(১) সুদ কাকে বলে?
সুদ ফার্সি শব্দ। এর আরবি প্রতিশব্দ রিবা।
কাউকে প্রদত্ত ঋণের মূল পরিমাণের উপর অতিরিক্ত আদায় করাকে রিবা বা সুদ বলে।
মহানবি (সাঃ)-এর আবির্ভাবকালে এটি একধরনের ব্যবসায়ে রূপান্তরিত হয়েছিল। আরবসহ বিশ্বের অনেক সমাজে এ প্রথা প্রচলিত ছিল। যার ফলে ধনী আরও ধনী হতো আর গরিব ক্রমান্বয়ে নিঃস্ব হয়ে যেত। এটা ছিল শোষণের নামান্তর। তাই ইসলাম এটাকে হারাম ঘোষণা করে।
সুদের সংজ্ঞা দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
“যে ঋণ কোনো লাভ নিয়ে আসে তা-ই রিবা (সুদ)।”
(জামি সগির)
(২) সুদ কী?
ঋণদাতা কর্তৃক ঋণগ্রহীতা থেকে মূলধনের অতিরিক্ত কোনো লাভ নেওয়াই হলো সুদ।
যেমন কোনো ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে একশত টাকা এ শর্তে ঋণ দিল যে গ্রহীতা একশত দশ টাকা পরিশোধ করবে। এক্ষেত্রে একশত টাকার অতিরিক্ত দশ টাকা হলো সুদ। কেননা এর কোনো বিনিময় মূল্য নেই।
শুধু টাকা পয়সা বা মাল সম্পদ বিনিময়েই সুদ সীমাবদ্ধ নয়। বরং একই শ্রেণিভুক্ত পণ্যদ্রব্যের লেনদেনে কম-বেশি করা হলেও তা সুদের আওতাভুক্ত হবে।
যেমন- এক কেজি চালের বিনিময়ে দেড় কেজি চাল নেওয়া কিংবা এক কেজি চাল ও অতিরিক্ত অন্য কিছু নেওয়াও সুদ হবে।
মহানবি (সাঃ) স্পষ্ট করে বলেছেন,
“সোনার বিনিময়ে সোনা, রুপার বিনিময়ে রুপা, যবের বিনিময়ে যব, আটার বিনিময়ে আটা, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর, লবণের বিনিময়ে লবণ, এমনিভাবে সমজাতীয় দ্রব্যের নগদ আদান-প্রদানে অতিরিক্ত কিছু হলেই তা সুদ হবে।”
(মুসলিম)
(৩) ঘুষ অর্থ কি?
ঘুষ অর্থ উৎকোচ।
স্বাভাবিক প্রাপ্যের পরও অসদুপায়ে অতিরিক্ত সম্পদ বা সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করাকে ঘুষ বলে।
(৪) ঘুষ কাকে বলে?
অধিকার নেই এরূপ বস্তু বা বিষয় লাভের জন্য দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে অন্যায়ভাবে কোনো সম্পদ বা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া কিংবা নেওয়াকে ঘুষ বলে।
কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের কাজের জন্য নির্দিষ্ট বেতন-ভাতা পায়৷ কিন্তু তারা যদি ঐ কাজের জন্যই অন্যায়ভাবে আরও বেশি কিছু গ্রহণ করে তা হলো ঘুষ। যেমন কারও কোনো কাজ আটকে রেখে তার নিকট থেকে টাকা পয়সা আদায় করা।
সমাজে নানাভাবে ঘুষের প্রচলন দেখা যায়। সাধারণত মানুষ অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য টাকা-পয়সা ঘুষ দিয়ে থাকে। এ ছাড়া উপহারের নামে নানা দ্রব্যসামগ্রী যেমন, টিভি, ফ্রিজ, গহনা, ফ্ল্যাট ইত্যাদিও ঘুষ হিসেবে দেওয়া হয়।
বস্তুত দ্রব্যসামগ্রী যে মূল্যমানেরই হোক, টাকা-পয়সা কম হোক বা বেশি হোক, ঘুষ হিসেবে ব্যবহৃত হলে তা হারাম হবে।
(৫) সুদ-ঘুষের কুফল ও পরিণতি
সুদ ও ঘুষ অত্যন্ত জঘন্য অর্থনৈতিক অপরাধ। এর কুফল ও অপকারিতা অত্যন্ত ভয়াবহ।
সুদ মানবসমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যের জন্ম দেয়। ধনী আরও ধনী হয়। গরিব আরও গরিব হয়। ফলে সমাজের মধ্যে শ্রেণিভেদ গড়ে ওঠে। পারস্পরিক মায়া-মমতা, ভালোবাসা ও সহযোগিতার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
সুদের কারণে জাতীয় প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যাহত হয়। লোকেরা বিনিয়োগে উৎসাহী হয় না। বরং সম্পদ অনুৎপাদনশীলভাবে সুদি কারবারে লাগায়। ফলে দেশের বিনিয়োগ কমে যায়, জাতীয় উন্নতি বাধাগ্ৰস্ত হয়।
ঘুষও মানবসমাজে অশান্তি ডেকে আনে। ঘুষখোর ব্যক্তি নিজ দায়িত্ব কর্তব্যে অবহেলা করে, আমানতের খিয়ানত করে। নিজ ক্ষমতা ও দায়িত্বের অপব্যবহার করে।
ঘুষদাতা ও ঘুষখোর অন্য লোকের অধিকার হরণ করে। ফলে অধিকার বঞ্চিতদের সাথে তাদের শত্রুতা সৃষ্টি হয়। সমাজে মারামারি-হানাহানির সূত্রপাত ঘটে।
বস্তুত সুদ ও ঘুষের অপকারিতা অত্যন্ত মারাত্মক। এটি সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ডেকে আনে।
সুদ ও ঘুষের প্রভাবে মানুষ নৈতিক ও মানবিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। বরং অসৎ চরিত্র ও মন্দ অভ্যাসের চর্চা শুরু করে। মানুষের মধ্যে লোভ-লালসা, অপচয় ও পাপাচারের প্রসার ঘটে।
অনেক সময় সুদ-ঘুষের অতিরিক্ত অর্থের জন্য মানুষ নানা রূপ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। সন্ত্রাস, ছিনতাই, রাহাজানি, খুন ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
“যে সমাজে জিনা-ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়ে তার অধিবাসীরা দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে নিপতিত হয়। আর যে সমাজে ঘুষ লেনদেন প্রসার লাভ করে সে সমাজে ভীতি ও সন্ত্রাস সৃষ্টি হয়ে থাকে।”
(মুসনাদে আহমাদ)
আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে সুদ ও ঘুষের প্রভাব অত্যন্ত ক্ষতিকর। ধর্মীয় দিক থেকেও এর কুফল অত্যন্ত ব্যাপক। সুদ- ঘুষের মাধ্যমে উপার্জিত সম্পদ হারাম বা অবৈধ। আর হারাম কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়।
যার শরীর হারাম খাদ্যে গঠিত, যার পোশাক পরিচ্ছদ হারাম টাকায় অর্জিত এরূপ ব্যক্তির কোনো ইবাদত কবুল হয় না, এমনকি তার কোনো দোয়াও আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন না।
সুদ ও ঘুষের লেনদেনকারী যেমন মানুষের নিকট ঘৃণিত তেমনি সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সাঃ)-এর নিকটও ঘৃণিত। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সাঃ) সুদ ও ঘুষের লেনদেনকারীকে অভিসম্পাত করেন, লানত দেন।
একটি হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে,
“নবি করিম (সাঃ) সুদখোর, সুদ দাতা, সুদ চুক্তি লেখক ও সুদি লেনদেনের সাক্ষীকে অভিশাপ দিয়েছেন।”
(মুসলিম)
নবি করিম (সাঃ) অন্যত্র বলেছেন,
“ঘুষ প্রদানকারী ও ঘুষ গ্রহণকারী উভয়ের উপরই আল্লাহর অভিসম্পাত।”
(বুখারি ও মুসলিম)
সুদ ও ঘুষ লেনদেন করার পরিণতিও অত্যন্ত ভয়াবহ। এর ফলে মানুষ আল্লাহ তায়ালার শাস্তির যোগ্য হয়ে যায়। এমনকি অনেক সময় দুনিয়াতেও আল্লাহ তায়ালা তাদের পাকড়াও করেন।
মহানবি (সাঃ) বলেন,
“কোনো গ্রামে বা দেশে যখন জিনা ব্যভিচার ও সুদ ব্যাপকতা লাভ করে তখন সেখানকার অধিবাসীদের উপর আল্লাহর আযাব আসা অনিবার্য হয়ে পড়ে।”
(মুসতাদরাকে হাকিম)
পরকালে সুদ ও ঘুষের লেনদেনকারীর স্থান হবে জাহান্নাম। কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তি মহা শাস্তির সম্মুখীন হবে।
সুদখোরদের অবস্থার বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“যারা সুদ খায় তারা সে ব্যক্তির ন্যায় দণ্ডায়মান হবে যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে। এটা এজন্য যে তারা বলে, বেচা-কেনা তো সুদের মতোই।”
(সূরা বাকারা, আয়াত ২৭৫)
ঘুষখোরদের পরিণতি প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
“ঘুষদাতা ও ঘুষখোর উভয়ই জাহান্নামি।”
(তাবারানি)
অন্য হাদিসে রাসুল (সাঃ) ঘুষখোরদের অভিনব শাস্তির বিষয় বর্ণনা করেছেন।
হাদিস শরিফে এসেছে,
“আদ গোত্রের এক ব্যক্তিকে নবি করিম (সাঃ) যাকাত আদায়ের জন্য নিয়োগ করলেন। তার ডাকনাম ছিল ইবনুল লুতবিয়্যা। সে (যাকাত আদায় করে) ফিরে এসে মহানবি (সাঃ)-কে বলল, এই মাল আপনাদের আর এই মাল আমাকে উপঢৌকন দেওয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মিম্বারে দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণ প্রকাশ করার পর বলেন- যেসব পদের অভিভাবক আল্লাহ আমাকে করেছেন, তার মধ্য থেকে কোনো পদে আমি তোমাদের কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ করি। সে আমার কাছে ফিরে এসে বলে, এগুলো আপনাদের, আর এগুলো আমাকে উপঢৌকন দেওয়া হয়েছে। এ ব্যক্তি তার বাবা-মায়ের ঘরে বসে থাকে না কেন? যদি সে সত্যবাদী হয় তবে সেখানেই তো তার উপঢৌকন পৌঁছে দেওয়া হবে। আল্লাহর শপথ। তোমাদের কোনো ব্যক্তি অনধিকারে (বা অবৈধভাবে) কোনো কিছু গ্রহণ করলে, কিয়ামতের দিন সে তা বহন করতে করতে আল্লাহর সামনে হাজির হবে। অতএব আমি তোমাদের কাউকে আল্লাহর দরবারে এই অবস্থায় উপস্থিত হতে দেখতে চাই না যে, সে উট বহন করবে আর তা আওয়াজ করতে থাকবে অথবা গাভী (বহন করে নিয়ে আসবে আর তা) হাম্বা হাম্বা করতে থাকবে অথবা বকরি (বোঝা বহন করে নিয়ে আসবে আর তা) ভ্যা ভ্যা করতে থাকবে। অতঃপর তিনি তাঁর দু’হাত এত উপরে উঠালেন যে, তাঁর বগলের শুভ্রতা দৃষ্টিগোচর হলো। তিনি বলেন, হে আল্লাহ! আমি কি (তোমার হুকুম) পৌঁছে দিয়েছি? তিনবার তিনি এ কথা বলেন।”
(বুখারি ও মুসলিম)
(৬) ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ-ঘুষের বিধান
ইসলামে সুদ ও ঘুষকে স্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এগুলো অবৈধ, কোনো অবস্থাতেই সুদ-ঘুষের লেনদেন বৈধ নয় ৷
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন,
“আর আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।”
(সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৭৫)
অন্য আয়াতে এসেছে,
“হে ইমানদারগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় কর। তাহলে তোমরা সফলকাম হতে পারবে।”
(সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৩০)
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন,
“হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর ও সুদের যা বকেয়া আছে তা ত্যাগ কর, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক।”
(সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৭৮)
ঘুষের আদান প্রদানও হারাম বা অবৈধ।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“তোমরা পরস্পরের ধনসম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিয়দংশ অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে জেনেশুনে বিচারকদের নিকট পেশ করো না।”
(সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৮৮)
সুদ ও ঘুষ সর্বাবস্থায় হারাম। তা গ্রহণ করা যেমন হারাম তেমনি দেওয়াও হারাম। তেমনিভাবে সুদ দেওয়া ও সুদ নেওয়া উভয়টিই সমান অপরাধ। এমনকি সুদের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকাও অপরাধ। রাসুল (সাঃ) সুদি কারবারে বা সুদি লেনদেনে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তিকে অভিশাপ দিয়েছেন।
বস্তুত সুদ ও ঘুষ খুবই জঘন্য অপরাধ। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বহু হাদিসে মানুষকে এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন।
সুদ ও ঘুষের লেনদেন অত্যন্ত গর্হিত কাজ। নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ এরূপ কাজ কখনোই করতে পারে না।
আমরাও জীবনের সর্বাবস্থায় সুদ ও ঘুষের লেনদেন থেকে বিরত থাকব।
পবিত্র ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট ইসলাম’ (inbangla.net/islam) এর সাথেই থাকুন।