(১) সূরাতুল নাস এর পরিচয়
কুরআন মাজিদের সর্বশেষ সূরা হলো সূরা আন-নাস। এই সুরাটি কুরআন মাজিদের ১১৪ তম সূরা। সুরাটি সপ্তম হিজরিতে মদিনায় অবতীর্ণ হয়েছে। সূরা আন-নাস এর আয়াত সংখ্যা ৬টি।
সূরাতুল নাসে ‘আন-নাস’ শব্দটি মোট পাঁচবার ব্যবহত হয়েছে। এটির নামকরণ করা হয়েছে সূরায় ব্যবহৃত ‘আন-নাস’ শব্দ দ্বারা। অভিশপ্ত ও বিতাড়িত শয়তানের অনিষ্ট থেকে কীভাবে বাঁচা যাবে তা-ই সূরাতুল নাস এর আলোচ্য বিষয়।
পবিত্র কুরআনের প্রথম সূরা আল-ফাতিহায় আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা করা হয়েছে। তারপর তার নিকট সরল পথের সন্ধান চাওয়া হয়েছে। অতঃপর কুরআনের অন্যান্য সূরায় মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শয়তান মানুষকে সঠিক পথ থেকে বিরত রাখতে চায়। তাই সবশেষে এ সূরায় আল্লাহ পাকের নিকট শয়তান থেকে আশ্রয় চাওয়া হয়। এভাবে কুরআনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সামঞ্জস্য বজায় রাখা হয়েছে।
(২) সূরা নাস বাংলা লেখা
কুল আউযু বিরাব্বিন নাস। মালিকিন্ নাস। ইলাহিন্ নাস। মিন শাররীল ওয়াস ওয়াসিল খান্নাস। আল্লাযি ইউওয়াসয়িসু ফি সুদুরিন নাস। মিনাল জিন্নাতি ওয়ান নাস।
(৩) সূরা নাস বাংলা উচ্চারণ সহ
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)
১য় আয়াত: قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ
উচ্চারণ: কুল আউযু বিরাব্বিন নাস।
অর্থ: বলুন, আমি আশ্রয় চাই মানুষের পালনকর্তার কাছে,
২য় আয়াত: مَلِكِ النَّاسِ
উচ্চারণ: মালিকিন্ নাস।
অর্থ: মানুষের অধিপতির কাছে।
৩য় আয়াত: إِلَهِ النَّاسِ
উচ্চারণ: ইলাহিন্ নাস।
অর্থ : মানুষের মাবুদের কাছে।
৪র্থ আয়াত: مِن شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ
উচ্চারণ: মিন্ শাররিল ওয়াস্ওয়াসিল খান্নাস।
অর্থ: তার অনিষ্ট থেকে, যে কুমন্ত্রণা দেয় ও আত্মগোপন করে,
৫ম আয়াত: الَّذِي يُوَسْوِسُ فِي صُدُورِ النَّاسِ
উচ্চারণ: আল্লাযি ইউওয়াসয়িসু ফি সুদুরিন নাস।
অর্থ: যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে।
৬ষ্ঠ আয়াত: مِنَ الْجِنَّةِ وَ النَّاسِ
উচ্চারণ: মিনাল জিন্নাতি ওয়ান নাস।
অর্থ: জ্বিনের মধ্য থেকে অথবা মানুষের মধ্য থেকে।
(৪) সূরা নাস বাংলা অর্থসহ
সূরা নাস আরবি | বাংলা উচ্চারণ | বাংলা অর্থ |
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ | বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম | পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি) |
قُلۡ أَعُوذُ بِرَبِّ ٱلنَّاسِ | কুল আউযু বিরাব্বিন নাস। | বলুন, আমি আশ্রয় চাই মানুষের পালনকর্তার কাছে, |
مَلِكِ ٱلنَّاسِ | মালিকিন্ নাস। | মানুষের অধিপতির কাছে। |
إِلَـٰهِ ٱلنَّاسِ | ইলাহিন্ নাস। | মানুষের মাবুদের কাছে। |
مِن شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ | মিন্ শাররিল ওয়াস্ওয়াসিল খান্নাস। | তার অনিষ্ট থেকে, যে কুমন্ত্রণা দেয় ও আত্মগোপন করে, |
الَّذِي يُوَسْوِسُ فِي صُدُورِ النَّاسِ | আল্লাযি ইউওয়াসয়িসু ফিসুদুরিন নাস। | যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে। |
مِنَ الْجِنَّةِ وَ النَّاسِ | মিনাল জিন্নাতি ওয়ান নাস। | জ্বিনের মধ্য থেকে অথবা মানুষের মধ্য থেকে। |
(৫) সূরা আন নাস এর ছবি
(৬) surah an nas bangla uccharon audio mp3
(৭) sura nas bangla uccharon video mp4
(৮) সূরা নাস এর ব্যাখ্যা
সূরাতুল নাস-এর আয়াতসমূহে দুই প্রকারের আলোচনা রয়েছে।
প্রথম তিন আয়াতে মহান আল্লাহর তিনটি গুণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো রব, মালিক ও ইলাহ।
অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালাই মানুষের রব, মালিক ও ইলাহ । তিনি ব্যতীত আর কেউ এ তিনটি গুণের অধিকারী নয় । মানুষ হলো তীর বান্দা। সুতরাং মানুষের উচিত সর্বাবস্থায় আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া । এভাবে সূরার প্রথম অংশে আল্লাহ তায়ালার তিনটি গুণের উল্লেখ করে তার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়েছে।
সুরার দ্বিতীয় অংশে শয়তানের কুমন্তরণা থেকে বেঁচে থাকার জন্য মহান আল্লাহর আশ্রয় কামনা করা হয়েছে।
মানুষকে কুমন্ত্রণাদাতা শয়তান দুই ধরনের।
এক প্রকার শয়তানকে দেখা যায় না। তারা অদৃশ্য হয়ে মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয়। তারা জিন শয়তান। আর অন্য প্রকার রয়েছে মানুষের মাঝে। মানুষ শয়তানও মানুষকে খারাপ কাজ করতে উৎসাহ যোগায় ও ধোঁকা দেয়।
শয়তান মানুষের প্রকাশ্য দুশমন। সে গোপনে, প্রকাশ্যে, ঘুমস্ত অবস্থায়, জাগ্রত অবস্থায় সবসময় মানুষকে কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে। তার কাজই হলো কুমন্ত্রণা দিয়ে মানুষের অন্তরকে বিপথগামী করা। মানুষ যেন আল্লাহ তায়ালাকে ভুলে যায়, তার ইবাদত না করে ইত্যাদি কুমন্ত্রণা শয়তান দিয়ে থাকে।
শয়তান শুধু জিনই নয় বরং মানুষের মধ্যেও শয়তান রয়েছে। মানুষ শয়তানও অন্যকে প্রতারিত করে, দীন থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। এসব শয়তান থেকে আল্লাহ তায়ালার আশ্রয় ব্যতীত বেঁচে থাকা সন্তব নয়। এজন্য এ সূরায় শয়তানের সকল কুমন্ত্রণা ও অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহ তায়ালার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
উভয় ধরনের শয়তান মানুষকে ধোঁকা দিয়ে আল্লাহর আনুগত্য থেকে ফিরিয়ে রাখে। আল্লাহর ইবাদাত থেকে ফিরিয়ে রাখে। ভালো কাজ করতে বাধা প্রদান করে।
আল্লাহ তা’আলার সাহায্য ছাড়া শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচা যায় না। তাই সূরাতুল নাস এ এই দুই প্রকার শয়তান থেকেই আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
(৯) সূরা আন নাস এর ফজিলত
ফজর আর মাগরিবে এই দুই ওয়াক্তের ফরজ নামাজের পর সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক ও সুরা নাস প্রতিটি তিনবার করে পড়া সুন্নত। অন্যান্য ফরজ সালাতের আদায় করে একবার করে এই তিন সুরা পড়ার কথা বলা হয়েছে।
একবার এক ইয়াহুদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর জাদু করেছিল। যার ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। জিবরিল আলাইহিস সালাম তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানালেন যে, এক ইয়াহুদি তাকে জাদু করেছে এবং যে জিনিস দিয়ে জাদু করা হয়েছে তা একটি কুপের মধ্যে পাথরের নিচে আছে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই জিনিসগুলো কূপ থেকে উদ্ধার করার জন্য লোক পাঠালেন। সেই কূপের মধ্যে পাথরের নিচে কয়েকটি গিরা পাওয়া গিয়েছিল। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুরা নাস ও ফালাক একসঙ্গে পড়ে (ওই গিরায়) ফুক দেন এবং গিরাগুলো সঙ্গে সঙ্গে খুলে যায়। আর তাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বিছানা থেকে ওঠেন।
আবু দাউদ, তিরমিযী ও নাসায়ীর এক দীর্ঘ রেওয়ায়েতে রসুলুল্লাহ বলেন,
যে ব্যক্তি সকাল-বিকাল সূরা এখলাস, ফালাক ও নাস পাঠ করে তা তাকে বালা-মুসীবত থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে যথেষ্ট হয়।
(ইবনে-কাসীর)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হাবীব বর্ণনা করেন,
এক রাত্রিতে বৃষ্টি ও ভীষণ অন্ধকার ছিল। আমরা রসূলুল্লাহ -কে খুঁজতে বের হলাম। যাখন তাকে পেলাম, তখন প্রথমেই তিনি বললেনঃ বল। আমি আরয করলাম, কি বলব? তিনি বললেনঃ সূরা এখলাস ও কুল আউযু সূরাদ্বয়। সকাল-সন্ধ্যায় এগুলো তিন বার পাঠ করলে তুমি প্রত্যেক কষ্ট থেকে নিরাপদ থাকবে।
(মাযহারী)
সূরা নাস পড়লে শয়তানের অনিষ্ট ও যাদু থেকে হেফাজতে থাকা যায়। হাদিসে এসেছে,
“যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যা সুরা ইখলাস ও এই দুই সুরা ( সুরা ফালাক ও সুরা নাস) পড়বে সে সকল বিপদ-আপদ থেকে নিরাপদ থাকবে।”
(তিরমিজি)
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন,
“রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রাতে যখন ঘুমাতে যেতেন, তখন নিজের উভয় হাত এক সঙ্গে মিলাতেন। তারপর সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক, সুরা নাস পড়তেন এবং উভয় হাতে ফুঁক দিতেন। তারপর দেহের যতটুকু অংশ সম্ভব হাত বুলিয়ে নিতেন। তিনি মাথা, মুখমণ্ডল ও শরীরের সামনের অংশ থেকে শুরু করতেন। তিনি এরূপ তিনবার করতেন।”
(বুখারি)
(১০) সূরাতুল নাস এর নৈতিক শিক্ষা
পৃথিবীতে আমরা এসেছি আল্লাহর আনুগত্য এবং ইবাদাত করার জন্য। তিনি আমাদের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা। তিনি আমাদের মালিক। তিনিই ইবাদাত পাওয়ার একমাত্র যোগ্য।
কিন্তু শয়তান আমাদেরকে আল্লাহর আনুগত্য থেকে ফিরিয়ে রাখার জন্য কুমন্ত্রণা দেয়। আমাদেরকে খারাপ পথে নিয়ে যেতে চায়।
আমরা যদি আল্লাহর স্মরণ করি, তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করি তাহলে শয়তান আমাদেরকে ধোঁকা দিতে পারবে না। আমাদের কোনো অনিষ্ট করতে পারবে না।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রতিপালক। তিনিই আমাদের মাবুদ। আমাদের সকল কিছুই তার দান। তিনিই সমগ্র বিশ্বজগতের প্রকৃত অধিপতি। সুতরাং তার আদেশ-নিষেধ আমরা সবসময় মেনে চলব। আর শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে বেঁচে থাকব। কেননা শয়তান মানুষকে অন্যায়, অনৈতিক ও অশ্লীল কাজের দিকে পরিচালনা করে। ফলে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে বেঁচে থাকতে পারলে অনৈতিক কাজ থেকেও বেঁচে থাকা যাবে।
আলোচিত/উত্তরিত অনুসন্ধানসমূহ: সূরাতুল নাস, সূরা নাস বাংলা উচ্চারণ সহ, surah nas bangla, সূরা নাস বাংলা অর্থসহ।
[সূত্র: এনসিটিবি]