প্রিয় দ্বীনি ভাই-বোন, এ পাঠটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- সূরা বাকারার ৩২, ৩৩ ও ৩৪ নং আয়াতের বাংলা অনুবাদ জানতে পারবেন; এসব আয়াতের ব্যাখ্যা বুঝতে পারবেন; এ আয়াতসমূহ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবেন।
নিম্নে সহজ ও সংক্ষিপ্তভাবে সূরা বাকারার ৩২, ৩৩ ও ৩৪ নং আয়াতের অনুবাদ, ব্যাখ্যা ও শিক্ষা তুলে ধরা হলো-
অনুবাদ
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।
৩২. | قَالُوا۟ سُبْحَٰنَكَ لَا عِلْمَ لَنَآ إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَآ إِنَّكَ أَنتَ ٱلْعَلِيمُ ٱلْحَكِيمُ কা-লূছুবহা-নাকা লা- ‘ইলমা লানা ইল্লা-মা ‘আল্লামতানা-ইন্নাকা আনতাল ‘আলীমুল হাকীম। তাঁরা (ফেরেশতারা) বলল, আপনি মহান ও পবিত্র। আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তাছাড়া আমাদের কোন জ্ঞান নেই। বস্তুত আপনিই মহাজ্ঞানী, বিজ্ঞানময়। |
৩৩. | قَالَ يَٰٓـَٔادَمُ أَنۢبِئْهُم بِأَسْمَآئِهِمْ فَلَمَّآ أَنۢبَأَهُم بِأَسْمَآئِهِمْ قَالَ أَلَمْ أَقُل لَّكُمْ إِنِّىٓ أَعْلَمُ غَيْبَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ وَأَعْلَمُ مَا تُبْدُونَ وَمَا كُنتُمْ تَكْتُمُونَ কা-লা ইয়াআ-দামূআম্বি’হুম বিআছমাইহিম ফালাম্মাআম্বাআহুম বিআছমাইহিম কা-লা আলাম আকুল্লাকুম ইন্নী আ‘লামুগাইবাছছামা-ওয়া-তি ওয়ল আরদি, ওয়া আ‘লামুমা- তুবদূ না ওয়ামা- কুনতুম তাকতুমূন। তিনি (আল্লাহ) বললেন, হে আদম! তাদেরকে সকল নাম বলে দাও। অতঃপর যখন সে তাদেরকে এদের নাম বলে দিল তখন তিনি বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, আকাশ ও পৃথিবীর সমস্ত অদৃশ্য বস্তু সম্বন্ধে আমি অবগত এবং তোমরা যা প্রকাশ কর এবং যা গোপন রাখ, নিশ্চিতভাবে আমি তাও জানি। |
৩৪. | وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَٰٓئِكَةِ ٱسْجُدُوا۟ لِءَادَمَ فَسَجَدُوٓا۟ إِلَّآ إِبْلِيسَ أَبَىٰ وَٱسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ ٱلْكَٰفِرِينَ ওয়া ইযকুলনা- লিলমালাইকাতিছজু দূলিআ-দামা ফাছাজাদূ ইল্লা ইবলীছা আবা-ওয়াছতাকবারা ওয়া কা-না মিনাল কা-ফিরীন। আর যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম, আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলিস ব্যতীত সকলেই সিজদা করল; সে অমান্য করল ও অহংকার করল এবং সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। |
ব্যাখ্যা
৩২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা
এ আয়াতে জাগতিক বস্তুর নাম বলার ব্যাপারে ফেরেশতাদের অপারগতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পূর্বোক্ত আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা আদম (আ) কে যাবতীয় বস্তুর নাম শেখালেন এবং ফেরেশতাদের কাছে তা পেশ করে তাদের নাম জানতে চাইলেন। ফেরেশতাগণ নাম বলতে অক্ষমতা প্রকাশ করে আল্লাহর কাছে নিবেদন করলেন যে, হে আল্লাহ! সব মহিমা আপনার। সকল দোষ-ত্রুটি ও দুর্বলতা থেকে একমাত্র আপনিই মুক্ত। আমরা তো কেবল ততটুকুই জানি যতটুকু আপনি আমাদের জানিয়েছেন। একমাত্র আপনিই সর্বজ্ঞ, সর্বদ্রষ্টা ও মহাজ্ঞানী।
উপরিউক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, সকল ফেরেশতার জ্ঞান তাঁদের সংশ্লিষ্ট বিভাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বায়ু সম্পর্কে নিযুক্ত ফেরেশতাদের পানি সম্পর্কে জ্ঞান নেই এবং মাটি সম্পর্কে নিয়োজিত ফেরেশতাদের বায়ু সম্পর্কে জ্ঞান নেই। কিন্তু মানুষের জ্ঞান যত কমই হোক না কেন সমষ্টিগতভাবে মানুষকে যে ব্যাপক জ্ঞান দান করা হয়েছে তা ফেরেশতাদের দেওয়া হয়নি।
একথা মনে করার কোন অবকাশ নেই যে, আদম (আ) কে যাবতীয় বস্তুর তত্ত্ব শিখিয়ে দেওয়া এবং ফেরেশতাদের শিখিয়ে না দেওয়ার পেছনে আল্লাহর পক্ষপাতিত্ব রয়েছে। কেননা আদম ও ফেরেশতা সৃষ্টির উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন নয়; বরং ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য ও লক্ষে তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষকে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দুনিয়া পরিচালনার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই আল্লাহ তা‘আলা আদমকে এমন সব উপাদান দিয়ে তৈরি করেছেন যেসব উপাদান দিয়ে তৈরি করলে সার্বিক বিষয়ে জ্ঞান অর্জন সহজ্জ হয়।
সুতরাং যাকে যে উদ্দেশে সৃষ্টি করা হয়েছে তাকে সে জ্ঞানই দেওয়া হয়েছে। যেহেতু মানুষ দুনিয়ার প্রাণি তাই আল্লাহ তাকে দুনিয়া সম্পর্কিত যাবতীয় জ্ঞান দান করেছেন।
৩৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যা
পূর্বোক্ত দুটি আয়াতে এ কথা বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা হযরত আদম (আ) কে খলিফা হিসেবে যোগ্য করে গড়ে তোলার লক্ষে যাবতীয় জাগতিক বস্তুর নাম ও গুণাগুণ শিখিয়েছেন এবং ফেরেশতাদের সামনে তাঁর যোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করার লক্ষে ফেরেশতাগণকে ঐ বস্তুগুলোর পরিচয় বর্ণনা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ফেরেশতাগণ তা অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। কারণ তারা তা জানতেন না। ফেরেশতাদের অপারগতা প্রকাশ করার পর বর্তমান আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা হযরত আদম (আ) কে ঐ সমস্ত বস্তুর নাম ফেরেশতাদের বলে দেবার আদেশ দান করেন এবং হযরত আদম (আ) আল্লাহর আদেশ পালনার্থে সকল বস্তুর নাম বলে দিলেন।
অতঃপর আল্লাহ ফেরেশতাদের সামনে ঘোষণা করলেন, একথা তো আমি আগেই বলেছিলাম যে, আকাশ ও ভূ-ম-লের যাবতীয় দৃশ্য-অদৃশ্য বস্তু সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ অবগত এবং তোমরা আদমের যোগ্যতা সম্পর্কে প্রকাশ্যে ও গোপনে যে অভিমত পোষণ করেছিলে তাও আমার অজানা নয়। অর্থাৎ হযরত আদম (আ)-এর মধ্যে কি কি যোগ্যতা নিহিত আছে তা তোমরা জান না এবং আমি জানি বলেই তাঁকে খিলাফতের মর্যাদায় আসীন করেছি।
আল্লাহ তা‘আলা এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের দ্বারা ফেরেশতাদের জানিয়ে দিলেন যে, আমি হযরত আদম (আ) কে শুধু ক্ষমতা এবং ইখতিয়ারই দিচ্ছি না; বরং সাথে সাথে প্রচুর জ্ঞানও দিয়েছি। আদম (আ) কে খলিফা নিযুক্ত করায় তোমরা যে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করেছিলে তা প্রকৃত ব্যাপারের একটি দিক মাত্র। এতে কল্যাণেরও একটি বড় দিক রয়েছে এবং কল্যাণের দিকটি বিপর্যয়ের দিক থেকে অধিকতর মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ বিধায় তা উপেক্ষা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
৩৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যা
এ আয়াতে জ্ঞানের কারণে নূরের তৈরি ফেরেশতা এবং আগুনের তৈরি জিন জাতির ওপর মাটির তৈরি মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। জিন ও ফেরেশতারা যখন জ্ঞানের প্রতিযোগিতায় আদম (আ)-এর নিকট হেরে যায়, তখন আল্লাহ তা‘আলা হযরত আদম (আ) কে সাজদা দিয়ে সম্মান প্রদর্শনের জন্য ফেরেশতাদের আদেশ দান করলেন।
আল্লাহর আদেশ মোতাবেক সব ফেরেশতা আদম (আ)-এর প্রতি সম্মান দেখাল কিন্তু আগুনের তৈরি ইবলিস এই বলে আল্লাহর আদেশের বিরোধিতা করল যে, আমি আগুনের তৈরি আর আদম (আ) মাটির তৈরি। সুতরাং আমি শ্রেষ্ঠ। আমি আদমের নিকট মাথা অবনত করতে পারব না। এ গুরুতর অপরাধের কারণে আল্লাহ ইবলিসকে চিরকালের জন্য ফেরেশতাদের নিকট থেকে বের করে দিলেন এবং তার শাস্তির জন্য দোযখ নির্দিষ্ট হয়ে গেল।
‘এবং সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।’ এ বাক্যাংশ দ্বারা বুঝা যায় যে, সম্ভবত একাকী ইবলিসই সিজদা করতে অস্বীকার করেনি; বরং জিনদের একটি দলও হয়ত বিদ্রোহ করেছিল এবং ইবলিস তাদের নেতা ছিল, তাই তার নামই এখানে উল্লেখ হয়েছে।
শিক্ষা
আমরা উক্ত তিনটি আয়াত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি যে-
- মহামহিম আল্লাহর সৃষ্টি জগতের মধ্যে মানব মানুষই সর্বাধিক শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী।
- ফেরেশতা ও জিন জাতি থেকেও মানুষ শ্রেষ্ঠ।
- মানুষের জন্যই পৃথিবীর সব কিছু সৃষ্টি করা হয়েছে।
- অহংকার করা কোন সৃষ্টির জন্য সমীচীন নয়। অহংকার কেবল আল্লাহর জন্য শোভন। তাই কোন অংহকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। অহংকার পতনের মূল।
- ফেরেশতাদের সর্দার ইবলিস আল্লাহর আদেশ অমান্য করে এবং অহংকারবশত মানব জাতির শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকার করে ফলে সে অভিশপ্ত শয়তানে পরিণত হয়।
- অহংকার না করে নিঃশর্তভাবে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ যাবতীয় মর্যাদা ও সফলতার চাবিকাঠি।
- আল্লাহর আদেশ নিষেধ তথা তাঁর বিধানমত জীবন পরিচালনা না করলে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।
- সর্বাবস্থায় আল্লাহর বিধান মেনে চলার মধ্যেই সৃষ্টিলোক এবং মানবজাতির মুক্তি ও সফলতা নির্ভর করে। সুতরাং আমরা সর্বাবস্থায় আল্লাহর সকল বিধান মেনে চলব।
পবিত্র ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট ইসলাম’ (inbangla.net/islam) এর সাথেই থাকুন।