(১) হজ শব্দের অর্থ কি?
‘হজ’ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ সংকল্প করা, ইচ্ছা করা ইত্যাদি।
(২) হজ কাকে বলে?
ইসলামি পরিভাষায় নির্দিষ্ট দিনসমূহে নির্ধারিত পদ্ধতিতে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পবিত্র কাবাঘর ও সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহে বিশেষ কার্যাদি সম্পাদন করাকে হজ বলে।
(৩) হজ কি?
হজ একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক ও শারীরিক ইবাদত। যিলহজ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত মক্কা, মিনা, আরাফা এবং মুয্দালিফায় আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুল (সাঃ)-এর নির্দেশ মোতাবেক বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করাও হজের অন্তর্ভুক্ত।
(৪) হজ কখন ফরজ হয়?
প্রত্যেক সুস্থ, প্রাপ্তবয়স্ক, বুদ্ধিমান ও সামর্থ্যবান মুসলিম নরনারীর উপর জীবনে একবার হজ আদায় করা ফরজ। এরপর যতবার হজ করবে তা নফল হিসেবে গণ্য হবে এবং অনেক সাওয়াবের অধিকারী হবে।
হজ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ গৃহে হজ করা তার অবশ্য কর্তব্য।” (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত ৯৭)
যেসব লোক কাবাঘর পর্যন্ত যাতায়াতের দৈহিক ক্ষমতা রাখে এবং হজ হতে ফিরে আসা অবধি পরিবারবর্গের আবশ্যকীয় ব্যয় বাদে যাতায়াতের খরচ বহন করতে সক্ষম, তাদের উপর হজ ফরজ।
মহিলা হাজি হলে একজন সঙ্গী থাকতে হবে। সঙ্গী হবেন স্বামী অথবা এমন আত্মীয় যার সাথে বিবাহ সম্পর্ক হারাম। যেমন: বাবা, ছেলে, ভাই, চাচা, মামা ইত্যাদি। সফরসঙ্গীর ব্যয়ভার মহিলা হাজিকেই বহন করতে হবে।
(৫) হজের ইতিহাস
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে সালাত অন্যতম। সালাত আদায় ও আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশের জন্য পৃথিবীতে সর্বপ্রথম মক্কা নগরীতে যে ঘর (ইবাদতখানা) তৈরি হয়, তার নাম ‘বাইতুল্লাহ’ বা আল্লাহর ঘর। কালক্রমে এ পবিত্র ঘর জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে।
প্রায় চার হাজার বছর আগের কথা। ইরাকে জন্ম নেওয়া আল্লাহর নবি হযরত ইব্রাহিম (আঃ) আল্লাহর আদেশে বিবি হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাইল (আঃ)-কে কাবাঘরের নিকটবর্তী জনমানবশূন্য স্থানে রেখে যান। বিবি হাজেরা স্বামীকে লক্ষ করে বললেন, “আমাদের এমন মরু প্রান্তরে ফেলে রেখে কেন চলে যান?” উত্তরে স্বামী বললেন, “আল্লাহর নির্দেশ।” বিবি হাজেরা বললেন, “তাহলে আল্লাহর ইচ্ছাই পূর্ণ হোক। তিনি অবশ্যই আমাদের বাঁচিয়ে রাখবেন।” যাওয়ার সময় হযরত ইব্রাহিম (আঃ) তাঁদের জন্য দোয়া করলেন।
দোয়াটি পবিত্র কুরআনে এভাবে বর্ণিত আছে,
“হে আমাদের প্রতিপালক! আমি আমার বংশের কতককে বসবাস করালাম অনুর্বর উপত্যকায় তোমার পবিত্র ঘরের নিকট। হে আমাদের প্রতিপালক! এ জন্য যে, তারা যেন সালাত কায়েম করে। অতএব তুমি কিছু লোকের অন্তর তাদের প্রতি অনুরাগী করে দাও এবং ফল ফলাদি দ্বারা তাদের রিযিকের ব্যবস্থা করে দাও যেন তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।”
(সূরা ইব্রাহিম, আয়াত ৩৭)
নবি ইব্রাহিম (আঃ)-এর প্রার্থনা আল্লাহ তায়ালা কবুল করলেন।
হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর রেখে যাওয়া সামান্য খাদ্য ও পানীয় কয়েক দিনের মধ্যেই ফুরিয়ে গেল। মা ও শিশু পুত্র ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর। মা হাজেরা নিকটস্থ সাফা পাহাড়ে উঠে চারিদিকে তাকিয়ে দেখেন, আবার মারওয়া পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চারিদিকে তাকান, কোথাও কোনো কাফেলা দেখা যায় কি না, যাতে তাদের নিকট থেকে সামান্য পানি নিয়ে পিপাসা কাতর পুত্রের মুখে দেওয়া যায়। কিন্তু কোথাও কোনো জনমানবের চিহ্নও দেখা গেল না। এমনিভাবে সাতবার সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ি করলেন। তারই নিদর্শনস্বরূপ হাজিগণ ঐ স্থানে (সাঈ) দ্রুত হাঁটেন। মা হাজেরা কোথাও পানির সন্ধান না পেয়ে শিশুর কাছে ফিরে এসে বিস্ময়ে দেখলেন, নিকটেই মাটি ফুঁড়ে স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা বইছে। এ পানির ফোয়ারাই ছিল বিখ্যাত যমযম কূপের উৎস। বিবি হাজেরা শিশু ইসমাইলকে পানি পান করিয়ে তার তৃষ্ণা নিবারণ করলেন। নিজেও তৃপ্তিসহকারে পানি পান করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। মরুভূমিতে যেখানে পানি থাকে সেখানে আকাশে পাখি ওড়ে। দূর হতে তা দেখে কাফেলা এসে জমা হয়। জুর্হুম বংশের এক বাণিজ্য কাফেলা এসে মা হাজেরার অনুমতি নিয়ে সেখানে বসবাস শুরু করল। ক্রমে আরও লোকজন এসে জড়ো হলো। সকলের বিশ্বাস, এ পুণ্যাত্মা মা ও শিশুর কল্যাণেই আল্লাহ তায়ালা এ ঊষর মরুর বুক চিরে পানির ঝর্ণা প্রবাহিত করেছেন। ধীরে ধীরে মক্কা একটি জনপদে পরিণত হলো।
হযরত ইসমাইল যখন কিশোর বয়সে উপনীত হলেন তখন ইব্রাহিম (আঃ) একটি অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হলেন। পুত্র ইসমাইলকে কুরবানি করার জন্য আল্লাহ তায়ালা তাঁকে আদেশ করলেন। আল্লাহ্ তায়ালাকে খুশি করার জন্য হযরত ইব্রাহিম (আঃ) আপন পুত্রকে কুরবানি করতে প্রস্তুত হয়ে এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। তারপর আল্লাহ্ তায়ালা ইব্রাহিম (আ)-কে কাবাঘরের স্থানটি দেখিয়ে তা পুনঃনির্মাণের আদেশ দিলেন। ইব্রাহিম (আঃ) পুত্র ইসমাইলকে সাথে নিয়ে পবিত্র কাবাঘর পুনঃনির্মাণ করেন।
তারপর এ দোয়া করেন,
“হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের এ কাজ কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাত।”
(সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১২৭)
এরপর আল্লাহ্ তায়ালার নির্দেশে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) মানুষকে হজের জন্য আহবান করেন।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,
“এবং আপনি মানুষের নিকট হজের ঘোষণা করে দিন, তারা আপনার নিকট আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রের পিঠে, তারা আসবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে।”
(সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত ২৭)
হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর আহ্বানে কাবা শরিফ আবার তাওহিদপন্থীদের পুণ্যভূমিতে পরিণত হলো। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) চলে গেলেন আপন কর্মক্ষেত্রে। আর হযরত ইসমাইল (আঃ) রয়ে গেলেন মক্কায় ৷ পরবর্তীকালে তিনিও নবি হলেন। মৃত্যুর সময় কাবার দায়িত্বভার অর্পণ করে গেলেন আপন বংশধরের উপর। কালক্রমে তারা আল্লাহকে ভুলে গিয়ে মূর্তিপূজা শুরু করল। কাবাগৃহে তারা স্থাপন করল ৩৬০টি মূর্তি। হজের সময় ইব্রাহিম (আঃ)-এর প্রথাগুলো পালিত হতো তবে তারা পূজা-অর্চনা করত প্রতিমার সামনে।
উত্তরাধিকার সূত্রে কুরাইশ বংশ তখনো কাবার রক্ষক এবং হজের তত্ত্বাবধায়ক ছিল। ফলে দেশ-বিদেশে ছিল তাদের যথেষ্ট সম্মান। এ বংশেই জন্মগ্রহণ করেন আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। বাল্যকাল থেকে তিনি মূর্তিপূজাকে অপছন্দ করতেন। মক্কায় অতি অল্পসংখ্যক লোক তখনো মূর্তিপূজাকে ঘৃণা করতেন। তাঁদের বলা হতো হানিফ বা একনিষ্ঠ। তাঁরা মূর্তি পূজা না করে ইব্রাহিমি হজ পালন করতেন। মক্কা বিজয়ের পর নবি করিম (সাঃ) পুনরায় ইব্রাহিমি হজ চালু করেন।
(৬) হজের তাৎপর্য
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে হজ পঞ্চম। সারাবিশ্বের মুসলিম জাতির মহাসম্মেলন। বিশ্বের সকল মুসলিম যে এক উম্মত, হজ মৌসুমে মক্কায় এর বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায়।
পৃথিবীর সকল দেশের মুসলমানগণ আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় নির্দিষ্ট দিনগুলোতে মক্কায় একত্র হয়। সম্মিলিতভাবে অনুষ্ঠান পালন করে। সকলের ধর্ম এক, উদ্দেশ্য এক, কর্মসূচিও এক। সকলের পরিধানে একই ধরনের সাদা পোশাক।
হজের সময় ভাষা, বর্ণ, জীবন পদ্ধতির বিভিন্নতা সত্ত্বেও তারা সকলে একই ধ্বনি উচ্চারণে একাকার হয়ে যায়। সকলের হৃদয়ে এক আল্লাহর নাম। এতে পৃথিবীর সব দেশের লোকের পরস্পর মিলনের সুযোগ হয়। পরস্পরের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান হয়। প্রয়োজনীয় সমস্যা সমাধানের সুযোগ হয়। এভাবে হজ সারাবিশ্বের মুসলমানকে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করে।
প্রতি বছর হাজিদের হজে গমন ও প্রত্যাবর্তনের ফলে মুসলিম জাহানের প্রত্যেক অঞ্চলে মুসলমানের প্রাণে এক অভিনব আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ইসলামের প্রাণচাঞ্চল্য পরিবেশ বজায় রাখার জন্য হজের যে এক বিরাট অবদান আছে এর মাধ্যমে তা বাস্তবে প্রতিফলিত হয়।
(৭) হজের ফজিলত
ইসলামে প্রত্যেকটি ইবাদতেরই যথেষ্ট গুরুত্ব ও ফজিলত রয়েছে। হজেরও অনেক গুরুত্ব ও ফজিলত রয়েছে।
হজের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
“যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহ যিয়ারতে এসে কোনো অশ্লীল কাজ করল না, আল্লাহর অপছন্দনীয় কোনো কাজে লিপ্ত হলো না, সে গুনাহ বা পাপ থেকে এমনভাবে পবিত্র হয়ে ফিরল যেমন সে পবিত্র ছিল সেদিন, যেদিন সে তার মায়ের পেট থেকে জন্মগ্রহণ করেছিল।”
(বুখারি ও মুসলিম)
তিনি আরও বলেন,
“তোমরা হজ ও উমরাহ পর পর করতে থাক। কারণ এ দুইটি ইবাদত দারিদ্র্য, অভাব এবং গুনাহগুলোকে এমনভাবে দূর করে দেয় যেমন আগুনের ভাটি লোহা, সোনা ও রুপার ময়লা দূরীভূত করে তা বিশুদ্ধ করে দেয়। হজে মাবরুরের (মাকবুল) প্রতিদান হচ্ছে একমাত্র জান্নাত”।
(নাসাঈ)
যে মুসলমানদের উপর হজ ফরজ তাদের উচিত খুশি মনে হজ পালন করা।
(৮) হজের ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতসমূহ
ক) হজের ফরজ কয়টি?
হজের ফরজ তিনটি-
- হজের নিয়তে ইহরাম বাঁধা।
- আরাফার ময়দানে ৯ই জিলহজ তারিখে অবস্থান (ওকৃষ্ণ) করা।
- তাওয়াফে যিয়ারত করা।
খ) হজের ওয়াজিব কয়টি?
হজের ওয়াজিব কাজ সাতটি-
- আরাফার ময়দান হতে প্রত্যাবর্তনের সময় মুযদালিফায় অবস্থান করা।
- সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝখানে দৌড়ানো বা সাঈ করা। .
- শয়তানকে (জামরাতুল আকাবায়) কংকর নিক্ষেপ করা।
- তাওয়াফে বিদা অর্থাৎ মক্কার বাইরে থেকে আগত হাজিদের জন্য বিদায়কালীন তাওয়াফ করা। একে তাওয়াফুল বিদা (বিদায়ী তাওয়াফও) বলে।
- মাথা মুড়ানো বা চুল ছাঁটা।
- কুরবানি করা।
- দম দেওয়া।
গ) হজের সুন্নত কয়টি?
হজের অনেক সুন্নত রয়েছে। নিচে ১০টি সুন্নাত উল্লেখ করা হলো-
- বহিরাগতদের জন্য তাওয়াফে কুদুম (আগমনী তাওয়াফ) করা।
- হাজরে আসওয়াদ থেকে তাওয়াফ শুরু করা।
- জিলহজ মাসের ৭ তারিখে ইমামের মক্কায় হজ সম্পর্কে খুতবা প্রদান করা। ৯ তারিখে আরাফায় দ্বিপ্রহরের পর খুতবা প্রদান করা। একাদশ তারিখে মিনায় খুতবা দেওয়া।
- ৮ই জিলহজে মক্কা থেকে মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করা, মিনায় উপস্থিত হয়ে যোহর থেকে ৯ই জিলহজের ফজর পর্যন্ত অবস্থান করে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা।
- ৯ই জিলহজে সূর্য ওঠার পর মিনা থেকে আরাফার দিকে রওয়ানা করা।
- সম্ভব হলে আরাফাতে গোসল করা।
- ইহরাম বাঁধার আগে গোসল করা।
- মুয্দালিফায় রাত কাটানোর পর ফজরের নামায আদায় করে সূর্য উদয়ের পূর্বে মিনার দিকে রওয়ানা করা।
- জিলহজ মাসের ১১, ১২ তারিখে কংকর নিক্ষেপ (রামি) এর জন্য মিনাতে রাতযাপন করা।
- জিলহজ মাসের ১১, ১২ ও ১৩ তারিখে ক্রমধারা ঠিক রেখে কংকর নিক্ষেপ করা।
(৯) হজ পালনের নিয়ম
ইসলামের প্রতিটি কাজ নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে আদায় করতে হয়। হজ আদায়েরও নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে।
নিম্নে হজ পালনের নিয়মাবলি ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করা হলো-
ক) ইহরাম
- ইহরাম আরবি শব্দ। এর অর্থ নিষিদ্ধ। নামাযের উদ্দেশ্যে যেমন তাহরিমা বাঁধতে হয়, হজের জন্যও তেমনি ইহরাম বাঁধতে হয়। এটি হজের আনুষ্ঠানিক নিয়ত।
- শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখ থেকে জিলহজ মাসের ৯ তারিখ পর্যন্ত যেকোনো দিন ইহরাম বাঁধা যায়। এ সময় ছাড়া অন্য সময় ইহরাম বাঁধলে হবে না। এ সময় ইরামের পোশাক পরবে ও কিবলামুখী হয়ে সরবে তালবিয়া পাঠ করবে।
- হজ মৌসুম ছাড়া অন্য সময় যদি কেউ কাবাঘর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মক্কা গমনের ইচ্ছা করে তবে তাকেও হজের ইহরাম বাঁধার স্থানে (মিকাতে) পৌঁছে ইহরাম বাঁধতে হবে।
খ) তাওয়াফে কুদুম (আগমনি তাওয়াফ)
ইহরাম বাঁধার পর মক্কা পৌঁছে কাবাঘরের চারধারে তাওয়াফ করতে হয়। অর্থাৎ সাতবার ঘুরতে হয়। মক্কা শরিফ পৌছার পর এটি প্রথম তাওয়াফ। এ কারণে একে তাওয়াফে কুদুম বা আগমনি তাওয়াফ বলা হয়। হাজরে আসওয়াদ হতে তাওয়াফ শুরু করতে হয়।
গ) তাওয়াফে কুদুম (আগমনি তাওয়াফ)
ইহরাম বাঁধার পর মক্কা পৌঁছে কাবাঘরের চারধারে তাওয়াফ করতে হয়। অর্থাৎ সাতবার ঘুরতে হয়। মক্কা শরিফ পৌছার পর এটি প্রথম তাওয়াফ। এ কারণে একে তাওয়াফে কুদুম বা আগমনি তাওয়াফ বলা হয়। হাজরে আসওয়াদ হতে তাওয়াফ শুরু করতে হয়।
ঘ) সাঈ
আগমনি তাওয়াফ শেষ করে কাবাঘরের অনতিদূরে অবস্থিত সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝের পথটি সাতবার অতিক্রম করতে হয়। একে বলা হয় সাঈ। সাফা পাহাড় থেকে সাঈ শুরু করে মারওয়া পাহাড়ে শেষ করতে হয়।
তারপর ইহরাম অবস্থায় জিলহজ মাসের সাত তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এ সময়ের মধ্যে যতবার ইচ্ছা তাওয়াফ করা যায় এগুলো নফল তাওয়াফ। সাঈ করার প্রয়োজন নেই ৷ নফল তাওয়াফে অনেক সাওয়াব পাওয়া যায়।
ঙ) ৭ই জিলহজ
এ তারিখে যোহর নামাযের পর ইমাম খুত্বা দেন। এ খুত্বায় তিনি হজ সম্পর্কীয় জ্ঞাতব্য বিষয় বিশেষ করে ৮ তারিখ মিনায় এবং ৯ তারিখ আরাফাতে করণীয় বা আকাম সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় নিয়ম-কানুন বর্ণনা করেন।
চ) ৮ই জিলহজ
এ তারিখে হাজিগণ সূর্যোদয়ের পর মিনায় আসেন। মিনায় যাওয়ার পূর্বে সুন্নাত অনুযায়ী গোসল করে ও ইহরামের চাদর পরে ‘মসজিদুল হারাম’ বা বাইতুল্লাহ্ শরিফে আসেন। ইহরাম ও নিয়তের সাথে সাথেই তালবিয়া পাঠ করতে করতে মিনায় যেতে হয়। সেখানে পরের দিন পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা সুন্নাত।
ছ) ৯ই জিলহজ
- নবম তারিখ আরাফার দিবস। এদিন সকালেই ‘আরাফায় অবস্থানের’ উদ্দেশ্যে মিনায় ফজরের নামায আদায় করে আরাফার ময়দানের দিকে রওয়ানা করতে হয়।
- এখানে ইমামের পেছনে যোহরের ওয়াক্তে যোহর ও আসর উভয় নামায একসঙ্গে আদায় করতে হয়। নামাযের পূর্বে ইমাম খুত্বা দেন। খুতবায় হজের বাকি বিধিবিধান বর্ণনা করেন। আরাফার ময়দানে অবস্থান হজের একটি ফরজ কাজ।
- ৯ তারিখ অথবা অনিবার্য কারণে ৯ তারিখের রাত পরবর্তী সুবহি সাদিকের পূর্বে কোনো সময়ে এক মুহুর্তের জন্য হলেও আরাফার মাঠে অবস্থান করতে হয়। অন্যথায় হজ হবে না।
- এদিন সূর্যাস্তের সাথে সাথে আরাফার মাঠ থেকে মুযদালিফায় ফিরে আসতে হয়। মুযদালিফায় পৌঁছে এশার নামাযের সময়ে মাগরিব ও এশা এক সঙ্গে আদায় করতে হয়। এ রাত মুযদালিফায় কাটাতে হয়।
জ) ১০ই জিলহজ
- দশম দিন কুরবানির দিন। এদিন সকালে সূর্যোদয়ের পূর্বে হাজিগণ মিনার পথে রওয়ানা হয়।
- মিনার এক স্থানে শয়তানের প্রতিকৃতি হিসেবে পরপর তিনটি পাকা স্তম্ভ আছে। সেখানে পৌঁছে এদিন বড় শয়তানের প্রতিকৃতিকে লক্ষ্য করে সাতটি কংকর নিক্ষেপ করতে হয়।
- কংকরগুলো ছোলা পরিমাণ বড় হতে হয়। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) যখন আল্লাহর ইঙ্গিতে প্রাণপ্রিয় একমাত্র পুত্র ইসমাইল (আঃ)-কে কুরবানি করতে যাচ্ছিলেন, তখন শয়তান পিতা-পুত্রের মনে সংশয়ের সৃষ্টি করে তাঁদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়েছিল। তাঁরা বিরক্ত হয়ে শয়তানের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করেছিলেন। আল্লাহর প্রতি তাঁদের ভালোবাসা ও নিষ্ঠার প্রতি সম্মান দেখিয়ে হাজিগণ এ পাথর নিক্ষেপ করে থাকেন।
- কংকর নিক্ষেপের পর এ মিনাতেই কুরবানি করতে হয়। কুরবানির পর হাজিগণ মাথা কামিয়ে ইহরাম থেকে মুক্ত হন। চুল ছোট করলেও চলে, তবে সমস্ত মাথার চুল সমপরিমাপে কাটতে হয়। মেয়েদেরকে চুলের অগ্রভাগের কিছুটা কাটলেই চলে।
- তারপর ঐ তারিখেই অথবা ১১ কিংবা ১২ তারিখে মক্কা ফিরে কাবাঘর তাওয়াফ করতে হয়। এ তাওয়াফকে তাওয়াফে যিয়ারত বলা হয়। এটি হজের একটি ফরজ কাজ। মক্কায় প্রথম প্রবেশের সময় যদি সাফা ও মারওয়ায় সাঈ না করে থাকে তবে এ তাওয়াফের পর সাঈ করতে হয়। আগে করে থাকলে আর প্রয়োজন হয় না। তারপর মিনায় ফিরে যেতে হয় এবং সেখানেই ১১ ও ১২ তারিখ থাকতে হয়।
- ১১ ও ১২ তারিখ দুপুরের পর মিনার তিনটি স্তম্ভের প্রতিটিতে সাতটি করে কংকর মারতে হয়। তারপর ইচ্ছে করলে ১২ তারিখেই মক্কায় ফিরে আসতে পারেন। যদি কেউ মিনায় থেকে যান তবে তাঁকে ১৩ তারিখ দুপুরের পর তিনটি স্তম্ভে পাথর নিক্ষেপ করে মক্কায় ফিরতে হয়। এভাবে হজের কার্যাবলি সমাপ্ত করতে হয়।
- যারা বহিরাগত তাদের সর্বশেষ কাজ হচ্ছে বিদায়ী তাওয়াফ করা। একে ‘তাওয়াফুল বিদা’ বা প্রত্যাবর্তনকালীন তাওয়াফও বলে। বহিরাগতদের জন্য এ তাওয়াফ ওয়াজিব।
ঝ) হজের ত্রুটি ও তা সংশোধনের উপায়
হজ পালনকালে অনিচ্ছায়ও অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি বা নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটতে পারে। এই ত্রুটির কোনোটি গুরুতর আবার কোনোটি সাধারণ পর্যায়ের হয়ে থাকে। হজের ওয়াজিব পালনে ধারাবাহিকতার ব্যতিক্রম ঘটলে ‘দম’ ওয়াজিব হয়। যেমন: মাথা মুণ্ডনের পূর্বে শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ করা। আর ‘দম’ হচ্ছে একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা কুরবানি করা। উট, গরু বা মহিষের এক-সপ্তমাংশও এর স্থলাভিষিক্ত হতে পারে।
সাধারণভাবে ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজগুলো বা হারাম শরিফ এলাকায় নিষিদ্ধ কোনো কাজ করলে প্রতিকার স্বরূপ ‘দম’ বা কুরবানি করতে হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাদাকা দিতে হয়।
(১০) সাম্য ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় হজের ভূমিকা
হজ একান্তই ব্যক্তিগত ইবাদত। আল্লাহর প্রেমিক হাজিগণ আল্লাহর নৈকট্য ও ভালোবাসা লাভের জন্য হজ করে থাকেন। তা সত্ত্বেও সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।
- বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা মুসলিম সম্প্রদায় হজের মৌসুমে বিশেষভাবে ধর্মীয় ও নৈতিক চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে। যাঁরা হজে যান তাঁদের মন ধর্মীয় চেতনায় উদ্দীপ্ত থাকে, অনুরূপভাবে যাঁরা তাঁদের বিদায় সম্ভাষণ জানাতে আসে, তাঁদের মধ্যেও ধর্মীয় চেতনাশক্তি জাগ্রত হয়। হাজিগণ যে স্থান দিয়ে গমন করেন, তাঁদের ‘লাব্বাইক’ ধ্বনি শুনে সেখানকার অনেক মানুষের মনও হজের প্রতি আগ্রহী হয়।
- বিভিন্ন দেশ হতে আগত হাজিদের শারীরিক অবকাঠামো, ভাষা ও সংস্কৃতি ভিন্ন কিন্তু মিকাতের (ইহরাম বাঁধার স্থান) কাছে এসে একই ধরনের কাপড় পরিধান করে। সবার মুখে একই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত করে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তোলে মক্কা ও মদিনায় একত্র হয়ে একই ইমামের পেছনে নামায আদায় করে। সমবেত মুসলিম জনতা ভাষা, জাতি, দেশ ও গোত্রের কৃত্রিম বৈষম্য ভেঙে দিয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্ব স্থাপনের বিরাট সুযোগ পায়। মানুষের মনে সাম্যের ধারণা জন্মায়।
- হজের এই মহাসম্মেলনে পৃথিবীর সব শ্রেণির মানুষই এসে সমবেত হয়। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আদান-প্রদান ঘটে। ভাব বিনিময় হয়। বিশ্বশান্তি স্থাপনে এবং জাতিসমূহের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, কলহ মিটিয়ে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের বিশেষ সুযোগ পায়। হজের এ শিক্ষা মানবসমাজে বাস্তবায়িত হলে, মানুষের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, হানাহানি, মারামারি দূর হয়ে পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা, মমত্ববোধ ও সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সৃষ্টি হবে।
পবিত্র ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট ইসলাম’ (inbangla.net/islam) এর সাথেই থাকুন।