Skip to content

 

ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতি

ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বর্ণনা

আলোচ্য বিষয়:

ইসলাম মানব জাতির ইহকালীন ও পরকালীন উৎকর্ষ সাধনের জন্য শিক্ষাকে অপরিসীম গুরুত্ব দিয়েছে। আল-কুরআনের প্রথম বাণি ‘ইক্রা’ অর্থাৎ পড়। এ থেকে ইসলামে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়।

মহানবি (সাঃ) সাহাবিদের শিক্ষার জন্য মক্কায় দারুল আরকাম নামক শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করেন এবং মসজিদে নববি মুসলমানদের শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন।

খুলাফায়ে রাশেদিনের আমলেও মুসলমানগণ শিক্ষা বিস্তারে অবদান রাখেন। উমাইয়া ও আব্বাসী শাসনামলে মুসলিম মনীষীগণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অবদান রাখেন।

রসায়নশাস্ত্র, ভূগোলবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, বীজগণিত, পাটিগণিত, জ্যামিতি, সাহিত্য, ইতিহাস ও জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি শাস্ত্রে মুসলমানগণ বিস্ময়কর অবদান রাখেন।

মুসলমানদের শিক্ষার বুনিয়াদ অতি শৈশবকালে মকতব থেকে শুরু হয়। পীর-মাশায়িখ, সুফী সাধক ও ইসলাম প্রচারকদের মাধ্যমে বাংলাশে ইসলাম প্রচার হয়েছে। তাঁরা এদেশে অসংখ্য মসজিদ-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন।

(১) ইসলামের পরিচয়

ক) ভূমিকা

ইসলাম আল্লাহ তাআলার একমাত্র মনোনীত ধর্ম। ইসলাম আরবি শব্দ। এটি (سلْ ٌم) শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ আত্মসমর্পণ করা, আনুগত্য প্রকাশ করা, শান্তির পথে চলা, মুসলমান হওয়া।

পরিভাষাগত অর্থ বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, জীবনদাতা ও মৃত্যুদাতা আল্লাহ তাআলার কাছে বিনা দ্বিধায় আত্মসমর্পণ করে তার আদেশ নিষেধ মেনে চলা। তাঁর দেয়া বিধান অনুসারে জীবন যাপন করা। আর যিনি ইসলামের বিধান অনুসারে জীবন যাপন করেন তিনি হলেন মুসলিম।

ইসলাম সকল নবি রাসূলের দ্বিন বা জীবন বিধান।

আল্লাহ তাআলা বলেন

‘‘তিনি তোমাদের জন্যে দ্বিনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারিত করেছেন যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি প্রত্যাদেশ  করেছি আপনার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে তোমরা দ্বিনকে প্রতিষ্ঠিত  করবে এবং পার্থক্য সৃষ্টি করবে না।’’

(সূরা আশ শুরা-৪২: ১৩)

সকল নবি যেমন মুসলিম ছিলেন, তেমনি হযরত নূহ (আ)  ইসলামের অনুসারি ছিলেন, যা তাঁর কথার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে।

পবিত্র কুরআনে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, হযরত  মূসা(আ) বলেন-

‘‘আমি মুসলিম হওয়ার জন্য আদিষ্ট হয়েছি।’’  

(সূরা ইউনুস ১০:৭২)

এ কারণেই হযরত ইরবাহীম (আ) নিজেকে ও নিজ উম্মতকে ‘উম্মতে মুসলিমা’ বলেছিলেন।

আল-কুরআনে এসেছে,

‘‘হে আমাদের পালনকর্তা। আমাদের উভয় কে মুসলিম করো এবং আমাদের বংশধর থেকে একটি মুসলিম তথা  আত্মসমর্পণকারী দল বানাও’’।

(সূরা বাকারা২: ১২৮) 

হযরত ইবরাহীম (আঃ) তাঁর সন্তানদের উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেন, 

‘‘তোমরা মুসলমান হওয়া ছাড়া কখনও মৃত্যুবরণ করো না’’।

(সূরা বাকারা ২:১৩২)

মোট কথা, প্রত্যেক নবি-রাসূল কর্তৃক আনীত দ্বিন বা ধর্ম হলো ইসলাম।

খ) ইসলামের মূল ভিত্তি

ইসলাম পাঁচটি মূল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। রাসূল (সাঃ) এর বাণী

“ইসলাম পাঁচটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর  বান্দা ও রাসূল, সালাত কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, রমযানের রোযা রাখা এবং হজ্জ করা। (সহিহ বুখারি, সহিহ  মুসলিম) 

ইসলামের এই পাঁচটি ভিত্তির বর্ণনা নিম্নে দেওয়া হল

i) তাওহিদ ও রিসালাতে বিশ্বাস 

এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল। অর্থাৎ তাওহিদ ও  রিসালাতে বিশ্বাস করা। আল্লাহর প্রভুত্ব জীবনের সর্বক্ষেত্রে মেনে নিয়ে সে অনুযায়ী কাজ করা। আল-কুরআনের উপর পূর্ণ  বিশ্বাস স্থাপন করে তাঁর অনুসরণ করা এবং মুহাম্মদ (সাঃ) কে সর্বশেষ নবি ও রাসূল হিসেবে স্বীকার করা। 

ii) সালাত কায়েম করা 

 ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ হল সালাত। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, বিবেকসম্পন্ন মুসলমান নর-নারীর উপর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত  সালাত আদায় করা ফরয। কোন মুসলমান সালাতকে অস্বীকার করলে সে আর মুসলমান থাকেনা। সালাত একজন  মুমিনকে সকল প্রকার অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে রক্ষা করে। 

iii) যাকাত আদায় করা 

যাকাত ইসলামের অন্যতম ভিত্তি। যাকাত হলো- কোন মুসলিম নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে বৎসরান্তে তার  সম্পদের শতকরা ২.৫ ভাগ কুরআন বর্ণিত ৮টি নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করাকে যাকাত বলে। যাকাত দিলে সম্পদ বিশুদ্ধ ও  পবিত্র হয়। সম্পদ বাড়ে ও সমাজ দারিদ্র মুক্ত হয়। 

iv) সিয়াম পালন করা 

সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় নিয়তের সাথে পানাহার ও যৌন ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত  থাকার নাম সাওম বা রোযা। প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ, মুসাফির নয় এমন ব্যক্তির উপর রমজান মাসের সিয়াম পালন করা  ফরয। সিয়াম ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম স্তম্ভ। রমজানের সিয়াম বা রোযা ছাড়াও শাওয়াল মাসের ছয়টি রোযা,  মান্নত রোযা এবং বৎসরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিনসমূহে রোযা রাখার বিধান রয়েছে। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি  তাকওয়ার অধিকারী হতে পারে। 

v) হজ্জ পালন করা

ইসলামের পাঁচটি বুনিয়াদের মধ্যে হজ্জ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। হজ্জ দৈহিক ও আর্থিক ইবাদত। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের  আশায় হজ্জের মাসের নির্ধারিত দিনসমূহে নির্ধারিত পদ্ধতিতে বায়তুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ ও সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহ যিয়ারত এবং  জিলহজ্জ মাসের নয় তারিখে আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হয়ে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ইবাদত করাকে হজ্জ বলে। আর্থিকভাবে  সামর্থবান ব্যক্তিদের উপর জীবনে একবার হজ্জ করা ফরয। 

খ) ইসলাম মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম 

ইসলাম মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম। আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিকর্তা হিসেবে তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের জীবন পরিচালনার জন্য বিধি  বিধান দিয়েছেন। সৃষ্টিকর্তা হিসেবে তিনি জানেন মানুষের জীবন যাপনের জন্য বিধি বিধান কেমন হওয়া উচিত। তাই,  তিনি মানুষের ইহকাল ও পরকালে মুক্তির জন্য বিধান দিয়েছেন। উক্ত বিধি-নিষেধ পালনের মাধ্যমে মানুষ ইহকালীন শান্তি  ও পরকালীন মুক্তি লাভ করতে পারে। আল্লাহ তাআলা মানুষ সৃষ্টি করার সময়ই তাকে সেই সহজাত প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি  করেছেন।

এ প্রসঙ্গে মহানবি (সাঃ)বলেন,

‘‘প্রতিটি শিশুই সহজাত প্রকৃতি তথা ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু  তাদের পিতা মাতার কারণে ইহুদির সন্তানেরা ইহুদি ধর্মে, খ্রিস্টানরা খ্রিস্টান ধর্মে এবং অগ্নি পুজকরা মাজুসী ধর্মে দীক্ষিত হয়ে থাকে’’।

(আবু দাউদ, তিরমিযি)

মানুষের মনের মধ্যে ইসলামি ফিতরাত থাকার কারণেই সে নিজেকে অসীম শক্তির  কাছে সঁপে দিতে চায়।

গ) সারসংক্ষেপ

  • ইসলাম আল্লাহ তাআলার একমাত্র মনোনীত ধর্ম। ইসলাম শব্দের অর্থ-আত্মসমর্পণ আর মুসলিম শব্দের অর্থ হচ্ছে আত্মসমর্পণকারী। হযরত আদম (আঃ) থেকে নিয়ে সকল নবি-রাসূল ইসলাম প্রচার করেছেন।
  • ইসলামের মূল ভিত্তি  পাঁচটি। যথা-
  1. এই সাক্ষ্য প্রদান করা যে আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল
  2. সালাত কায়েম করা
  3. যাকাত আদায় করা
  4. সিয়াম পালন করা
  5. হজ্জ পালন করা
  • যারা ইসলামের অনুশাসন  মেনে প্রতিটি আদেশ নিষেধ পালন করবে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ ও সাফল্য দান  করবেন।

(২) ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা

ক) ইসলাম শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম 

ইসলাম শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম। ইসলামে অনর্থক মানুষের সাথে ঝগড়া-বিবাদ করা নিষিদ্ধ কাজ। কাউকে  গালি দেওয়া, কারো কুৎসা রটনা করা বা চোগলখুরি করা ইসলামে নিষিদ্ধ। কাউকে ব্যঙ্গ করাও ইসলামে  বৈধ নয়।

ইসলামের মর্মবাণী হল- সকল মানুষ সমান। মানুষে মানুষে কোন শ্রেণি বিভাগ বা ভেদাভেদ নেই। সকল মানুষ  হযরত আদম(আ) থেকে সৃষ্টি। তাই আরব, অনারব, সাদা-কালো, ধনী, দরিদ্রের মাঝে কোন পার্থক্য নাই। একজন অপর  জনের বিপদে আপদে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিবে।

রক্তের বন্ধন ছিন্ন করা ইসলামে নিষিদ্ধ। ভাই ভাই হয়ে  একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার বিধান ইসলামে রয়েছে। অনর্থক কোন প্রাণি হত্যা করাকেও ইসলাম অপরাধ  হিসেবে গণ্য করে। 

মহানবি হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) বলেন,

‘‘মুসলমান সেই ব্যক্তি যার হাত এবং মুখের অনিষ্টতা থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ থাকে’’।  

(তিরমিযি, নাসায়ি)

আল্লাহ তাআলা মহানবি হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) কে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

 ‘‘আমি তো আপনাকে বিশ্ববাসীর প্রতি রহমত রূপেই প্রেরণ করেছি’’।

(সূরা আম্বিয়া ২১: ১০৭)

সুতরাং ইসলাম সর্ব প্রকার জুলুম, নির্যাতন, শোষণ, ও ব না থেকে মানুষকে মুক্ত করে শান্তির ছায়াতলে আশ্রয় দেয়।  ইসলাম শুধু মানুষের প্রতি ন্যায়সঙ্গত আচরণ ও ইনসাফ কায়েম করার কথা বলেনা; প্রাণিকূলের প্রতি দয়া ও সদাচরণ এবং তাদের অধিকার রক্ষার তাগিদও দিয়েছে। 

খ) ইসলাম মানুষের স্বভাবজাত ও বিশ্বজনীন ধর্ম 

আল্লাহ তাআলা মানুষের ফিতরাত বা স্বভাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই ইসলামের বিধি বিধান দিয়েছেন। তাই ইসলাম মানুষের  স্বভাবজাত ধর্ম। ইসলামের মধ্যে এমন কিছু নেই, যা পালন করা মানুষের জন্য কষ্ট সাধ্য।

বিশ্বনবি (সাঃ) বলেছেন,  

“প্রতিটি শিশু সহজাত ধর্ম বা ইসলামি ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে।”

(আবু দাউদ, তিরমিযি)

এই হাদিস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, প্রতিটি শিশুর মাঝেই হিদায়াত গ্রহণ তথা ইসলামি শরিয়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার  মতো গুণাবলি রয়েছে। ইসলামি শরিয়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা মানবের স্বভাবের পরিপন্থী নয়। 

আল্লাহ তাআলা বলেন,   

“আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, কঠিন করতে চান না”। .

(সূরা বাকারা ২: ১৮৫)

 এ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, ইসলামের অনুসরণ এবং ইসলাম পালন অত্যন্ত সহজ কাজ, কঠিন কিছু নয়। 

গ) ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা 

হযরত আদম (আ) থেকে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) পর্যন্ত পৃথিবীতে অসংখ্য নবি রাসূল আগমন করেছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই  নিজ নিজ যুগে নিজ নিজ জাতি ও দেশের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তি ছিলেন। আল্লাহ তাঁদেরকে শুধু দ্বিন প্রচারের  জন্যই প্রেরণ করেননি। তাঁদের অনেকেই আবার জগত বিখ্যাত ও ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন। প্রত্যেক নবি ও রাসূলের  শরিয়াত ভিন্ন ভিন্ন থাকলেও দ্বিন ছিল ইসলাম। এই দ্বিন ইসলাম হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মাধ্যমে পরিপূর্ণতা লাভ  করেছে।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আখেরি নবি ও রাসূল। ইসলাম হচ্ছে সকল নবি রাসূলের শরিয়াতের নির্যাস।

আল্লাহ  তাআলা বলেন,

‘‘আমি সকল বিষয়ের সুস্পষ্ট বিবরণ দিয়ে এই গ্রন্থখানা অবতীর্ণ করেছি’’।

(সূরা আন-নাহল ১৬:৮৯)

এ আয়াত দ্বারা স্পষ্ট করা হয়েছে যে, মানব জীবনে যা কিছু প্রয়োজন তার সব কিছুর নীতি নির্ধারণী বর্ণনা আল কুরআনে  রয়েছে। মহানবি (সাঃ) এর পবিত্র জীবনাদর্শ হচ্ছে আল কুরআনের ব্যাখ্যা। আল্লাহ তাআলা ইসলামকে পরিপূর্ণতা দান  করে আয়াত নাযিল করেছেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন,   

‘‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বিনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ পূর্ণ করলাম এবং  দ্বিন হিসেবে ইসলামকে তোমাদের জন্য মনোনীত করলাম’’।

(সূরা আল-মায়িদাহ ৫:৩)

ঘ) সারসংক্ষেপ

  • ইসলাম শান্তি ও সম্প্রতির ধর্ম। ইসলামে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষ সমান। ইসলামে কোন শ্রেণি বিভেদ নেই।  আরব, অনারব, সাদা, কালো, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই।
  • ঝগড়া-বিবাদ ইসলামে নিষিদ্ধ কাজ। মানুষকে  হিংসা-বিদ্বেষ, ঝগড়া-বিবাদ, গালি-গালাজ, চোগলাখুরি করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। ইসলামে  কোন কঠোরতা নাই। আল্লাহ তাআলা সকল কাজ মানুষের সামর্থ্যরে মধ্যে রেখেছেন। ইসলামে কোন কিছু অস্পষ্ট নয়।  আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য সব কিছু স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
  • আল-কুরআন ইসলামি শরিয়াতের মূল উৎস। ইসলাম  একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। তাই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করা সকল মানুষের জন্য কল্যানময়।

(৩) ইসলামি শিক্ষা

ক) ইসলামি শিক্ষার পরিচয় 

“যে শিক্ষা ব্যবস্থায় সৃষ্টিকর্তাকে জানার এবং ইসলামকে একটি পরিপূর্ণ জীবনাদর্শ হিসেবে শিক্ষা দেওয়ার ও  গ্রহণ করার ব্যবস্থা আছে, তাই ইসলামি শিক্ষা”।

এ শিক্ষা ব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থী ইসলামের গুরুত্ব  অনুধাবন করে জীবনের সর্বক্ষেত্রে তার প্রয়োগ করার সুযোগ পায়। শিক্ষাথীরা ইসলামি চেতনা ও আদর্শে গড়ে উঠে এবং  ব্যক্তি পরিবার, সমাজ, ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামের আদর্শ অনুযায়ী জীবন পরিচালনার যোগ্যতা অর্জন করে।

এ শিক্ষার  মূল ভিত্তি হলো আল কুরআন এবং মহানবি (সাঃ) এর সুন্ন্াহ। এ শিক্ষা আদর্শ জীবন ও সমাজ গঠনের যুগোপযোগী শিক্ষা।  এ শিক্ষা গ্রহণ করা প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর উপর ফরয। 

খ) ইসলামি শিক্ষার উদ্দেশ্য 

সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও ইলাহকে সঠিকভাবে জানা এবং স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক কী হবে তা জানার জন্য ইসলামি শিক্ষা  গ্রহণ করা অপরিহার্য। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবন পদ্ধতি সম্পর্কে জানার জন্যও ইসলামি শিক্ষা গ্রহণ করতে  হবে।

ইসলামি শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ স্রষ্টার সঠিক পরিচয় লাভ করে, তাঁর উদ্দেশ্যে সঠিকভাবে ইবাদত করতে সক্ষম হয়। ইসলামি সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য ও জ্ঞান বিজ্ঞানের অফুরন্ত ভান্ডারের সাথে পরিচয়ের জন্য ইসলামি শিক্ষা  অত্যাবশ্যক।

মানুষ আল্লাহর খলিফা হিসেবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য ইসলামি শিক্ষা লাভ করা অতীব  জরুরি। 

গ) ইসলামি শিক্ষার বৈশিষ্ট্য 

i) অহী ভিত্তিক শিক্ষা 

ইসলামি শিক্ষার মূল ভিত্তি হলো আল-কুরআন। ইসলামি শিক্ষার দ্বিতীয় ভিত্তি হচ্ছে মহানবি (সাঃ) এর হাদিস। তাই এ  শিক্ষা অন্যান্য শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।

এ শিক্ষার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার পরিচয় জানা যায় এবং  মানুষের প্রতি আল্লাহর অধিকার এবং আল্লাহর প্রতি মানুষের যে অধিকার রয়েছে তা জানা যায়। 

ইসলামি শিক্ষা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তাআলার একত্ববাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ তাআলার পরিচয়, রিসালাত,  মুআমালাত ও মুআশারাত সংক্রান্ত শিক্ষা বাদ দিয়ে ইসলামি জীবন ও সমাজ কল্পনা করা যায় না। আল-কুরআনের প্রথম  বাণীই হলো সৃষ্টিকর্তার নামে শিক্ষা গ্রহণ করার নির্দেশ সম্বলিত।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

‘‘পড়ো, তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন’’।  

(সূরা আলাক-৯৬:১)

ইসলামের সকল শিক্ষাই কুরআন-হাদিসের আলোকে রচিত। মানুষের পার্থিব জীবনে যে শিক্ষার প্রয়োজন হয়, তা কুরআন  সুন্নাহর নির্দেশনা অনুযায়ী করলে তা ইসলামি শিক্ষায় পরিণত হয়। 

আল্লাহ তাআলা বলেন,

‘‘রাসূল যা নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ করো এবং যা থেকে বিরত করেন তা বর্জন করো’’।

(সূরা হাশর ৫৯:৭)

মহানবি (সাঃ) বলেন,

‘‘আমি তোমাদের কাছে দু’টো জিনিস রেখে যাচ্ছি- যতো দিন তোমরা তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে রাখবে, ততদিন তোমরা  পথভ্রষ্ট হবে না। তা হ’ল আল্লাহর কিতাব আর তাঁর রাসূলের সুন্নাহ।”  

(মুয়াত্তা)

ii) নৈতিকতা সম্বলিত শিক্ষা 

ইসলামি শিক্ষার মাধ্যমে একজন মানুষ ইসলামি বিশ্বাস ও মূল্যবোধের আলোকে সকল কাজ কর্মে আল্লাহর কাছে  জবাবদিহিতার চেতনা লাভ করে। এ নৈতিক শিক্ষা মানুষকে সকল প্রকার অন্যায়-অসত্য, জুলুম, নির্যাতন করা থেকে পুত পবিত্র রাখে। মানুষের চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস ও চরিত্রকে পরিশুদ্ধ করে। 

iii) ইহকাল ও পরকালের কল্যাণময় শিক্ষা 

ইসলামি আকিদা বিশ্বাস অনুযায়ী একজন মুসলমানকে দুনিয়া ও আখিরাত এই উভয় জগতের মঙ্গল ও শান্তির জন্য  দুনিয়াতেই কাজ করতে হয়। ইসলামি শিক্ষা দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করে। অন্যান্য শিক্ষায়  শুধু জাগতিক কল্যাণের দিকটা প্রাধান্য পায়।

See also  শিক্ষার্থীর বৈশিষ্ট্য

আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে দু‘আ করার বিষয়বস্তু শিখাতে গিয়ে এভাবে বলেছেন,

‘‘হে আমাদের প্রভু। আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ দান কর’’।  

(সূরা বাকারা ২: ২০১)

মানুষকে ইহকালে সুখ-সমৃদ্ধি লাভের কথা যেমন ভাবতে হয়, তেমনি পরকালের কথাও চিন্তা করতে হয়।  ইসলামি শিক্ষা শুধু বৈষয়িক কিংবা ধর্মীয় কোন শিক্ষা নয়। মানব জাতির গোটা জীবন ব্যবস্থা তথা পার্থিব ও পারলৌকি  প্রয়োজন পূরণ করার জন্য এ শিক্ষা অপরিহার্য। 

ঘ) সারসংক্ষেপ

  • যে শিক্ষা ব্যবস্থায় মানুষ তার সৃষ্টিকর্তাকে জানার এবং ইসলামকে একটি পরিপূর্ণ জীবনাদর্শ হিসেবে শিক্ষা দেওয়ার ও  গ্রহণ করার ব্যবস্থা রয়েছে, তাই ইসলামি শিক্ষা।
  • ইসলামি শিক্ষা গ্রহণ করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরয। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করার নির্দেশ রয়েছে ইসলামে। আল্লাহর দ্বিনকে সমুন্নত রাখার এবং প্রচারের জন্য প্রত্যেক মুসলমানকে ইসলামি শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়।
  • ইসলামি শিক্ষা অহী ভিত্তিক শিক্ষা। ইসলামি  সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অফুরন্ত ভান্ডারের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্যও ইসলামি শিক্ষা  অপরিহার্য। ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি অপরাধ কর্ম থেকে সহজে বিরত থাকতে পারে। তাই ইসলামি শিক্ষার গুরুত্ব  অপরিসীম।

(৪) প্রাথমিক শিক্ষায় মকতব-এর ভূমিকা

ক) মকতব এর পরিচয় 

মাকতাব (مكتب) শব্দটি আরবি। এর শাব্দিক অর্থ লেখার স্থান, শিক্ষা কেন্দ্র, বিদ্যালয় ইত্যাদি। ব্যবহারিক অর্থে  মাকতাব বা মকতব হচ্ছে- ইসলামের মৌলিক শিক্ষালয়। মুসলিম শিশুদের ইসলামি শিক্ষার প্রাথমিক কেন্দ্র।

একজন  মুসলিম শিশু মায়ের কোল ছেড়ে ইসলামি শিক্ষার হাতেখড়ি এখানেই হয়। এ প্রতিষ্ঠানে কোমলমতি শিশুরা ইসলামের  মৌলিক জ্ঞান অর্জন করে। আরবি বর্ণমালার পরিচয়, যুক্ত বর্ণগঠন, শব্দ গঠনসহ বাক্য গঠন এখানেই শিখে। অতঃপর  কুরআন শরীফ শিক্ষা গ্রহণ এই মকতব থেকেই হয়ে থাকে।

মকতবের মাধ্যমেই কোমলমতি শিশুকে ইসলামের সাথে  পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। এখানে পবিত্র কুরআন পাঠ শিক্ষার সাথে সাথে ইসলামের বুনিয়াদি বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হয়।

ইমান, ইসলাম, সালাত, সাওম, হজ্জ ও অন্যান্য ইবাদত বিষয়ক শিক্ষা শিশুরা এখান থেকেই গ্রহণ করে থাকে। এখান  থেকেই সালাত আদায় করার পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া হয়। ব্যবহারিক জীবনের প্রয়োজনীয় আদব-কায়দা, শিষ্টাচার, সত্য কথা  বলার গুরুত্ব, নম্রতা, ভদ্রতা, সৌজন্য, বড়দের শ্রদ্ধা করা ও ছোটদের স্নেহ করার শিক্ষা এখান থেকেই লাভ হয়। শরীর মন  পবিত্র করার শিক্ষা এখানেই গ্রহণ করে থাকে। শিশু বয়সে মকতবে অর্জিত শিক্ষা মানুষকে পরিণত বয়সেও ইসলামি  তরিকায় জীবন যাপন করতে সহায়তা করে। 

এ প্রয়োজনবোধ থেকে প্রতিটি মহল্লায়, প্রতিটি গ্রামে ও জনপদে মসজিদের পাশাপাশি ইসলামি শিক্ষা কেন্দ্র মকতব গড়ে  উঠেছে। মকতব গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মকতব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন  করে আসছে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণভাবে মুসলিম জন-সাধারণের কষ্টার্জিত অর্থে পরিচালিত হয়। 

খ) মকতবের ঐতিহাসিক পটভূমি 

ইসলামের মৌলিক শিক্ষা বিস্তারের জন্য ইসলামের প্রথম যুগেই পবিত্র মক্কা নগরীতে দারুল আরকাম নামক মাদরাসা  প্রতিষ্ঠিত হয়। যা ইসলামি শিক্ষার সূতীকাগার হিসেবে পরিচিত। এরই ধারাবাহিকতায় রাসূল (সাঃ) ও সাহাবায়ে কিরামের  যুগে মসজিদে দ্বীন শিক্ষার ব্যবস্থা করা হতো।

মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মদিনায় হিজরত করার পর মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে এর মধ্যে গড়ে তোলেন ইসলামি শিক্ষা কেন্দ্র। শিশু-কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ সকল বয়সের জ্ঞান পিপাসুরা দেশের বিভিন্ন  অঞ্চল থেকে এখানে আসতো। এরই ধারাবাহিকতায় মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র মসজিদ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হতে থাকে। 

আব্বাসী আমলের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক ও উচ্চ পর্যায়ের দুই ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো মকতব।

৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানগণ স্পেন বিজয় করেন। সেখানে মুসলমানগণ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান  গড়ে তোলেন। শুধু কর্ডোভাতেই ছিল দুইশত প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৭০টি কলেজ এবং ৭০টি পাবলিক লাইব্রেরি।

ভারত বর্ষে  মুসলিম শাসকগণ কয়েক শতক পর্যন্ত শাসনকার্য পরিচালনা করেন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে এবং  ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের পর থেকে এদেশে অসংখ্য দ্বিনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয়ভাবে ও আলিম-উলামাগণের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠে। এ সকল প্রতিষ্ঠানে যেমন মৌলিক শিক্ষা দেওয়া হতো,  তেমনি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানও শিক্ষা দেওয়া হতো।

মুঘল আমলে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হতো মকতবে। শিশুর শৈশবের  প্রথম পাঠ হিসেবে পবিত্র কুরআন শিক্ষার মাধ্যমে শুরু হতো পাঠ্য জীবন। আর সে সময়ের বেশির ভাগ মকতব ছিল  মসজিদ চত্বরে। অষ্টাদশ শতাব্দিতে ভারত বর্ষে প্রায় ৮০ হাজার মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত ছিল। 

ভারতে মুসলিম শাসনামলে শিক্ষার স্তর তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত ছিল। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা স্তর। ইসলামের  মৌলিক ও নৈতিক শিক্ষা ছিল প্রাথমিক স্তরের অন্তর্ভুক্ত। মকতবেই মূলত এই প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হতো। এ থেকে  বোঝা যায় যে, ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ধারায় মকতবের গুরুত্ব অনেক বেশি। 

গ) মকতবের কার্যাবলী 

মকতবে ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা দেওয়া হয়। এই মকতবে কালিমা, সালাত, সাওম, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি মৌলিক  ইবাদত আদায় করার পদ্ধতি শিশুদেরকে হাতে কলমে শিক্ষা দেওয়া হয়। মকতবেই শিশুদেরকে সালাতের নিয়ম কানুন,  আহকাম-আরকান,ওয়াজিব,সুন্নাত,ইত্যাদি শিক্ষা দেওয়া হয়। 

শৈশব থেকেই শিশুদেরকে মৌলিক আকিদা-বিশ্বাস ও ইমান সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করতে হয়। ইমান আকিদা বিশ্বাস  সংক্রান্ত শিক্ষা কার্যক্রম প্রাথমিকভাবে এই মকতবই দিয়ে থাকে। তাছাড়া প্রাথমিক মাসআলা-মাসায়িল সংক্রান্ত বিষয়াদি  এই মকতব থেকেই শিক্ষা দেওয়া হয়। সুতরাং মকতবের কার্যাবলী মুসলিম জীবনে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। 

ঘ) মকতবের প্রয়োজনীয়তা 

  1. মুসলিম জীবনে মকতবের প্রয়োজনীয়তা খুবই বেশি। মকতব মুসলিম জীবনে ইমানের যে বীজ বপন করে। তা-ই একদিন  মহীরূহ ধারণ করে। কাজেই মুসলিম সমাজ সকল যুগেই মকতব প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করে আসছে।
  2. শিশুদের কোমলমতি  মন হলো কাদা মাটির মতো। ইসলামের পথে চলার জন্য শিশুদের মকতবের শিক্ষাই বেশি কার্যকর ও ফলপ্রসূ হয়ে থাকে। মানুষের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক গুণাবলীর উন্নয়নই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। একজন শিশু মকতবের শিক্ষার মাধ্যমে এ  সকল মানবীয় গুণাবলী অর্জন করতে পারে। 
  3. মকতবে পড়ালেখার মাধ্যমে শিশুর মনে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের মূল ভিত্তি স্থাপিত হয়। কাজেই মকতবের প্রয়োজনীয়তা  অনস্বীকার্য। বলা যায় যে, মকতবই শিশুদের ইমান ও নৈতিক ভীত গঠনের উপযুক্ত স্থান।

(৫) ইসলামি সংস্কৃতি

ক) সংস্কৃতির পরিচয় 

সংস্কৃতি শব্দটি সাধারণত সাকাফাহ, তাহ্যিব, তামাদ্দুন বা কালচারের প্রতিশব্দ। আরবিতে যাকে বলা হয়  সাকাফাহ্ (ةَ قافَثَ) সংস্কৃতি শব্দটি সংস্করণ বা সংস্কার বিশেষ্য পদ থেকে গঠিত। সংস্করণ অর্থ বিশোধন,  সংশোধন। আর সংস্কার অর্থ শুদ্ধিকরণ, শাস্ত্রীয় নীতিমালা ও অনুষ্ঠানাদি দ্বারা পবিত্রকরণ বা শোধন করণ, পরিষ্কার বা  নির্মল করণ, উৎকর্ষ সাধন, উন্নতি বিধান ও মেরামতকরণ। 

অতএব, সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের উপযুক্ত, সুন্দর, মার্জিত ও পরিশীলিত আচার-আচরণ, আহার-বিহার, চলাফেরা, শোক তাপ, আনন্দ-বেদনার অভিব্যক্তি, শিল্প, সাহিত্য, ভাষা, ধর্মীয় রীতি-নীতি, মানবিক ও আধ্যাত্মিক চিন্তা-ভাবনা এবং  মানুষের দিন রাত্রির হাজারো কাজ-কর্ম এ সব কিছুরই সমষ্টি। 

খ) ইসলামি সংস্কৃতি পরিচয় 

ইসলামি জীবন দর্শনের আলোকে মানুষের ব্যবহারিক জীবন ও পরিবেশে যে সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়েছে তাই ইসলামি সংস্কৃতি। 

ইসলামি সংস্কৃতিতে ইসলামি মূল্যবোধ, আকীদা-বিশ্বাস ও আচরণিক কার্যাদি সবই ইসলামি শরিয়াতের অনুকূল থাকে।  শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য শিল্প ইত্যাদি ইসলামি ভাবধারায় গড়ে উঠে। 

এক কথায়, জীবনের বিভিন্ন স্তরে ইসলামি মৌল বিশ্বাসের ভিত্তিতে যত নিয়মাবলী, বিধি-বিধান পালনীয় এর সব কিছুই  ইসলামি সংস্কৃতির অঙ্গ।

ইসলামি জীবন বোধের বিপরীতে কোন আচার-আচরণ ও কৃষ্টি কোন মুসলমান গ্রহণ করলে তা  ইসলামি সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হয়না। বরং বিজাতীয় অনুকরণ, কুসংস্কার, বিদআত ও ক্ষেত্র বিশেষে শিরক হিসেবে  আখ্যায়িত হয়। ইসলামি সংস্কৃতিতে বিজাতীয় অনুকরণ নিষিদ্ধ।

মহানবি (সাঃ) বলেন,

‘‘যে ব্যক্তি অপর জাতির অনুসরণ করবে সে সেই জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হবে’’।  

(মুসনাদে আহমদ)

গ) ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার গুরুত্ব 

ইসলামি শরিয়াতের মূল দাবি অনুযায়ী একজন মানুষ চিন্তা ও কর্মের সংস্কার ও পরিশুদ্ধি ছাড়া প্রকৃত মুসলমান হতে পারে না। তাই, একজন মানুষকে ইসলামি সংস্কৃতিতে সংস্কৃতিবান হতে হলে প্রথমে মুসলমান হতে হবে অর্থাৎ ইসলামের  পরিপূর্ণ অনুসারি হতে হবে।

ইসলামি সংস্কৃতি ইমানের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এটি ইমানের রক্ষাকবচ। মুসলিম জাতির পরিচিতি কেবল ইসলামি সংস্কৃতির মাধ্যমেই তুলে ধরা সম্ভব।

সমাজে যদি ইসলামি সংস্কৃতির চর্চা না  থাকে তাহলে বিজাতীয় সংস্কৃতি সেখানে বাসা বাঁধে। বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে জাতীয় সত্তা, পরিচিতি বা জাতীয় ঐক্য রক্ষার জন্য ইসলামি সংস্কৃতির চর্চা আবশ্যক।

ঘ) ইসলামি সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য 

ইসলাম যেমন কালজয়ী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, তেমনি ইসলামি সংস্কৃতিও কালজয়ী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এ সংস্কৃতির  বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ সংস্কৃতি মানব রচিত কোন কিছু থেকে উৎসারিত নয়। এ সংস্কৃতির উৎস হলো আল-কুরআন ও সুন্নাহ। সকল মানুষের  জন্য এ সংস্কৃতি অপরিহার্য। আল্লাহ তাআলা মানব জাতির জন্য যে জীবন পদ্ধতি দান করেছেন তাই এই সংস্কৃতির মূল  উৎস।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

“নিঃসন্দেহে ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র দীন।”  

(সূরা আলে ইমরান ৩: ১৯)

ইসলামি সংস্কৃতি বিশ্বজনীন। এটা কোন দেশ, কাল বা স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। একজন মুসলমান যে কোন দেশের,  যে কোন সমাজের বা যে কোন কালের হোক না কেন ইসলামি সংস্কৃতি তাকে সুন্দর ও শালীন জীবন দান করে। 

ইসলামি সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- মানুষে মানুষে কোন প্রভেদ না করা। উচুঁ-নিচু, সাদা-কালো, আরব-অনারব এর  মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। সকলেই আদম সন্তান আর আদম মাটির তৈরি।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেন, 

‘‘সকল মানুষ আদম (আ:) থেকে উৎসারিত আর আদম (আ:) মাটি থেকে তৈরি’’।  

(তিরমিযি, মুসনাদে আহমদ)

ইসলামি সংস্কৃতি সাম্যের ধারক ও বাহক। সকল মানুষ ইসলামের দৃষ্টিতে সমান। বর্ণবাদ, শ্রেণিবাদ ও আভিজাত্যবাদের  কোন স্থান ইসলামে নেই।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

‘‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যদাসম্পন্ন যে, তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকি’’।

(সূরা আল হুজুরাত-৩৯:১৩)

ইসলামি সংস্কৃতি ইমান ও আমলের সমন্বয়ে গঠিত। একজন মুসলমান যা বিশ্বাস করে তা আমলে পরিণত করা তার জন্য  অপরিহার্য কর্তব্য। ইসলামে ইমান ব্যতীত আমলের যেমন কোন মূল্য নেই, তেমনি আমল ব্যতীত ইমানের কোন মূল্য নেই। একজন মানুষকে ইসলামি সংস্কৃতিবান তখনই বলা হবে, যখন ইমান ও আমলের সমন্বয়ে তার জীবন পরিচালিত  হয়।

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,

“যারা ইমান আনে ও সৎ কর্ম করে, তাদের আপ্যায়নের জন্য রয়েছে জান্নাতুল ফেরদাউস’’।  

(সূরা কাহাফ-১৮:১০৭)

ইসলামি সংস্কৃতিতে ইহকালীন জীবন ও পরকালীন জীবন একই সূত্রে গাথা। তাই ধর্ম ও সমাজ বা রাষ্ট্রকে আলাদা করে  দেখানো যায় না। 

ইসলামি সংস্কৃতিতে বেহায়াপনা, নির্লজ্জতা, ধোকাবাজি করা, অশ্লীলতা ও উলঙ্গপনার কোন স্থান নাই। মার্জিত রুচিশীল ও  পরিশীলিত জীবনাচার হল ইসলামি সংস্কৃতি। 

ঙ) সারসংক্ষেপ

  • ইসলামি সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের উপযুক্ত, সুন্দর ও মার্জিত ও পরিশীলিত আচার-আচরণ, আহার-বিহার, চলাফেরা, শোক তাপ, আনন্দ-বেদনার অভিব্যক্তি। মানুষের শিল্প-সাহিত্য, ভাষা, ধর্মীয় রীতি-নীতি, মানবিক ও আধ্যাত্মিক চিন্তা-ভাবনা।  ইসলামি মূল্যবোধ, আকিদা-বিশ্বাস, আচরণিক কার্যাদি ইত্যাদি ইসলামি সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া শিল্প, সাহিত্য,  সঙ্গীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য শিল্প ইত্যাদি ইসলামি ভাবধারায় গড়ে উঠে।
  • ইসলামি সংস্কৃতিতে বেহায়াপনা, নির্লজ্জতা,  অশ্লীলতা ও উলঙ্গপনার কোন স্থান নাই। মার্জিত, রুচিশীল ও পরিশীলিত জীবনাচার ইসলামি সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য।

(৬) ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষা, জ্ঞান ও বিজ্ঞান চর্চা

শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। মুসলমানগণ শিক্ষা ও  জ্ঞান-বিজ্ঞানে পৃথিবীকে আলোকিত করেছে। মুসলমানদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের  উন্নয়নে মুসলমানদের অবিস্মরণীয় অবদানের বিষয়ে এখানে জানাবো। 

ক) শিক্ষা বিস্তারে মহানবি (সাঃ) এর পদক্ষেপ

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। তিনি নবুওয়াত লাভের পর থেকে তাঁর গৃহকে শিক্ষালয় হিসেবে  ব্যবহার করেন। তাঁর স্ত্রী হযরত খাদিজা (রা.) ও হযরত আয়েশা (রা) ছিলেন আদর্শ শিক্ষক। মহানবি (সাঃ) এর মৃত্যুর  পর তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণের গৃহ ছিল নারীদের শিক্ষা কেন্দ্র। হযরত হাফসা (রা) ও উম্মে সালমা (রা.) নারী শিক্ষায় অগ্রণী  ভূমিকা পালন করেন। 

নবুওয়াতের প্রাথমিক পর্যায়ে মক্কার নিরিবিলি স্থানে হযরত আরকাম (রা.) এর বাড়িটি বিদ্যা শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে  পরিগণিত হয়। এখানে মুসলিমগণ একত্রিত হয়ে শিক্ষা লাভ করতেন। তাছাড়া মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ইসলাম  গ্রহণকারী নও মুসলিমদের শিক্ষা দানের জন্য গোত্রে গোত্রে শিক্ষক সাহাবিদের পাঠাতেন। আর সেখানে সাহাবিদের  তত্ত্বাবধানে শিক্ষায়তন গড়ে উঠত। 

মক্কা থেকে হিজরতের পর তিনি মসজিদে নববিকে শিক্ষার মহাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন। তিনি মসজিদে নববির  প্রাঙ্গণে “সুফ্ফা” নামে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলেন। দেশের বিভিন্ন অ ল থেকে বহু মানুষ এখানে শিক্ষা  গ্রহণের জন্য আসতেন। অনেক সাহাবি “সুফফা” বিশ্ববিদ্যালয়ের আজীবন ছাত্র ও শিক্ষকের ভূমিকায় ব্যাপৃত ছিলেন। 

মহানবি (সাঃ) নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও শিক্ষা বিস্তারে এত গুরুত্ব দিতেন যে, বদরের যুদ্ধে শিক্ষিত যুদ্ধ বন্দীদের মুক্তিপণ  নির্ধারণ করে ছিলেন কয়েক জন নিরক্ষর মুসলিমকে শিক্ষাদান করার মাধ্যমে। 

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর শিক্ষার প্রভাবে ও প্রত্যক্ষ প্রেরণায় আরবরা এক সুসভ্য শিক্ষিত জাতিতে পরিণত হয়। 

খ) শিক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানে খুলাফায়ে রাশেদিনের অবদান 

মানব জাতির মহান শিক্ষক মহানবি (সাঃ) এর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষার বুনিয়াদ খোলাফায়ে রাশেদিনের আমলে ব্যাপক ও বিস্তৃতি  লাভ করে। খুলাফায়ে রাশেদিনের চার খলিফা শিক্ষা বিস্তারে অতুলনীয় ভূমিকা পালন করেন। মহানবি (সাঃ) এর আমলের পর এ যুগে পরিকল্পিত উপায়ে মসজিদ কেন্দ্রিক শিক্ষা শুরু হয়। এ সময়ে তাফসিরুল  কুরআন, হাদিস, ফিকহ শাস্ত্র ও প্রাক-ইসলামি যুগের কবিতা পঠন-পাঠন হতে থাকে। 

হযরত আবুবকর (রা.) পবিত্র কুরআন একত্রে গ্রন্থাকারে সংকলনের মহান দায়িত্ব পালন করেন। আর পরবর্তীতে হযরত  উসমান (রা.) একই পঠন রীতিতে পবিত্র কুরআনের সংকলন করেন। হযরত আবুবকরের (রা.) আমলে মসজিদে নববি ছিল প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র। খুলফায়ে রাশেদিনের আমলে রাষ্ট্রিয়ভাবে ইসলাম প্রচারের সাথে সাথে শিক্ষা বিস্তারের জন্য  ব্যাপক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। 

খলিফা হযরত আলী (রা.) নিজেই একজন অসাধারণ পন্ডিত ও বিজ্ঞানী ছিলেন। হযরত আলী (রা.) নিজেই দর্শন,  ইতিহাস, ন্যায়শাস্ত্র, ব্যাকরণ, হাদিস, কাব্য ইত্যাদির উপর সাপ্তাহিক মজলিসে বক্তৃতা দিতেন। তাঁর শাসনামলে রাষ্ট্রের  বিখ্যাত শিক্ষা নগরীগুলোর ঔজ্জ¦ল্য দেদীপ্যমান হয়ে সাম্রাজ্যের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। 

চার খলিফার মধ্যে হযরত উমর (রা) শিক্ষা বিস্তারে বেশি কাজ করেন। তিনি শিক্ষা বিস্তারের অংশ হিসেবে দামেশক,  সিরিয়া, বসরা, কুফা প্রভৃতি বিখ্যাত শহরে পাঠ দান করার জন্য বিদ্বান ব্যক্তিদের প্রেরণ করেন। তখন হযরত আবদুল্লাহ  ইবনে মাসউদের অধীনে প্রায় ৪০০০ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করত। কুফা নগরীতে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ২৪ জন সাহাবিসহ  সহস্রাধিক সাহাবির জ্ঞানের স্পর্শে কুফা নগরী আলোকিত হয়েছিল। 

গ) শিক্ষার উন্নয়ন ও জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশে উমাইয়া খলিফাদের অবদান

উমাইয়া যুগের শিক্ষার বিষয়বস্তু আরো ব্যাপকতা লাভ করে। এই যুগের শিক্ষা ব্যবস্থায় হালাল-হারামের বিষয়াদি, আরবি  ব্যাকরণ, ইসলামের বিজয় ইতিহাস নতুন আঙ্গিকে পাঠদান করা হয়। এ ছাড়া দেশপ্রেম, সামরিক বিভাগে যোগদানের জন্য  উৎসাহমূলক বক্তৃতা, তীর নিক্ষেপ, ঘোড়দৌড়, শিক্ষা, সফর এবং সাঁতার কাটা শিক্ষা দেয়া হয়। উমাইয়া খলিফা উমর ইবনে আবদুল আযিযের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় হাদিস সংকলনের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন  করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। 

উমাইয়া শাসনামলে কুফা, বসরা, দামেশক, মক্কা ও মদিনায় অনেক বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। উমাইয়া আমলে  ধর্মীয় আইন-কানুন ফিকহ শাস্ত্র প্রণীত হয় এবং বিধিবদ্ধ মাযহাব সৃষ্টি হয়। 

এ সময়ে ভূগোল, জ্যোর্তিবিদ্যা, অনুবাদ ও চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রতি মনোযোগ দেওয়া হয়। উমাইয়া যুগের বৈজ্ঞানিক খালেদ  বিন ইয়াজিদ ছিলেন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রবর্তক। জাফর আস সাদিক রসায়ন বিজ্ঞানের জনক জাবির আল হাইয়ানের  উস্তাদ ছিলেন। 

ঘ) শিক্ষা বিস্তার ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে আব্বসীয় খলিফাদের অবদান 

আব্বাসী যুগকে শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণ যুগ বলা হয়। শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখাই তাঁদের অবদানে সমৃদ্ধ  হয়। আব্বাসী আমলে সাম্রাজ্যের সর্বত্র অসংখ্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।

বাগদাদ, কায়রো ও কর্ডোভাতে উচ্চ পর্যায়ের  বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক জ্ঞান চর্চা হত। আব্বাসী আমলে শিক্ষাকে জনগণের দোর গোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য অসংখ্য পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ সকল পাঠাগারে গবেষণা বিভাগ ও অনুবাদ বিভাগ  থাকত। 

খলিফা আল-মামুনের শাসনামলে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গভীর গবেষণা ও অন্য ভাষায় রটিত মুণ্যবান গ্রন্থ অনুবাদের  জন্য ‘বাইতুল হিকমাহ’ নামে একটি প্রতিষ্টান চালু করা হয়।

See also  মানবজাতির কল্যাণে আল-কুরআনের শিক্ষা

বায়তুল হিকমাহ ইতিহাস বিখ্যাত ছিল। আব্বাসী শাসনামলে সাহিত্য কলা ও সংস্কৃতির বিপুল উৎকর্ষ সাধিত হয়। ভাষাতত্ত্ব, অলংকার শাস্ত্র , উপন্যাস, কবিতা  প্রভৃতি শাস্ত্র এ আমলে ব্যাপক উৎকর্ষতা লাভ করে। এ যুগে প্রাচীন আরবি কবিতাসমূহ পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। 

ইসলামি জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা যেমন-হাদিস, তাফসির, ফিকহ, আকাইদ প্রভৃতি বিষয়সমূহের চর্চা ও গবেষণা  ব্যাপকভাবে চলতে থাকে। ফিকহকে বিধিবদ্ধ শাস্ত্র হিসেবে এ যুগেই সম্পাদনা করা হয়। তাছাড়া ছিহাহ সিত্তার হাদিস গ্রন্থ  সমূহ আব্বাসী শাসনামলেই সম্পাদিত হয়। 

বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে এ যুগের মনীষী পন্ডিতদের সৃজনশীল অবদান আধুনিক কালেও বিস্ময়কর বলে মনে হয়।  আব্বাসী যুগে চিকিৎসা শাস্ত্র, গণিত শাস্ত্র, উদ্ভিদ বিদ্যা, জ্যোর্তিবিদ্যা, ভূতত্ত্ব বিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে অভাবনীয় উন্নতি সাধিত  হয়।

আব্বাসী আমলে মুসলমানগণ গ্রিক, সংস্কৃত, পারসী, সিরীয় ভাষা হতে অসংখ্য মূল্যবান গ্রন্থ অনুবাদ করেন। ফলে,  বিপুল সংখ্যক মুসলিম পন্ডিত, মনীষী ও বিজ্ঞানীর ছোঁয়ায় দুনিয়া ভরে উঠে। 

স্পেনে জ্ঞান বিজ্ঞানের সম্প্রসারণে মুসলমানদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালি থেকে  শিক্ষার্থীরা এখানে এসে ভীড় জমাত। স্পেনের কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালে শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। স্পেনে শিক্ষা ও সংস্কৃতির যে বিপুল উন্নতি সাধিত হয়েছিল তা বুঝা যায় সেখানকার শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানীদের ঐতিহাসিক  কার্যকলাপ এবং বিশ্বখ্যাত লাইব্রেরি সমূহের কার্যক্রম দেখে। শুধু কর্ডোভাতেই ১৭০ জন শিক্ষাবিদ বিজ্ঞানীর জন্ম হয়েছিল। 

প্রাচীন মিশরে ও মুসলমানগণ জ্ঞান বিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছিলেন। গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবী মিশরে অনেক  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। ফাতেমী আমলে মিশরে প্রচুর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মহিলা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়।  খলিফা আল হাকাম জ্ঞান চর্চার জন্য দারুল হাকাম প্রতিষ্ঠা করেন। এই ভবন থেকে কবিতা, আইন, ব্যাকরণ, সমালোচনা,  আয়ুর্বেদ, জ্যোতির্বিদ্যা, শব্দ বিজ্ঞান প্রভৃতি পাঠদান করা হত। 

ঙ) সারসংক্ষেপ

  • মহানবি (সাঃ) ছিলেন মানব জাতির মহান আর্দশ শিক্ষক। তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণের গৃহ ছিল আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
  • খুলাফায়ে  রাশেদিনের মহান খলিফাগণ শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষার উন্নয়ন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের  বিকাশে উমাইয়া খলিফাগণ বিশেষ অবদান রাখেন।
  • আব্বাসী শাসনামলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখা তাঁদের অবদানে  সমৃদ্ধ হয়। আব্বাসী যুগে চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত শাস্ত্র, উদ্ভিদ বিদ্যা, জ্যোর্তিবিদ্যা, ভূ-তত্ত্ববিদ্যা, রসায়নবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে  অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়।
  • মুসলমানগণ গ্রিক, সংস্কৃত, পারসি ও সিরিয় ভাষা হতে অসংখ্য মূল্যবান গ্রন্থ অনুবাদ  করেন। ফাতেমী আমলে মিশরে প্রচুর কলেজ, মহিলা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। মোটকথা মুসলিম খলিফাগণ  শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সম্প্রসারণে বিপুল অবদান রেখে গেছেন।

(৭) সাহিত্য ও দর্শন শাস্ত্রে মুসলিমদের অবদান

ক) সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান 

ইসলামে সাহিত্যের গুরুত্ব রয়েছে। শিক্ষার অন্যান্য শাখার ন্যায় সাহিত্যেও মুসলমানদের অবদান বিস্ময়কর। অবশ্য,  ইসলাম সাহিত্যকে সব সময় পরিশীলিত ও মানব কল্যাণময় রাখার চেষ্টা করে। 

পবিত্র কুরআন মানব জাতির জন্য এক আদর্শ, অতুলনীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাহিত্য। কুরআন নাযিলের কারণে ইসলামপূর্ব  যুগের অশ্লীল কাব্য বন্ধ হয়ে যায়। সাহিত্যে নতুন দিগন্তের উন্মেষ ঘটে। পবিত্র কুরআনকে কেন্দ্র করে তাফসির এবং  হাদিস সাহিত্য বিশ্বে অতুলনীয় স্থান দখল করেছে।

হাদিস আরবি সাহিত্যের অমূল্য ভান্ডার। হাদিসকে কেন্দ্র করে  সাহিত্যের আরো অনেক শাখা সৃষ্টি হয়েছে। যার দ্বারা মানুষ চিন্তা চেতনা ও নৈতিকতার উৎকর্ষতা লাভ করছে। হাদিসের  ভাষা খুবই উন্নত ও মার্জিত। এটি আদর্শ সাহিত্যের পরিচয় বহন করে। 

হযরত হাস্সান ইবনে সাবিত: রাসূল (সাঃ) এর যুগে শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন। 

হযরত আয়িশা (রা): কাব্যপ্রতিভার অধিকারী ছিলেন। হাদিস শাস্ত্রে তাঁর অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। 

ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা): একজন কবি, সাহিত্যিক, সুবক্তা ও সুলেখক ছিলেন। তাঁর রচিত ‘‘নাহজুল  বালাগাহ ও দীওয়ান-ই-আলী’’ সাহিত্য রত্ন হিসেবে বিবেচিত।

খলিফা আল-মানসুর: জ্ঞান বিজ্ঞানের একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি কবিতা পছন্দ করতেন এবং কাব্য রসিক ছিলেন। আরবি কবিতাবলী তাঁরই আগ্রহে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ হয়। 

খলিফা হারুন-অর-রশিদ: নিজেই একজন কবি ছিলেন। তাঁর সময়েই বিখ্যাত আরব্য উপন্যাস “আলিফ লায়লা ও লায়লা”  গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ হয়। 

খ) দর্শন শাস্ত্রে মুসলমানদের অবদান 

জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে সকল শাখায় মুসলমানগণ গৌরবোজ্জ্বল অবদান রেখেছেন তার মধ্যে “দর্শন শাস্ত্র” অন্যতম। গ্রিক  দর্শনের উত্তরাধিকার এবং দর্শন চিন্তায় নতুন প্রাণের সার, এই ছিলো মুসলিম দর্শনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কুরআন  থেকেই মুসলমানগণ দর্শন শাস্ত্র চর্চার প্রেরণা লাভ করেন। কেননা, স্রষ্টা ও সৃষ্টির পরিধি, ব্যাপ্তি ও ব্যাপকতার চিন্তা থেকেই  মূলত ইসলামি দর্শনের সূচনা। 

ইসলামি দর্শন হলো ‘‘সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর ইচ্ছা ও বিধান মোতাবেক জীবন পরিচালনা করার জন্য বিশ্ব প্রকৃতির চর্চা  করা’’। সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করার পর মানুষ নিজের যুক্তির কি রকম ব্যবহার করে তা দিয়েই তার  বিচার হবে-এই মতবাদের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতার ধারণা। নবি মুহাম্মদ (সাঃ) নিজেই এর  শিক্ষা দান করেছেন। এ ধারণা সাহাবায়ে কিরামের হাতে আরো স্পষ্টতা লাভ করে একটি পূর্ণাঙ্গ দর্শনে পরিণত হয়। 

তারপর অব্যাহতভাবে এই দর্শন দামেশ্ক, কুফা, বসরা ও বাগদাদে উদার নৈতিক চিন্তাধারার সৃষ্টি করে এবং আব্বাসী  শাসনামলে তা পূর্ণতা লাভ করে। তখন মুসলিম জাতির মধ্যে সৃষ্টি হয় একাধিক দার্শনিক সম্প্রদায়ের। সূফিবাদ, মুতাযিলা  মতবাদ এবং আশআরী মতবাদ প্রভৃতি ইসলামের দার্শনিক চিন্তা ধারার ফসল। 

মুসলিম দর্শন চিন্তা আব্বাসী আমলে ব্যাপকতা লাভ করে। খলিফা মনসূরের আমলে (৭৫৪-৭৭৫) গ্রিক, সংস্কৃতি ও  পাহলভী ভাষার গ্রন্থাদি ব্যাপকভাবে আরবিতে অনুবাদ হতে থাকে। তাছাড়া, এরিস্টটল, টলেমী, ইউক্লিড প্রভৃতি গ্রিক  মনীষীদের গ্রন্থ আরবিতে অনূদিত হয়। খলিফা মামুনের আমলে এই তৎপরতা আরো ব্যাপকতা লাভ করে।

মুসলিম  দার্শনিকদের মধ্যে দুইটি ধারার সৃষ্টি হয়। একটি আল-কুরআনের দ্বারা প্রভাবিত, অন্যটি গ্রিক দর্শন দ্বারা।

আল-কুরআনের  ধারায় রয়েছেন হযরত আলী, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, ইমাম জাফর সাদিক, ইমাম রাযী , ইমাম গাযালী প্রমুখ। অন্য  ধারায় যে সকল মনীষী রয়েছেন তাঁরা হলেন- আল-কিন্দী, আল-ফারাবী, ইবনে সীনা, ইবনে রুশদ, ইবনে তুফাইল প্রমুখ  দার্শনিক ও বিজ্ঞানীগণ।

দার্শনিকদের মধ্যে আরো খ্যাতিমান হচ্ছেন-ইবনে বাজা, ইয়াহিয়া আন-নাহবী, আবুল ফারায আবু  সুলাইমান আল-সাজযী, থাবিত বিন কোরা, মুহাম্মদ আল-মুকাদ্দেসী, আহমদ ইবনে সাহা আল-বালখী, ইউসুফ ইবনে  মুহাম্মদ নিশাপুরী, হাসান ইবনে সাহল ইবনে মুহাবির, আহমদ ইবনে তাইয়্যিব আল-সারাখসী এবং আবুল হাসান আল আমবী অন্যতম। 

ইমাম গাযালি: মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ ও দার্শনিক ছিলেন। তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এহইয়ায়ে উলুমুদ্দিন (ধর্মীয় বিজ্ঞানের পুনর্জীবন), কিমিয়ায়ে সাআদাত, (সৌভাগ্যের পরশমণি), এবং তাহাফুত-ফালাসিফা। 

ইবনে রুশদ: আরব জগতের শ্রেষ্ঠতম চিন্তানায়কদের অন্যতম এবং পৃথিবীর যে কোন বিখ্যাত দার্শনিকদের সাথে তাঁর  তুলনা হতে পারে। প্লেটোর রিপাবলিক গ্রন্থের ব্যাখ্যা, ফারাবির যুক্তি শাস্ত্রের সমালোচনা এবং ইবনে সীনার সূত্রের  আলোচনা তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম। 

ইবনুল আরাবি: সূফী দর্শন মতবাদের সূচনা করেন। তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হলো আল-ফুতুহাতুল মাক্কিয়া এবং আল-হিকাম।  দর্শন শাস্ত্রের আরেক দিকপাল হলেন-ফার্সী কবি জালালূদ্দিন রুমী (১২০৭-১২৭৩)। রুমির দর্শন চিন্তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন তাঁর  সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা “মসনবি”। 

আল্লামা ইকবাল: ঊনিশ শতকের খ্যাতিমান কবি ও দার্শনিক ছিলেন (১৮৭৩-১৯৩৮)। তিনি পারস্য দর্শন সম্পর্কে  গবেষণার জন্য জার্মানির মিউনিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। পাশ্চাত্য দর্শন এবং ইসলামি দর্শনের  বোঝাপড়া ছিল তাঁর দার্শনিক চিন্তার অন্যতম বিষয়। 

গ) সারসংক্ষেপ

  • আলা-কুরআন এক অতুলনীয় সাহিত্য ভান্ডার। পবিত্র কুরআনকে কেন্দ্র করে তাফসীর এবং হাদিস সাহিত্য অতুলনীয়  স্থান দখল করেছে।
  • দর্শন শাস্ত্রে মুসলমানদের অবদান অবিস্মরনীয়। ইসলামি দর্শন হলো “ সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর ইচ্ছা  ও বিধান মোতাবিক জীবন পরিচালনা করার জন্য বিশ্বপ্রকৃতির চর্চা করা”।
  • মুসলিম দার্শনিকগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য  হলেন- আল-কিন্দী, আল-ফারাবী, ইবনে সীনা, ইবনে রুশদ, ইবনে তুফাইল প্রমূখ দার্শনিক ও বিজ্ঞানীগণ।

(৮) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মুসলিমদের অবদান

ক) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে মুসলিম মনীষীগণ

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এক নয়। উভয়ের মাঝে পার্থক্য রয়েছে।

আমাদের চার পাশে যা কিছু ঘটছে তা কেন, কীভাবে ঘটছে  তার জবাব অনুসন্ধানই হল বিজ্ঞান।

এজন্যই বিজ্ঞানীরা নানা পরীক্ষা, নিরীক্ষা, গবেষণা, গণনা, পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। 

অন্যদিকে প্রযুক্তি হচ্ছে, বিজ্ঞানের উপাদেয় আবিষ্কার গুলোকে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহার করা।

বিজ্ঞান দেয় জ্ঞান আর  প্রযুক্তি দেয় এর প্রয়োগের কলা কৌশল। 

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে মুসলিম জাতির অবদান অসামান্য। মুসলিম বিজ্ঞানীগণের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আবিস্কার ও তার  প্রয়োগ বিশ্ব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। মুসলমানদের ইবাদত চন্দ্র-সূর্য পরিক্রমণ হওয়ার কারণে জ্যোতির্বিজ্ঞানের  দিকে দৃষ্টি দিতে হয়।

  • বিজ্ঞানী আল ফাজারী প্রথম সমুদ্রে সূর্য ও নক্ষত্রসমূহের উচ্চতা নির্ণয়ের জন্য Astrolabe আস্তারলব  নির্মাণ করেন। এই যন্ত্র তৈরি ছাড়া ও তিনি অঙ্কশাস্ত্রের অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নির্মাণ করেন।
  • কর্ডোভার বিজ্ঞানী আল জারকালী (১০২৯-১০৮৭) টলেডোর রাজপ্রাসাদের বাগানে দুই চৌবাচ্চা নিয়ে একটি জলঘড়ি নির্মাণ করেন।  চন্দ্রকলার হ্রাস বৃদ্ধি অনুযায়ী এই দুইটি চৌবাচ্চার পানি নিয়ন্ত্রিত হতো। 
  • বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী নাসির উদ্দিন আল তূসী (১২০১-১২৭৪) মান মন্দিরে নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে প্রয়োজনীয় সূক্ষ্ম  যন্ত্রপাতি তৈরির ব্যবস্থা করেন। এতে উদ্ভাবিত যন্ত্রগুলো যে শুধু বৈজ্ঞানিক মানসম্মত তা নয়, এর সূক্ষ্ম কারুকাজ অতীব  বিস্ময়কর। যন্ত্রপাতির নির্মাণ এবং প্রয়োগ বিধি বর্ণনা করে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এতে এগারটি যন্ত্রের বিবরণ পাওয়া  যায়। 
  • গ্রহ, নক্ষত্র, চন্দ্র ও পৃথিবীর বিভিন্ন পরিমাপের জন্য মুসলিম প্রযুক্তিবিদগণ নানা ধরনের স্কেল উদ্ভাবন করেন। তার মধ্যে  ডায়াগোনাল স্কেল, আকাশ ফলক, বলয় ও ফলক আলিদাদ ও রুলার ও সংযোগ ফলক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।  মুসলমানরা যে রাসায়নিক জ্ঞান অর্জন করেন তার ভিত্তিতে তারা নিম্নোক্ত বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে বিশাল উন্নয়ন ও প্রযুক্তি  জ্ঞান কাজে লাগায়। মধ্যে : 
  1. Pharmaceutical or Medicinal Preparation.
  2. Paper Making.
  3. Glass Enamel and pottery Glassing.
  4. Chemicals Prepared on the basis of acquired Khowledge for Various applications- অন্যতম।
  • পানি ঠান্ডা করার প্রযুক্তি প্রথমে মুসলমানরা আবিষ্কার করেন। গ্যাস ঘনীভূতকরণ, ঠান্ডা পানি দিয়ে স্পঞ্জ কাপড় ইত্যাদি  আর্দ্র করতে এ যন্ত্র ব্যবহৃত হত। খনিজ তেল উত্তোলন ও পরিশোধন প্রক্রিয়ায় মুসলমানরা সাফল্য লাভ করে। কীভাবে  অপরিশোধিত তেলকে শোধন করা হতো তার প্রক্রিয়া বর্ণনা করেছেন আল রাজী তাঁর গ্রন্থ Book of the secret of secret।
  • সুগন্ধি ও তৈল উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রযুক্তিও মুসলিম বিজ্ঞানীরাই তৈরি করেন। এ শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল দামেশ্ক।  এখান থেকে উৎপাদিত পণ্য সুদূর ভারত বর্ষ ও চীনে রপ্তানি হতো।
  • ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুসলমান কর্তৃক সমরকন্দ বিজয় করার পর চীনাদের কাছ থেকে কাগজ তৈরির পদ্ধতি আয়ত্ত্বে আনে।  মুসলমানদের প্রথম কাগজ তৈরির কারখানা স্থাপিত হয় বাগদাদে ৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে। কাগজ শিল্পে মুসলমানদের অবদানের  মধ্যে বাঁশের ছাঁচ আবিষ্কর, কাগজ উৎপাদনে তিসি, লিনেন এবং সূতি কাগজের খন্ডাংশের ব্যবহার, প্রক্রিয়াজাতকরণ,  কাগজকলে পানিবাহিত চাকার সাহায্যে হাতুড়ি চালানো ইত্যাদি অন্যতম।
  • বাঁশের ছাঁচ আবিষ্কারের ফলে মুসলমান বিজ্ঞানীগণ কাগজ তৈরির প্রযুক্তিকে বহুদূর এগিয়ে নিয়েছিলেন। কাগজ তৈরির  জন্য নেয়া এটিই সত্যিকার প্রথম পদক্ষেপ, কারণ কারিগররা একই ছাঁচ থেকে একহারা লম্বা সীট তৈরি করতে পারতেন। 
  • পশম, লিনেন, তুলা, রেশম প্রভৃতি ছিল মুসলিম বস্ত্রশিল্পের প্রধান কাঁচামাল। ভেড়ার লোম, মোহাইর নামক এঙ্গোরা  ছাগলের পশম দিয়ে তৈরি হতো সুন্দর সুন্দর পশমী কাপড়, শাল ও কোট। স্পেনের আসবেলিয়া শহরে ১৫১ হিজরিতে  ১৬ হাজার কারখানায় বস্ত্র উৎপাদিত হতো। মারিরা ও খিরা শহরে ৬ হাজার কারখানা শুধু রেশমী, সার্টিং ও পশমী কাপড়  তৈরি হতো।
  • তাছাড়া কার্পেট শিল্পে ও মুসলমান বিজ্ঞানীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। একাদশ শতাব্দীর মুসলিম  কারিগরদের হাতে চামড়া তৈরির প্রযুক্তির উন্নতি সাধিত হয়। এ শিল্পটি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে বিপুল প্রভাব বিস্তার করে।  লেদার প্রযুক্তিতে মুসলিম প্রবর্তিত রীতিই বিশ্বে ঊনিশ শতক পর্যন্ত চালু ছিল। 
  • যন্ত্রকৌশল, বই বাঁধাই ও সিরামিক শিল্প, কাঁচ শিল্প, সাবান শিল্প, ধাতব শিল্প, কালি ও রঞ্জক পদার্থ তৈরী প্রভৃতি শিল্পে  প্রযুক্তিগত দিক থেকে মুসলমানগণ অগ্রগামী ছিলেন। 

খ) সারসংক্ষেপ

আল কুরআন একটি বিজ্ঞানময় গ্রন্থ। ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই মুসলমানগণ আল-কুরআনের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে  বিজ্ঞান চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। আব্বাসী যুগে মুসলিম বিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন। আল কুরআনের বিজ্ঞানময়তার কারণে মুসলমানদের শিক্ষা, গবেষণা এবং আবিস্কার খুলে দিয়েছিল আধুনিক সভ্যতার দ্বার।  মুসলমানগণইই বিভিন্ন ভাষা থেকে বিভিন্ন বিষয়ের বই-পুস্তক আরবিতে অনুবাদ করে জ্ঞান-ভান্ডার সমৃদ্ধ করেছিলেন।

(৯) ভূগোল ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে মুসলিমদের অবদান

ক) ভূগোল শাস্ত্রে মুসলমানদের অবদান 

পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন নির্দেশনা এবং ঐতিহাসিক স্থানের বিবরণ প্রভৃতি মুসলমানদেরকে ভূগোল শাস্ত্র অধ্যয়নে উদ্বুদ্ধ  করেছে। তাছাড়া পবিত্র হজ্জ পালন, নামাযের জন্য কিবলা নির্ধারণ, পৃথিবীর জল-স্থল, পাহাড়-পর্বত, মৃত্তিকা, অরণ্য,  জলবায়ু, দেশ-দেশান্তরের মানুষ, সমুদ্রের জোয়ার ভাটা, ঋতু পরিবর্তন, দিন-রাত্রির আবর্তন এবং চন্দ্র-সূর্যের কক্ষপথ  সম্পর্কে যে আল-কুরআনে কৌতুহল উদ্দীপক অসাধারণ বৈজ্ঞানিক বিবরণ রয়েছে তা জানার জন্যই মুসলমানগণ ভূ-বিদ্যার  দিকে গভীরভাবে দৃষ্টিনিক্ষেপ করেছেন। মহানবি (সাঃ) এর বাণী তাঁদেরকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে।

আব্বাসী  খিলাফত প্রতিষ্ঠা ও বাগদাদে মুসলিম জাহানের রাজধানী প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মুসলমানরা ভূ-বিদ্যার প্রতি বেশি আগ্রহী  হয়েছে।

আব্বাসী শাসনামলে মুসলমানগণ এশিয়া, ইউরোপ, স্পেন ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ বিজয়ের পর সেখানে গমন  সহজতা ও ইসলামের আদর্শ প্রচারের জন্য ব্যাপক গবেষণা করেন। গ্রিক ভূগোলবিদদের তথ্য উপাত্ত দ্বারা মুসলমাগণ  আরো এ বিদ্যাকে সমৃদ্ধ করেন। তাঁরা গ্রিকদের বহু ভূগোল গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করেন মূসা আল খাওয়ারিজমী(মৃত্যু- ৮৪৭ খৃ:) এবং সাবিত বিন কুরা (মৃত্যু-৯০১ খৃ:) 

কয়েকজন বিখ্যাত ভূগোলবিদ ও তাঁদের অবদান-

  • আল-খাওয়ারিজমী: নবম শতকের শ্রেষ্ঠ ভূ-বিজ্ঞানী ছিলেন। তাঁর রচনার দ্বারা আরবিতে ভূ-বিজ্ঞানের ভিত স্থাপিত হয়। “সুরাতুল আরদ”  নামক গ্রন্থটি আজও তাঁকে অমর করে রেখেছে। খলিফা আল মামুনের আমলে যে সকল মনীষী পৃথিবীর প্রথম মানচিত্র  অংকন করেন তাঁদের মধ্যে আল-খাওয়ারিজমী অন্যতম। খাওয়ারেজমীর নেতৃত্বে বিজ্ঞানীদের একটি দল ফোরাত নদীর  উপরে পামিরের নিকটবর্তী সিনজিরার পরিমাপ কার্য চালান। তিনি পৃথিবীর পরিধি ২০ হাজার ৪০০ মাইল এবং ব্যাস  ৬৫০০ মাইল বলে মতামত দেন। 
  • ইয়াকুব বিন ইসহাক আল কিন্দি: জ্যোতির্বিদ্যা ও দর্শন চর্চার পাশাপাশি ভূগোল চর্চায় ও খ্যাতি অর্জন করেন। ভূগোল  বিষয়ে তাঁর দুটি মৌলিক গবেষণা রয়েছে। তা হলো-‘রাসমুল মামুর মিনাল আরদ’ এবং “রিসালাতুল বিহার ওয়াল মাঁল  ওয়াল জাযর”। 
  • ইবনে খুরদাদবিহ: সর্ব প্রথম ভূগোল বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁকে আরবি ভূ-গোলবিদদের জনক বলা হয়। তাঁর ‘কিতাবুল  মামালিক ওয়াল মামালিক’ একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ। এতে প্রধান প্রধান বাণিজ্য পথ এবং জাপান, চীন, কোরিয়া প্রভৃতি দেশের বর্ণনা রয়েছে।
  • ইবনে ওয়াদী আল ইয়াকুবী (মৃ:২৭৮ হি): ভূগোল বিদ্যায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর গ্রন্থ “কিতাবুল বুলদান” এ  অনেক ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক আলোচনা রয়েছে। 
  • মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আল মুকাদ্দেসী (মৃত্যু ৩৭৫ হি:): সর্বশ্রেষ্ঠ ভূগোলবিদ ছিলেন। সুদীর্ঘ ২০ বৎসর ভ্রমণ করে তিনি  পৃথিবীর বহু নির্ভুল তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেন। মুসলিম জাহানকে তিনি ১৪টি ভাগে বিভক্ত করে প্রত্যেক বিভাগের পৃথক  মানচিত্র তৈরি করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল- “আহসানুত তাকাসীম ফী সারিফাতিল আকালিম”। 
  • ইয়াকুত আল হামাভী (১১৭৯ খৃ:): গ্রিক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ১২২৮ সালে “মাজমাউল বুলদান’’ নামক গ্রন্থ  রচনা করেন। এই পুস্তকে তিনি বিভিন্ন জাতির বিবরণ এবং বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞানের তথ্য বর্ণের ক্রমানুসারে সজ্জিত করেন এটি একটি বিশ্বকোষ হিসাবে মর্যাদা প্রাপ্ত। 
  • আল-বিরুনী (৯৭৩-১০৪৮): ছিলেন বিশ্বের প্রথিত ভূগোলবিদদের অন্যতম। তাঁর রচিত অমর গ্রন্থ “কিতাবুল হিন্দ”।  তিনিই সর্ব প্রথম পৃথিবীর গোলাকার মানচিত্র তৈরি করেন। “কিতাবুত তাফহীম’’ গ্রন্থে এ বিষয়ে তিনি বিস্তারিত ভাবে  আলোকপাত করেন। 
  • আল ইদ্রিসী (জন্ম-১০৯৯): মুসলিম বিশ্বের অনন্য প্রতিভার অধিকারী ভূগোলবিদ। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম “কিতাবুল  রোজারী”। তিনি একটি খ-গোলক (Galestial sphere) তৈরি করেছিলেন এবং একটি গোলকে পৃথিবীর অবস্থান নির্দেশ  করেছিলেন। তিনি প্রায় ৭০টি মানচিত্র রচনা করেছিলেন এবং এতে পৃথিবীর অক্ষাংশ পরম্পরায় ৭টি আবহাওয়া বিভাগ  চিহ্নিত করেছিলেন।  

মুসলিম ভূগোলবিদদের মধ্যে আরো যারা খ্যাতি লাভ করেছিলেন তাদের মধ্যে আল মাসউদী, ফাজারী, ফারাগানী, আবু  ইসহাক ফারিসী, আল হারাবী, তকী উদ্দিন আল বদরী, আবু হামিদ আল কাদাসী এবং শামসুদ্দিন সূয়ুতী অন্যতম।

See also  ইলম শব্দের অর্থ, কী, কাকে বলে, কত প্রকার? ইলমের গুরুত্ব

খ) জ্যোতির্বিদ্যায় মুসলমানদের অবদান 

জ্যোতির্বিজ্ঞান মহাকাশ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞান। এটি এমন এক বিজ্ঞান যাতে আকাশ ম-লের গ্রহ-নক্ষত্র প্রভৃতি  জ্যোতিস্কের শ্রেণি বিভাগ, গতিবিধি এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আলোচিত হয়েছে। 

জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্র এক নয়। জ্যোতিষশাস্ত্র হলো ভবিষ্যত গণনামূলক শাস্ত্র। জ্যোতির্বিজ্ঞানে আলোচিত হয়  গ্রহ-নক্ষত্র, চন্দ্র-সূর্য ও অতিলৌকিক বস্তুসমূহের গতিবিধি। আর জ্যোতিষ শাস্ত্রে আলোচনা করা হয়, মানুষ ও সাম্রাজ্যের  উপর গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব সম্পর্কে। 

জ্যোতিষ শাস্ত্র ইসলামে নিষিদ্ধ হলেও বহু মুসলিম বিজ্ঞানী জ্যোর্তিবিজ্ঞানের পাশাপাশি জ্যোতিষ শাস্ত্রও চর্চা করেছেন।  তবে, তাঁরা রাশি নির্ণয় ও ব্যক্তি সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী করা থেকে বিরত থাকতেন। যাঁরা ভবিষ্যত গণনার বিরোধিতা  করতেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন- ইবনে সীনা, ইবনে রুশদ, আল গাযালি, আল বিরুনী এবং নাসির উদ্দিন তুসি। 

মুসলমান বিজ্ঞানীগণ পৃথিবীর আকার, অক্ষাংশের বিবর্তন সংক্রান্ত তথ্য নিরূপণ করেন। গ্রহের তির্যক গতি সম্পর্কে আল মাইমুন এবং বায়ু মন্ডল সংক্রান্ত প্রতিফলন তথ্য আবুল হাসান আবিস্কার করেন।

মুসলমানরাই সর্ব প্রথম ইউরোপে  মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলিম বিজ্ঞানীরাই প্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্র, দিক নির্ণয় যন্ত্রসহ দোলক ও অন্যান্য যন্ত্র আবিস্কার  করেন। 

জ্যোতির্বিজ্ঞানের কয়েকজন মুসলিম মনীষী-

মুহাম্মদ ইবরাহীম আল ফাজারী: আব্বাসী খলিফা আল মনসুরের দরবারের বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি বহু  গ্রন্থ রচনা ও অনেক প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আবিস্কার করেন। 

আল নিহাওয়ান্দি: প্রথম যুগের একজন প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ ছিলেন। তিনি গবেষণা করে যে “মুসতামাল” নামক নির্ঘন্ট  প্রণয়ন করেছিলেন যা গ্রিক ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে সমাদৃত হয়েছিল।  ক্স আল খাওয়ারেজমী- ইসলামের ইতিহাসের এক অনন্য সাধারণ বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ আল খাওয়ারিজমী(৭৮০- ৮৫০খ্রি:) জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জন করেন। তাঁর প্রস্তুতকৃত নির্ঘন্ট পরবর্তীতে সম্পাদিত হয় এবং  এডোলার্ড কর্তৃক ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। বিভিন্ন যন্ত্রের ব্যবহারবিধি সম্পর্কে তিনি ‘‘কিতাবুল আমল বিল  এ্যাস্ট্রোলেব’’ নামক দুইটি বই সহ অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেন।

আল ফারাগানী: আল মামুনের শাসনামলের অন্যতম জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি পৃথিবীর ব্যাস নতুন করে পরিমাপ  করেছিলেন এবং গ্রহসমূহের আপেক্ষিক দূরত্ব নির্ধারণ করেছিলেন। 

আবু মাশার আল বালখী: একজন বিশিষ্ট জ্যোতির্বিদ ছিলেন। তাঁর চারটি গ্রন্থ ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়।  ক্স আল বাত্তানী ছিলেন মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী। জ্যোতির্বিদ্যার উপর তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ হল “কিতাবুল  জিজ”। 

আবু রায়হান আল বেরুনি (জন্ম-৯৭৩ খৃ:): বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। বিজ্ঞানে তাঁর সুবিশাল গ্রন্থ হচ্ছে  “কানুনে মাসউদী”। তিনি ত্রিকোণোমিতিকে উচ্চ স্তরে উন্নীত করেন। 

অন্যান্য বিজ্ঞানের পাশাপাশি ইবনে সীনা জ্যোতির্বিজ্ঞানেও বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি সংখ্যা গণনার জন্য যন্ত্রপাতির  উদ্ভবের দিকে বেশি নযর দেন। ফলে, সূক্ষ্ম গণনার উপযোগী Vernier এর মতো একটি যন্ত্র আবিস্কার করেন। দশম শতাব্দির শেষের দিকে বহু জ্যোতির্বিজ্ঞানী বাগদাদে বসবাস করতেন। এঁদের আবিষ্কার, গবেষণা গ্রন্থ ও সূত্রের মাধ্যমে আধুনিক ইউরোপ ও বিশ্ববাসী আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় আত্মনিয়োগ করে। 

ঘ) সারসংক্ষেপ

  • আমরা জানি যে আল-কুরআন একটি বিজ্ঞানময় গ্রন্থ। আল-কুরআনে বর্ণিত বিভিন্ন নির্দেশনা, ঐতিহাসিক স্থানের  বিবরণ, নামাযের জন্য কিবলা নির্ধারণ, জোয়ার-ভাটা, ঋতু পরিবর্তন, দিন-রাত্রির আবর্তন এবং চন্দ্র-সূর্যের কক্ষ পথ  সম্পর্কে আল কুরআনে বর্ণিত অসাধারণ বৈজ্ঞানিক বিবরণ মুসলমান ভূগোলবিদদেরকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছে। মহানবি (সাঃ) এর বাণী মুসলমানদেরকে ভূগোল চর্চায় আরো বেশি উৎসাহিত করেছে।
  • আল-বেরুনী সর্ব প্রথম পৃথিবীর  গোলাকার মানচিত্র রচনা করেন। আল-ইদ্রিসী পৃথিবীর ৭০টি মানচিত্র রচনা করেন। আল-কুরআনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ  অনুপ্রেরণায় বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো জ্যোতির্বিজ্ঞানে মুসলমানগণ অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে ইতিহাসে স্মরণীয়  হয়ে আছেন। মুসলমান বিজ্ঞানীগণ পৃথিবীর আকার ও অক্ষাংশের বিবর্তন সংক্রান্ত তথ্য নিরূপণ করেন।

(১০) চিকিৎসা শাস্ত্রে মুসলিমদের অবদান

ক) ইসলামের প্রাথমিক যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞান 

মুসলমানদের মধ্যে চিকিৎসাবিদ্যার ধারণা আল-কুরআনকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয়েছে। পবিত্র কুরআনের ৬৬৬৬টি  আয়াতের মধ্যে ৩৫৫ টি আয়াতে চিকিৎসার ইঙ্গিত রয়েছে। জার্মান পন্ডিত Dr. Carl Opitzy এ সকল আয়াত নিয়ে  বিশদ আলোচনা করেছেন।

আয়াতগুলোকে তিনি তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা:

Medicin তথা চিকিৎসা বিষয়ক:

এতে রয়েছে-

  • সৃষ্টি, ভ্রণ, গর্ভধারণ, গর্ভাবস্থা, শিশু পরিচর্যা, আয়তকাল ইত্যাদির আলোচনা। 
  • শরীর জ্ঞান-(Anatomy), শরীর বৃত্ত (Physiology) 
  • নিদানশাস্ত্র (Pathology), নিদান (Eteology), মননবিদ্যা (Psychologhy), মনন-নিদান (Psycho-Pathology) 
  • সাধারণ চিকিৎসা ও বিশেষ চিকিৎসা 
  • মৃত্যু ও পুনর্জীবন। 

Hygine তথা স্বাস্থ্য বিদ্যা:

  • ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি: পোশাক, বিশ্রাম, পুষ্টি, পানীয় ইত্যাদি। 
  • সমাজগত স্বাস্থ্যবিধি; ঘরবাড়ি, সংক্রামক ব্যাধি ইত্যাদি। 
  • আকস্মিক মহাদুর্ঘটনা, মহামারী ইত্যাদি। 

Gesundheitsgesetze স্বাস্থ্য বিধান:

  • শারীরিক পুষ্টি বিধান, মদ, মাংস ইত্যাদি বিষয়ক 
  • যৌন বিধি বিজ্ঞান, সুষ্ঠু ও অসুষ্ঠু যৌন ক্রিয়া 
  • আনুষ্ঠানিক বিধি-বিধান-ত্বকচ্ছেদ, রোজা, অযু, গোসল, পীড়া, ক্লান্তি, বিনোদন ইত্যাদি। 
  • সামাজিক বিধি-বিধান হত্যা, প্রতিশোধ, অভিভাবকত্ব। 

খ) মহানবি (সাঃ) এর চিকিৎসা বিধান 

মহানবি (সাঃ) এর চিকিৎসা বিষয়ক অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। পবিত্র বুখারী শরীফে “তিব্বুন নবি” শীর্ষক ৮০টি পরিচ্ছেদ  রয়েছে। এ হাদিসগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় অধিকাংশই রোগ নিরাময়ের জন্য। রোগ নিরাময়ের ব্যবস্থা হিসেবে  মহানবি (সাঃ) মোটামোটি পাঁচটি পদ্ধতি ব্যবহারের উল্লেখ করেছেন। যথা: 

  • হাজামত বা রক্ত মোক্ষণ পদ্ধতি;
  • লোলুদ বা মুখ দিয়ে ওষুধ ব্যবহার;
  • সাউত বা নাক দিয়ে ওষুধ ব্যবহার; 
  • মাসঈ বা পেটের বিশোধনের জন্য ওষুধ ব্যবহার; 
  • কাওয়াই তথা লোহা পুড়ে ছ্যাকা দেওয়া। 

আর ওষুধ হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছেন-মধু, কালজিরা, মেহেদী, খেজুর, জলপাই, কাকরোল, মক্কার সোনামুখী গাছ,  মান্না, ব্যাঙের ছাতার মতো এক প্রকার উদ্ভিদ। ঘৃত কুমারী, এন্টেমনি, মৌরী, মাদুরের পোড়া ছাই, উটের দুধ ইত্যাদি। 

গ) খোলাফায়ে রাশেদিনের আমলে চিকিৎসা

মহানবি (সাঃ) এর যুগে আরবে চিকিৎসক হিসেবে যাঁর খাতি ছিল তিনি ছিলেন হারিস বিন কালদা। তিনি “কালামুল হারেস  মা’আ ফিমরা” নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। হারেসের চিকিৎসা বিধির অন্যতম হলো  অত্যধিক আহারই সকল রোগের কারণ। ‘‘যদি নিরোগ থাকতে চাও, তাহলে সকালে ঘুম থেকে উঠবে; ঋণ মুক্ত থাকবে  এবং স্ত্রী লোকের সংসর্গ পরিত্যাগ করবে’’। 

নযর বিন হারেস নামে এ সময় একজন চিকিৎসক ছিলেন। এই পাপাত্মা মহানবি (সাঃ) এর কুৎসা রটনা করতো। বদরের  যুদ্ধে সে বন্দী হয়। এ যুগে আবু হাফসা ইয়াজিদ নামে অপর একজন চিকিৎসকের নাম জানা যায়। তিনি প্রথমে ইয়াহুদি  ছিলেন পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

মহানবি (সাঃ) এর সময় ইবনে উবায় রামছাতুন তামিমী একজন ক্ষত ও অস্ত্রোপচার  বিশেষজ্ঞ ছিলেন। এছাড়া জয়নাব ও রাফিজা নামের দুই জন মহিলা চিকিৎসকের নাম পাওয়া যায়। প্রথমোক্ত জয়নাব  খোলাফায়ে রাশিদার যুগে চক্ষু রোগের চিকিৎসা করতেন। অন্যজন মসজিদে নববির আঙ্গিনায় তাঁবুতে যে হাসপাতাল তৈরি  করা হয়েছিল তিনি তার প্রধান ছিলেন। 

ঘ) উমাইয়া আমলে চিকিৎসা বিজ্ঞান 

উমাইয়া আমলে মহানবি (সাঃ) এর চিকিৎসা বিধান এবং খোলাফায়ে রাশেদিনের আমলের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ধারা  অব্যাহত থাকে। এ সময় ইবনে খাত্তাল, মাসার যাওয়াইযাহ প্রমুখ চিকিৎসকগণ একাধিক গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করেন।  উমর ইবনে আবদুল আযিয আলেকজান্দ্রিয়া হতে মেডিকেল স্কুল ও চিকিৎসকদের ইরাকে স্থানান্তর করেন। এর ফলে  মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি হয়। 

ঙ) আব্বাসী শাসনামলে চিকিৎসা বিজ্ঞান

আব্বাসী যুগে (৭৫০-১২৫৮) মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞান উন্নতির স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করে। আব্বাসী যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাকে  দু’টি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়: অনুবাদ যুগ ও মৌলিক অবদানের যুগ।

i) অনুবাদ যুগ

মুসলিম বিজ্ঞানীদের চিকিৎসা শাস্ত্রে নিজেদের অবদান যুক্ত করার প্রথম পদক্ষেপ ছিল পূর্ববর্তী বিখ্যাত  চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের গ্রন্থসমূহ আরবি সিরিয়াক প্রভৃতি ভাষায় অনুবাদ করা। নিজস্ব উদ্যোগ ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়  একদল অনুবাদক একাজে লিপ্ত হয়েছিলেন। 

ii) মৌলিক অবদানের যুগ

যে সকল মুসলিম চিন্তাবিদ ও মনীষীগণ চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণা ও উন্নতির ক্ষেত্রে মৌলিক অবদান রেখেছেন তাঁদের  মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন-

  • আত্তাবারির চিকিৎসা বিষয়ক বিশ্বকোষ “ফেরদৌস আল হিকমাহ” আরবিতে লিখিত প্রথম চিকিৎসা গ্রন্থ।  ৮ম শতকে মুসলিম রসায়নবিদ ইবনে হাইয়ান মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন মাত্রা যোগ করেন। চিকিৎসা শাস্ত্র সম্পর্কে  তিনি অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। ইবনে নাদিম এর মতে-চিকিৎসা শাস্ত্র সম্পর্কে তিনি ৫০০ পুস্তক রচনা করেন। 
  • সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানী আল-রাযীর প্রায় ২০০ গ্রন্থের মধ্যে ৬০টি ছিল চিকিৎসা বিষয়ক। তিনি মূত্রথলী ও  বৃক্কের পাথরের বিষয়ের উপর বই লিখেন। তিনিই সর্বপ্রথম বসন্ত ও হাম রোগের পার্থক্য নির্ণয় করেন ও তাদের লক্ষণ ও  উপসর্গের বিশদ বর্ণনা দেন। 
  • আলকিন্দি চিকিৎসা বিজ্ঞানে ও যথেষ্ট অবদান রাখেন। তাঁর ২৭০টি গ্রন্থের মধ্যে ২৭টি ছিল চিকিৎসা বিজ্ঞান সংক্রান্ত।  আলী ইবনে রাব্বান সর্বপ্রথম আরবি ভাষায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তাঁর “ফিরদাউসুল হিকমাহ”  চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রথম বিশ্বকোষ হিসেবে স্বীকৃত।
  • হুনায়েন ইবনে ইসহাক একজন প্রসিদ্ধ অনুবাদক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী ছিলেন (৮০৯-৮৭৭)। তাঁর চিকিৎসা গ্রন্থগুলোর  মধ্যে আদারিয়াতুল মুফরাদাত, কুন্নাশুল খাফ্ফা, তারিখুল আতিব্বা অন্যতম। 
  • আলী ইবনে আব্বাস একজন প্রসিদ্ধ চিকিৎসা বিজ্ঞানী ছিলেন। তাঁর রচিত “কিতাবুল মালিকী” তাঁকে অমর করে রেখেছে।  তিনি সুদক্ষ শল্যবিদ ছিলেন। তিনি ব্যান্ডেজ ব্যবহার করার কথা উল্লেখ করেছেন। 
  • আবুল কাশেম খালাফ আল যাহরাবি (৯৩৬-১০১৩) ইউরোপে তিনি “বুকাসিস” আল জাহারভিয়াস’’ ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিলেন। ইউরোপ ও স্পেনে তিনি সর্ব প্রথম সার্জিক্যাল বিদ্যা প্রচলন করেন। 
  • ইবনে সীনা (৯৮০-১০৩৭) পাশ্চাত্যে আবি সীনা নামে পরিচিত। চিকিৎসা বিষয়ে তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান চিকিৎসা বিশ্বকোষ  “আল কানুন ফিত্তিব্ব”। এ ছাড়া এ বিষয়ে তিনি আরো ১৫টি গ্রন্থ রচনা করেন। ইবনে সীনার “আল কানুন” গ্রন্থটি  প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে অত্যন্ত প্রভাবশালী গ্রন্থ।  

চ) ঔষধ বিজ্ঞান

ঔষধ বিজ্ঞানে মুসলমানদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। আরব বিজ্ঞানীরা ঔষধ বিজ্ঞান (Pharmacology) নিয়ে বিভিন্ন  বিন্যাসে বহু গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। সর্বশ্রেষ্ঠ আরব ওষুধ বিজ্ঞানী (Pharmacologist) ছিলেন ১৩ শতকের বিখ্যাত উদ্ভিদ  বিজ্ঞানী ইবনুল বায়তার। চার খন্ডে রচিত তাঁর গ্রন্থ “জা’মে মুফরাদাতিল আদবিয়া ওয়াল আগজিয়া” তে ১৪০০ শত  ঔষধের নাম দেওয়া হয়েছে যার মধ্যে ৩০০ টি সম্পূর্ণ নতুন।

এ ছাড়া ইবনে সীনা, ইবনে ওয়াহশিয়া, মুয়াফফাক আল  হারবাবী, ইসহাক ইবনে সুলাইমান, আত্-তামিমী, ইবনে জাজলা, আল কোহেন, আল-আত্তার এবং মূসা বিন মাইমুনের  নাম ওষুধ বিজ্ঞানী হিসেবে উল্লেখযোগ্য।

রসায়নের প্রতিষ্ঠাতা জাবির বিন হাইয়ান “বিষ” বিষয়ক “কিতাবুস সুমুম”  (Book of Poison) প্রণয়ন করেন যা আরব ফার্মাকোলজির অন্যতম উৎস। 

ছ) হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা

মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ হাসপাতাল নির্মাণের ব্যাপারেও গুরুত্বারোপ করেছেন। এ সময়ে সরকারি ও বেসরকারিভাবে  নির্মিত হয়েছিল অসংখ্য হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এ ক্ষেত্রে মহানবি (সাঃ) ছিলেন মুসলিম বিজ্ঞানীদের অনুপ্রেরণার উৎস।  ইসলামের ইতিহাসে প্রথম হাসপাতাল তিনিই নির্মাণ করেছিলেন। নাসিবা বিনতে কাব আল আনসারী ছিলেন এই  হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক।

মহানবি (সাঃ) এর যুগ থেকে নিয়ে উমাইয়া যুগ পর্যন্ত অসংখ্য ভ্রাম্যমান হাসপাতাল যুদ্ধ  ক্ষেত্রে চিকিৎসা দিতো।

উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ান সর্ব প্রথম বিপুল অর্থ ব্যয় করে বিশাল হাসপাতাল  নির্মাণ করেন। এই হাসপাতালে রোগীর শ্রেণি বিন্যাস অনুযায়ী পৃথক পৃথক বিভাগ ছিল। পরবর্তীকালে ইসলামি শাসনের  বিভিন্ন সময়ে বাগাদাদ, কর্ডোভা, দামেশক এবং কায়রো শহরে অনেক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়।

ইসলামি যুগে  হাসপাতালের ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ ড. ডানন্ড ক্যাম্বল লিখেছেন- “একমাত্র কর্ডোভাতেই ইসলামি  শাসনামলে প্রায় ৫০০ চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল”। তাছাড়া মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রতিটি শাসকই হাসপাতাল স্থাপন  করেছিলেন। 

জ) সারসংক্ষেপ

  • চিকিৎসা শাস্ত্রে মুসলমানদের বিশেষ অবদান রয়েছে। পবিত্র কুরআনে চিকিৎসা বিষয়ে ৩৫৫টি আয়াতে ইঙ্গিত রয়েছে। 
  • চিকিৎসা শাস্ত্রে মুসলমানদের মধ্যে মহানবি মুহাম্মদ (সাঃ) নিজেই ছিলেন একজন চিকিৎসক। সহিহ বুখারিতে মহানবি  (সাঃ) এর চিকিৎসা সংক্রান্ত ৮০টি পরিচ্ছেদ রয়েছে। মহানবি (সাঃ) যুগে হারেস বিন কেলদা এবং নযর বিন হারেস নামে  দুই জন বিখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন। তাছাড়া জয়নাব ও রাফিজা নামক দুইজন মহিলা চিকিৎসকের নাম পাওয়া যায়। খুলাফায়ে রাশেদিনের আমলে মসজিদে নববির আঙ্গিনায় তাঁবু খাটিয়ে হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছিল।
  • আব্বাসী শাসনামলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষ  সাধন করেন। মুসলিম শাসনামলে হাসপাতাল নির্মানের বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
  • উমাইয়া আমলে  চিকিৎসা বিজ্ঞান আরো সম্প্রসারিত হয়। এ সময় বহু গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ হয়। উমর ইবনে আবদুল আযিয  আলেকজান্দ্রিয়া হতে মেডিকেল স্কুল ও চিকিৎসকদের ইরাকে স্থানান্তর। উমাইয়া খলিফা মারওয়ান  সর্ব প্রথম বিপুল অর্থ ব্যয়ে বিশাল হাসপাতাল নির্মাণ করেন। মুসলিম শাসনামলে কর্ডোভা-তেই প্রায় ৫০০ হাসপাতাল  নির্মিত হয়েছিল।

(১১) বাংলাদেশে ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশে আলিম, সুফী, পীর আওলিয়ার ভূমিকা

ক) বাংলাদেশে ইসলামি শিক্ষা বিস্তারের সূচনা

বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল হিজরি প্রথম শতক থেকেই।

দশম হিজরিতে পবিত্র আরাফাতের  ময়দানের মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার পর সমবেত সাহাবায়ে কিরাম ইসলামের দাওয়াত  প্রচারের জন্য বিশ্বের প্রতিটি দিকে ছুটে যান। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে হযরত উমর (রা) এর যুগে সাহাবাদের  আগমন ঘটেছিল বলে জানা যায়। তাছাড়া মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশসহ আরব ও পারস্য থেকে আলিম উলামা, পীর  আউলিয়া, দরবেশগণের আগমন ঘটেছিল ইসলাম ও ইসলামি শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে।

তাঁরা এ অঞ্চলের অধিবাসীদের  সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। অন্যদিকে এ অঞ্চলের গরীব, অসহায়, শোষিত, নির্যাতিত, মানুষ একটু  শান্তি ও অধিকার লাভের আশায় প্রতীক্ষা করছিল। আরব, পারস্য ও মধ্য এশিয়া থেকে আগত মুসলিম প্রচারকদের  আচরণ, মানবপ্রীতি, সাম্য ও শান্তি এবং উদারতায় মুগ্ধ হয়ে অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করে।

ইসলাম প্রচারকগণ মানুষের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য যেমন দৃষ্টি দিয়েছিলেন; তেমনি তাদের মাঝে  শিক্ষা-দীক্ষা ও তাহযীব-তামাদ্দুন ও সংস্কৃতির উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন।   

খ) ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতি বিকাশে আলিম ও পীর-অলিদের ভূমিকা 

i) হযরত শাহ জালাল ইয়ামানী (রাঃ) 

হযরত শাহ জালাল ইয়ামানী (রাঃ) ইয়েমেনে জন্মগ্রহণ করেন। ইসলামের বিভিন্ন শাস্ত্র শিক্ষা গ্রহণ করেন। বহু দেশ ও  জনপদ অতিক্রম করে তিনি ভারতের দিল্লীতে এসে খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সাথে কয়েকদিন কাটান। তারপর তিনি  তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে বঙ্গদেশে এসে হাজির হন। তখন সিলেটে হিন্দুরাজা গৌর গোবিন্দের রাজত্ব ছিল।

রাজা গৌর  গোবিন্দের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বুরহানুদ্দিন নামক জনৈক মুসলমান গৌড়ের সুলতান ফিরোজ শাহের (১৩০২-২২) কাছে প্রতিকার চাইলে সুলতান ফিরোজশাহ গৌর গোবিন্দকে শাস্তি প্রদানের জন্য সিকান্দার গাজীকে এক বাহিনীসহ  প্রেরণ করেন। যুদ্ধে গৌর গোবিন্দ পরাজিত হয় এবং পলায়ন করে। হযরত শাহ জালাল সিকান্দার গাজীর সৈন্যবাহিনীর  সাথে ছিলেন এবং তিনি ও রাজা গৌর গোবিন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

গৌর গোবিন্দের পরাজয়ের পর তিনি  সিলেটে ইসলাম প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং সেখানে খানকা প্রতিষ্ঠা করে ইসলামের অমীয় বাণী প্রচার করতে  থাকেন। তাঁর শিষ্য ও অনুচরবৃন্দ বাংলাদেশ ও আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং ইসলাম প্রচার করতে থাকে।  তাঁর শিষ্যগণ ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা, নোয়াখালী, রংপুর, চট্টগ্রাম এবং আসাম প্রদেশের বিভিন্ন অ লে ইসলাম প্রচারে  ব্রতী হয়েছিলেন। 

ii) হযরত শাহ মাখদুম (রাঃ) 

হযরত শাহ মাখদুম (রাঃ) বাগদাদ থেকে ইসলাম প্রচারে জন্য বাংলাদেশে আগমন করেন। বাগদাদে থাকাবস্থায়ই তিনি  ইসলামি শিক্ষায় পান্ডিত্য লাভ করেন। পরে আধ্যাত্মিক শিক্ষায় ও তিনি খ্যাতিমান হয়ে উঠেন।

হযরত শাহ মাখদুম স্থানীয়  জনসাধারণের কাছে দরবেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। সে কালে যারাই বাঁচার তাগিদে রাজশাহী অঞ্চলে আসতেন,  তাদের উপরই এই অলী আল্লাহর প্রভাব পড়ত। তিনি সারা বছর নিয়মিত ভাবে রোজা রাখতেন এবং নিয়মিত ইবাদতে মশগুল থাকতেন। অতি অল্প আহার করতেন। তাঁর আহারের মধ্যে ছিল সামান্য দুধ ও শরবত। 

iii) হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রাঃ) 

হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রাঃ) সিন্ধু থেকে নবম শতাব্দীর শেষভাগে চট্টগ্রাম শহরের উত্তরে নাসিরাবাদের এক পর্বত চূড়ায় এসে খানকা ও মসজিদ স্থাপন করেন।

তিনি বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বা লে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের কাজে বিশেষ  অবদান রাখেন। চট্টগ্রাম ছাড়াও তিনি পার্শ্ববর্তী অন্যান্য অ লে ইসলাম প্রচার করেন। দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক ও ভক্ত উক্ত মসজিদে নামায আদায় করে থাকেন। 

iv. হযরত মাওলানা কেরামত আলী জৌনপুরি (রাঃ) 

হযরত মাওলানা কেরামত আলী জৌনপুরি (রাঃ) ভারতের রায়বেরেলির অন্তর্গত জৌনপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন  বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক সৈয়দ আহমদ বেরলভীর বিশিষ্ট শাগরেদ। আসাম, উত্তর-পূর্ববঙ্গে সংস্কার আন্দোলন ও ইসলাম  শিক্ষা প্রচারে হযরত কারামত আলী সাহেব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

কেরামত আলী সাহেব ছিলেন হযরত আবু  বকর সিদ্দিক (রা) এর পঞ্চত্রিংশাতিতম পুরুষ। তাঁর উস্তাদ সৈয়দ আহমদ বেরলভী (রাঃ) ইসলাম প্রচারের নির্দেশ দেন। এ  নির্দেশ মেনে তিনি প্রথমে আজমগড়, গাজীপুর, ফয়জাবাদ, সুলতানপুর ও জৌনপুরে আপনজনদের মাঝে ইসলাম প্রচারের  কাজে আত্মনিয়োগ করেন। অতঃপর জৌনপুর থেকে কলকাতায়, কলকাতা থেকে খুলনা, যশোর, বরিশাল, চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ,  ঢাকা, সিলেট এবং আসামের বিভিন্ন অ লে ইসলামের দাওয়াতি কাজ করেন। 

v) মাওলানা নেসার উদ্দিন আহমদ 

বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসার কাজে মাওলানা নেসার উদ্দিন আহমদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তিনি এদেশের  মানুষকে ইসলামের দাওয়াত এবং শিরক, বিদআত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন জাতিকে ইসলামের আলো দেখিয়েছেন। 

পরাধীন, স্বাধীন, অনুকূল-প্রতিকূল সর্বাবস্থায়ই তিনি দ্বীন প্রচারের মহান দায়িত্ব সমানভাবে পালন করেছেন। তিনি ওয়াজ,  নসীহত, মসজিদ, মাদরাসা প্রতিষ্ঠা এবং আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এদশে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের কাজ  করেছেন।তিনি একাধারে ছিলেন ইসলামি জ্ঞান বিজ্ঞানে সুপন্ডিত, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও দ্বীনি শিক্ষার মহান সাধক। শর্ষিনা দারুস সুন্নাহ আলিয়া মাদরাসা তাঁর অমর কীর্তি।

শিক্ষা সমাপ্তির পর তিনি তাঁর মুরশিদের নির্দেশে ইসলামি  শিক্ষা দীক্ষা ও আর্দশ প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করে অল্প কালের মধ্যেই খিলাফত লাভ করত সুফী তরিকার দীক্ষা দানে  অনুমতিপ্রাপ্ত হন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ও নির্দেশে বহু ইসলামি পুস্তক রচিত হয়। তিনি বরিশাল, পটুয়াখালী, ফরিদপুর ও  খুলনা জেলার বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। 

গ) সারসংক্ষেপ

  • বহু পীর-আউলিয়া ইসলাম প্রচারে বাংলাদেশে আগমন করেছেন। অনেক আলিম ইসলাম প্রচার ও ইসলাম শিক্ষা সংস্কৃতি  বিকাশে বিশেষ অবদান রেখেছেন।
  • আরবের ধর্ম প্রচারকগণ ইসলাম প্রচার করেছেন। মুসলিম রাজা, বাদশাহগণও  ইসলাম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁদের মধ্যে সুলতান মাহমুদ মাহী সওয়ার মহাস্থানগড় এলাকায় ইসলাম প্রচার করেছেন। ময়মনসিংহে শাহ সুলতান রুমী, হযরত বাবা আদম শহীদ এবং রাজশাহীতে শাহ মাখদুম ইসলাম প্রচার  করেন।
  • উপমহাদেশে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে আলিম-উলামাগণই ঔপনিবেশিক শাসন  থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন।

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/islam

Islamic information to the point!View Author posts

You cannot copy content of this page