(১) মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সমকালীন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা
মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত নবি ও রাসুলগণের মধ্যে মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) হলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল। তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে আরবের মানুষ চরম বর্বরতা ও অজ্ঞতার মাঝে ডুবে ছিল।
আরবের মানুষদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল চরমভাবে অধঃপতিত। তারা অসংখ্য মূর্তি তৈরি করত এবং মূর্তির পূজা করত। গোত্রের ভিন্নতার পাশাপাশি তাদের মূর্তিও ভিন্ন ভিন্ন ছিল। তারা পবিত্র কাবাঘরে ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করেছিল।
কালের এই চরম অবক্ষয়ের কারণে একজন পথপ্রদর্শক হিসেবে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে প্রেরণ করেন। আল্লাহ তাঁর নিকট মহাগ্রন্থ আল-কুরআন অবতীর্ণ করেন। মহানবি (সাঃ) মানুষকে মুক্তির পথ প্রদর্শন করেন।
ক) সামাজিক অবস্থা
মহানবি (সাঃ)-এর আবির্ভাবের পূর্বে আরব সমাজের লোকেরা নবি ও রাসুল এর শিক্ষা ভুলে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের আচার ব্যবহার ও চালচলন ছিল বর্বর ও মানবতাবিরোধী। তাই সে যুগকে ‘আইয়্যামে জাহিলিয়্যা’ বা অজ্ঞতার যুগ বলা হয়।
সুষ্ঠু ও সুন্দর সামাজিক ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। মানুষের জান, মাল, ইজ্জতের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। নরহত্যা, রাহাজানি, খুন-খারাবি, ডাকাতি, মারামারি, কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়া, জুয়াখেলা, মদ্যপান, সুদ, ঘুষ, ব্যভিচার ছিল তখনকার প্রচলিত ব্যাপার।
তৎকালীন সমাজে নারীর কোনো মর্যাদা ছিল না। নারীদের সামাজিক জীব মনে করা হতো না; বরং দাসী হিসেবে তাদের বিক্রি করা হতো, ভোগ বিলাসের বস্তু মনে করা হতো। যার বর্ণনা পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে এসেছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তানের (ভূমিষ্ঠ হওয়ার) সুসংবাদ দেওয়া হয় তখন তাদের মুখমন্ডল কালো হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়। তাকে যে সংবাদ দেওয়া হয়, তার গ্লানি হেতু সে নিজ সম্প্রদায় থেকে আত্মগোপন করে। সে চিন্তা করে হীনতা সত্ত্বেও সে তাকে রেখে দেবে, না মাটিতে পুঁতে ফেলবে। সাবধান! তারা যা সিদ্ধান্ত করে তা খুবই নিকৃষ্ট।”
(সূরা আন্-নাহল, আয়াত ৫৮-৫৯)
এক কথায় অপরাধের এমন কোনো দিক ছিল না যা তারা করত না।
খ) সাংস্কৃতিক অবস্থা
জাহিলি যুগে আরবের অধিকাংশ লোক নিরক্ষর ও অশিক্ষিত থাকলেও সাহিত্যের প্রতি তাদের খুব অনুরাগ ছিল। তাদের অনেকেই মুখে মুখে গীতিকবিতা চর্চা করত।
তৎকালীন আরবে উকায মেলা নামে বাৎসরিক একটি মেলা বসত। মেলায় তৎকালীন সময়ের প্রসিদ্ধ কবিগণ তাদের স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করত। যেসব কবিতা সেরা বিবেচিত হতো তা সোনালি বর্ণে লিখে পবিত্র কাবার দেয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো।
আরবি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ ‘আস-সাবউল মুআল্লাকাত’ (সাতটি ঝুলন্ত গীতিকবিতা) জাহিলি যুগেই রচিত। কবিতা রচনার কারণে আরবরা জাহিলি যুগেই বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছিল। তাদের কবিতা মানের দিক থেকে ছিল খুব উন্নত।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন,
“যখন তোমরা আল্লাহর কিতাবের কোনো কিছু বুঝতে না পার তবে তার অর্থ আরবদের কবিতায় তালাশ কর। কারণ কবিতা তাদের জীবনালেখ্য।”
(আল-মুফাচ্ছাল)
এতে বোঝা যায় প্রাচীন আরবের সাংস্কৃতিক জীবনে অসংখ্য প্রবাদ-প্রবচন, নানা কিংবদন্তি ও মুখরোচক কাহিনী এবং বাগ্মিতার প্রচলন ছিল, তবে তাদের সংস্কৃতি চর্চার প্রধান মাধ্যম ছিল কবিতা।
(২) মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জন্ম, শৈশব ও কৈশোর
ক) জন্ম ও শৈশব
আরব যখন চরম জাহিলিয়াতে নিমজ্জিত তখন আরবের কুরাইশ বংশে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্ম হয়।
-তাঁর পিতার নাম আব্দুল্লাহ।
-দাদার নাম আব্দুল মুত্তালিব।
-মাতার নাম আমিনা।
-নানার নাম ওয়াহাব।
জন্মের পূর্বেই তাঁর পিতা ইন্তিকাল করেন। দাদা আব্দুল মুত্তালিব তাঁর নাম রাখেন মুহাম্মদ। আর তাঁর মাতা নাম রাখেন আহমাদ। জন্মের পর মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ধাত্রী মা হালিমার ঘরে লালিত-পালিত হন।
হালিমা বনু সাদ গোত্রের লোক ছিলেন। আর বনু সাদ গোত্র বিশুদ্ধ আরবিতে কথা বলত। ফলে মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)ও বিশুদ্ধ আরবি ভাষায় কথা বলতেন।
শৈশবকাল থেকে মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মাঝে ন্যায় ও ইনসাফের নজির দেখা যায়। তিনি ধাত্রী হালিমার একটি স্তন পান করতেন অন্যটি তাঁর দুধভাই আব্দুল্লাহর জন্য রেখে দিতেন।
হালিমা মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে পাঁচ বছর লালন-পালন করে তাঁর মা আমিনার নিকট রেখে যান। তাঁর বয়স যখন ছয় বছর তখন তাঁর মাতা ইন্তিকাল করেন।
প্রিয়নবি (সাঃ) অসহায় হয়ে পড়লে তাঁর লালন- পালনের দায়িত্ব নেন দাদা আব্দুল মুত্তালিব। আর আট বছর বয়সে তাঁর দাদাও মারা যান। এরপর লালন- পালনের দায়িত্ব নেন চাচা আবু তালিব।
খ) কৈশোর
চাচা আবু তালিব অত্যন্ত আদর স্নেহ দিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে লালন-পালন করতে থাকেন।
আবু তালিবের আর্থিক অবস্থা ছিল অসচ্ছল। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এ অবস্থা অবলোকন করে চাচার সহযোগিতায় কাজ করা শুরু করেন। তিনি মেষ চরাতেন।
মেষপালক রাখাল বালকদের জন্য তিনি ছিলেন উত্তম আদর্শ। তাদের সাথে তিনি বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতেন। কখনোই তাদের সাথে কলহ বা ঝগড়া-বিবাদ করতেন না।
তিনি ১২ বছর বয়সে ব্যবসার উদ্দেশ্যে চাচার সঙ্গে সিরিয়া যান। যাত্রা পথে ‘বুহায়রা’ নামক এক পাদ্রির সাথে দেখা হলে বুহায়রা মুহাম্মদকে অসাধারণ বালক বলে উল্লেখ করেন এবং ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন যে, ‘এ বালকই হবে শেষ যামানার আখেরি নবি (শেষ নবি)।’
শৈশবকাল থেকেই মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন সত্যবাদী ও শান্তিকামী।
সিরিয়া থেকে ফিরে এসে তিনি ফিজার যুদ্ধের বিভীষিকা দেখলেন। যুদ্ধটি শুরু হলো নিষিদ্ধ মাসে। তা ছাড়া কায়স গোত্র অন্যায়ভাবে কুরাইশদের উপর এ যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। এ জন্য একে ‘হারবুল ফিজার’ বা অন্যায় যুদ্ধ বলা হয়। পাঁচ বছর যাবৎ এ যুদ্ধ স্থায়ী হয়।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এ যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেননি। তবে যুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এ যুদ্ধে বহু মানুষ আহত ও নিহত হয়। তাতে তাঁর কোমল হৃদয় কেঁদে উঠে। আহতদের আর্তনাদ শুনে তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন। শান্তিকামী মানুষ হিসেবে এ অশান্তি তাঁর সহ্য হলো না। তাই তিনি আরবের শান্তিকামী যুবকদের নিয়ে ‘হিলফুল ফুযুল’ (শান্তি সংঘ) গঠন করলেন।
এই সংঘের উদ্দেশ্য ছিল আর্তের সেবা, অত্যাচারীকে প্রতিরোধ ও অত্যাচারিতকে সাহায্য করা, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা এবং গোত্রে গোত্রে শান্তি, সম্প্রীতি বজায় রাখা। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ঐ হিলফুল ফুযুল সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট ছিল।
মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর চারিত্রিক গুণাবলি- আমানতদারি, সত্যবাদিতা, ন্যায়নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতার কারণে তৎকালীন আরবের লোকজন তাঁকে আল-আমিন (বিশ্বাসী) উপাধি দিয়েছিল। নবুয়ত প্রাপ্তির পর যারা তাঁকে অস্বীকার করেছিল তারাও তাঁকে মিথ্যাবাদী বলতে পারেনি।
(৩) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর যৌবনকাল, নবুয়ত প্রাপ্তি ও ইসলাম প্রচার
ক) যৌবনকাল
যুবক মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা ও চারিত্রিক গুণাবলির সংবাদ মক্কার দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল। তখনকার আরবের শ্রেষ্ঠ সম্পদশালী বিদুষী ও বিধবা মহিলা হযরত খাদিজা (রা.) তাঁর ব্যবসার দায়িত্ব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর অর্পণ করেন।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর ব্যবসায়িক কাজে সিরিয়া যান। তিনি এ ব্যবসায় আশাতীত লাভবান হয়ে দেশে ফিরে আসেন। যুবক হয়েও খাদিজা (রা.)-এর ব্যবসায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যে দায়িত্বশীলতা ও সততার পরিচয় দিয়েছিলেন তা সর্বকালে সকল যুবকের জন্য আদর্শ।
খাদিজা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর গুণাবলি পর্যবেক্ষণ করার জন্য তাঁর অত্যন্ত বিশ্বস্ত কর্মচারী ‘মাইসারা’কে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে সিরিয়া পাঠান। মাইসারা সিরিয়া থেকে ফিরে এসে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর চারিত্রিক গুণাবলির বর্ণনা খাদিজা (রা.)-কে দেন। তাতে মুগ্ধ হয়ে খাদিজা নিজেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নিকট তাঁর বিবাহের প্রস্তাব পাঠান।
চাচা আবু তালিবের অনুমতি নিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) খাদিজাকে বিবাহ করেন। এ সময় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বয়স ছিল পঁচিশ বছর। আর খাদিজা (রা.)-এর বয়স ছিল চল্লিশ বছর।
বিবাহের পর খাদিজার আন্তরিকতায় ও সৌজন্যে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) প্রচুর সম্পদের মালিক হন। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এ সম্পদ নিজের ভোগ-বিলাসে ব্যয় না করে অসহায়, দুঃখী, পীড়িত ও গরিব-মিসকিনদের সেবায় ব্যয় করেন।
আজকের সমাজে আমরা যদি মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ন্যায় আর্তমানবতার সেবায় সম্পদ ব্যয় করি, তাহলে সমাজের দুঃস্থ, অসহায় ও গরিব-দুঃখীদের কষ্ট লাঘব হবে, সমাজে শান্তি বিরাজ করবে।
মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বয়স যখন পঁয়ত্রিশ বছর তখন কাবা শরিফ পুনর্নির্মাণ করা হয়।
হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) স্থাপন নিয়ে আরবের বিভিন্ন গোত্রে বিরোধ দেখা দেয়। সবাই হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের গৌরব অর্জন করতে চায়। তাতে কেউ ছাড় দিতে রাজি নয়। ফলে গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার উপক্রম হয়। অতঃপর সকলে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, পরের দিন সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি কাবা ঘরে প্রবেশ করবে তার ফয়সালা মেনে নেওয়া হবে।
দেখা গেল পরের দিন সকলের আগে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কাবা ঘরে প্রবেশ করলেন। সবাই এক বাক্যে বলে উঠল, এই এসেছেন আল-আমিন, আমরা তাঁর প্রতি আস্থাশীল ও সন্তুষ্ট।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও নিরপেক্ষতার সাথে যে ফয়সালা দিলেন, সকলে তা নির্দ্বিধায় মেনে নিল। ফলে তারা অনিবার্য রক্তপাত থেকে মুক্তি পেল।
এভাবে বর্তমান সময়েও বিচক্ষণতা ও নিরপেক্ষতার সাথে বিচারকার্য পরিচালনা করলে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। জাতি অনেক অনিবার্য দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও রক্তপাত থেকে মুক্তি পাবে।
খ) নবুয়ত প্রাপ্তি
হযরত খাদিজা (রা.)-এর সাথে বিবাহের পর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মক্কার অদূরে হেরা পর্বতের গুহায় গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। দীর্ঘদিন ধ্যানে মগ্ন থাকার পর ৪০ বছর বয়সে ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে পবিত্র রমযান মাসের কদরের রাতে হযরত জিবরাইল (আঃ) তাঁর নিকট ওহি নিয়ে আসেন এবং তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হন।
জিবরাইল (আঃ) বললেন,
“পড়ুন! আপনার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন”।
(সূরা আলাক, আয়াত ১)
উত্তরে মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন, আমি পড়তে জানি না। জিবরাইল (আঃ) তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, পড়ুন। তিনি বললেন, আমি পড়তে জানি না। এভাবে তিনবার প্রিয়নবি (সাঃ)-কে জড়িয়ে ধরলেন। অতঃপর তৃতীয়বারের সময় তিনি পড়তে সক্ষম হলেন।
বাড়ি ফিরে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) হযরত খাদিজা (রা.)-এর নিকট সব ঘটনা খুলে বললেন এবং জীবনের আশংকা করলেন। তখন হযরত খাদিজা (রা.) তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন- না, কখনো না। আল্লাহর শপথ! তিনি আপনাকে কখনো অপদস্থ করবেন না। কারণ আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, দুঃস্থ ও দুর্বলদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন, নিঃস্ব ও অভাবীদের উপার্জনক্ষম করেন। মেহমানদের সেবাযত্ন করেন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে (লোকদের) সাহায্য করেন।
এতে বোঝা যায় যে, নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বেও হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কী রকম আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে মানবিক মহৎ গুণাবলি অনুশীলন করতেন এবং মানবতার সেবায় নিয়োজিত থাকতেন। আমাদের উচিত বাস্তবজীবনে মহানবির এসব আদর্শ অনুশীলন করা।
গ) ইসলাম প্রচার
নবুয়ত প্রাপ্তির পর মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বিপথগামী মক্কাবাসীর নিকট ইসলাম প্রচার আরম্ভ করেন। তিনি ঘোষণা করেন, আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসুল। তিনি আরও ঘোষণা করেন, ইসলামই আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম, আল-কুরআন এ ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ। আল্লাহ সমগ্র বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, নিয়ামক এবং সবকিছুর মালিক। তিনি সকল সৃষ্টির জীবন ও মৃত্যুদানকারী।
প্রথম তিন বছর তিনি গোপনে তাঁর আত্মীয়স্বজনকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। পরে আল্লাহর নির্দেশে প্রকাশ্যে ইসলামের পথে দাওয়াত দেওয়া শুরু করলেন। এতে মূর্তি পূজারিরা তাঁর বিরোধিতা করতে শুরু করল।
নবিকে তারা ধর্মদ্রোহী, পাগল বলে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে লাগল। তারা তাঁর উপর শারীরিক, মানসিক নির্যাতন চালাল, পাথর ছুড়ে আঘাত করল, আবর্জনা নিক্ষেপ করল, অপমানিত ও লাঞ্ছিত করল। মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে নেতৃত্ব, ধন-সম্পদ ও সুন্দরী নারীর লোভ দেখাল। তিনি বললেন, আমার এক হাতে চন্দ্র আর অন্য হাতে সূর্য এনে দিলেও আমি এ সত্য প্রচার করা থেকে বিরত হব না।
সত্য প্রচারে মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যে আত্মত্যাগ, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছেন তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদেরও সত্য ও ন্যায়ের পথে আত্মত্যাগী, দৃঢ়সংযমী, ধৈর্যশীল ও কষ্ট-সহিষ্ণু হওয়া উচিত।
(৪) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মাদানি জীবন
মক্কার কাফিররা মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে ইসলাম প্রচার থেকে বিরত রাখতে না পেরে তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিল। অতঃপর আল্লাহর নির্দেশে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায় হিজরত করলেন।
মক্কার তুলনায় মদিনায় শান্ত ও নির্মল পরিবেশে এসে মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) গুরুত্বপূর্ণ অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করলেন, আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের মাঝে চলমান দীর্ঘ দিনের যুদ্ধ বন্ধ করলেন। মুহাজির (ইসলামের উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকারী) ও আনসারদের (মুহাজিরদেরকে সার্বিকভাবে সাহায্যকারী মদিনাবাসী) মাঝে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন ও সৌহার্দ স্থাপন করলেন।
সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হলো। গড়ে তুললেন ইসলামি আদর্শের ভিত্তিতে সুশৃঙ্খল সমাজ ব্যবস্থা। সকল মুসলিমের মিলনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুললেন মসজিদে নববি।
ক) মদিনা সনদ কী?
মদিনা ছিল বিভিন্ন ধর্ম ও গোত্রের লোকজনের আবাস। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এই সকল জাতিকে এক করে সেখানে একটি ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা নিলেন। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি সকল গোত্রের নেতাদের সাথে বৈঠক করে একটি লিখিত সনদ প্রণয়ন করেন, যা ইসলামের ইতিহাসে ‘মদিনা সনদ’ নামে খ্যাত।
খ) মদিনা সনদ প্রধান কিছু ধারা
এই সনদে মোট ৪৭টি ধারা ছিল। তার মধ্যে প্রধান ধারাগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
- সনদে স্বাক্ষরকারী মুসলমান, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিক সম্প্রদায়সমূহ সমানভাবে নাগরিক অধিকার ভোগ করবে।
- মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) হবেন প্রজাতন্ত্রের প্রধান এবং সর্বোচ্চ বিচারালয়ের কর্তা।
- মুসলমান ও অমুসলমান সম্প্রদায় স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে।
- কেউ কুরাইশ বা অন্য কোনো বহিঃশত্রুর সাথে মদিনাবাসীর বিরুদ্ধে কোনোরূপ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারবে না।
- স্বাক্ষরকারী কোনো সম্প্রদায় বহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে সকল সম্প্রদায়ের সমবেত প্রচেষ্টায় তা প্রতিহত করা হবে।
- বহিঃশত্রু কর্তৃক মদিনা আক্রান্ত হলে সকলে সম্মিলিতভাবে শত্রুর মোকাবিলা করবে এবং প্রত্যেকে স্ব-স্ব গোত্রের যুদ্ধভার বহন করবে।
- কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হবে। তার অপরাধের জন্য গোটা সম্প্রদায়কে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না।
- মদিনা পবিত্র নগরী বলে ঘোষণা করা হলো। এখন থেকে এই শহরে রক্তপাত, হত্যা, ব্যভিচার এবং অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলো।
- ইহুদি সম্প্রদায়ের মিত্ররাও সমান স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা ভোগ করবে।
- হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর অনুমতি ব্যতীত মদিনার কোনো গোত্র কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না।
- স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়সমূহের মধ্যে কখনো বিরোধ দেখা দিলে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তা মীমাংসা করবেন।
- সনদের ধারা ভঙ্গকারীর উপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষিত হবে।
এই মদিনা সনদ হলো মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান, যার মাধ্যমে ইসলাম ও মহানবি (সাঃ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব ফুটে উঠেছে।
আমাদের উচিত রাষ্ট্রের কল্যাণে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করে সুন্দর সমৃদ্ধ গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করা।
(৫) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মক্কা বিজয় ও বিদায় হজ
ক) মক্কা বিজয়
অনুকূল পরিবেশ পাওয়ায় মদিনায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার খুব দ্রুত ঘটতে লাগল।
ষষ্ঠ হিজরিতে মক্কার কুরাইশরা মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও মুসলমানদের সাথে হুদায়বিয়ার সন্ধি করে।
কুরাইশরা সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করলে রাসুল (সাঃ) ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে ১০০০০ (দশ হাজার) মুসলিম নিয়ে মক্কা অভিমুখে অভিযান পরিচালনা করেন।
মক্কার অদূরে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁবু স্থাপন করেন। কুরাইশরা মুসলিমদের এই বাহিনী দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হলো। তারা কোনো প্রকার বাধা দেওয়ার সাহস করল না। বিনা রক্তপাতে ও বিনা বাধায় মুসলিম বাহিনী মক্কা বিজয় করল।
মক্কা বিজয়ের পর আল্লাহর রাসূল সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন।
তিনি বললেন,
“আজ তোমাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই, যাও তোমরা মুক্ত ও স্বাধীন।”
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)
সে সময়ে তিনি ইসলামের চরম শত্রু আবু সুফিয়ানসহ সকলকে হাতের নাগালে পেয়েও যেভাবে ক্ষমা করে দিয়েছেন মানবতার ইতিহাসে তা বিরল।
ভুল বুঝতে পারার পর আমাদের শত্রুরা অনুতপ্ত হলে আমরাও তাদের বিনা শর্তে ক্ষমা করে দেব। ক্ষমা একটি মহৎ গুণ।
খ) বিদায় হজ ও এর ভাষণ
মক্কা বিজয়ের পর দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করতে লাগল। আরবের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইসলাম পৌছে গেল। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বুঝলেন আর বেশিদিন পৃথিবীতে তাঁর থাকা হবে না। তাই তিনি ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে (দশম হিজরিতে) হজ করার ইচ্ছা করলেন। এ উদ্দেশ্যে উক্ত সালের যিলকদ মাসে লক্ষাধিক সাহাবি নিয়ে হজ করতে গেলেন, যা বিদায় হজ নামে পরিচিত।
এ হজে রাসুল (সাঃ)-এর সহধর্মিণীগণও তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
যুল হুলাইফা নামক স্থানে এসে সকলে ইহরাম (হজের পোশাক) বেঁধে বাইতুল্লাহর উদ্দেশে রওনা হন।
জিলহজ মাসের নবম তারিখে আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত জনসমুদ্রের উদ্দেশে মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এক যুগান্তকারী ভাষণ দেন। এ ভাষণে বিশ্ব মানবতার সকল কিছুর দিকনির্দেশনা ছিল।
আরাফাতের ময়দানের পার্শ্বে ‘জাবালে রহমত’ নামক পাহাড়ে উঠে মহানবি (সাঃ) প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করলেন। অতঃপর বললেন-
- হে মানব সকল! আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনবে। কারণ আগামী বছর আমি তোমাদের সাথে এখানে সমবেত হতে পারব কিনা জানি না।
- আজকের এ দিন, এ স্থান, এ মাস যেমন পবিত্র, তেমনই তোমাদের জীবন ও সম্পদ পরস্পরের নিকট পবিত্ৰ।
- মনে রাখবে অবশ্যই একদিন সকলকে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে হবে। সেদিন সকলকে নিজ নিজ কাজের হিসাব দিতে হবে।
- হে বিশ্বাসীগণ! স্ত্রীদের সাথে সদয় ব্যবহার করবে। তাদের উপর তোমাদের যেমন অধিকার আছে তেমনই তোমাদের উপরও তাদের অধিকার রয়েছে।
- সর্বদা অন্যের আমানত রক্ষা করবে এবং পাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে ও সুদ খাবে না।
- আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করবে না। আর অন্যায়ভাবে একে অন্যকে হত্যা করবে না।
- মনে রেখ! দেশ, বর্ণ-গোত্র, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মুসলমান সমান। আজ থেকে বংশগত শ্রেষ্ঠত্ব বিলুপ্ত হলো। শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র মাপকাঠি হলো আল্লাহভীতি ও সৎকর্ম। সে ব্যক্তিই সবচাইতে সেরা, যে নিজের সৎকর্ম দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।
- ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না; পূর্বের অনেক জাতি একারণেই ধ্বংস হয়েছে। নিজ যোগ্যতা বলে ক্রীতদাস যদি নেতা হয় তার অবাধ্য হবে না। বরং তার আনুগত্য করবে।
- দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। তোমরা যা আহার করবে ও পরিধান করবে তাদেরকেও তা আহার করাবে ও পরিধান করাবে। তারা যদি কোনো অমার্জনীয় অপরাধ করে ফেলে, তবে তাদের মুক্ত করে দেবে, তবুও তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করবে না। কেননা তারাও তোমাদের মতোই মানুষ, আল্লাহর সৃষ্টি। সকল মুসলিম একে অন্যের ভাই এবং তোমরা একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।
- জাহিলি যুগের সকল কুসংস্কার ও হত্যার প্রতিশোধ বাতিল করা হলো। তোমাদের পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহর বাণী এবং তাঁর রাসুলের আদর্শ রেখে যাচ্ছি। এগুলো যতদিন তোমরা আঁকড়ে থাকবে ততদিন তোমরা বিপথগামী হবে না।
- আমিই শেষ নবি। আমার পর কোনো নবি আসবে না।
- তোমরা যারা উপস্থিত আছ তারা অনুপস্থিতদের কাছে আমার বাণী পৌঁছে দেবে।
তারপর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আকাশের দিকে তাকিয়ে আওয়াজ করে বলতে লাগলেন, হে আল্লাহ! আমি কি তোমার বাণী সঠিকভাবে জনগণের নিকট পৌছাতে পেরেছি? সাথে সাথে উপস্থিত জনসমুদ্র থেকে আওয়াজ এলো, হ্যাঁ। নিশ্চয়ই পেরেছেন। অতঃপর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক।
এরপরই আল্লাহ তায়ালা নাজিল করলেন,
“আজ আমি তোমাদের ধর্মকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামত তোমাদের জন্য পরিপূর্ণ করে দিলাম। ইসলামকে তোমাদের জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম।”
(সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ৩)
মহানবি (সাঃ) কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। উপস্থিত জনতাও নীরব থাকল। অতঃপর সকলের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘আল-বিদা’ (বিদায়)। একটা অজানা বিয়োগ-ব্যথা উপস্থিত সকলের অন্তরকে ভারাক্রান্ত করে তুলল।
মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর ভাষণের মাধ্যমে যে দিকনির্দেশনা তুলে ধরেছিলেন বাস্তব জীবনে তিনি তা অনুশীলন করেছেন। আমরাও আমাদের ভাষণে বা বক্তব্যে যা বলব বাস্তব জীবনে তা অনুশীলন করব। তাহলে আমাদের দেশ ও জাতি আরও সুন্দর, সমৃদ্ধ ও উন্নত হবে।
পবিত্র ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট ইসলাম’ (inbangla.net/islam) এর সাথেই থাকুন।