প্রিয় দ্বীনি ভাই-বোন, এ পাঠটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- সূরা বাকারার ৩০ ও ৩১ নং আয়াতের বাংলা অনুবাদ জানতে পারবেন; আয়াত নং ৩০ ও ৩১-এর শিক্ষাসমূহ অনুধাবন করতে পারবেন।
নিম্নে সহজ ও সংক্ষিপ্তভাবে সূরা বাকারার ৩০ ও ৩১ নং আয়াতের অনুবাদ, ব্যাখ্যা ও শিক্ষা তুলে ধরা হলো-
অনুবাদ
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।
৩০. | وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَٰٓئِكَةِ إِنِّى جَاعِلٌ فِى ٱلْأَرْضِ خَلِيفَةً قَالُوٓا۟ أَتَجْعَلُ فِيهَا مَن يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ ٱلدِّمَآءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ قَالَ إِنِّىٓ أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ ওয়া ইযকা-লা রাব্বুকা লিলমালইকাতি ইন্নী জা-‘ইলুন ফিল আরদিখালীফাতান কালূআতাজ‘আলুফীহা- মাইঁ ইউফছিদুফীহা- ওয়া ইয়াছফিকু দ দিমাআ ওয়ানাহনু নুছাব্বিহুবিহামদিকা ওয়া নুকাদ্দিছুলাকা কা-লা ইন্নী আ‘লামুমা-লা- তা‘লামূন। বলল, আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে? আমরাই তো আপনার গুণকীর্তন ও পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তিনি বললেন, অবশ্যই আমি যা জানি তোমরা তা জান না। |
৩১. | وَعَلَّمَ ءَادَمَ ٱلْأَسْمَآءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى ٱلْمَلَٰٓئِكَةِ فَقَالَ أَنۢبِـُٔونِى بِأَسْمَآءِ هَٰٓؤُلَآءِ إِن كُنتُمْ صَٰدِقِينَ ওয়া‘আল্লামা আ-দামাল আছমাআ কুল্লাহা- ছু ম্মা ‘আরাদাহুম ‘আলাল মালাইকাতি ফাকা-লা আম্বিঊনী বিআছমাই হাউলাই ইন কুনতুম সা-দিকীন। আর তিনি আদম (আ)-কে যাবতীয় নাম (জ্ঞান) শিক্ষা দিলেন। অতঃপর তা ফেরেশতাদের সামনে পেশ করলেন। অতঃপর বললেন, এসবের নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। |
ব্যাখ্যা
৩০ নং আয়াতের ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মানব সৃষ্টির রহস্যের কথা বর্ণনা করেছেন। মানুষকে আল্লাহ শুধু একটি সৃষ্টি হিসেবেই সৃষ্টি করেননি, বরং আল্লাহ প্রতিনিধিত্বের বিরল সম্মান দিয়ে অন্যান্য সৃষ্টি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও মহত্বের অধিকারী করে সৃষ্টি করেছেন। এ প্রসঙ্গে অন্তর্নিহিত নিগূঢ় তত্ত্ব ও বিশ্ব প্রকৃতিতে তাঁর অবস্থানের কথাও সঠিকভাবে বলে দিয়েছেন। এ আয়াত দ্বারা মানব জাতির ইতিহাসের এমন এক অধ্যায় উন্মুক্ত করা হয়েছে যে, এ সম্পর্কে জ্ঞান লাভের কোন উপায় মানুষের জানা ছিল না।
আল্লাহ তা‘আলা যখন ফেরেশতাদের নিকট পৃথিবীতে তাঁর খলিফা হিসেবে মানুষ সৃষ্টির কথা ঘোষণা করলেন তখন ফেরেশতারা তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে আরয করলেন, আপনি কি পৃথিবীতে এমন এক জাতি সৃষ্টি করতে চান যারা মারামারি, হানাহানি ও ঝগড়া-বিবাদ করবে ও পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করবে? আমরাই তো আপনার গুণকীর্তন ও পবিত্রতা ঘোষণা করছি। ফেরেশতাদের এ বক্তব্য তাদের আপত্তি নয়। কারণ আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপত্তি জানানোর কোন অধিকার কারও নেই। সুতরাং এটা তাদের প্রকৃত ব্যাপার জানবার প্রবল আগ্রহ মাত্র।
ফেরেশতাদের এ উক্তির পেছনে যুক্তিও ছিল। কারণ, মানব সৃষ্টির পূর্বে যাদের পৃথিবীতে সৃষ্টি করা হয়েছিল তারা সকলেই বিশেষ করে ‘জিন’ জাতি মারামারি ও হানাহানি করে ভীষণ অঘটন ঘটিয়েছিল। এসব জাতির ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও তাদের পরিণতি ফেরেশতাদের চোখের সামনেই ঘটেছিল। সুতরাং আগত জাতি সম্পর্কে তাদের এ জিজ্ঞাসা অযৌক্তিক ছিল না।
আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের এ অনুসন্ধিৎসার প্রেক্ষিতে জানিয়েছিলেন যে, খলিফা নিয়োগ করার প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা আমি জানি, তোমরা এটি বুঝতে পারবে না। কারণ শুধু ইবাদাত-বন্দেগির জন্যই মানুষ সৃষ্টি করা হবে না। দুনিয়া আবাদ এবং সৃষ্টিকুলের শাসনকার্য পরিচালনা করাও মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য।
৩১ নং আয়াতের ব্যাখ্যা
আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতির পিতা হযরত আদম (আ)-কে নিছক একটি সৃষ্টি হিসেবে সৃষ্টি করেননি। বরং তাঁকে পৃথিবীতে আল্লাহর খিলাফত বা প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সৃষ্টি করেছেন।
আর খিলাফতের গুরুত্ব দায়িত্ব পালন করার জন্য অপরিহার্য প্রয়োজন হচ্ছে সৃষ্টিজগতের সমগ্র বস্তু ও বিষয় অবহিত হওয়া। অন্যথায় খিলাফতের মতো এ মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। কাজেই মহান আল্লাহ হযরত আদম (আ)-কে সমগ্র বস্তুর নাম, গুণাগুণ সম্পর্কিত জ্ঞান দান করে খলীফার যোগ্য করে তোলেন।
আর ফেরেশতাদের স্বভাব প্রকৃতি এমন যে, খিলাফতের দায়িত্ব পালনের এবং যাবতীয় জাগতিক জ্ঞান লাভের যোগ্যতা আল্লাহ তা‘আলা তাদের দেননি।
তাই আল্লাহ আদম (আ)- কে সমস্ত বস্তুর নাম, গুণাগুণ ও তথ্যাদি শিক্ষা দিলেন। কারণ মানুষ বস্তুর নামের সাহায্যেই সে সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান আহরণ করে থাকে। মানুষের জ্ঞান লাভের এটাই মাধ্যম। মূলত মানুষের সমস্ত জ্ঞান বস্তুর নামের ওপরই নির্ভরশীল। আর আদম (আ)-কে সকল জিনিসের নাম শিখিয়ে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে যাবতীয় বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান দান করা।
অতঃপর খলীফা হিসেবে হযরত আদম (আ)-এর যোগ্যতা ফেরেশতাদের সম্মুখে প্রকাশ করার উদ্দেশেই আল্লাহ বস্তুগুলোকে ফেরেশতা ও আদম (আ)-এর সামনে উপস্থিত করে সেগুলোর নাম ও গুণাগুণ জানতে চাইলেন।
ফেরেশতাগণ তখন বস্তুর নাম ও গুণাগুণ বলতে অপরাগতা প্রকাশ করলেন। আদম (আ) সকল বস্তুর নাম, গুণাগুণ ও তথ্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বলে দিলেন। তখন খলীফা হিসেবে আদম (আ)-এর যোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়ে গেল।
এ আয়াতের মাধ্যমে একথাই দিবালোকের ন্যায় প্রতিভাত হয়ে উঠলো যে, হযরত আদম (আ)-কে পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত করা সার্থক হয়েছে।
শিক্ষা
আমরা উল্লিখিত দুটি আয়াত থেকে যে শিক্ষা লাভ করতে পারি, তা হলো-
- মানুষ মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। মানুষের প্রতি রয়েছে মহান আল্লাহর অফুরন্ত নিয়ামাত ।
- মহান আল্লাহর অজস্র নিয়ামাতের মধ্যে সবচেয়ে বড় নিয়ামাত হল পৃথিবীতে মানুষ মহান আল্লাহর খলিফা।
- মানুষের সৃষ্টি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা নিরর্থক সৃষ্টি নয়।
- মানুষ সৃষ্টির মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী ।
- মানব প্রজন্ম সৃষ্টির পেছনে মহান আল্লাহর মহাপরিকল্পনা রয়েছে।
- ফেরেশতাগণ আল্লাহর বিশেষ সৃষ্টি। তাঁরা মহান আল্লাহর গুণকীর্তন ও স্তব-স্তুতিতে সদা নিমগ্ন থাকেন।
- মানব সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য সম্বন্ধে প্রথমে ফেরেশতাগণ অবহিত ছিলেন না-আল্লাহ তাদেরকে সে মহাপরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। আল্লাহ জানেন অন্য কেউই তা জানে না।
- মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি। কাজেই তারা আল্লাহর বিধানমত চলবে এবং পৃথিবীকে পরিচালনা করবে, এবং তা বাস্তবায়ন করবে। পরামর্শ ভিত্তিক খিলাফতের দায়িত্ব পালন করার শিক্ষাও এখানে রয়েছে।
- অতএব আমরা মহান স্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, আল্লাহর প্রতিনিধি। আমাদের কাজ হবে তাঁরই দাসত্ব ও আনুগত্য করা এবং তাঁরই বিধান জীবনে বাস্তবায়িত করা। তাহলেই আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য সার্থক হবে।
পবিত্র ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট ইসলাম’ (inbangla.net/islam) এর সাথেই থাকুন।