(১) হাদিস সংরক্ষণ ও সংকলন
রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর বাণী, কর্ম ও মৌনসম্মতিকে সাধারণভাবে হাদিস বলা হয়। সুতরাং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) থেকেই হাদিসের উৎপত্তি।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় হাদিস লিখে রাখা নিষেধ ছিল। কেননা তখন আল-কুরআন নাজিল হচ্ছিল। এ অবস্থায় মহানবি (সাঃ)-এর হাদিস লিখে রাখলে তা আল-কুরআনের বাণীর সাথে সংমিশ্রণের আশঙ্কা ছিল। এ কারণে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় ব্যাপকভাবে হাদিস লিপিবদ্ধ করে সংরক্ষণ করা হয়নি।
তবে সাহাবিগণ মহানবি (সাঃ)-এর বাণীসমূহ মুখস্থ রাখতেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কোন সময় কী কাজ করতেন তা খেয়াল রাখতেন। আরবদের স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। তাঁরা একবার যা স্মৃতিতে ধারণ করতেন কখনোই তা ভুলতেন না। ফলে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতিটি বাণী ও কাজ সাহাবিগণের স্মৃতিতে সংরক্ষিত হতো। রাসুলুল্লাহ (সাঃ)ও স্বয়ং তাঁদের হাদিস মুখস্থ করার জন্য উৎসাহিত করতেন।
তিনি বলেন,
“আল্লাহ ঐ ব্যক্তির জীবন উজ্জ্বল করবেন, যে আমার কথা শুনে তা মুখস্থ করল ও সঠিকরূপে সংরক্ষণ করল এবং এমন ব্যক্তির নিকট পৌছে দিল যে তা শুনতে পায়নি।”
(তাবারানি)
সাহাবিগণ রাসুল (সাঃ)-এর কথা শুনতেন, তা মনে রাখতেন এবং তা হুবহু বন্ধুবান্ধব, পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনের নিকট পৌঁছে দিতেন। এভাবে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জীবদ্দশাতেই হাদিস সংরক্ষণ শুরু হয়।
তা ছাড়া লিখিত আকারেও সেসময় বেশ কিছু হাদিস সংরক্ষিত হয়। বহু সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর অনুমতিক্রমে ব্যক্তিগত উদ্যোগে হাদিস লিখে রাখতেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.)-এর সহিফা ‘আস-সাদিকা’-এর কথা উল্লেখযোগ্য। এ সহিফাতে তিনি রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর বহুসংখ্যক হাদিস লিখে রেখেছিলেন। তা ছাড়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর চিঠিপত্র, সন্ধিপত্র-চুক্তিনামা, সনদ, ফরমান ইত্যাদি লিখিত আকারে সংরক্ষিত ছিল।
হাদিস সংকলনের ক্ষেত্রে উমাইয়া খলিফা হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযিয (রাঃ)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনিই সর্বপ্রথম সরকারিভাবে হাদিস সংগ্রহ ও সংকলনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় হাদিস সংগ্রহ ও সংকলনে নতুন গতি সঞ্চার হয়। এরই ধারাবাহিকতায় হযরত ইমাম মালিক (রাঃ) সর্বপ্রথম হাদিসের বিশুদ্ধ সংকলন তৈরি করেন। তাঁর এ গ্রন্থের নাম আল-মুয়াত্তা।
হিজরি ৩য় শতক ছিল হাদিস সংকলনের স্বর্ণযুগ। এ সময় হাদিসের বিশুদ্ধতম ছয়টি কিতাব সংকলিত হয়।
এগুলোকে একত্রে সিহাহ সিত্তাহ বা ছয়টি বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থ বলা হয়। এ ছয়টি গ্রন্থ এবং এদের সংকলকগণের নাম:
- সহিহ বুখারি- ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল আল-বুখারি (রাঃ)।
- সহিহ মুসলিম- ইমাম আবুল হুসাইন মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ আল-কুশাইরি (রাঃ)।
- সুনানে নাসাই- ইমাম আবু আব্দুর রহমান আহমদ ইবনে শুআইব আন-নাসাই (রাঃ)।
- সুনানে আবু দাউদ- ইমাম আবু দাউদ সুলায়মান ইবনে আশআস (রাঃ)।
- জামি তিরমিযি- ইমাম আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা আত-তিরমিযি (রাঃ)।
- সুনানে ইবনে মাজাহ- ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইয়াজিদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে মাজাহ (রাঃ)।
(২) হাদিসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
ইসলামি শরিয়তে হাদিসের গুরুত্ব অপরিসীম। হাদিস হলো শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস। এটিও এক প্রকার ওহি। মহানবি (সাঃ) আল্লাহ তায়ালার নির্দেশনা প্রাপ্ত হয়েই মানুষকে নানা বিষয়ের নির্দেশনা প্রদান করতেন।
যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“আর তিনি নিজ প্রবৃত্তি থেকে কোনো কথা বলেন না। তা তো ওহি, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়।”
(সূরা আন-নাজম, আয়াত ৩-৪)
সুতরাং রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর বাণী ও কাজের অনুসরণ করা আবশ্যক।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর আনুগত্য করলে প্রকারান্তরে আল্লাহ তায়ালারই আনুগত্য করা হয়। আল্লাহ তায়ালা এতে সন্তুষ্ট হন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“আপনি বলুন! তোমরা আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য কর। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে জেনে রাখুন, আল্লাহ তো কাফিরদের পছন্দ করেন না।”
(সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৩২)
আল-হাদিস পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা স্বরূপ। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে শরিয়তের যাবতীয় আদেশ- নিষেধ, বিধি-বিধান ও মূলনীতি অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করেছেন। অতঃপর নবি (সাঃ)-এর দায়িত্ব ছিল এসব বিধি-বিধান স্পষ্টরূপে বর্ণনা করা।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“আর আমি আপনার প্রতি কুরআন নাজিল করেছি, মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যা তাদের প্রতি নাজিল করা হয়েছে।”
(সূরা আন-নাহল, আয়াত ৪৪)
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কুরআনের বিধি-বিধানসমূহের প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা দিতেন। অনেক ক্ষেত্রে নিজে আমল করার দ্বারা এসব বিধান হাতে-কলমে শিক্ষা দিতেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর এসব বাণী ও কর্মই হাদিস। সুতরাং কুরআনের বিধি-বিধান সুস্পষ্টরূপে অনুসরণের জন্য হাদিস অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। নিম্নের উদাহরণের মাধ্যমে আমরা আরও ভালোভাবে বিষয়টি বুঝতে পারি।
যেমন- কুরআন মজিদে সালাত কায়েম করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কীভাবে কোন সময়,কত রাকআত সালাত আদায় করতে হবে তার বিস্তারিত দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি। ঠিক তেমনিভাবে কুরআনে যাকাত প্রদানেরও হুকুম দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কে যাকাত দেবে, কাকে দেবে, কতপরিমাণ দেবে, এর কোনো নিয়ম সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়নি। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) হাদিসের দ্বারা আমাদের এসব নিয়ম-কানুন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে বর্ণনা করেছেন। ফলে আমরা যথাযথভাবে এগুলো আদায় করতে পারছি।
এজন্য আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
“রাসুল তোমাদের যা দেন তা তোমরা গ্রহণ কর। আর যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।”
(সূরা আল-হাশর, আয়াত ৭)
আর রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর আদেশ-নিষেধ এর পরিপূর্ণ আনুগত্য ও অনুসরণের জন্যও হাদিস জানা অত্যাবশ্যক। কেননা হাদিসের মাধ্যমেই আমরা এসব বিষয় জানতে পারি।
মহানবি (সাঃ) স্বয়ং হাদিসের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন,
“আমি তোমাদের মধ্যে দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা এ দুটোকে আঁকড়ে থাকবে: ততদিন পর্যন্ত তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হলো আল্লাহর কিতাব (আল-কুরআন) এবং অপরটি তাঁর রাসুলের সুন্নাহ।”
(মুয়াত্তা)
প্রকৃতপক্ষে, কুরআন ও হাদিস ইসলামি শরিয়তের সর্বপ্রধান দুটি উৎস। এগুলো মানুষকে সত্য, ন্যায় ও শান্তির পথে পরিচালনা করে। এ দুটোর শিক্ষা ও আদর্শ ত্যাগ করলে মানুষ পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। সুতরাং মানবজীবনে আল-কুরআনের পাশাপাশি মহানবি (সাঃ)-এর হাদিসের প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য।
পবিত্র ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট ইসলাম’ (inbangla.net/islam) এর সাথেই থাকুন।