(১) পরিচ্ছন্নতা কাকে বলে?
পরিষ্কার, সুন্দর ও পরিপাটি অবস্থাকে পরিচ্ছন্নতা বলে। শরীর, মন ও অন্যান্য ব্যবহার্য বস্তু সুন্দর ও পবিত্র রাখা, ময়লা-আবর্জনা ও বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে মুক্ত রাখাকে পরিচ্ছন্নতা বলা হয়। দুর্নীতিমুক্ত, ভেজালমুক্ত ও ঝামেলামুক্ত অবস্থাও পরিচ্ছন্নতার অন্যতম রূপ।
পরিচ্ছন্নতার আরবি প্রতিশব্দ হলো নাজাফাত। ইসলামি শরিয়তে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা অর্থে সাধারণত তাহারাত শব্দটিই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
ইসলামি পরিভাষায়, শরিয়ত নির্দেশিত পদ্ধতিতে দেহ, মন, পোশাক, খাদ্য, বাসস্থান ও পরিবেশ পরিষ্কার ও নির্মল রাখাকে তাহারাত বলা হয়।
(২) পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব
মানবজীবনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার গুরুত্ব অপরিসীম। পরিচ্ছন্ন থাকা মুমিনের বৈশিষ্ট্য। নোংরা, ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত থাকা ইমানদারগণের স্বভাব নয়। বরং মুমিনগণ সদা সর্বদা পরিষ্কার ও পবিত্র থাকেন।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
“পবিত্রতা ইমানের অর্ধেক।”
(মুসলিম)
প্রকৃত ইমানদার হওয়ার জন্য পবিত্র থাকা অপরিহার্য। কেননা পবিত্রতা ব্যতীত কোনো ইবাদত কবুল হয় না। সালাত আদায়ের জন্য মানুষের শরীর, পোশাক ও সালাতের স্থান পরিষ্কার ও পবিত্র হতে হয়। এগুলো নাপাক থাকলে সালাত শুদ্ধ হয় না। তেমনি আল-কুরআন তিলাওয়াতের জন্যও পাক-পবিত্র হতে হয়। অপবিত্র অবস্থায় আল-কুরআন স্পর্শ করাও নিষিদ্ধ।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
“আর এটা (আল-কুরআন) পবিত্রগণ ব্যতীত আর কেউ স্পর্শ করবে না।”
(সূরা আল-ওয়াকিয়া, আয়াত ৭৯)
পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিদের সবাই ভালোবাসে। আল্লাহ তায়ালাও তাদের ভালোবাসেন, পছন্দ করেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং যারা পবিত্র থাকে তাদেরও ভালোবাসেন।”
(সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২২২)
ইসলামি শরিয়তে পরিষ্কার-পবিত্র থাকার জন্য ওযু, গোসল ও তায়াম্মুমের বিধান প্রদান করা হয়েছে। দৈনিক পাঁচবার সালাতের পূর্বে ওযু করার দ্বারা মানুষের সকল অপবিত্রতা ও অপরিচ্ছন্নতা দূরীভূত হয়।
(৩) দৈহিক পরিচ্ছন্নতা
দৈহিক পরিচ্ছন্নতা মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দৈহিক পরিচ্ছন্নতা হলো হাত, পা, মুখ, দাঁত ও গোটা শরীর পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন থাকা।
কারও হাত, পা, মুখ, দাঁত, তথা গোটা শরীর অপরিষ্কার ও ময়লাযুক্ত থাকলে তা থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। এসব ময়লা, দুর্গন্ধ থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা দরকার। কেননা অপরিচ্ছন্ন মানুষকে সকলে ঘৃণা করে।
গোসল করার দ্বারা আমরা নিজেদের শরীর পরিচ্ছন্ন রাখতে পারি। শরীরের ময়লা ও দুর্গন্ধ দূর করতে পারি।
রাতের বেলা ঘুমানোর পর সকালে আমাদের মুখমণ্ডল পরিচ্ছন্ন, সতেজ ও নির্মল থাকে না। চোখে পিঁচুটি লেগে থাকে, দাঁত দুর্গন্ধযুক্ত হয়। খাদ্য গ্রহণ করলেও আমাদের দাঁতে ময়লা লাগে। সুতরাং দাঁত মুখ সদা- সর্বদা পরিষ্কার রাখতে হয়।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) দাঁত পরিষ্কারের জন্য মিসওয়াক করতেন। আমাদেরও তিনি মিসওয়াক করতে উৎসাহিত করেছেন।
তিনি বলেছেন,
“আমার উম্মতের কষ্টের আশঙ্কা না করলে আমি তাদের প্রত্যেক সালাতের আগে মিসওয়াক করার আদেশ দিতাম।”
(বুখারি)
আমাদের অনেকে চুল ও নখ বড় রাখে। এতে দেখতে খারাপ লাগে। নখ বড় হলে এতে ময়লা জমে। অতএব, নখ কেটে ছোট ও পরিষ্কার রাখতে হবে। চুল পরিপাটি করে রাখতে হবে। এটাই ইসলামের বিধান।
মহানবি (সাঃ) একবার এলোমেলো চুলের এক লোককে দেখে বললেন, এ ব্যক্তি কি চুল ঠিক করার কিছু পেল না?
প্রস্রাব-পায়খানা করে ভালোভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়াও ইসলামের বিধান। এজন্য প্রথমে ঢিলা-কুলুখ ব্যবহার করতে হবে। এখন সহজলভ্য টিস্যু ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। অতঃপর পানি ব্যবহার করে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র হতে হবে।
মহানবি (সাঃ) বলেছেন,
“নিশ্চয় প্রস্রাবই বেশির ভাগ কবর আযাবের কারণ হয়ে থাকে।”
(মুসনাদে আহমাদ)
অপর একটি হাদিসে এসেছে,
“তোমরা প্রস্রাবের ছিটা-ফোঁটা থেকে বেঁচে থাক। কারণ কবরের বেশিরভাগ আযাব প্রস্রাবের ছিটা-ফোঁটা থেকে বেঁচে না থাকার কারণে হবে।”
(দারাকুতনি)
দৈহিক পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার গুরুত্ব সীমাহীন। সুতরাং আমরা প্রতিদিন গোসল করব। পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পূর্বে ভালোভাবে ওযু করব। আমাদের হাত, পা, নখ, চুল, দাঁত, চোখ সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখব।
(৪) পোশাকের পরিচ্ছন্নতা
দৈহিক পরিচ্ছন্নতার মতো পোশাক পরিচ্ছদের পবিত্রতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাপড়-চোপড় পরিষ্কার থাকলে দেহ মন ভালো থাকে, কাজে উৎসাহ পাওয়া যায়।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
“আপনার পরিচ্ছদ পবিত্র রাখুন।”
(সূরা আল মুদ্দাস্সির, আয়াত ৪)
আমাদের প্রিয়নবি (সাঃ) সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরতেন। কাপড়-চোপড় অল্প মূল্যের হতে পারে, ছেঁড়া ফাটা হতে পারে, কিন্তু তা পরিষ্কার হওয়া উচিত। এজন্য সবসময় কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে।
(৫) পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা
আমাদের চারপাশে যা কিছু রয়েছে সবকিছু নিয়েই আমাদের পরিবেশ। ঘর-বাড়ি, গাছ-পালা, হাট-বাজার, স্কুল-মাদ্রাসা, দোকানপাট, রাস্তাঘাট এসবই আমাদের পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত। এগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা আমাদের কর্তব্য। পরিবেশ পরিচ্ছন্ন না থাকলে নির্মল জীবন-যাপন করা সম্ভব নয়।
যেখানে সেখানে কফ-থুথু, মলমূত্র ফেললে পরিবেশ নোংরা হয়। বিভিন্ন উচ্ছিষ্ট, ময়লা-আবর্জনা, রাসায়নিক বর্জ্য ডাস্টবিনে না ফেলে রাস্তাঘাটে ফেলা উচিত নয়। এতে রাস্তাঘাট ময়লা হয়। নোংরা- আবর্জনা আমাদের শরীরে ও পোশাকে লাগে। নানা রকম রোগজীবাণু জন্মে। আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি।
পানি ও বায়ু পরিবেশের অন্যতম উপাদান। এ দুটো মানবজীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা পানি পান করি, পানিতে গোসল করি, কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করি। সুতরাং পানি ও বায়ু সবসময় পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন রাখা দরকার। পানিতে ময়লা-আবর্জনা ফেলা যাবে না। অনেকে পানিতে মলমূত্র ত্যাগ করে। এটা ঠিক নয়। আমরা নির্দিষ্ট জায়গায় মলত্যাগ করব। ফলে আমাদের বায়ুও দুর্গন্ধযুক্ত হবে না।
পরিবেশ আমাদের। এ পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব আমাদেরই। সুতরাং আমরা এ ব্যাপারে সতর্ক হব। আমাদের ঘর-বাড়ি, স্কুল-কলেজ, রাস্তাঘাট পরিষ্কার রাখব। সপ্তাহে অন্তত একদিন পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাব।
যানবাহন, বাসস্টেশন, ফেরিঘাট, খেলার মাঠ, হাট-বাজারও পরিষ্কার রাখা দরকার। আমরা এ ব্যাপারেও সচেষ্ট হব। এলাকার পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের সাহায্য করব।
পবিত্র ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট ইসলাম’ (inbangla.net/islam) এর সাথেই থাকুন।