এ পাঠ অধ্যয়নে আপনি- সুফি কারা, তা জানতে পারবেন। হযরত শেখ বাহাউদ্দিন নকশাবন্দি (র) এর জীবনাদর্শের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা জানতে পারবেন; হযরত খাজা মুইনউদ্দিন চিশতি (র) এর জীবনাদর্শের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা জানতে পারবেন; হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দি (র) এর জীবনাদর্শের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা জানতে পারবেন। হযরত হাসান আল-বসরি (র) এর জীবনাদর্শের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা জানতে পারবেন। হযরত আব্দুল কাদির জিলানি (র) জীবনাদর্শের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা জানতে পারবেন।
(১) সুফি কারা?
‘সুফ’ অর্থ পশম আর ‘তাসাওউফ’ এর অর্থ পশমী বস্ত্রে পরিধানের অভ্যাস (লাবসুস–সুফ)। অতঃপর মরমীতত্ত্বের সাধনায় কারও জীবনকে নিয়োজিত করার কাজকে বলা হয় তাসাওউফ। যিনি নিজেকে এইরূপ সাধনায় সমর্পিত করেন তিনি সুফি নামে অভিহিত হন।
যদিও অনেকে এটিকে ইসলামের অংশ বলে মনে করেন, কিন্তু বাস্তবে প্রচলিত ‘সুফিবাদ’ ও ‘তাসাইউ সাধনা’ কোন ইসলামের পরিভাষায় নয়, এটি কুরআন ও সুন্নাহর বাহিরে গিয়ে মানুষ সৃষ্ট নতুন মতবাদ।
সুফিবাদকে তাসাওউফ বলা হয়, যার অর্থ আধ্যাত্মিক তত্ত্বজ্ঞান। বলা হয়ে থাকে, আত্মা-সম্পর্কিত আলোচনা এর মুখ্য বিষয়। সুফিবাদ কোন একটি ইসলামি আধ্যাত্মিক দর্শন নয়। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে আল্লাহর নবি মুহাম্মদ (সা.) এর শিখানে পদ্ধতি, নির্দেশনা ও তার জীবনাদর্শকে উপেক্ষা করে, আত্মার পরিশুদ্ধি হাসিলের উদ্দেশ্যে, ইসলামে খোলসে সৃষ্ট নতুন পদ্ধতি বা মতবাদই হলো সুফিবাদ বা তাসাউফ।
সুফিবাদীধারায় বিকশিত হয় প্রধান চারটি তরিকা-
- আবদুল কাদির জিলানি (রহ.) প্রতিষ্ঠিত কাদেরিয়া তরিকা,
- সুলতানুল হিন্দ খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি প্রতিষ্ঠিত চিশতিয়া তরিকা,
- খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দি প্রতিষ্ঠিত নক্শবন্দিয়া তরিকা,
- শেখ আহমদ মুজাদ্দিদ-ই-আলফি সানি সারহিন্দি প্রতিষ্ঠিত মুজাদ্দিদিয়া তরিকা।
(২) সুফিদের জীবনাদর্শ
ক) হযরত শেখ বাহাউদ্দিন নকশাবন্দি (র)
জন্ম ও পরিচয়
হযরত শেখ বাহাউদ্দিন মুহাম্মদ নকশাবন্দি (র) ছিলেন নবম হিজরি শতকের একজন মহান সাধক।
তিনি বুখাবার সন্নিকটে ‘কাসরে আরেফান’ নামক স্থানে ৭১৮ হিজরি সনের মুহাররাম মাসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল হযরত জালালুদ্দিন (র) হযরত শেখ বাহাউদ্দিন মুহাম্মদ নক্শবন্দী (র.) শৈশবকাল হতেই হযরত মুহাম্মদ সামমাসী (র) এর সাহচর্যে আসেন। বাল্যকাল হতেই তাঁর চরিত্র-আদর্শে আধ্যাত্মিকতার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যাচ্ছিল। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় তাঁর জীবন যাপন ছিল অতি সাদামাটা।
শিক্ষা-দীক্ষা
১৮ বছর বয়সে তিনি বাবা মুহাম্মদ সামমাসির নিকট হতে সূফি তরিকার শিক্ষা লাভ করেন। সামমাসির ইন্তেকালের পর বাহাউদ্দিন বুখরায় ফিরে যান। এরপর তিনি নাফাস গমন করে আস-সামমানির বিখ্যাত শিষ্য আমির কুলানের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর আবার বুখারায় ফিরে আসেন এবং আমির কুলানের বিখ্যাত শিষ্য আরিফ আদ্-দাদীক কিরানির নিকট সুফিবাদের শিক্ষা গ্রহণ করেন। এখানে তিনি দীর্ঘ সাত বছর শিক্ষা গ্রহণ করেন।
নকশাবন্দিয়া সিলসিলার তরিকা
হযরত শেখ বাহাউদ্দিন মুহাম্মদ নকশাবন্দি(র) ছিলেন হানাফি মাযহাবের অনুসারী এবং ‘নকশাবন্দিয়া’ তরীকার প্রতিষ্ঠাতা ও ইমাম। ‘নকশবন্দ’ অর্থ চিত্রকর। তিনি নকশা বন্দি তরিকার মাধ্যমে তাঁর মুরিদানদের কলবের মধ্যে আল্লাহ পাকের নকশা বা চিত্র অংকন করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এজন্য তিনি নকশাবন্দি উপাধি লাভ করেন। তা ছাড়া তিনি ও তাঁর সুযোগ্য খলিফাগণের প্রচেষ্টায় এ সিলসিলার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার ও প্রসার লাভ করে। এজন্যও তাঁকে নকশাবন্দিয়া বলা হয়ে থাকে। তরিকার দিক থেকে তিনি ওয়াস করনির অনুসারী ছিলেন।
মৃত্যু
হযরত শেখ বাহাউদ্দিন মুহাম্মদ নক্শবন্দী (র) একবার হজ্জ পালনের জন্য গিয়েছিলেন। ঈদুল আযহার দিনে সকল হজ্জ যাত্রী পশু কোরবানি দিলেন। তিনি কোন পশু কোরবানি না দিয়ে বলেন, আমি আজ আমার ছোট ছেলেকে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি দিলাম। পরে জানা যায় যে, তার সাহেবজাদা ঐ ঈদের দিনই ইন্তেকাল করেছিলেন।
এ মহান সূফি সাধক ৭৯১ হিজরি রবিউল আউয়াল মাসের ৩ তারিখ ইন্তেকাল গমন করেন। তাঁকে কাসবে আরেফানে দাফন করা হয়।
খ) হযরত খাজা মঈিনউদ্দিন চিশতি (র)
জন্ম ও পরিচয়
হযরত খাজা মুইনউদ্দিন চিশতি (র) ইরানের সানজার নামক গ্রামে ৫৩৭ হিজরি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম গিয়াসউদ্দিন (র)। মাতার নাম উম্মুল ওয়ারাহ। পিতৃ কুলের দিক দিয়ে তিনি ইমাম হোসাইন (রা) এবং মাতৃকূলের দিক দিয়ে ইমাম হাসান (রা) -এর বংশধর। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতিয়া তরিকায় দীক্ষা গ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব করার কারণে তাঁর নামের শেষে চিশতি শব্দটি যুক্ত করা হয়েছে। চিশতি একটি গ্রামের নাম। এই গ্রামে তাঁর সপ্তম উর্ধ্বতন পীর খাজা ইসহাক চিশতি (র) বসবাস করতেন। এজন্য তাঁর প্রচারিত তরিকাকে চিশতিয়া তরিকা বলা হয়।
খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির (র) বাবা একজন আল্লাহ ভক্ত এবং বিত্তশালী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সর্বদা কুরআন ও হাদিসের বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনার চেষ্টা করতেন। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতিও বাল্যকালে অত্যন্ত যত্ন ও স্নেহের সাথে প্রতিপালিত হয়েছিলেন। একজন পরিপূর্ণ মানুষের অতি উন্নত চরিত্রের গুণাবলি ফুটে উঠেছে তাঁর মধ্যে। এজন্য তিনি ‘আফতাবে হিন্দ’(ভারতের সূর্য) ‘সুলতানুল হিন্দ’ (ভারতের আধ্যাত্মিক বাদশাহ) এবং ‘গরীবে নেওয়াজ’ (গরিব দরদী) ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।
বাল্যকাল
হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (র) এর বয়স যখন সাত বছরে উপনীত হয়েছিলেন, তখন হতেই তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিয়মিত আদায় করতেন। শুধু নামায আদায় করেই ক্ষান্ত হতেন না, এ শিশু বয়সে তিনি নিয়মিত রোযা রাখতেন ও যিকিরের মজলিসে যোগ দিতেন। কথিত আছে যে, তিনি যখন নয় বছর বয়সে উপনীত হন, তখন তিনি অর্থসহ কুরআন শরীফ হিফয করেন। এরপর তিনি তাফসির, হাদিস, ফিক্হ ও ইল্মে তাসাউফের জ্ঞান অর্জন করেন।
শিক্ষা-দীক্ষা
১৫ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। এর কিছু দিন পর তাঁর মাও ইন্তেকাল করেন। অতঃপর তিনি বুখারা গমন করেন এবং মাওলানা শরফুদ্দীন ও মাওলানা হাসান উদ্দিনের শীষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ২২ বছর বয়সে তিনি বুখারা ত্যাগ করে জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র বাগদাদ গমন করেন। সেখানে তিনি বড়পীর হযরত আব্দুল কাদির জিলানি (র) -এর সান্নিধ্য লাভ করেন। আবদুল কাদির জিলানি (র) তাঁকে শরী‘আত, মারিফত, তরিকত ও হাকিকতের বাতিনী ইল্ম শিক্ষা প্রদান করেন। অলী-দরবেশগণের সাহচার্য লাভের জন্য তিনি সিরিয়া, কিরমান, হামাদান, তাবরিজ, আস্তারাবাদ, আরাকান, হিরাত, বলখ প্রভৃতি স্থান ভ্রমণ করেন। তিনি মক্কা ও মদীনা ভ্রমণ করেন।
অবদান
বিখ্যাত অলী ও পীর হযরত উসমান হারূনী (র.) -এর নির্দেশনায় সর্বশেষে তিনি ভারতবর্ষে আগমন করেন। তখন ভারতবর্ষের সর্বত্র কুফর ও শিরকে পরিপূর্ণ ছিল। সেখানে তখন অত্যাচারী শাসকদের শাসন চলছিল। তাই দ্বীন প্রচারের শপথ নিয়ে তিনি প্রথমেই দিল্লিতে উপস্থিত হন। সেখান থেকে তিনি আজমির শরীফ গমন করেন। সেখানে তিনি মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে তিনি ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর হিদায়াতি বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে দলে দলে অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করে।
কিন্তু সেখানকার হিন্দুরাজ রাজ্য হারানোর ভয়ে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি ও তাঁর অনুসারীদের ওপর নানাভাবে অত্যাচারনির্যাতন শুরু করে। কিন্তু খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির কারামতের কাছে রাষ্ট্রপক্ষের কোন কৌশলই সফল হয়নি। বরং দিনদিন তাঁর অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ঐতিহাসিকদের মতে, খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির প্রচেষ্টায় ভারত বর্ষে কিছু দিনের মধ্য ৯০ লক্ষাধিক লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এর পর তিনি স্বাধীনভাবে ইসলাম প্রচার শুরু করেন এবং লাখ লাখ লোক ইসলাম ধর্মে দীক্ষা লাভ করেন।
গ্রন্থ রচনা
তাঁর রচিত উল্লেখ্যযোগ্য গ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে (১) আনীসুল আরওয়াহ (২) গাঞ্জুল আসরার (৩) হাদিসুল মাআরিফ (৪) রিসালায়ে অযুদিয়া (৫) দিওয়ানে খাজা (৬) রিসালায়ে দর কাসবে লাফুস ইত্যাদি।
হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রা) ছিলেন উত্তম চরিত্রগুণে গুণান্বিত। গরিব-দুঃখীদের তিনি অত্যন্ত ভালোবাসতেন। অসহায়, আশ্রয়হীন ও দরিদ্র মানুষ তাঁর দরবারে অবস্থান করত। লক্ষ লক্ষ অমুসলিম তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তা কোন যুদ্ধের ফলে নয় ; বরং তাঁর চরিত্র মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে।
মৃত্যু
এই মহান অলী হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (র) ৬৩৩ হি: (১১৩৬ খ্রি) ইন্তেকাল করেন। ভারতের আজমিরে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
গ) হযরত শাইখ আহমদ সিরহিন্দি (র)
জন্ম ও পরিচয়
হযরত শাইখ আহমদ সিরহিন্দি (র.) ছিলেন এ উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ আলিম, বিখ্যাত ধর্মীয় নেতা, বিশ্ববিখ্যাত সংস্কারক ও সাধক। তাঁর নিষ্ঠা, সাহসিকতা এবং আত্মত্যাগের জন্য তিনি ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন।
তাঁর প্রকৃত নাম আবুল বারাকাত বদরুদ্দীন। পিতার নাম শাইখ আহমদ আহাদ। তিনি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা) -এর ২৮তম অধস্তন বংশধর ছিলেন। ভারতের পূর্ব পাঞ্জাব এলাকার সিরহিন্দ নামক স্থানে ১৪ শাওয়াল ৯৭১ হিজরি মোতাবেক ২৬ মে ১৫৬৪ খ্রি. শুক্রবার দিন তিনি জন্ম লাভ করেন।
শিক্ষা-দীক্ষা
শিশু বয়সেই তিনি পবিত্র কুরআন হিফয করেন। তাঁর পিতা একজন বিখ্যাত আলিম ও বুযুর্গ ছিলেন। পিতার কাছেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। অতঃপর স্থানীয় মাদরাসার শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি ১০ বছর বয়সে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য কানপুর গমন করেন। তিনি সেখানে দশ বছর অবস্থান করে বিখ্যাত আলিমগণের নিকট হতে কুরআন, হাদিস, তাফসির, ফিক্হ, সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন ইত্যাদি শাস্ত্রে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ইসলামের একজন খ্যাতনামা পন্ডিত হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
মাত্র ১৭ বৎসর বয়সে তিনি কানপুর মাদ্রাসায় অধ্যাপনা শুরু করেন। তাঁর নিকট শিক্ষা লাভের জন্য দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য জ্ঞান পিপাসু আসতে থাকে।
গ্রন্থ রচনা
তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে (১) মায়ারিফ-ই-লাদ্দুনিয়্যা (২) রিসালা-ই-মাবদা ওয়া মাআদ (৩) মুকাশিফাত-ইগায়রিয়া (৪) শরহি রুবাইয়াত (৫) রিসালায়ে রদ্দে রাওয়াফিয (৬) মাকতুবাত শরীফ ইত্যাদি।
ধর্মীয় সংস্কার সাধন
তাঁর সময়ে উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে শিরক, বিদআত ও নানারূপ কুসংস্কারের প্রচলন ঘটেছিল। তখন মুসলিম শাসকগণ স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিয়ে দেশ চালাতেন। তারা দেশে ইসলাম পরিপন্থী নানা রূপ রীতিনীতি চালু করেছিলেন। শায়খ আহমদ সিরহিন্দি এসব দেখে চুপচাপ বসে থাকতে পারেন নি। তিনি দেশে প্রচলিত কুসংস্কারের অসারতা প্রমাণ করে প্রকৃত ইসলাম প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে এ ভূখন্ডে প্রকৃত ইসলাম স্থায়িত্ব লাভ করে।
সে সময় ইসলামের প্রচার ও প্রসারের কাজ মোটেও সহজ ছিল না। স¤্রাট আকবর কর্তৃক প্রচারিত দ্বীন-ই-ইলাহির বিরোধিতা করায় দীর্ঘদিন তাঁকে কারাগারে নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। এত নির্যাতনের মধ্যেও তিনি থেমে যাননি। বরং তিনি সংস্কারমূলক কাজ চালিয়ে যান। তখন গোয়ালিয়রের কারাগারে যত বন্দী রাখা ছিল তারা সবাই শাইখ আহমদ সিরহিন্দির ভক্ত ও অনুরক্ত হয়ে গিয়েছিলো। এভাবে কারাগারে থাকতেই ইসলামের এক বিরাট বিপ্লব সৃষ্টি হলো।
আধ্যাত্মিক সাধনা
শাইখ আহমদ সিরহিন্দির ছিলেন মূলত একজন সংগ্রামী সমাজ সংস্কারক। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম করে গেছেন। পাশাপাশি তিনি আধ্যাত্মিক সাধকও ছিলেন। শরী‘আতের শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি তাঁর পিতার নিকট আধ্যাত্মিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর তিনি দিল্লির বিখ্যাত পীর হযরত বাকী বিল্লাহর নিকট মুরিদ হন। তিনি তাঁর তরিকায় দীক্ষা গ্রহণ করেন।
মৃত্যুর পূর্বে তিনি খাদেমদেরকে বলেন, “তোমরা আমার জন্য অনেক কষ্ট ও পরিশ্রম করেছ। শুধু আজকের রাতটা আরও একটু কষ্ট স্বীকার কর। এরপর হয়ত আর করতে হবে না।” শেষ রাতে উঠে উযু করে তাহাজ্জুদের নামায আদায় করে বিছানায় বসেই বলেন, “এটাই আমার শেষ তাহাজ্জুদের নামায পড়া হলো; হয়তো আর জীবনে কখনো ঘটবে না।” সেদিন ফজরের নামায জামায়াতে আদায় করে মোরাকাবা-মোশাহাদায় বসলেন এবং জীবনের শেষ নামায সেদিনই পড়েছিলেন।
মৃত্যু
বাংলাদেশ-পাক-ভারতের একজন সাধক, সংস্কারক ও সংগ্রামী আলিম ৬৩ বছর বয়সে ২৮ সফল ১০৩৪ হিজরি মোতাবেক ৩০ নভেম্বর ১৬২৪ খ্রি. বুধবার সিরহিন্দে ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশ এক মহান সাধক হারালো।
ঘ) হযরত হাসান আল-বসরী (র)
জন্ম ও পরিচয়
হযরত হাসান আল-বসরী (র) একজন প্রখ্যাত তাবেঈ ছিলেন। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের একজন বিখ্যাত জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব। তিনি অত্যন্ত মুত্তাকী ও আল্লাহ প্রেমিক ছিলেন। আধ্যাত্মিক গুণে বিশেষভাবে গুণান্বিত ছিলেন।
হযরত হাসান আল বসরী (র) ২১ হিজরি মোতাবেক ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে মদিনা মুনাওয়ারায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম আবু সাইদ। পিতার নাম ইয়ামার। মাতার নাম খায়েরাহ, যিনি উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামার সেবিকা ছিলেন। হাসান বসরী মায়ের সাহচর্যে বড় হতে থাকেন। হাসান বসরীর জন্মের সময় হযরত উমর (রা) খলিফা ছিলেন। জন্মের পর ‘তাহনিক’ করার জন্য হযরত উমর (রা) এর নিকট নিয়ে যাওয়া হলে তিনি তাঁকে তাহনিক করে বলেন, ‘বাহঃ শিশুটি কি সুন্দর’! খলিফার ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর নাম রাখেন ‘হাসান’। হাসান শব্দের অর্থ সুন্দর।
হযরত হাসান বসরীর মা খায়েরাহ উম্মুল মু‘মিনিন হযরত উম্মে সালমা (র) এর সেবিকা ছিলেন। হাসান বসরীকে উম্মে সালামা (র) -এর ঘরে রেখে বিভিন্ন কাজ করতেন। হাসান বসরী যখন ক্ষুধার কারণে কেঁদে ওঠতেন, তখন উম্মে সালামা (র) তাকে কোলে তুলে নিতেন এবং দুধ পান করাতেন।
শিক্ষা-দীক্ষা
হযরত হাসান বসরী ১৪ বৎসর বয়স পর্যন্ত উম্মে সালামার (রা) সাহচর্যে বেড়ে ওঠেন। তারপর তিনি পিতার সাথে বসরায় চলে যান। সেখানেই তিনি বসতি স্থাপন করেন। এ কারণে তাঁকে ‘বসরী’ বলা হয়। শৈশবে তিনি কুরআন হিফয করেন। তিনি অসংখ্য সাহাবির সাহচার্য লাভ করেন। সাহাবায়ে কিরামের নিকট হতে কুরআন, হাদিস, ফিকহ ইত্যাদিতে দক্ষতা অর্জন করেন। মদীনার বাইরেও তিনি বসরার সমকালীন শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস ও ফকিহদের নিকট জ্ঞানার্জন করেন। হাসান বসরী (র) অনেক সাহাবিসহ হযরত আলী (রা) -এর নিকট নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। তাঁদের নিকট থেকে তিনি ইল্মে তাসাউফের দীক্ষা লাভ করেন। এভাবে তিনি জ্ঞান ও কর্ম, মহত্ত্ব ও পূর্ণতা, তাকওয়া, খোদাভীরুতা ও আধ্যাত্মিক গুণাবলিতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠেন। ইবনে সা‘দ (র) লিখছেন, ‘হাসান বসরী (র) ছিলেন বহু পূর্ণতার অধিকারী, উচুঁ স্তরের আলিম, সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারি ব্যক্তি। ভুল-ভ্রান্তি থেকে মুক্ত ফকীহ, পার্থিব ভোগ বিলাসের প্রতি নির্মোহ, আবিদ, অগাধ জ্ঞানের অধিকারী, স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল ভাষী সুদর্শন এক পুরুষ।’
অবদান
হাসান বসরী সম্পর্কে ইমাম আয-যাহাবী (র) লিখেছেন, ‘তিনি মহাজ্ঞানী ও জ্ঞানের সাগর ছিলেন। সাহবীদের মধ্যে হতে তিনি হযরত উসমান, হযরত আলী, হযরত আবু মুসা আল-আশ‘আরি, আবদুল্লাহ ইবনে উমর, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আমর ইবনুল আস, আনাস ইবনে মালিক, জাবির ইবনে মুয়ারিয়া, মাকাল ইবনে ইয়াসার, আবু বাকরা, সামুরা ইবনে জুনদুব, মুগীরা ইবনে শুবা (রা) প্রমুখ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের নিকট থেকে হাদিসের জ্ঞান অর্জন করেন।
হাসান বসরী সম্পর্কে আল্লামা নবুবী (র) বলেন, ‘তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত আলিম। কেউ কেউ তাকে সূফি তরিকার তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করেন।’
ইমাম শা‘বী বলতেন, ‘আমি এই দেশে (ইরাকে) অন্য কাউকে তাঁর চেয়ে ভালো পাইনি।’
হযরত কাতাদা (র) মানুষকে এই বলে উপদেশ দিতেন যে, ‘তোমরা হাসান বসরির অনুসরণ করবে।’
ইমাম আল গাযালি (র) বলেছেন, ‘মানুষের মধ্যে হাসান আল বসরী (র) ছিলেন কথার দিক দিয়ে নবীদের কথার সাথে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ ব্যক্তি। হিদয়াতের দিক দিয়ে সাহাবিদের অধিক নিকটবর্তী। তাছাড়া ভাষার শুদ্ধতা ও স্পষ্ট উচ্চারণে তিনি ছিলেন একজন চূড়ান্ত পর্যায়ের মানুষ।’
হযরত হাসান বসরী (র) নিজকে খুবই ছোট মনে করতেন। তিনি সাহাবিদের মতো বিনয়ী জীবন যাপন করতেন। অহেতুক ও বাজে কথা তিনি কখনো বলতেন না। তাঁর যাবতীয় কথা হতো জ্ঞান-মূলক ও উপদেশমূলক। তিনি বিশুদ্ধ সাবলিল ও প্রাঞ্জল ভাষায় কথা বলতেন। তিনি অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে কথা বলতেন। তিনি হাজ্জাজ বিন ইউসুফের বিভিন্ন অপকর্মের জোরালো প্রতিবাদ করে সাহসকিতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
হাসান বসরী বলতেন, ‘যে ব্যক্তি তার বিনয়ীভাবের জন্য পশমের মোটা পোশাক পরে, আল্লাহ তার দৃষ্টি ও অন্তরের আলো বাড়িয়ে দেন। আর যে ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশে পরে, তাকে খোদাদ্রোহীদের সাথে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ এমনিভাবে বিভিন্ন উক্তির মাধ্যমে লোকদেরকে তিনি সংযত করার পাশাপাশি আল্লাহ প্রেমে উদ্বুদ্ধ করতেন। হাসান বসরীর (র) চেষ্টায় বসরা, কুফা, বাগদাদ সহ বিভিন্ন অঞ্চলে ইলমে তাসাউফের প্রচার ও প্রসার লাভ করে। এজন্য তাঁকে সূফিবাদের শাস্ত্রীয় ও তাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।
তাঁর শিষ্য হিসেবে রাবেয়া বসরী (র), হাবিব আযমিসহ অনেক উঁচু স্তরের অলি ছিলেন। তিনি আবদুল ওয়াজিদ বিন যায়েদ (র) কে খিলাফত প্রদান করেছিলেন।
মৃত্যু
হাসান বসরী (র) ৮৮ বছর জীবিত ছিলেন। তিনি ১১০ হিজরি মোতাবেক ৭২৮ খ্রি. জুমুআর রাতে ইন্তেকাল করেন।
(৫) হযরত আবদুল কাদির জিলানি (র)
জন্ম ও পরিচয়
হযরত আবদুল কাদির জিলানি ৪৭০ হিজরি মোতাবেক ১০৭৭ খ্রি. ইরানের জিলান শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। জন্মস্থানের নামানুসারে তাঁকে জিলানি বলা হয়। তাঁর উপনাম আবু সালেহ, উপাধী মাহবুবে সুবহানি (আল্লাহর প্রিয়), কুতুবে রব্বানি (প্রতি পালকের দলের নেতা)। পিতার নাম আবু সালেহ মুসা, মাতার নাম সাইয়্যেদা উম্মুল খায়ের ফাতিমা। আবদুল কাদির জিলানি পিতার দিক দিয়ে হযরত হোসাইন (রা) -এর বংশধর এবং মাতার দিক থকে ইমাম হোসাইন (রা) -এর বংশধর ছিলেন। এজন্য হযরত আবদুল কাদির জিলানিকে ‘আওলাদে রসূল’ বলে গণ্য করা হয়।
শিক্ষা-দীক্ষা
বাল্যকাল থেকে আবদুল কাদির জিলানি (র) পড়াশুনার প্রতি খুব মনোযোগী ছিলেন। অল্প বয়সে তার পিতা ইন্তেকাল করেন। তাঁর মা তাঁর প্রয়োজনীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। তাঁর মাতা অত্যন্ত পরহেযগার ছিলেন এবং সময় সুযোগ পেলেই কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করে সময় কাটাতেন। আবদুল কাদির জিলানি (র) তখন মায়ের কাছে বসে তা শুনতেন। মায়ের কুরআন তিলাওয়াত শুনেই তিনি পাঁচ বছর বয়সে পবিত্র কুরআন শরীফের আঠারো পারা মুখস্থ করে ফেলেন। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র বাগদাদ গমন করেন। সেখানে তিনি নিযামিয়া বিশ্ববিদ্যায়ে ভর্তি হন। সেখান থেকেই তিনি তাফসির, হাদিস, ফিক্হ, উসূল, ধর্মতত্ত্ব, তর্কশাস্ত্র, ইতিহাস ও দর্শনে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। বয়সের দিক দিয়ে কম হলেও পড়াশুনায় ছিলেন খুবই মনোযোগী। তাই অল্প দিনের মধ্যেই তিনি অনেক কিছু শিখে ফেলেন। আরবি ভাষায় তিনি দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। আরবিতে সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখতে পারতেন। বাগদাদে শিক্ষা গ্রহণকালে তিনি কষ্ট স্বীকার করেন। খেয়ে না খেয়ে তিনি লেখা পড়া করেছেন। এ অদম্য ইচ্ছার কারণেই তিনি জগত বিখ্যাত জ্ঞানী হতে পেরেছিলেন।
গ্রন্থ রচনা
আবদুল কাদির জিলানি (র) শুধু ইলমে শরী‘আত ও মারিফাতের পন্ডিত ছিলেন না ; বরং তিনি কাব্য, দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি শাস্ত্রে সুপন্ডিত ছিলেন। তাঁর প্রণীত কিতাবের মধ্যে রুতুহুল গায়েব, গুনিয়াতুত তালেবিন, ফাতহুর রব্বানী, কাসীদায়ে গাওসিয়া, হিযবু বাশারিল খাইরাত, জালালুল খাতির, আল-মাওয়াহিবুর রহমানিয়া, বাহ্জাতুল আস্রাত।
সত্যবাদিতার দৃষ্টান্ত স্থাপন
আবদুল কাদির জিলানি (র) যখন উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশে বাগদান গমন করেন, তখন তাঁর মা তাঁকে ৪০টি স্বর্ণমুদ্রা জামার আস্তিনের মধ্যে সেলাই করে দিয়েছিলন। আর মিথ্যা না বলার উপদেশ দিয়েছিলেন। মায়ের উপদেশ তিনি মনে প্রাণে গ্রহণ করেছিলেন। বাগদাদ যাওয়ার সময় তাঁর কাফেলা ডাকাতের কবলে পড়েছিল। ডাকাতরা যাত্রীদের সব কিছু লুটে নেয়। অতঃপর ডাকাতরা আবদুল কাদির জিলানির (র) নিকট কিছু আছে কিনা জানত চাইলে তাঁর নিকট ৪০টি স্বর্ণমুদ্রা রয়েছে বলে জানান। জামার আস্তিনের মধ্যে লুকানো স্বর্ণ-মুদ্রা দেখে ডাকাতরা সত্য কথা বলার কারণ জানতে চাইলেন। আবদুল কাদির জিলানি বললেন, ‘আমার মা আমাকে সর্বাবস্থায় সত্যকথা বলা ও মিথ্যা হতে বিরত থাকতে উপদেশ দিয়েছেন। একারণেই আমি সত্য বলেছি। ডাকাত দল তাঁর এ সত্যবাদিতা ও সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে তাওবা করে খাঁটি মুসলমান হয়ে যান।
স্বভাব ও চারিত্রিক গুণাবলি
আবদুল কাদির জিলানি (র.) সাধারণ মানুষ থেকে ব্যতিক্রমী একজন মহান সাধক ও জ্ঞান তাপস ছিলেন। শৈশব কাল থেকেই তাঁর চারিত্রিক গুণাবলির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হতে থাকে। বর্ণিত আছে যে, দুগ্ধ পোষ্য অবস্থায় তিনি রমযান মাসে দিনের বেলায় মাতৃদুগ্ধ পান হতে বিরত থাকতেন। তাঁর মাতা তাঁকে দুগ্ধ পান করাতে গেলে তিনি মুখ ফিরিয়ে নিতেন। নিষিদ্ধ ৫ দিন ব্যতীত সারা বছর তিনি রোযা পালন করতেন। এর মধ্য দিয়েই তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। আবদুল কাদির জিলানি (র) অত্যন্ত মানব দরদি ছিলেন। গরিব-দুঃখীদের তিনি অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং সাহায্য করতেন। তাঁর ছাত্র জীবনে বাগদাদে অনটন দেখা দিয়েছিল। তিনি তাঁর নিকট থাকা স্বর্ণমুদ্রা হতে অভাবীদেরকে সাহায্য করেছিলেন এবং নিজে না খেয়ে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন।
আবদুল কাদির জিলানি (র) শরী‘আতের জ্ঞানার্জনের পর মারিফাতের (আধ্যাত্মিক) জ্ঞান লাভের জন্য বাগদাদের বিখ্যাত সূফি-দরবেশগণের দরবারে যাতায়াত শুরু করেন। আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য তিনি ২৫ বছর লোক চক্ষুর অন্তরালে ছিলেন। ৫২১ হিজরির শেষ ভাগে তিনি পুনরায় লোকালয়ে ফিরে আসেন এবং দ্বীন প্রচার শুরু করেন।
কাদিরিয়া তরিকা প্রতিষ্ঠা
আবদুল কাদির জিলানি (র) -এর নামে সূফিদের একটি তরিকা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর নাম ‘তরিকায়ে কাদিরিয়া’। এ তরিকায় ইলমে শরী‘আত ও ইলমে তাসাউফে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। হযরত আবদুল কাদির জিলানি (র.) এ তরিকার ইমাম। আমাদের দেশে তিনি ‘বড়পীর’ হিসেবে পরিচিত। অনেকে তাঁকে ‘গাউসুল আযম’ও (মহান সাহায্যকারী) বলে থাকেন।
মৃত্যু
আবদুল কাদির জিলানি ৯০ বৎসর বয়সে ৫৬১ হিজরি সালের ১১ই রবিউস সানি ইন্তেকাল করেন।
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা সুফি কারা এবং পাঁচ জন সুফির জীবনাদর্শ সম্পর্কে জানলাম।
হযরত শেখ বাহাউদ্দিন নকশাবন্দি (র) ছিলেন নবম হিজরি শতকের মুজাদ্দিদ। তিনি ছিলেন হানাফি মাযহাবের অনুসারী এবং নকশাবন্দিয়া তরিকার ইমাম ও প্রতিষ্ঠাতা।
ইরানের সীস্তান অঞ্চলের সানজার গ্রামে বিশ্ববিখ্যাত কামিল ওলি হযরত মুঈনুদ্দীন হাসান চিশতি (র) ৫৩৭ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁকে আফতাবে হিন্দ (ভারত সূর্য), সুলতানুল হিন্দ (ভারতের আধ্যাত্মিক সম্রাট), গরিব নওয়ায (গরিব দরদী) ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
হযরত শাইখ আহমদ সিরহিন্দি (র) ছিলেন এ উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় নেতা, বিশ্ববিখ্যাত সংস্কারক, সাধক, আলিম। শাইখ আহমদ মুজাদ্দিদে আলফে সানী বা ‘দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সংস্কারক’ তাঁর উপাধি।
ইমাম হাসান বসরী (র) একজন প্রখ্যাত তাবেঈ ও জ্ঞান সাধক ছিলেন। তিনি ছিলেন আল্লাহর প্রেমিক মহামণীষী। তাঁর অবদান যেমন ছিলো ইলমে শরী‘আতে, তেমনি ছিলো ইলমে মা‘রিফাতে। নির্লোভ-নির্মোহ মানবদরদী ও মানবতার বন্ধু ছিলেন তিনি।
আরেকজন মহাজ্ঞানী ও মহাপন্ডিত ছিলেন আব্দুল কাদির জিলানি (র)। যিনি ছিলেন শরী‘আত ও মা‘রিফাতের জ্ঞানের মোহনা। তাঁর প্রতিষ্ঠিত তরিকার নাম কাদিরিয়া তরিকা। তিনি ছিলেন বড় পীর বা মহান শিক্ষক। তিনিও ছিলেন উন্নত মানবিক চরিত্রের অধিকারী মানবতার বন্ধু।
তাঁরা সবাই ছিলো মানবদরদী, আধ্যাত্মিক সাধক ও ধর্মীয় নেতা।
পবিত্র ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট ইসলাম’ (inbangla.net/islam) এর সাথেই থাকুন।