম্নে ‘শ্বশুর শাশুড়ির সাথে সম্পর্ক’ নিয়ে বিস্তারিভাবে আলোচনা করা হলো-

আমরা অনেকেই স্ত্রীর উপর তার স্বামীর যে বাবা মা আছে, তার পরিবারের অন্যন্য সদস্যরা আছে, আত্মীয় আছেন, এদের উপর কি দায়িত্ব ইসলাম বর্তিয়েছে তা কুরআন সুন্নাহর আলোকে জানতে চাই।

তাই আজকের এই পোষ্টটিতে আমরা-

  • শ্বশুর শাশুড়ির সাথে সম্পর্ক কি?
  • শ্বশুর শাশুড়ি কোন শ্রেণী আত্নীয়?
  • শ্বশুর শাশুড়ির খেদমত কি ইসলামে বাধ্যতামূলক বা ফরজ?
  • শ্বশুর শাশুড়ির সেবা করতে স্ত্রী ‍কি বাধ্য, ইসলাম কি বলে?
  • ইসলামে শ্বশুর শাশুড়ির প্রতি দায়িত্ব

ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহ এর আলোকে ব্যাখ্যা করব।

এই পোষ্টটি সম্পূর্ণ মনোযোগের অধ্যয়ন করলে, আশা করি আপদের আর কোন সংশয় থাকবে না, সুন্দর ও সহজভাবে বিষয়েগুলোকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে বলা হয়েছে।

ইসলাম গোট মানব সমাজটা থেকে একটা সুন্দর ফ্রেমে আবদ্ধ করার জন্য, মিলেমিশে সবাই সবার প্রতি দায়িত্ব পালন করার জন্য, যে ধরনের নিয়ম-নীতি দরকার এ বিষয়গুলো ইসলাম সবই অন্তর্ভুক্ত করেছে। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলো বিবেচনা করেছে।

এজন্যই পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,

“তোমরাই সর্বোত্তম উম্মাত, মানব জাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে, তোমরা সৎ কাজে আদেশ করবে ও অসৎ কাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে; আর যদি গ্রন্থ প্রাপ্তরা বিশ্বাস স্থাপন করত তাহলে অবশ্যই তাদের জন্য মঙ্গল হত; তাদের মধ্যে কেহ কেহ মু’মিন এবং তাদের অধিকাংশই দুস্কার্যকারী।”

(সূরা আলে-ইমরান , আয়াত নং-১১০)

যে প্রশ্নটা নিয়ে সম্প্রতি আমাদের দেশের একটা বিতর্ক লক্ষ্য করা যায়। যে শ্বশুর শাশুড়ির প্রতি ছেলের বউয়ের কোন দায়িত্ব আছে কিনা, তাদের সেবা যত্ন করা তার বউয়ের কর্তব্য কিনা, কেউ বলছে অবশ্যই করা লাগবে, কেউ বলছে না এটা তো কোরান হাদিসে সেটা বলে নাই। এই যে সামাজিক সংকট দিন দিন তৈরি হচ্ছে আসলে বিষয়টা ঠিক এরকম সরল সমীকরণের বিশ্লেষণ করলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে না, আমাদের এখানে দুই বিষয় মাথায় রাখতে হবে।

প্রত্যকটা জিনিসকে বিশ্লেষণ করতে হলে প্রধানত দুইটা দিক দরকার। একটা হলো মানবিক দিক, আরেকটা হলো ধর্মীয় বা শরীয়তের দিক।

মানবিক এবং আইনী দিক এই দুইটা কোন একটা রাষ্ট্রের সবার ক্ষেত্রে সমানই হয়, কিন্তু ধর্মীয় দিকটা ধর্মের ব্যবধানের কারণে কোন কোন ধর্ম কোন বিষয়ে কিছুটা বেশি প্রায়োরিটি দিয়েছে, একটাকে কম প্রায়রিটি দিয়েছে।

আমরা ধর্মীয় দিকটা বিশ্লেষণ করলে সাধারনত আমাদের ইসলাম ধর্মের তথা কোরআন এবং সুন্নাহ তে যেটা আছে সেটা বিশ্লেষণ করবো।

প্রথমে যদি মানবিক দিক নিয়ে কথা বলি-

শ্বশুর শাশুড়ির সাথে তার কি সম্পর্ক, মানবিক দিকে তারাও একজন মানুষ, মানুষ হিসেবে অপর একজন মানুষের প্রতি যে দায়িত্বটা পালন করা দরকার, আমি আপনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, বাসে বসা আাছি, পাশের লোকটা অসুস্থ হয়ে কাত হয়ে পড়ে গেছে, আমি তাকে চিনিওনা জানিওনা তার কোন খোঁজ খবরও আমার নেই, শুধু পার্শ্বপর্তী যাত্রী শুধু মানবিক কারণে ঐ মহুর্তে তার জন্য সেবা-যত্ন করাটা আমার দায়িত্ব।

আর একজন বউয়ের জন্য সবচেয়ে কাছে যে মানুষটা বসবাস করে তিনি হলেন শ্বশুর-শাশুড়ি, বিয়ের পরে বাচ্চা হইতে তার এক দুই বছর সময় লাগে, অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন পাইতে সময় লাগে তারা দূরে থাকে, সবচেয়ে কাছে যে লোকটা বসবাস করে বসবাসের দিক থেকে শ্বশুর শাশুড়ি। তারা একই বাড়িতে থাকে, একই ছাদের নিচে থাকে অথবা এক বাড়িতে না থাকলেও তাদের মধ্যে যোগাযোগটা খুব কাছাকাছি, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলেও তাদের প্রতি বউ দায়িত্ব আছে। এটা কিন্তু গিভ এন্ড টেইক, এটা কিন্তু যৌথ/বাইলিটারাল, শুধু ছেলের বউ শ্বশুর শাশুড়ির জন্য করে যাবে এমন কিন্তু নয়। বউও তো মানুষ, বউ এর প্রতিও শাশুড়ির মানবিক দায়িত্ব যেটুকু মানবিক দায়িত্ব হিসেবে সে রকম অবশ্যই পালন করতে হবে, যেহেতু দুইজনেই মানুষ।

দ্বিতীয় ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বিষয়টাকে বিশ্লেষণ করে তাহলে-

কোরআনুল কারিকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যাদের প্রতি দায়িত্ব পালনের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেছেন,

“তোমরা ইবাদাত কর আল্লাহর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না। আর সদ্ব্যবহার কর মাতা-পিতার সাথে, নিকট আত্মীয়ের সাথে, ইয়াতীম, মিসকীন, নিকট আত্মীয়- প্রতিবেশী, অনাত্মীয়- প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সাথে। নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদেরকে যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী।”

[সূরা নিসা, আয়াত নং-৩৬]

তো এখন এই নিকট আত্নীয় কারা ও কিভাবে হয়? নিকট আত্মীয় প্রধানত দুইভাবে হয়, একটা হলো রক্ত সম্পর্কীয় একটা হল বৈবাহিক সম্পর্কীয়।

রক্ত সম্পর্কে মাঝে সর্বপ্রথম ধাপের নিকট আত্মীয় হলো- মাতা পিতা এবং সন্তান; এর দ্বিতীয় ধাপের নিকট আত্মীয় হলো- ভাইবোন; তৃতীয় ধাপে এদর পরে যারা আছে যেমন- চাচারা, ফুফুরা, খালারা, মামারা এরকম।

অপরদিকে, বৈবাহিক সম্পর্কীয় আত্নীয়র দিক থেকে যদি দেখি যে, বৈবাহিক কারণে সৃষ্ট সম্পর্কের মাঝে, সবচেয়ে কাছের নিকট আত্মীয় হলো শ্বশুর-শাশুড়ি।

তাইলে কুরআনে কারীমে মাতা পিতার পরেই যাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে তারা হলো নিকট আত্মীয় এবং নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে সবার প্রথমে কিন্তু শ্বশুর শাশুড়ি আছে।

সুতরাং কোরানের নির্দেশ অনুযায়ী নিকট আত্মীয়দের প্রতি দায়িত্ব পালনে নির্দেশ কোরআন দিয়েছে, তাই এর মাঝে সর্বাগ্রে শ্বশুর-শাশুড়ি আসবে।

প্রশ্নটা যেটা দেখা দিয়েছে সেটা হলো- আমাদের শ্বশুর শাশুড়ি মনে করে বউ বিয়ে করে আনছি, বান্দি আনছি, দাসী আনছি, দাসী বান্দির মত তাদেরকে ব্যবহার করে, যা ইচ্ছে তাদের প্রতি আচরণ করে ওই ক্ষোভটা কিন্তু তৈরি হয়েছে এখানেই। মাতা-পিতার খেদমতের কথা বলা হয়েছে কোরআনে, তাহেল শ্বশুর শাশুড়ি তো আমার স্বামীর মাতা-পিতা আমার তো আর না, আমি তাদের খেদমত কেন করব?

শ্বশুর শাশুড়ির খেদমত করতে হবে কেন? তো এই আইডটা কেন উৎপত্তি হয়েছে? ঐ যে কিছু শ্বশুর শাশুড়ি আছে যারা ছেলের বউদের কে মানবিক মর্যাদা দেয় না, ন্যূনতম মূল্যবোধ তাদের প্রতি প্রদর্শন করেনা, মানবিক মর্যাদায় তাদেরকে যে স্থানটুকু টুকু দেওয়া দরকার বা যে মর্যাদাটুকু দেওয়ার দরকার, যে পারিবারিক সম্মান যেটুকু তার প্রাপ্য ছিল, সামাজিক সম্মান যেটুকু প্রাপ্য ছি,ল তার প্রতি যে সদাচরণ টা আশা করা ছিল, অনেক শ্বশুর শাশুড়ির পক্ষ থেকে সেটা কিন্তু পাওয়া যায় না এইটা শ্বশুর-শাশুড়িদের মোটেও উচিত নয়।

অনুরূপভাবে কুরআনে মাতা-পিতা প্রতি সদ্ব্যবহার করার কথা বলো হয়েছে, শ্বশুর-শাশুড়ি তো নিজের মাতা-পিতা না, তাদের প্রতি আমার কোন দায়িত্ব নেই, যদি এটা বলা হয় তাহলে সরাসরি কুরআনের বাণী লঙ্ঘন করা হবে।

কারণ কুরআনে মাতা পিতার পরপরই নিকট আত্নীয়ের প্রতি সদ্ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে, আর বৈবাহিক সম্পর্কে নিকট আত্নীয়দের প্রথমেই রয়েছে শ্বশুর শাশুড়ি সুতরাং তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে হবে।

এখন প্রশ্ন হল খেদমত বা সেবা বলতে কি বুঝানো হয়?

আমরা সেবা বলতে মনে করি হাত মা টিপো, মাথায় তেল দিয়ে দাও, গোসল করতে সাহায্য করো, আসলে ব্যাপারটা এরকম না, সেবা হলো যেই প্রয়োজনটা তার রয়েছে সেই প্রয়োজন পূরণের জন্য আমার যা যা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার আমি তা নেব, এটার নাম হলো সেবা বা সার্ভিস।

এজন্য শ্বশুর শাশুড়ির প্রতি, স্বামী-স্ত্রী দুজনের কথাই কিন্তু এটা, হাজবেন্ডের শ্বশুর শাশুড়ি যেমন স্ত্রীর মা-বাবা, অনুরূপভাবে ওয়াইফের শ্বশুর-শাশুড়ি আবার হাজবেন্ডের মা-বাবা, তাদের জন্য যেটুকু করণীয় মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে, নিকট আত্মীয়র হক, হিসেবে অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, জামা কাপড়ের দরকার হলে জামা কাপড় দেওয়া, প্রয়োজন হলে খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করা, অন্য যে ধরনের বিনোদনের দরকার তার ব্যবস্থা করা অর্থ্যাৎ যেই সার্ভিস টুকু তাদের পাওয়া উচিত বা যেই জিনিসটুকু তারা ডিজার্ভ করে বা যেটা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে যে জিনিসগুলো দরকার সে জিনিসগুলো করতে হবে এটা নিকট আত্নীয়ের প্রতি হক।

এখন শ্বশুর শাশুড়ির কথা কোরআনে সরাসরি নাই বলে তাকে একেবারে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে হবে, বউদের জন্য এটা যেমন উচিত না। আবার ছেলের বউকে একদম দাসি-বান্দির মত ব্যবহার করতে হবে, এটাও শ্বশুর-শাশুড়ি উচিত না। এই দুই পক্ষই এক্সট্রিম অবস্থায় চলে যাওয়ার কারণে এই সংকটা তৈরি হয়েছে, আমাদের পরিবারের বন্ধন গুলো আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পরিবারের যে একটা সৌন্দর‌্য ছিল, যে মায়া-মমতায় জড়াজড়ি করি মোর দেহখানি রহিয়াছে পরি, এইটা কিন্তু আজকে হারিয়ে যাচ্ছে।

পরিবারের মাঝে মায়া-মমতা করে কিন্তু এখন আর নাই, এখন নিজেদের মধ্যে হিংসা বিদ্বেষী, স্বার্থপরতা, নিজেদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি এবং রেসারেসি এগুলো চলে আসছে। যেটা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও সমর্থনযোগ্য নয়, আমাদের এই বঙ্গের যে আর্থসামাজিক, হাজার হাজার বছরের যে ঐতিহ্য এই যে পারিবারিক সংস্কৃতি, এটার সাথেও সংহতি পূর্ণ নয় এবং ইসলামও সেটাকে অনুমোদন করেনা।

প্রিয় দ্বীনী ভাই-বোন, উপরোক্ত আলেচনার মাধ্যমে আমরা শ্বশুর শাশুড়ির খেদমত কি ইসলামে বাধ্যতামূলক বা ফরজ, শ্বশুর শাশুড়ির সেবা করতে স্ত্রী ‍কি বাধ্য ইসলাম কি বলে, শ্বশুর শাশুড়ি কোন শ্রেণী আত্নীয়, শ্বশুর শাশুড়ির সাথে সম্পর্ক কি, ইসলামে শ্বশুর শাশুড়ির প্রতি দায়িত্ব ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে সম্পর্ণরূপে পরিষ্কার একটি ধারণা অরজন করতে পারলাম।

[সূত্র: ড. আনোয়ার হোসেন মোল্লা]

Leave a Reply

nv-author-image

ইন বাংলা নেট ইসলাম

পবিত্র ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত যা কিছু বাংলাতে।View Author posts