সূরা হাশর পবিত্র কুরআনের ৫৯তম সূরা। এখানে সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত অর্থাৎ ২২, ২৩ এবং ২৪তম আয়াত নিয়ে অর্থসহ উল্লেখ করা হয়েছে।
(১) সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের সংক্ষিপ্ত প্রেক্ষাপট
হাশর শব্দের অর্থ একত্র হওয়া, জড়ো হওয়া ইত্যাদি। সুরা হাশর সুরাটি মদিনায় অবতীর্ণ। এর ৩ রুকু, ২৪ আয়াত। এই সুরায় ইহুদিদের নির্বাসনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
মদিনা থেকে দুই মাইল দূরে বনু নাজিরের বসবাস। তারা নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ ছিল। এ অবস্থায় নবী করিম (সা.) তাদের মহল্লায় গেলে তারা তাঁকে একটি ছাদের নিচে বসতে দেয়। পরে ছাদ থেকে পাথর গড়িয়ে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। আল্লাহ তাআলা ওহির মাধ্যমে তাঁকে এ বিষয়ে জানানো হলে তিনি জায়গাটি থেকে সরে যান। তাদের জানিয়ে দেন, ‘তোমরা চুক্তি ভঙ্গ করেছ। তোমাদের যেখানে ইচ্ছা চলে যাওয়ার জন্য ১০ দিন সময় দেওয়া হলো। এরপর তোমাদের কাউকে পাওয়া গেলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।’
নবী করিম (সা.) চতুর্থ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে তাদের পাড়া ঘেরাও করেন। নিরুপায় হয়ে তারা নতিস্বীকার করলে নবী করিম (সা.) আবারও তাদের সুযোগ করে দিয়ে বললেন, ‘অস্ত্র ছাড়া যতটা পারো জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে এখনই এলাকা ত্যাগ করো।’ আদেশ মেনে তারা দেশত্যাগ করল। কেউ চলে গেল খাইবার উপত্যকায়, কেউ সিরিয়ায়।
সুরাটির শেষ তিন আয়াতে আছে, ‘তিনি আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তিনি অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা। তিনি পরম করুণাময়’।
(২) সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের ফজিলত
এ তিন আয়াতের ফজিলত অত্যন্ত বেশি।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
যে ব্যক্তি সকালে তিনবার ‘আউযু বিল্লাহিস সামিইল আলিমি মিনাশ শাইতানির রাজিম’। পাঠ করার পর সূরা হাশরের শেষ আয়াত তিনটি তিলাওয়াত করবে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য সত্তর হাজার ফেরেশতা নিয়োগ করে দেবেন। তাঁরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য রহমতের দোয়া করতে থাকবে। সেদিন সে মারা গেলে শহিদের মৃত্যু লাভ করবে। আর সন্ধ্যাকালে যে ব্যক্তি এভাবে পাঠ করবে সেও এ ফজিলত লাভ করবে।
(তিরমিযি)
হযরত মা’কাল বিন ইয়াসার রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি সকাল বেলা তিন বার পড়বে “আউজুবিল্লাহিস সামীয়িল আলীমি মিনাশ শাইতানির রাজীম”। তারপর সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত [হুয়াল্লাহুল্লাজী লা-ইলাহা শেষ পর্যন্ত] তিলাওয়াত করবে। তাহলে আল্লাহ্ তা’আলা উক্ত ব্যক্তির জন্য ৭০ হাজার ফেরেস্তা নিযুক্ত করেন। যারা উক্ত ব্যক্তির জন্য মাগফিরাতের দু’আ করতে থাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। আর এ সময়ের মাঝে যদি লোকটি মারা যায়, তাহলে সে শহীদের মৃত্যু লাভ করে। আর যে ব্যক্তি এটি সন্ধ্যার সময় পড়বে, তাহলে তার একই মর্যাদা রয়েছে। [তথা মাগরিব থেকে সকাল পর্যন্তের জন্য ৭০ হাজার ফেরেস্তা গুনাহ মাফীর জন্য দু’আ করে, আর সে সময়ে মারা গেলে শহীদের সওয়াব পাবে]।
(সুনানে দারেমী)
(৩) সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের আরবি
সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের আরবি: هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلَامُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ هُوَ اللَّهُ الْخَالِقُ الْبَارِئُ الْمُصَوِّرُ لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى يُسَبِّحُ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
(৪) সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের বাংলা উচ্চারণ
সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের বাংলা উচ্চারণ: হুআল্লা হুল্লাজি লা ইলাহা ইল্লাহু। আলিমুল গাইবি ওয়াশ শাহাদাতি হুয়ার রাহমানুর রাহিম। হুআল্লা হুল্লাজি লা ইলাহা ইল্লাহু। আল-মালিকুল কুদ্দুসুস সালামুল মু’মিনুল মুহাইমিনুল আযিযুল জাব্বারুল মুতাকাব্বির। সুবহানাল্লাহি আম্মা ইউশরিকুন। হুআল্লাহুল খালিকুল বারিয়ুল মুসাওয়্যিরু লাহুল আসমাউল হুসনা। ইউসাব্বিহু লাহু মা ফিসসামাওয়াতি ওয়াল আরদ্, ওয়াহুয়াল আযিযুল হাকিম।
(৫) সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের বাংলা অর্থ
সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের বাংলা অর্থ: তিনি আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তিনি অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা। তিনি পরম করুণাময়, পরম দয়াময়। তিনিই আল্লাহ্, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তিনিই মালিক, তিনিই পবিত্র, তিনিই শান্তি, নিরাপত্তাবিধায়ক, তিনিই রক্ষক, তিনিই পরাক্রমশালী, তিনিই প্রবল, তিনিই অহংকারের অধিকারী। ওরা যাকে শরিক করে আল্লাহ্ তার থেকে পবিত্র, মহান। তিনিই আল্লাহ্, সৃজনকর্তা, উদ্ভাবনকর্তা, রূপদাতা, সব সুন্দর নাম তাঁরই। আকাশ ও পৃথিবীতে যা-কিছু আছে সমস্তই তাঁর পবিত্র মহিমা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রমশালী, তত্ত্বজ্ঞানী।
(৬) সূরা আল-হাশরের শেষ তিন আয়াতের একটি সারণি
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيمِ
দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে।
প্রথম আয়াত | هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ বাংলা উচ্চারণঃ “হু আল্লা হুল্লাজী লা(আ) ইলাহা ইল্লা হু ওয়া আলিমুল গাইবী। ওয়াশ শাহাদাতী হুয়ার রাহমানুর রাহীম। অর্থঃ তিনিই আল্লাহ তা’আলা, তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি দৃশ্য ও অদৃশ্যকে জানেন তিনি পরম দয়ালু, অসীম দাতা। |
দ্বিতীয় আয়াত | هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلَامُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يُشْرِكُونَ বাংলা উচ্চারণঃ হু আল্লা হুল্লাজী লা(আ) ইলাহা ইল্লা হু। ওয়া আল মালিকুল কুদ্দুসুস সালামুল ম্যু মিনুল মুহাইমিনুল আজিজুল জাব্বারুল মুতাকাব্বির। ছুব হানাল্লাহী আম্মা ইউশরিকুন। অর্থঃ তিনিই আল্লাহ তিনি ব্যতিত কোন উপাস্য নেই। তিনিই একমাত্র মালিক,পবিত্র, শান্তি ও নিরাপত্তা দাতা, আশ্রয়দাতা, পরাক্রান্ত, প্রতাপান্বিত, মাহাত্মশীল। তারা যাকে অংশীদার করে আল্লাহ তা’ আলা তা থেকে পবিত্র। |
তৃতীয় আয়াত | هُوَ اللَّهُ الْخَالِقُ الْبَارِئُ الْمُصَوِّرُ لَهُ الْأَسْمَاء الْحُسْنَى يُسَبِّحُ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ বাংলা উচ্চারণঃ হু আল্লাহুল খালেকুল বারিয়্যুল মুছাব্বিরু লাহুল আছমা(আ)উল হুছনা। ইউ ছাব্বিহু লাহু মা ফিছ ছামা ওয়াতি ওয়াল আরদ্ ওয়া হুয়াল আজীজুল হাকীম। অর্থঃ তিনিই আল্লাহ তা’আলা, স্রষ্টা, উদ্ভাবক, রূপদাতা, উত্তম নাম সমূহ তাঁরই। নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সবই তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময়। |
(৭) সূরা আল-হাশরের শেষ তিন আয়াতের তাফসির
এ আয়াতসমূহ আল্লাহ তায়ালার গুণবাচক নামে পরিপূর্ণ। আল্লাহ তায়ালার এসব গুণবাচক নাম তাঁর ক্ষমতা ও পরিচয়ের স্বরূপ প্রকাশ করে। তিনি সর্বশক্তিমান। আসমান জমিন সবকিছুর মালিক। তিনি যা ইচ্ছা করেন তাই হয়। তিনি ব্যতীত আর কোনো ইলাহ নেই। তিনিই একমাত্র ইলাহ বা মাবুদ। আসমান ও জমিনের সবই তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। সুতরাং মানুষের উচিত একমাত্র তাঁরই দাসত্ব করা। সর্বাবস্থায় তাঁরই ইবাদত বন্দেগি করা।
সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের প্রথম আয়াত:
তিনিই আল্লাহ্, তিনি ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই, তিনি গায়েব ও উপস্থিত বিষয়াদির জ্ঞানী [১]; তিনি দয়াময়, পরম দয়ালু [২]।
[১] অর্থাৎ সৃষ্টির কাছে যা গোপন ও অজানা তিনি তাও জানেন আর যা তাদের কাছে প্রকাশ্য ও জানা তাও তিনি জানেন। এই বিশ্ব-জাহানের কোন বস্তুই তার জ্ঞানের বাইরে নয়। [ইবন কাসীর বাগভী]
[২] অর্থাৎ তিনি রহমান ও রহীম বা দাতা ও পরম দয়ালু। একমাত্র তিনিই এমন এক সত্তা যার রহমত অসীম ও অফুরন্ত। সমগ্র বিশ্ব চরাচরব্যাপী পরিব্যাপ্ত এবং বিশ্ব-জাহানের প্রতিটি জিনিসই তাঁর বদান্যতা ও অনুগ্রহ লাভ করে থাকে। [ইবন কাসীর]
(তাফসীরে জাকারিয়া)
সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের দ্বিতীয় আয়াত:
তিনিই আল্লাহ্, তিনি ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই। তিনিই অধিপতি, মহাপবিত্র [১], শান্তি-ত্রুটিমুক্ত, নিরাপত্তা বিধায়ক, রক্ষক পরাক্রমশালী, প্রবল, অতীব মহিমান্বিত। তারা যা শরীক স্থির করে আল্লাহ তা হতে পবিত্র, মহান।
[১] মূল ইবারতে الْقُدُّوسُ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যা আধিক্য বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। এর মূল ধাতু قدس। এর অর্থ সবরকম মন্দ বৈশিষ্ট মুক্ত ও পবিত্র হওয়া। [ইবন কাসীর; কুরতুবী]
(তাফসীরে জাকারিয়া)
সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের তৃতীয় আয়াত:
তিনিই আল্লাহ সৃজনকর্তা, উদ্ভাবনকর্তা [১], রূপদাতা। সকল উত্তম নাম তাঁরই [২]। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সমস্তই তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে [৩]। আর তিনিই পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় [৪]।
[1] বলা হয় যে, خلق ‘খালক্ব’ এর অর্থ, স্বীয় ইচ্ছানুযায়ী আন্দাজ ও অনুমান করা। আর برأ ‘বারাআ’ অর্থ, সেটাকে সৃষ্টি করা, গড়া এবং অস্তিত্বে নিয়ে আসা।
[2] ‘আসমায়ে হুসনা’ (সুন্দর নামাবলী) এর আলোচনা সূরা আ’রাফের ১৮০নং আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে।
[3] অবস্থার ভাষায় এবং কথ্য ভাষাতেও। যেমন, পূর্বে বর্ণনা হয়েছে।
[4] যে জিনিসেরই তিনি ফায়সালা করেন, তা হিকমত, কৌশল ও প্রজ্ঞা হতে শূন্য থাকে না।
(তাফসীরে আহসানুল বায়ান)
[সূত্র: এনসিটিবি ও hadithbd.com]