Skip to content

সংক্ষেপে ৯ জন ইসলামিক জীবনাদর্শ/জীবনচরিত

সংক্ষেপে ৯ জন ইসলামিক জীবনাদর্শ বা জীবনচরিত

আলোচ্য বিষয়:

জীবনাদর্শ বলতে এমন কিছু ব্যক্তির জীবন বুঝানো হয় যাদের জীবন আদর্শ জীবন এবং যাদের জীবন থেকে আমাদের শিক্ষণীয় অনেক কিছু রয়েছে।

আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তাঁর মনোনীত বান্দাদের প্রতি ওহী অবতীর্ণ করে আমাদেরকে বিভিন্ন বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহর নিকট থেকে ওহীপ্রাপ্ত এ বান্দাগণই হলেন নবি ও রাসু আর যারা রাসুলুল্লাহ (সা.) -এর আদর্শ অনুসরণ করে নিজের জীবনকে আলোকিত ও মহিমান্বিত করেছেন তাঁরা হলেন আল্লাহর প্রিয় বন্ধু বা ওলী। আমরা মহান আন্নার ঐ সকল মহান নবি-রাসুল ও ওলীদের জীবনাদর্শ সম্পর্কে জানব। তাঁদের আদর্শ অনুসরণ করে আমাদের জীবন আলোকিত করব।

নিম্নে সংক্ষেপে ৯ জন ইসলামিক জীবনাদর্শ/জীবনচরিত তুলে ধরা হলো-

(১) মহানবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.)

আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সর্বশেষ নবি ও রাসুল। তাঁকে আমাদের জন্য পৃথিবীতে রহমতস্বরূপ প্রেরণ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন,

“আমি তো আপনাকে জগৎসমূহের রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।”

(সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭)

ক) আরবের সমকালীন পরিবেশ

মহানবি (সা.)-এর আবির্ভাব সময়কালকে আইয়্যামে জাহেলিয়া বলা হতো। আইয়্যামে জাহেলিয়া অর্থ অজ্ঞতা ও বর্বরতার যুগ। এ সময় আরবের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা খুবই ভয়াবহ ছিল। সমগ্র আরববাসী শিরক ও পাপাচারে নিমজ্জিত ছিল। তারা মদ, জুয়া, নারী ও যুদ্ধ-বিগ্রহ নিয়ে নিমগ্ন থাকতো। তাদের মধ্যে ভালো-মন্দের কোনো পার্থক্য ছিল না। ঝগড়া-বিবাদ, চুরি-ডাকাতি, হত্যা, লুণ্ঠন, দুর্নীতি ও যুদ্ধ-বিগ্রহ-ই ছিল তাদের জীবন। তারা এক আল্লাহর পরিবর্তে বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি পূজা করত। পবিত্র কাবা গৃহে তখন ৩৬০টি দেবদেবীর মূর্তি ছিল।

এ সময় আরবের নারীদের অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। তাদের কোনো সামাজিক অধিকার বা মর্যাদা ছিল। না। তাদেরকে ভোগের সামগ্রী মনে করা হতো। তারা কন্যা সন্তানের জন্মকে দুর্ভাগ্য ও লজ্জার কারণ মনে করত। এমনকি কোনো কোনো গোত্র তাদের কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিতেও দ্বিধা করত না। পণ্যদ্রব্যের ন্যায় দাস-দাসী বাজারে বিক্রয় করা হতো এবং তাদের সাথে অমানবিক আচরণ করা হতো। এরকম ভয়াবহ নৈতিক অধঃপতনের পরেও তারা সাহসিকতা, প্রখর স্মৃতিশক্তি, কাব্যচর্চা, বাগ্মিতা, গোত্রপ্রীতি ও আতিথেয়তা প্রভৃতি গুণে গুণান্বিত ছিলো। তাদের মধ্যে কিছু লোক ছিল যারা এক আল্লাহতে বিশ্বাস করত। তারা কুসংস্কার ও পৌত্তলিকতা থেকে দূরে থাকত, তাদেরকে ‘হানীফ’ বলা হতো।

এরকম ঘৃণ্য পাপাচার, কুসংস্কার ও বর্বরতায় নিমজ্জিত আরববাসীদের মধ্যে প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) কে প্রেরণ করা হয় বিশ্ববাসীর রহমতস্বরূপ। তিনি সকল নবি-রাসুলগণের মধ্যে সর্বশেষ নবি ও রাসুল। তিনি নবিগণের নবি, আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা.)।

খ) হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্ম ও পরিচয়

আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদেকের সময় মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। প্রসিদ্ধ মত অনুসারে হস্তিবাহিনীর ঘটনার ৫০ দিন পরে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম আবদুল্লাহ এবং মাতার নাম আমিনা। তিনি মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় তাঁর পিতা মৃত্যুবরণ করেন। দাদা আব্দুল মুত্তালিব তাঁর নাম রাখেন মুহাম্মাদ এবং স্নেহময়ী মা আমেনা তাঁর নাম রাখেন আহমাদ।

গ) ধাত্রী হালিমার গৃহে শিশু মুহাম্মাদ (সা.)

তৎকালীন আরবের প্রথা অনুসারে শিশু মুহাম্মাদ (সা.)-কে লালন-পালনের জন্য বনু সা’দ গোত্রের বিবি হালিমার নিকট অর্পণ করা হয়। এ সময়ে বিবি হালিমার পরিবার কিছুটা অভাবগ্রস্ত ছিলো। শিশু মুহাম্মাদ (সা.)-এর বরকতে অভাব দূর হয়ে প্রাচুর্যে ভরে ওঠে তার সংসার। পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত বিবি হালিমা তাঁকে নিজ সন্তানের ন্যায় আদর-যত্নে লালন-পালন করেন। এরপর শিশু মুহাম্মাদ (সা.) মা আমেনার গৃহে ফিরে আসেন। মা হালিমার গৃহে অবস্থানকালে শিশু বয়সেই তাঁর মধ্যে ন্যায়বিচারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয়। তিনি মাতৃদুগ্ধ পান করার সময় বিবি হালিমার বামপাশের দুগ্ধ পান করতেন। অন্য পাশ থেকে কখনই পান করতেন না; তাঁর দুধ ভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন। মা হালিমার গৃহে থাকাকালে ৩ বছর বয়সে দুজন ফেরেশতা তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করে মানবীয় সকল দূর্বলতা মুক্ত করে কুদরতি শক্তি ও প্রজ্ঞা বৃদ্ধি করে দেন। ধাত্রী, মা হালিমার প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা-ভক্তি ও ভালোবাসা ছিলো। তিনি নবুওয়াতের দায়িত্ব লাভের পরেও দুধ মা হালিমা ও তাঁর পরিবারকে অত্যন্ত সম্মান ও সহায়তা করতেন।

ঘ) মা আমেনার মৃত্যু ও এতিম মুহাম্মাদ (সা.)

মাতৃগৃহে ফিরে আসার পর মায়ের সীমাহীন আদর-ভালোবাসায় বালক মুহাম্মাদ (সা.) বড় হতে লাগলেন। তিনি ৬ বছর বয়সে পিতার কবর যিয়ারতের জন্য মায়ের সাথে মদীনায় যান। সেখান থেকে মক্কায় ফেরার পথে মা আমিনা ইন্তেকাল করেন। ফলে তিনি পিতা-মাতা উভয়কে হারিয়ে একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। এসময় দাদা আব্দুল মুত্তালিব এতিম মুহাম্মাদের লালন-পালনের দায়িত্ব নিলেন। দাদা তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ- ভালোবাসায় লালন-পালন করতে থাকেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁর আট বছর বয়সে দাদাও ইন্তেকাল করেন। এরপর তিনি চাচা আবু তালেবের তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠতে থাকেন।

ঙ) আল-আমিন উপাধি লাভ ও বুহাইরা পাদ্রীর ভবিষ্যদ্বাণী

বাল্যকালে মহানবি (সা.)-এর মধ্যে চারিত্রিক উত্তম গুণাবলির বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। তাঁর কোমল স্বভাব ও অমায়িক ব্যবহারে সবাই তাকে আদর-স্নেহ করতেন। তিনি সবাইকে শ্রদ্ধা করতেন ও ভালোবাসতেন। সর্বদা হাসি-খুশি থাকতেন, সকলের কষ্টে ব্যথিত হতেন। সদা সত্য কথা বলতেন, কখনো মিথ্যা বলতেন না। এজন্য শৈশবেই তাঁকে সবাই আল-আমিন বা বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত করেন।

১২ বছর বয়সে কিশোর মুহাম্মাদ (সা.) চাচা আবু তালেবের সাথে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া গমন করেন। পথে বুহাইরা নামক জনৈক খ্রিস্টান পাদ্রীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। খ্রিস্টান পাদ্রী তাঁকে শেষ জামানার নবি ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল হিসেবে চিনতে পারেন। তিনি আবু তালেবকে পরামর্শ দেন তিনি যেন এই বালককে পৌত্তলিক ইয়াহুদিদের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করেন; তাকে মক্কায় পাঠিয়ে দেন। তাই চাচা আবু তালেব পাদ্রীর পরামর্শ মোতাবেক মহানবি (সা.)-কে মক্কায় ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।

চ) শান্তি সংঘ প্রতিষ্ঠা ও হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) স্থাপন

শৈশব থেকেই মহানবি (সা.) আরব জাতির চারিত্রিক অধঃপতন লক্ষ করেছেন। এ সময়ে হরবে ফুজ্জারের ভয়াবহতা দেখে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন; তাঁর মন বিগলিত হয়। তাই তিনি সমাজের অরাজকতা দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় তিনি কতিপয় খুবককে নিয়ে ‘হিলফুল ফুযুল ) নামে একটি খুব শান্তিসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংঘের মাধ্যমে তিনি মুসাফিরদের নিরাপত্তা, মজলুম ও অসহায়ের সহায়তা এবং অত্যাচারীকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন ও আরবে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করেন। তিনি যে ভবিষ্যৎ জীবনে শান্তির অগ্রদূত হবেন, এ সাংগঠনিক তৎপরতা তাই প্রমাণ করে।

ছোটবেলা থেকেই মহানবি মুহাম্মাদ (সা.) অনন্যসাধারণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী ছিলেন। তিনি যখন একজন যুবক, সে সময় মক্কার গোত্রপ্রধানরা মিলে পবিত্র কা’বা ঘর সংস্কারের কাজ শুরু করেন। কা’বা ঘর সংস্কারের কাজ সমাপ্ত হলে পবিত্র হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) যথাস্থানে স্থাপন করা নিয়ে গোত্রসমূহের মধ্যে। বিবাদ শুরু হয়। অবশেষে গোত্রপ্রধানরা সিদ্ধান্ত নেয় যে, আগামীকাল সকালে সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি কা’বা চত্বরে প্রবেশ করবেন, তিনিই এ বিবাদ মীমাংসা করবেন। সকালবেলা হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সবার আগে কা’বা চত্তরে প্রবেশ করলেন। এটা দেখে সবাই সন্তুষ্ট হলো। তিনি তাঁর চাদরের মাঝখানে পবিত্র পাথরটি রেখে সকল গোত্রের সরদারকে চাদরের চারপাশ ধরতে বললেন। তারা সকলে মিলে চাদরটি ধরে যথাস্থানে নিয়ে গেল, হযরত মুহাম্মাদ (সা.) নিজ হাতে পাথরখানা কাবার দেয়ালে বসিয়ে দিলেন। ফলে আরব জাতি একটি ভয়াবহ যুদ্ধ থেকে রক্ষা পেল এবং সকলে পাথরটি বসানোর গৌরব লাভ করল।

ছ) বিবি খাদিজার সাথে বিবাহ

তৎকালীন আরবে খাদিজা (রা.)-এর সচরিত্রের যথেষ্ঠ সুনাম ছিল। তিনি নিষ্কলুষ চরিত্রের জন্য তাহিরা বা পূণ্যবর্তী নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি মহানবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর সততা ও আমানতদারিতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে তার ব্যবসায়-বাণিজ্য পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। মহানবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর নেতৃত্বে ব্যবসায় প্রচুর সাফল্য আসে। তাছাড়া তাঁর অমায়িক ব্যবহার, সততা ও বুদ্ধিমত্তায় তিনি তাঁর প্রতি আরো বেশি মুগ্ধ হয়ে যান। ফলে খাদিজাতুত তাহিরা তাকে বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) চাচা আবু তালেবের পরামর্শে এ প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করলেন। এ সময় খাদিজা (রা.) বয়স ছিল ৪০ বছর আর হযরত মুহাম্মাদ (সা.) -এর বয়স ছিল ২৫ বছর।

জ) মুহাম্মাদ (সা.)-এর নবুওয়াতের দায়িত্ব লাভ

হযরত মুহাম্মাদ (সা.) শৈশব হতেই সমাজকে পাপাচার ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতেন। হযরত খাদিজা (রা.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর তিনি প্রায়শ মক্কার অদূরে হেরা পর্বতের গুহায় গভীর চিন্তায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। অবশেষে ৪০ বছর বয়সে ৬১০ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র রমযান মাসের ২৭ তারিখ ওহী প্রাপ্ত হন। হযরত জিব্রাঈল (আঃ) তাঁকে সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত পাঠ করে শোনান; তিনি নবুওয়াত লাভ করেন। নবুওয়াত লাভের পর তিনি মহান আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত ও ইসলাম প্রচার শুরু করেন।

ঝ) গোপনে ইসলাম প্রচার

মহানবি (সা.) নবুয়ত লাভের কিছু দিন পরে আবার তাঁর প্রতি ওহী পাঠিয়ে আল্লাহ তা’আলা বললেন,

“হে রাসুল! আপনার প্রতিপালকের নিকট থেকে আপনার প্রতি যা নাযিল হয়েছে তা প্রচার করুন।”

(সূরা মায়িদা, আয়াত: ৬৭)

মহান আল্লাহর এ নির্দেশের পর মহানবি (সা.) আরববাসীকে পৌত্তলিকতা ত্যাগ করে সত্য ধর্ম ইসলাম গ্রহণের জন্য আহ্বান জানান। প্রথমে তিন বছর তিনি তাঁর নিকট আত্মীয়-স্বজন ও অন্তরঙ্গ বন্ধু-বান্ধবদের নিকট গোপনে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। হযরত খাদিজা (রা) সর্বপ্রথম তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এরপর বয়স্কদের মধ্যে তাঁর একান্ত সহচর আবু বকর (রা.), বালকদের মধ্যে হযরত আলী ও যায়েদ ইসলাম গ্রহণ করেন।

ঞ) প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার

নবুয়তের তিন বছর পর প্রকাশ্যে দাওয়াত প্রদানের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি মহান আল্লাহর নিকট থেকে ওহী আসলো।

আল্লাহ বললেন,

“আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করুন।”

(সূরা শুআরা, আয়াত: ২১৪)

রাসুলুল্লাহ (সা.) মহান আল্লাহর এ নির্দেশনা পেয়ে মক্কাবাসীদের সাফা পাহাড়ের পাদদেশে জড়ো করে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা দিলেন, হে আব্দুল মুত্তালিবের বংশধরগণ! আমি যদি বলি, এ পাহাড়ের অপর দিকে শত্রুপক্ষ রয়েছে। তারা তোমাদেরকে আক্রমণ করতে উদ্যত। তোমরা কি আমার কথা বিশ্বাস করবে? তারা সকলে বলল, হ্যাঁ অবশ্যই বিশ্বাস করব। তখন তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে সতর্ক করছি আসন্ন কঠিন শাস্তির ব্যাপারে। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। তখন আবু লাহাব (আল্লাহ তার প্রতি লা‘নত বর্ষিত করুন) বলে উঠল, আজই তুমি ধ্বংস হও। তুমি কি এজন্যই আমাদের এখানে ডেকেছিলে? আবু লাহাবের এ আচরণে রাসুল (সা.) অনেক কষ্ট পান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাসুল (সা.) কে সান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহ তা’আলা সূরা লাহাব নাযিল করেন।

ট) মুসলমানদের উপর কুরাইশদের নির্যাতন

প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের পর থেকেই মক্কার কুরাইশরা মহানবি (সা.) ও তাঁর অনুসারীদের উপর অত্যাচার ও নির্যাতন শুরু করে। ইসলাম ত্যাগে বাধ্য করার জন্য তারা মুসলমানদেরকে বন্দী করে রাখা, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কষ্ট দেওয়া, প্রহার করা, লৌহদণ্ড গরম করে শরীরের বিভিন্ন স্থানে দাগ দেয়া, প্রখর রৌদ্রে মরুভূমিতে চিৎ করে শুইয়ে পাথর চাপা দেওয়াসহ নানা প্রকারের অমানবিক নির্যাতন চালাতে থাকে। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া)। তাদের বর্বর নির্যাতনে হযরত আম্মারের মা সুমাইয়া (রা.) সর্বপ্রথম শহীদ হন। ইসলাম গ্রহণের অপরাধে হযরত বেলাল (রা.)-এর মুনিব তাঁকে অমানুষিক শাস্তি প্রদান করেন। তারা প্রিয়নবির পথে কাঁটা ছড়িয়ে রাখত, তাঁকে প্রস্তর মারত। কিন্তু তাদের অকথ্য অত্যাচারের পরেও তৌহিদের পথ থেকে কেউ বিচ্যুত হননি; তাদের সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হলো।

ঠ) আবিসিনিয়ায় গমন

নবদীক্ষিত মুসলমানদের উপর অমানবিক নির্যাতন দেখে প্রিয়নবি (সা.)-এর প্রাণ কেঁদে উঠল। তিনি কুরাইশদের অমানবিক নির্যাতন থেকে পরিত্রাণের জন্য অসহায় নওমুসলিমদেরকে আবিসিনিয়ায় আশ্রয় নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। প্রথমে নবুয়তের পঞ্চম বছর রজব মাসে হযরত উসমান ও তাঁর স্ত্রী রাসুল (সা.)-এর কন্যা রোকাইয়াসহ ১১জন পুরুষ ও ৪ জন মহিলা আবিসিনিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করলেন। কিছু দিন পর দ্বিতীয় ধাপে নারী-পুরুষ ও শিশুসহ আরও ৮৩ জন মুসলমান সেখানে আশ্রয় নেন। কুরাইশরা আমর ইবন আসের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে আশ্রিত মুসলিমদেরকে তাদের হাতে সমর্পণের অনুরোধ করে। কিন্তু বাদশাহ নাজ্জাসী মুসলমানদের কথায় মুগ্ধ হয়ে কুরাইশ প্রতিনিধি দলকে আবিসিনিয়া থেকে বের করে দেন।

ড) কুরাইশদের বয়কট ও দুঃখের বছর

কাফির-মুশরিকদের নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বনূ হাশিম ও বনূ আব্দুল মুত্তালিবের লোকজন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সহায়তায় এগিয়ে আসেন। এ ছাড়া ইতোমধ্যে মহানবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর চাচা হামযা (রা.) এবং হযরত উমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করায় মুসলমানদের শক্তি আরও বৃদ্ধি পায়। ফলে উপয়ান্তর না পেয়ে কুরাইশরা মিলে মহানবি মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর অনুসারীদেরকে বয়কটের সিদ্ধান্ত নিলো। তারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পরিবার ও অনুসারীদের উপর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করল। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর অনুসারীদের নিয়ে শিয়াবে আবু তালেব নামক নির্জন পার্বত্য উপত্যকায় আশ্রয় নিলেন। খাদ্য-পানীয় চরম সংকটসহ ভীষণ দুঃখ-কষ্টে তাঁদের দিন কাটে। এভাবে ৩ বছর কঠোর অগ্নিপরীক্ষার পরেও তাঁরা আল্লাহর উপর বিশ্বাস হারালেন না। অবশেষ ৩ বছর পর কুরাইশরা তাদের প্রত্যাহার করল।

কুরাইশদের থেকে মুক্তি পাওয়ার পর নবুয়তের ১০ম বছরে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় স্ত্রী বিবি খাদিজা (রা.) ও অভিভাবক চাচা আবু তালেব দুজনেই ইন্তেকাল করেন। তাঁরা ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শক্তি ও সাহায্যকারী, সত্যিকারের বন্ধু ও পরামর্শদাতা, বিপদে আপদে রক্ষাকর্তা। তাদের অভাবে মহানবি (সা.) ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়েন। এ সুযোগে কাফেররা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উপর অত্যাচার ও নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিলো। প্রিয়নবি (সা.)-এর একান্ত প্রিয়জনের মৃত্যু এবং এ ধরনের অত্যাচার নির্যাতনের জন্য এ বছরকে আমুল হুযন বা দুঃখের বছর বলা হয়।

ঠ) তায়েফ গমন

চাচা আবু তালেবের মৃত্যুর পর কুরাইশরা মহানবি (সা.)-এর উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। শেষ পর্যন্ত তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তায়েফ গমন করলেন। কিন্তু তায়েফবাসী তাকে প্রস্তরাঘাতে রক্তরঞ্জিত করল। তারা জঘন্য অত্যাচার করে তাঁকে পাগল বলে শহর থেকে তাড়িয়ে দিল।

ণ) রাসুল (সা.)-এর মিরাজ

মিরাজ অর্থ ঊর্ধ্ব গমন, ইসরা অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ। পবিত্র কুরআনে সূরা বনী ইসরাইল এর প্রারম্ভে এই ইসরা ও মিরাজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। স্বজন হারানোর বেদনা ও কাফিরদের অব্যাহত নিষ্ঠুর আচরণের এই দুঃসময়ে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীব (সা.) কে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে সৃষ্টির অপার রহস্য প্রদর্শন করেন এবং তাঁর দিদারে প্রিয় নবির মনকে আনন্দে ভরে দেন। এই পর্বটিকেই মিরাজ বলা হয়। মিরাজ রাসুল (সা.)- এর জীবনে অতি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। রাসুল (সা.) নবুয়তের ১০ম বা ১১শ বছরে রজব মাসের ২৭ তারিখ গভীর রজনীতে বোরাক নামক বেহেশ্তি বাহনে চড়ে কাবাগৃহ হতে জেরুজালেমে বাইতুল মাকদাস এবং পরে সেখান থেকে উর্ধ্বালোকে গমন করে মহান আল্লাহর দিদার লাভ করেন। মিরাজের রজনীতেই প্রিয়নবি (সা.)-এর উম্মতদের উপর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হয়।

ত) আকাবার শপথ

নবুয়তের দ্বাদশ বছরে হজ্জের সময়ে ইয়াছরিব (মদিনার পূর্ব নাম) থেকে আগত ১২ জনের একটি দল রাসুল (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা আকাবা উপত্যকায় মহানবি (সা.)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। তারা এক আল্লাহর উপাসনা করা এবং যাবতীয় পাপাচার থেকে দূরে থাকার শপথ করেন। ইসলামের ইতিহাসে এই শপথকেই আকাবার প্রথম শপথ বলা হয়।

আকাবার প্রথম শপথের পরবর্তী বছরে ৬২২ খ্রি. মদিনা হতে ৭৫ জনের একটি দল (৭৩ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলা) এসে রাসুল (সা.) এর হাতে বায়’আত গ্রহণ করেন। তাঁরা প্রিয়নবিকে তাঁদের দেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। এ ছাড়াও তাঁরা ইসলাম প্রচারে সর্বপ্রকার সাহায্য এবং ইসলামকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেন। ইসলামের ইতিহাসে এটাই আকাবার দ্বিতীয় শপথ। ইসলামের ইতিহাসে আকাবার শপথ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

থ) মদিনায় হিজরত

আকাবার শপথের পর মদিনায় ইসলাম দ্রুত প্রসার লাভ করতে থাকে। মদিনার মনোরম প্রকৃতি ও ইসলাম প্রচারের অনুকুল পরিবেশের জন্য মহানবি (সা.) সেখানে হিজরতের জন্য মনস্থির করেন। এদিকে মক্কার কুরাইশরা দারুন নদওয়া বৈঠকে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে। অবশেষে তিনি ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে ইসলামের জন্য মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে মদিনা হিজরত করেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হযরত আবু বকর (রা.) এ হিজরতের সময়ে সঙ্গী ছিলেন।

মহানবি (সা.) -এর শৈশব-কৈশোরের অনুপম চরিত্রিক মাধুর্যে আমাদের জন্য অনুসরণীয় অসংখ্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে; তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

  • আমরা ন্যায়বিচার করব ও অপরের অধিকার আদায়ে সর্বদা সচেষ্ট হবো;
  • ছোট-বড় সকলের সাথে উত্তম ব্যবহার করব, সকলকে সম্মান করব ও ভালোবাসবো; কাউকে অপমান করব না।
  • সর্বদা কঠোর পরিশ্রম করব; পরিবারের কাজে সহযোগিতা করব;
  • পরিবার ও সমাজে শান্তি বিনষ্টকারী কোনো আচরণ করব না;
  • সদা সত্য কথা বলব; কারও আমানত নষ্ট করব না:
  • বন্ধু ও সহপাঠীরা মিলে ভালো কাজ করার চেষ্টা করব; কোনো অন্যায় করব না;
  • অসহায় ও অত্যাচারিত মানুষকে সাহায্য করব এবং অত্যাচারীকে প্রতিহত করব:
  • সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করব;
  • সর্বোপরি ইসলামি আদর্শে নিজেদের জীবন গড়ব।

মহানবি (সা.) এর মাক্কী জীবন থেকে আমাদের শিক্ষণীয়:

  • সকলের মাঝে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া;
  • আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো শরিক নেই একথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করা;
  • বিপদে আপদে সর্বদা ধৈর্যধারণ করা;
  • ইসলামের প্রচার ও প্রসারে কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করা;
  • শত্রু হলেও তার আমানত রক্ষা করা;
  • নামাজ আমাদের জন্য মহান আল্লাহর উপহার, তাই ওয়াক্তমতো নামাজ আদায় করা।

(২) হযরত ইসমাঈল (আঃ)

হযরত ইসমাঈল (আঃ) ছিলেন আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মহান পূর্বপুরুষ। তিনি পিতা ইবরাহিম (আঃ) এর সাথে পবিত্র কাবাঘর নির্মাণ করেন। প্রিয় শিক্ষার্থী, আজ আমরা ইসমাঈল (আঃ)-এর জীবন ও চরিত্র-মাধুর্য সম্পর্কে জানব।

ক) জন্ম ও বংশ পরিচয়

হযরত ইসমাঈল (আঃ) ছিলেন ইবরাহিম (আঃ)-এর জ্যেষ্ঠপুত্র এবং মা হাজেরার গর্ভজাত সন্তান। তাঁর জন্মের সময় পিতা ইবরাহিম (আঃ)-এর বয়স ছিল ৮৬ বছর। তিনি সিরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতা বিবি হাজেরা মিসরের কিবতী রাজবংশীয় মহিলা ছিলেন। ইবরাহিম (আঃ)-এর বৃদ্ধ বয়সে মহান আল্লাহর নিকট দোয়ার বরকতে আল্লাহ তাঁকে উক্ত পুত্রসন্তান দান করেন। পবিত্র কুরআনে এ বিষয়ে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এক সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান করুন। অতএব আমি তাকে অতিসহনশীল এক পুত্রসন্তানের সুসংবাদ দিলাম।’ (সূরা আস-সাফফাত, আয়াত: ১০০-১০১)

খ) নির্বাসন ও জমজম কূপ সৃষ্টি

হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর জন্মের কিছুদিন পর ইবরাহিম (আঃ) মহান আল্লাহর নির্দেশে তাঁকে ও তাঁর মাকে মক্কার ফারান পর্বতের উপত্যকায় বিজন ভূমিতে একটি বড় গাছের নিচে রেখে আসেন। বস্তুত এটি ছিল মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বড় পরীক্ষা। তিনি তাঁদের খাবারের জন্য এক থলে খেজুর ও এক মশক পানি দিয়ে আসেন এবং তাদের খাদ্য-পানীয় ও হেফাজতের জন্য মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেন।

বিবি হাজেরা তাঁর সন্তানকে বুকের দুধ পান করিয়ে লালন-পালন করতে থাকেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যে তাঁদের পানি ও খাবার ফুরিয়ে যায়। দুগ্ধপোষ্য শিশু ইসমাঈল পানির পিপাসায় ছটফট করতে থাকেন। তিনি শিশুর কান্না সহ্য করতে না পেরে পানি ও খাবারের সন্ধানে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে ছোটাছুটি করতে থাকেন। এ পাহাড়দ্বয়ে সাতবার ছোটাছুটির পরেও কোথাও পানি কিংবা খাবার পেলেন না। অবশেষে ইসমাঈলের কাছে ফিরে এসে দেখতে পান যে, আল্লাহর অসীম কুদরতে শিশু ইসমাঈলের পায়ের আঘাতে সে স্থানে পানির স্রোতধারা প্রবাহিত হচ্ছে। এটাই হলো জমজম কূপের উৎস। হযরত হাজেরা (আঃ) ঐ কূপ থেকে নিজে এবং তার শিশুপুত্র ইসমাঈলকে পানি পান করান। তিনি মশক ভরে পানি রাখলেন এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন।

গ) কুরবানি

ইসমাঈল (আঃ) যখন ১৩ কিংবা ১৪ বছরের যুবক, তখন হযরত ইবরাহিম (আঃ) স্বপ্নযোগে পুত্র ইসমাঈল (আঃ) কে কুরবানির জন্য আদিষ্ট হন। নিঃসন্দেহে এটি ছিল মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি কঠিন পরীক্ষা।

স্বপ্ন থেকে জাগ্রত হয়ে ইবরাহিম (আঃ) পুত্রকে বললেন,

“হে আমার সন্তান! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে কুরবানি করছি। এ ব্যাপারে তোমার মতামত কী? তখন তিনি বললেন, হে আমার পিতা! আপনি যা করতে আদিষ্ট হয়েছেন, তা-ই করুন। ইনশাআল্লাহ আমাকে আপনি ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত দেখতে পাবেন।”

(সূরা আস সাফফাত, আয়াত: ১০২)

হযরত ইবরাহিম (আঃ) মিনা প্রান্তরে প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাঈলকে কুরবানি করতে শুরু করলেন। এমন সময় তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে আওয়াজ শুনতে পেলেন,

“হে ইবরাহিম! তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি।”

(সূরা আস সাফফাত, আয়াত: ১০৫)

আল্লাহর ইচ্ছায় পুত্র ইসমাঈল (আঃ) এর স্থলে একটি সাদা দুম্বা কুরবানি হয়ে গেল আর ইসমাঈল (আঃ) দুম্বার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন।

আল্লাহ তা‘আলা এ ঘটনা উল্লেখ করে বলেন,

“আমি ইসমাঈলকে এক মহান যবেহের বিনিময়ে মুক্ত করলাম এবং একে আমি পরবর্তী লোকদের মধ্যে স্মরণীয় করে রাখার ব্যবস্থা করলাম।”

(সূরা আস সাফফাত, আয়াত: ১০৭-১০৮)

এ স্মৃতির সম্মানার্থে কুরবানি করা উম্মতে মোহাম্মাদির উপর ওয়াজিব।

ঘ) কাবাগৃহ নিৰ্মাণ

কাবাঘর সর্বপ্রথম ফেরেশতাগণ এবং পরে হযরত আদম (আঃ) পুনর্নির্মাণ করেন। পরবর্তী সময়ে হযরত ইবরাহিম (আঃ) আল্লাহর হুকুমে হযরত ইসমাঈল (আঃ) এর সহযোগিতায় কাবা ঘর পুনর্নির্মাণ করেছিলেন।

কাবা ঘর নির্মাণের পর তাঁরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেন,

“হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের এ প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমকে কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি সবকিছু শোনেন এবং জানেন।”

(সূরা আল বাকরা, আয়াত: ১২৭)

ঙ) ইসমাঈল (আঃ)-এর গুণাবলি ও মহত্ত্ব

কুরআন মাজিদে ইসমাঈল (আঃ)-এর সততা, ধৈর্য, সহনশীলতা, ওয়াদা পালন, সালাতের হেফাজতকারী, পরিবারকে সালাত আদায়ের নির্দেশদানকারী এবং আল্লাহর ইবাদাতের দিকে মানুষকে আহ্বানকারী প্রভৃতি গুণের উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর প্রশংসায় পবিত্র কুরআনের ৯টি সূরার ২৫টি আয়াত বর্ণিত হয়েছে। তিনি ছিলেন যাবীহুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর সমীপে স্বেচ্ছায় জীবন উৎসর্গকারী।

তিনি বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল আরবি ভাষী ছিলেন। নবি (সা.) বলেন, সর্বপ্রথম ‘স্পষ্ট আরবি’ ভাষা ব্যবহার করেন হযরত ইসমাঈল (আঃ) তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। (আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ) ইসমাঈল (আঃ) ছিলেন কুরাইশী আরবি ভাষায় ওহীপ্রাপ্ত প্রথম নবি। এটি ইসমাঈল (আঃ) এর জন্য একটি অনন্য গৌরবের বিষয়। এ জন্য তাঁকে আবূল আরাব (أبول العربية) বা আরবদের পিতা বলা হয়।

চ) উপাধি

বর্ণিত আছে যে, একদা তিনি জনৈক ব্যক্তির সাথে একটি নির্ধারিত স্থানে অপেক্ষা করার অঙ্গীকার করেন। সে লোকটি কথা অনুযায়ী নির্দিষ্ট স্থানে না আসলেও তিনি তার জন্য তিন দিন পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকেন। অতঃপর তৃতীয় দিন লোকটির সাথে তাঁর সেখানে দেখা হয়। (ইবনে কাছির) নিজের ওয়াদা রক্ষার জন্য তিন দিন পর্যন্ত কষ্ট করে অপেক্ষা করেছিলেন বলে তাঁকে আল্লাহ তা‘আলা সাদেকুল ও‘আদ বা অঙ্গীকার পালনকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।

কুরআন মাজিদে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,

“তিনি ওয়াদা পালনে সত্যনিষ্ঠ ছিলেন এবং তিনি আল্লাহর রাসুল ও নবি।”

(সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৫৪)

ছ) মৃত্যু

হযরত ইসমাঈল (আঃ) ১৩৭ বছর বয়সে মক্কা নগরীতে ইন্তেকাল করেন (আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ)। প্রসিদ্ধ মত অনুসারে তাঁকে কাবার হাতীমে তাঁর মা হাজেরার কবরের পাশে দাফন করা হয়। মহান আল্লাহর প্রতি ইসমাঈল (আঃ)-এর অগাধ বিশ্বাস ও আনুগত্য, ত্যাগ এবং পিতৃভক্তি, অঙ্গীকার পালন ইত্যাদি আমাদের জীবনের অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।

(৩) হযরত খাদিজা (রা.)

ক) জন্ম ও পরিচয়

হযরত খাদিজা (রা.) ছিলেন মহানবি (সা.)-এর প্রথম স্ত্রী। তিনি বিখ্যাত কুরাইশ বংশের আবদুল উয্যা নামক পরিবারে ৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। বিশ্বের ইতিহাসে যে কয়জন সম্মানিত নারী রয়েছেন, তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

হযরত খাদিজা (রা.) আরবের একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর বিভিন্ন পণ্যের আমদানি-রপ্তানির ব্যবসায় তৎকালীন শাম দেশ তথা বর্তমান সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। হযরত খাদিজা (রা.) তাঁর ব্যবসা পরিচালনার জন্য বিভিন্ন সময় লোক নিয়োগ করতেন। তিনি মহানবি (সা.)-এর সততা, আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার কথা শুনে তাঁকে তাঁর ব্যবসা দেখাশোনা করার জন্য অনুরোধ করেন। মহানবি (সা.) তাঁর ব্যবসার দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর ব্যবসায় প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়।

খ) মুহাম্মাদ (সা.)-এর সাথে বিবাহ

হযরত খাদিজা (রা.) যুবক মুহাম্মাদ (সা.)-এর সততা, বিশ্বস্ততা, উন্নত চরিত্র ও বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাচা আবু তালিবের সম্মতিক্রমে ২০টি উট মাহরের বিনিময়ে এ বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিবাহের পর হযরত খাদিজা (রা.) তাঁর সকল সম্পদের দায়দায়িত্ব রাসুল (সা.)-এর উপর ছেড়ে দেন এবং তাঁকে ইচ্ছামতো সম্পদ খরচ করার অনুমতি দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ঐ সম্পদ অসহায় ও গরীব-দুঃখীদের মাঝে বিলিয়ে দেন।

গ) চারিত্রিক গুণাবলি

তিনি একজন আদর্শ নারী, আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ ব্যবসায়ী ও আদর্শ মা ছিলেন। হযরত খাদিজা (রা.) জাহিলি যুগে জন্মগ্রহন করেও সৎ চরিত্রের অধিকারি ছিলেন। কখনো কোনো অন্যায় ও অসৎ কাজ করেননি। মহানবি (সা.) -এর প্রতি তাঁর প্রবল ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল। তিনি নারীদের কল্যাণমূলক কাজে বিশেষভাবে মনোনিবেশ করেন। তিনি বিধবা নারীদেরকে আশ্রয় দিতেন ও অবহেলিত নারীদেরকে নিজ বাড়িতে শিক্ষা দিতেন। তিনি অবসর সময়ে সেলাই করতেন।

তিনি ছিলেন একজন দানশীল ও দয়ালু ব্যক্তি। তিনি শিশু, অসহায় ও এতিমদের ভালোবাসতেন। ইসলামের কল্যাণে তাঁর সকল সম্পদ দান করার কারণে আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট ছিলেন। হযরত খাদিজা (রা.)-এর স্বামীভক্তি ছিল অতুলনীয়। তিনি রাসুল (সা.)-এর সকল কাজে শক্তি ও সাহস যোগাতেন। বিপদে-আপদে কাছে থাকতেন, তাঁকে সান্ত্বনা দিতেন।

ঘ) হযরত খাদিজা (রা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব

হযরত খাদিজা (রা.) নারীকুলের গৌরব। তিনি সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তি। ইসলাম প্রচারে তাঁর অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তিনি জীবিতকালেই বেহেশতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন। খাদিজা (রা.)-এর কন্যা ফাতিমা (রা.) জান্নাতে নারীদের সর্দার।

রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সম্মানে বলেন,

“আল্লাহ খাদিজার চেয়ে কোনো মহৎ নারী আমাকে দেননি। তিনি এমন সময় আমাকে বিশ্বাস করেছিলেন, যখন সবাই আমাকে মিথ্যাবাদী বলে আখ্যায়িত করেছিল। আমার বিপদের সময় সবাই যখন আমাকে পরিত্যাগ করেছে, তখন তিনি আমাকে সমর্থন ও অর্থ সাহায্য করেছেন।”

(মুসনাদে আহমদ)

ওনার সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক আরো বর্ণিত আছে যে, বিশ্বের সকল নারীর উপর যে চারজন নারীর সম্মান রয়েছে তন্মধ্যে হযরত খাদিজা (রা.) অন্যতম।

হযরত খাদিজা (রা.) ছিলেন রাসুল (সা.)-এর সকল বিপদের বিশ্বস্ত সাথী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। জাহেলী যুগের কোন প্রকার অন্যায় ও পাপ তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁর উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আজও বিশ্বের নারীদের জন্য অনুপম আদর্শ।

(৪) উম্মুল মুমিনিন আয়েশা সিদ্দিকা (রা)

উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ছিলেন আমাদের প্রিয়নবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর সর্বকনিষ্ঠ স্ত্রী। অনন্য চারিত্রিক মাধুর্য দ্বারা তিনি মুসলমানদের বিশেষ করে নারী সমাজের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছেন। এ ছাড়াও কুরআন, হাদিসে এবং ফিকহ বিষয়ক জ্ঞানে তাঁর অবদান অপরিসীম।

ক) জন্ম ও শৈশব

প্রসিদ্ধ মতে তিনি নবুয়াতের চতুর্থ বছরে মক্কায় কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হযরত আবুবকর (রা.) এবং মাতা উম্মে রুম্মান। শৈশবকালেই তাঁর আচার-আচরণ, চাল-চলন ও কথাবার্তা সকলকে মুগ্ধ করেছিল।

খ) মহানবি (সা.)-এর সাথে বিবাহ

নবুয়াতের দশম বছরে মহানবি (সা.)-এর সাথে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর বিবাহ সম্পন্ন হয়। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয়তমা স্ত্রী। তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী যার ঘরে থাকা অবস্থায় তাঁর কাছে ওহি অবতীর্ণ হয়েছিল। স্ত্রী হিসেবে তাঁকে গ্রহণের মাঝে ইসলামের প্রভূত কল্যাণ ও হিকমত নিহিত ছিল।

গ) শিক্ষা জীবন

পিতার কাছেই শিশু হযরত আয়েশা (রা.)-এর লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। তিনি পিতার নিকট থেকে কুষ্টিবিদ্যা ও কাব্য শাস্ত্রে পারদর্শিতা অর্জনে সক্ষম হন। এ ছাড়া পিতার কাছে তিনি কাব্য, ইতিহাস, সাহিত্য ও প্রশাসন প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন ছাড়াও তিনি গৃহস্থলি বিদ্যায়ও পারদর্শী ছিলেন। তাঁর কৈশোর ও যৌবনের পুরোটা সময় কেটেছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক মহানবি (সা.)-এর একান্ত সান্নিধ্যে। তাই মহানবির সাহচর্যে তিনি কুরআন, হাদিস ও ফিকহ বিষয়ক জ্ঞানে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। নারীদের একান্ত বিষয়সমূহ তিনি মহানবি (সা.) এর কাছে জেনে অন্যদের শিক্ষা দিতেন।

ঘ) ইফকের ঘটনা

ষষ্ঠ হিজরি সনে বনু মুস্তালিক যুদ্ধে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) রাসুল (সা.)-এর সফরসঙ্গী ছিলেন। যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে তাঁর গলার হার হারিয়ে যায়। হার খুঁজতে গিয়ে তিনি কাফেলা থেকে পিছনে পড়ে যান। এতে তাঁর ফিরতে দেরি হয়। এ সুযোগে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই, হাসসান বিন সাবিত, মিসতাহ, হামনাহ প্রমুখ মুনাফিক তাঁর বিরুদ্ধে গুজব ছড়াতে থাকে। পবিত্র কুরআনে এটি ‘ইফকের ঘটনা’ বলে পরিচিত। এতে তিনি চরম মানসিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। তাঁর জীবন বিষণ্ন হয়ে ওঠে। এ ঘটনায় রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং তাঁর পিতামাতা চরম উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে যান। ফলে মহান আল্লাহ সূরা নূরের ১০টি আয়াত নাজিল করে আয়েশা (রা.)-এর নির্দোষ ও পবিত্রতা ঘোষণা করেন। এভাবে মুনাফিকদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলো এবং তাঁর মর্যাদাও পবিত্র কুরআনে স্থান পেল।

ঙ) ইসলামি জ্ঞান প্রসারে অবদান

ইসলামি শিক্ষা প্রচার ও সম্প্রসারণে আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি ছিলেন রাসুল (সা.)-এর স্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে বিচক্ষণ, বুদ্ধিমতি, অসাধারণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারিণী। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ব্যক্তিগত জীবনসহ পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা-সংস্কৃতি, চিকিৎসা, ইবাদাত, পরকাল সর্বোপরি শারঈ সকল বিধি-বিধান সম্পর্কে হাদিস বর্ণনা করে মুসলিম উম্মাহকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন।

তিনি ছিলেন নারীদের মধ্যে সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবি। অসংখ্য সাহাবি ও তাবেয়ী তাঁর কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাঁর থেকে বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ২২১০টি।

হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ছিলেন একজন শিক্ষক। তিনি তাফসীর, হাদিস, ফিকহ প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষাদানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। নারীদের বিভিন্ন বিষয়ের বিধান বর্ণনায়ও তিনি অগ্রগামী ছিলেন। তাঁর শিক্ষাকেন্দ্রে একসাথে ২০০ এর অধিক শিক্ষার্থী শিক্ষাগ্রহণ করতেন। মুসতাদরাক আল-হাকেম গ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে, আয়েশা (রা.) থেকে শরিয়তের এক-চতুর্থাংশ বিধি-বিধান বর্ণিত আছে।

চ) গুণাবলি

হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ছিলেন অনুপম চরিত্র-মাধুর্যের অধিকারী। তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ মেধাশক্তিসম্পন্ন, বিদুষী, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, তেজস্বিনী, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী, গৃহকর্মে সুনিপুণা, শিক্ষয়িত্রী, সত্যের সাধিকা, অগ্নিবর্ষী বাগীশ, সচ্চরিত্রা, মধুর আলাপী, ধৈর্যশীল, আদর্শ স্ত্রী, জ্ঞানতাপস ও সদালাপী। এক কথায় মানবীয় চারিত্রের সকল গুণই তাঁর মধ্যে বিরাজমান ছিল। তিনি অত্যন্ত ধৈর্যশীল মুমিনা ছিলেন। তিনি সর্বদা মহান আল্লাহর উপর ভরসা রাখেন। তাঁর সতীত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়। তা ছাড়া আল্লাহ তা’আলা তাঁর উসিলায় তায়াম্মুমের বিধান চালু করেন।

তিনি বছরের অধিকাংশ সময়ই রোযা রাখতেন এবং রাত্রি বেলায় আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগিতে নিজেকে মশগুল রাখতেন। দান-সদকা করতে তিনি পছন্দ করতেন। অসহায়, ফকির, মিসকিনকে কিছু দান করতে পারলে তিনি তৃপ্তি পেতেন। দানশীলতা, মিতব্যয়িতা, পরোপকারিতা, ধর্মপারায়ণতা, দয়াসহ সর্বপ্রকার গুণে তিনি গুণান্বিত ছিলেন।

ছ) মর্যাদা

হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) মহানবি (সা.)-এর স্ত্রীদের মধ্যে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর মর্যাদা সম্পর্কে বলেন,

“নারী জাতির উপর আয়েশা সিদ্দিকা (রা)-এর মর্যাদা তেমন, যেমন খাদ্যসামগ্রীর উপর সারিদের মর্যাদা।”

(বুখারি ও ইবনে মাজাহ)

সারিদ হলো আরবের শ্রেষ্ঠ খাদ্য যা রুটি-গোশত ও ঝোলের সমন্বয়ে তৈরি হয়।

রাসুল (সা.) আরও বলেন,

“আয়েশা (রা.) হলেন মহিলাদের সাহায্যকারিণী।”

(কানযুল উম্মাল)

এটি হাদিসে পাওয়া যায়,

“একবার আমর বিন আস (রা.) রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনার কাছে প্রিয়তম ব্যক্তি কে? তিনি বলেন, আয়েশা। আমি বললাম, পুরুষদের মধ্যে? তিনি বলেন, তাঁর বাবা।”

(বুখারি)

সুতরাং এ থেকে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর সুউচ্চ মর্যাদা প্রমাণিত হয়।

জ) ইন্তেকাল

উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ৫৮ হিজরির ১৭ রমযান ৬৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ১৩ জুলাই ইন্তেকাল করেন। তাঁকে জান্নাতুল বাকিতে সমাহিত করা হয়।

(৫) হযরত আবু বকর (রা.)

ক) জন্ম ও পরিচয়

হযরত আবু বকর (রা.) ছিলেন ইসলামের প্রথম খলিফা। তিনি মক্কার প্রসিদ্ধ কুরাইশ বংশের তায়িম গোত্রে ৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নাম আব্দুল্লাহ, উপনাম আবু বকর এবং উপাধি সিদ্দিক বা সত্যবাদী। হযরত আবু বকর (রা.) ছিলেন বয়সের দিক থেকে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর চেয়ে তিন বছরের ছোট। মহানবি (সা.)-এর প্রায় সমবয়সী হওয়ায় বাল্যকাল থেকে হযরত আবু বকর (রা.)-এর সঙ্গে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব ছিল। তিনি উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা (রা.)-এর পিতা।

খ) হযরত আবু বকর (রা.) এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা

একদা হযরত আবু বকর (রা.) ব্যবসার উদ্দেশ্যে ইয়েমেনে গমন করেন। মক্কায় ফিরে শুনলেন হযরত মুহাম্মাদ (সা.) নবুওয়াতপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করেছেন। এ ঘটনার কথা শুনে সাথে সাথেই তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দরবারে হাজির হয়ে কালেমা শাহাদাত বাণী উচ্চারণ করে ইসলাম গ্রহণ করেন। মহানবি (সা.) বলেছেন, আমি যাকেই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি, তার মধ্যেই কিছুটা সংকোচ লক্ষ্য করেছি, কেবল আবু বকর ছাড়া। তিনি ইসলামের আহ্বানে নির্দ্বিধায় তাৎক্ষণিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেন। এছাড়া মিরাজের অলৌকিক ঘটনা উল্লেখ করে কাফিরগণ আবু বকর (রা.) কে বললেন, এবার কী বলবে, তোমার বন্ধু বলেছে উনি নাকি এক রাতে সিরিয়া গিয়ে আবার ফেরতও এসেছেন। আবু বকর (রা.) বললেন, মহানবি (সা.) যদি বলেন, সাত আসমানের ওপরে গিয়েছেন, তবুও আমি বিশ্বাস করি। তখন মহানবি (সা.) তাকে ‘সিদ্দিক বা মহাসত্যবাদী উপাধি দেন।

গ) চারিত্রিক গুণাবলি

হযরত আবু বকর (রা.) ছিলেন স্বল্পভাষী, ধৈর্যশীল, সাহসী, পরোপকারী, বিচক্ষণ, দয়ালু, বৃদ্ধদের প্রতি যত্নশীল। তিনি যখন খোলাফায়ে রাশেদিনের খলিফা ছিলেন, তখনকার একটা ঘটনা তোমাদের সামনে তুলে ধরছি। মদিনায় বসবাস করতেন এক অসহায় বৃদ্ধ অন্ধ মহিলা। তিনি খুবই নিঃস্ব ও হতদরিদ্র এবং বয়সের ভারে দুর্বল ছিলেন। বৃদ্ধার কোনো আত্মীয়স্বজন ছিল না। বৃদ্ধার করুণ অবস্থা শুনে হযরত উমর (রা.) তার সেবা করা শুরু করলেন। প্রতিদিন তাকে খাওয়ানো ও অন্যান্য যত্ন শুরু করলেন। হঠাৎ একদিন দেখলেন, বৃদ্ধার সকল কাজ কেউ করে গেছে। দ্বিতীয় দিনও দেখলেন, বৃদ্ধার যন্ত্র করা হয়ে গেছে। তখন বৃদ্ধাকে হযরত উমর (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, কে তার এই সকল কাজ করেছেন। তখন বৃদ্ধা বললো, আমি তো চোখে দেখি না তবে লোকটি খুব যত্নের সঙ্গে আমার সকল কাজ করেছেন এবং তিনি খুব ভালো ব্যবহার করেছেন। হযরত উমর (রা.) বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবলেন কে এই কাজ করেছেন? তিনি গোপনে পরের দিন দেখলেন, স্বয়ং খলিফা হযরত আবু বকর (রা.) অভিযত্নে অসহায় অন্ধ বৃদ্ধা মহিলার সমস্ত কাজকর্ম সম্পন্ন করে চলে যাচ্ছেন।

হযরত আবু বকর (রা.) ইসলামের প্রথম মুসলিম পুরুষ। ইসলাম গ্রহণ করার পর তিনি সিদ্দিক (সত্যবাদী) এবং আতিক (দানশীল) উপাধি লাভ করেছিলেন। নবি করিম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ওফাতের তিনি প্রথম খলিফার দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্ব ও শাসনের ফলে ইসলামের শত্রুরা ধ্বংস হয়েছিল। হযরত আবু বকর (রা.) তাঁর শাসনামলে মুসলিম সাম্রাজ্য অনেক শক্তিশালী করেন। ইসলামের ইতিহাসে এই মহান ব্যক্তিত্বের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।

(৬) হযরত উমর (রা.)

হযরত উমর (রা.) ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা। তিনি ৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা নগরীর কুরাইশ বংশের বিখ্যাত আদি গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খাত্তাব। তিনি কুরাইশ বংশের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। আর মাতার নাম খানতামা। তিনি ছিলেন বিখ্যাত সেনাপতি হিশাম ইবন মুগিরার কন্যা। হযরত উমর (রা.) শিক্ষা-দীক্ষায় সুপরিচিত ছিলেন। তিনি কবিতা লেখায় পারদর্শী ছিলেন। কুস্তিবিদ্যায় তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। কুরআন ও হাদিসের জ্ঞানে হযরত উমর (রা.)-এর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। সাহসী যোদ্ধা, কবি ও সুবক্তা হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছিল।

ক) ইসলাম গ্রহণ

ইসলাম গ্রহণের পূর্বে হযরত উমর (রা.) ইসলাম ও মুসলমানদের ঘোরতর শত্রু ছিলেন। নবদীক্ষিত মুসলমানদের অমানুষিক নির্যাতন করতেন। তাঁর গৃহপরিচারিকা লুবানা ইসলাম কবুল করলে তিনি তাকেও নির্যাতন করেন। একদা তিনি তরবারি নিয়ে মহানবি (সা.) কে হত্যার জন্য ছুটলেন। পথিমধ্যে জানতে পারেন যে, তাঁর বোন ফাতিমা ও ভগ্নিপতি সাঈদ ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তিনি গতি পরিবর্তন করে বোনের বাড়িতে যান এবং বোন ও ভগ্নিপতিকে প্রচণ্ড মারতে থাকেন। তখন তারা কুরআন পাঠ করছিলেন। তাদের শরীর থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু কিছুতেই তাঁরা ইসলাম ত্যাগ করতে রাজি হলেন না। ইসলামের প্রতি তাদের দৃঢ়তা দেখে তিনি স্তম্ভিত হয়ে যান। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কী পড়ছিলে? উমরের বোন জবাব দিলেন, কুরআন পড়ছিলাম। হযরত উমর (রা.) বললেন, তা আমাকে দেখাও। বোন বললেন, তুমি অপবিত্র। অপবিত্র হাতে কুরআন স্পর্শ করা যাবে না। বোনের এ কথা শুনে উমর (রা.) পবিত্র হয়ে এলেন। তিনি পবিত্র কুরআনের সূরা ত্বাহা ও হাদিদের আয়াতগুলো পড়লেন। মহান আল্লাহর বাণী তাঁর মনের ভিতর তোলপাড় সৃষ্টি করে দিল। তিনি ইসলাম গ্রহণের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। উমর (রা.) বললেন, নবিজি কোথায়? আমি তাঁর কাছে যাব, মুসলমান হবো। এরপর তিনি প্রিয়নবির কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। মহানবি (সা.) দোয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! আবু জাহাল অথবা উমর ইবনুল খাত্তাব এ দুজনের একজনকে ইসলাম কবুল করার তাওফিক দিয়ে ইসলামকে শক্তিশালী করুন।’ তাঁর ইসলাম গ্রহণ মূলত মহানবি (সা.)-এর উক্ত দোয়ারই ফল। ইসলাম গ্রহণের পর হযরত উমর (রা.) কা‘বার সামনে প্রকাশ্যে নামায আদায়ের ঘোষণা দিলেন। নবি (সা.) উমর (রা.)-এর উপর খুশি হয়ে তাঁকে ‘ফারুক’ বা সত্য ও মিথ্যার প্রভেদকারী উপাধিতে ভূষিত করলেন।

খ) ইসলামের সেবা

হযরত উমর (রা.)-এর ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলমানদের শক্তি বহু গুণ বৃদ্ধি পায়। তিনি নিজের ধন-সম্পদের সর্বস্ব দিয়ে ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করলেন। তাবুক অভিযানে তিনি তাঁর অর্ধেক সম্পত্তি আল্লাহর রাস্তায় দান করেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করার পর প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার করা সম্ভব হয়। তিনি সকল যুদ্ধে মহানবি (সা.)-এর সাথি হয়ে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। খেলাফতের মহান দায়িত্ব পালনকালে তিনি ইসলামি রাষ্ট্রের শাসন, বিচার ও অর্থ ব্যবস্থায় বহু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

গ) চারিত্রিক গুণাবলি

হযরত উমর (রা.) ন্যায় বিচারক ছিলেন। তাঁর কাছে উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব, আপন-পর কোনো ভেদাভেদ ছিল না। মদ্য পানের অপরাধে নিজ পুত্র আবু শাহমাকে তিনি কঠোর শাস্তি দিয়েছিলেন।

তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। অর্ধজাহানের খলিফা হয়েও তিনি অত্যন্ত দীনহীন ও সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। তিনি সাথে কোন দেহরক্ষী রাখতেন না। বায়তুল মাল থেকে তাকে যে ভাতা দেওয়া হতো, তা-ও ছিল একেবারে নগণ্য। খাওয়া-দাওয়া করতেন একেবারে সামান্য। শুধু খেজুর ও রুটি দিয়ে আহার সম্পন্ন করতেন। খেজুর পাতার আসন ছিল তাঁর সিংহাসন।

তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল খুবই সাদাসিধে। তিনি তালিযুক্ত পোশাক পরিধান করতেন। জেরুজালেমের খ্রিষ্টান শাসকের আহ্বানে তিনি একবার সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি ও তাঁর ভৃত্য পালাবদল করে উটে আরোহণ করে জেরুজালেম পৌঁছান। উট যখন জেরুজালেম পৌঁছাল, তখন উটের পিঠে ছিল ভৃত্য আর খলিফা রশি ধরে হেঁটে আসছিলেন। তাঁর পরনে ছিল ধুলো মলিন ছিন্নবস্ত্র। খলিফার এই পোশাক ও অবস্থা দেখে খ্রিষ্টান শাসক ও অন্যান্য সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।

তাঁর চরিত্রে কঠোরতা ও কোমলতার অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি সত্য ও ন্যায়ের ব্যাপারে যেমন ইস্পাতসম কঠিন ছিলেন, তেমনি মানুষের অভাব-অনটন ও দুঃখ-কষ্টে ছিলেন মোমের মতো নরম। তিনি সাধারণ প্রজাদের দুঃখ-কষ্ট জানার জন্য গভীর রাতে একাকি পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে বেড়াতেন। এরই ধারাবাহিকতায় একদিন গভীর রাতে এক গৃহে ক্ষুধার্ত শিশুদের কান্নার আওয়াজ শুনতে পান। তখন তিনি বায়তুল মাল থেকে নিজ কাঁধে আটার বস্তা বহন করে সেই বাড়িতে গমন করেন। শিশুদের রুটি বানিয়ে খাওয়ানোর পর তিনি সেখান থেকে ফিরে আসেন। তিনি বলতেন— ‘যদি ফোরাত নদীর তীরে কোনো ছাগলের বাচ্চাও মারা যায়, এ বিষয়ে আল্লাহ আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন।’

তিনি ছিলেন গণতন্ত্রমনা ও সুশাসক। রাষ্ট্রের সকল গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনি সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করে করতেন। প্রাদেশিক গভর্নর নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি মজলিশে শূরার সাথে পরামর্শ করতেন।

তিনি ছিলেন সাম্য ও মানবতাবোধের মহান আদর্শ। তিনি শাসনব্যবস্থার সর্বক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করেছিলেন। হযরত উমর (রা.) কে একজন সাধারণ লোকের কাছেও জবাবদিহি করতে হয়েছিল। তিনি একদা জুমু’আর খুতবা দিচ্ছিলেন। হঠাৎ এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে অভিযোগ করলেন যে ‘বায়তুল মাল থেকে প্রাপ্ত কাপড় দিয়ে কারও পুরো একটি জামা হয়নি, অথচ খলিফার গায়ে সে কাপড়ের পুরো একটি জামা দেখা যাচ্ছে। খলিফা অতিরিক্ত কাপড় কোথায় পেলেন?’ তখন খলিফার পক্ষে তাঁর পুত্র আব্দুল্লাহ জবাব দিলেন ‘আমি আমার প্রাপ্য অংশটকু আব্বাকে দিয়েছি। তাঁর ও আমার দুটুকরা মিলিয়ে তাঁর জামা তৈরি করা হয়েছে।’ মানবতার ইতিহাসে একজন শাসকের এরুপ জবাবদিহির ঘটনা সত্যি-ই বিরল। আমাদের সমাজব্যবস্থায় শাসকদের জন্য এরুপ জবাবদিহির সুযোগ করা গেলে আশা করা যায় তারাও এ আদর্শে আদর্শবান হতে পারবেন।

হযরত উমর (রা.) একজন শিক্ষানুরাগীও ছিলেন। ইসলামের খেদমতে তিনি অনেক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মক্কা, মদিনা, সিরিয়া, কুফা, বসরাসহ যেখানেই জয়লাভ করেছেন সেখানেই শিক্ষা-প্ৰতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন।

হযরত উমর (রা.) সৃষ্টিকুলের ভাষাহীন পশু-পাখি ও প্রাণীদের প্রতি অত্যন্ত দরদি ছিলেন। এরুপ পশুদের প্রতি কেউ জুলম করে কি না, এরুপ প্রাণিকুল অনাহারে থাকে কি না খোঁজ-খবর নিতেন। তিনি বলতেন— ‘এরাও মহান আল্লাহর সৃষ্টি। প্রতিটি প্রাণীর প্রতি দয়া প্রকাশ করা পুরস্কার পাওয়ার মতো কাজ।’

মোট কথা ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা.) একজন আদর্শ মানুষ ছিলেন। মানব চরিত্রের সকল ভালো গুণ ও মহান আদর্শের সমাবেশ ঘটেছিল তাঁর জীবনে। আমরা তাঁর জীবনাদর্শ ভালোভাবে জানব এবং সে অনুযায়ী নিজেদের জীবন গড়তে সচেষ্ট হবো।

(৭) ইমাম আবু হানিফা (রহ.)

যে সকল মনীষী তাঁদের জ্ঞান-গবেষণার জন্য মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁকে ফিকহ শাস্ত্রের জনক বলে হয়। প্রিয় শিক্ষার্থী, আজ আমরা তাঁর জীবনাদর্শ জানব।

ক) জন্ম ও বংশ পরিচয়

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ৮০ হিজরি সনের ৪ শাবান মোতাবেক ৭০০ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম নুমান, পিতার নাম সাবিত। দাদার নামানুসারে তাঁর নাম রাখা হয় নুমান। তিনিই পরবর্তীতে ইমাম আযম আবু হানিফা নামে জাহিষ্যাত হন।

খ) জ্ঞানার্জন

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ছিলেন তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী। একবার যা পড়তেন বা শুনতেন তা মুখস্থ হয়ে যেতো। তিনি বাল্যকালেই পবিত্র কুরআন হিফয করেছিলেন। ইমাম শা’বীর পরামর্শে তিনি ইলমুল কালাম, পবিত্র কুরআন, হাদিস ও ফিকহ শাস্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং গভীর পান্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি মক্কা, মদিনা, কুফা, বসরা ও সিরিয়ার বিখ্যাত মুহাদ্দিসগণের নিকট হতে হাদিসের জ্ঞান লাভ করেন। পৰিত্ৰ হা উপলক্ষে মক্কা শরীফে এলে বিভিন্ন দেশের মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের সাথে আনের আদান-প্রদান করতেন। তিনি কয়েকজন সাহাবির সাক্ষাত পান। তাই তাকে তাবেঈ গণ্য করা হয়।

গ) ফিকহ শাস্ত্রে অবদান

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ফিকহ শাস্ত্রের উদ্ভাবক এবং হানাফি মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ইবাদাত ও আমলসমূহ আমরা যাতে সঠিকভাবে পালন করতে পারি সেজন্য তিনি কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত শরীয়াতের বিধি-বিধানকে অত্যন্ত সহজ করে গ্রন্থিত করেন। এজনাই বিশ্বের অধিকাংশ মুসলমান তাঁর মাযহাবকে অনুসরণ করেন। তাঁর উদ্ভাবিত ফাতওয়া হানাফি মাযহাবের বিখ্যাত গ্রন্থসমূহে লিপিবন্ধ করা হয়েছে। তিনি মুসলিম উম্মাহর জন্য প্রায় ৮৩ হাজার মাসআলার সমাধান করে গেছেন। তাঁর মাযহাবই সারা বিশ্বে সমাদৃত ও সহজ পালনীয়। ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ, ইমাম যুফারসহ আরো অনেক প্রসিদ্ধ ফকীহ তাঁর শিষ্য ছিলেন। ফিকহ শাস্ত্রে তাঁর অবদানের মূল্যায়ন করতে গিয়ে ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেন, যদি কোন ব্যক্তি ইলম ফিকহের ব্যাপক জ্ঞানার্জন করতে চায় সে যেন অবশ্যই ইমাম আবু হানিফা ও তাঁর শিষ্যদের সান্নিধ্য গ্রহণ করে। ইমাম আবু হানিফা হাদিস শাস্ত্রে ‘হাফেমুল হাদিস’ ছিলেন। তার সহিহ হাদিস সংকলন- ‘মুসনাদ আল-ইমাম আবি হানিফাহ’ একটি অমূল্য গ্রন্থ।

ঘ) চারিত্রিক গুণাবলি

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) অনুপম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তিনি নিয়মিত রাত্রি জাগরণ করে তাহাজ্জুদ সালাত ও আল্লাহর যিকির করতেন। তিনি কখন গিবত বা পরনিন্দা করতেন না। কখনও কারো সম্পর্কে। আলোচনা করলে তার ভালো দিকটাই আলোচনা করতেন। তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে সর্বদা সততা বজায় রাখতেন; পণ্যের দোষ-ত্রুটি কখনও গোপন করতেন না। তিনি ওয়াদা ও আমানত রক্ষা করতেন। ঋণী ব্যক্তিকে অবকাশ দিতেন, অধিকাংশ সময় তাদেরকে ক্ষমা করে দিতেন। তিনি খুব সাদাসিধা ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। তিনি খুব নম্র ও বিনয়ী ছিলেন।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) একজন মুস্তাকী ও পরহিমাগার ছিলেন। হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয় থেকে সবসময় নিজেকে পবিত্র রাখতেন। অধিকাংশ সময় চিন্তামগ্ন ও চুপ থাকতেন। তিনি দানশীল ও দয়ালু ছিলেন।

পার্থিব প্রভাব-প্রতিপত্তিকে তিনি অত্যন্ত তুচ্ছ মনে করতেন। তাঁকে খলিফা মানসুর বাগদাদের প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণ করার প্রস্তাব দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এ জন্য খলিফা তাঁকে জেলে আটক করে রাখেন। কোন কিছুতেই রাজি করাতে না পেরে খলিফা তাঁকে গোপনে বিষ প্রয়োগ করেন। এই বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিনি ১৫০ হিজরিতে সিজদাহরত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। আমরা এই মহান মনীষীর জীবনাদর্শ ভালভাবে জানব এবং তাঁর উন্নত নৈতিক আচরণগুলো নিজেদের জীবনে বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবো।

(৮) হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)

হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) ইসলামের অন্যতম প্রধান সাধক ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি গাউসুল আজম বড় পীর হিসেবেই সকলের নিকট পরিচিত। প্রিয় শিক্ষার্থী, আমরা আজ ইসলামের এ মহান সাধকের জীবনাদর্শ সম্পর্কে জানব।

ক) জন্ম ও বংশ পরিচয়

হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) হিজরী ৪৭০ সালে রমযান মাসের ১ তারিখ মোতাবেক ১০৭৭ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের জিলান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মভূমি জিলানের নামানুসারেই তাঁকে জিলানী বলা হয়। তাঁর উপাধি গাউসুল আযম, মুহিউদ্দিন বা দীনের পুনরুজ্জীবক ইত্যাদি। তাঁর পিতা আবু সালেহ মুসা জঙ্গী এবং মাতা উল খায়ের ফাতিমা। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.) -এর বংশধর ছিলেন।

খ) ব্যতিক্রমী শৈশব

শৈশবে হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর মধ্যে শিশুসুলভ চাঞ্চল্য ছিল না। তিনি ছিলেন শান্ত, নম্র, ভদ্র ও স্থির স্বভাবের অধিকারী। জনশ্রুতি রয়েছে যে, তিনি মায়ের কোলে থাকতে শুনেশুেনে ১৮ পারা কুরআন মাজিদ মুখস্থ করে ফেলেন। সাত বছর বয়স থেকে তাহাজ্জুদ নামায পড়তে শুরু করেন।

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের পর তিনি ১৮ বছর বয়সে বাগদাদের বিশ্ববিখ্যাত নিজামিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এখান থেকে তিনি তাফসির, হাদিস, ফিকহ, আরবি সাহিত্য, ইতিহাস ও আকিদা বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্য লাভ করেন।

গ) সত্যবাদিতা

তিনি সদা সত্য কথা বলতেন, কখনো মিথ্যা বলতেন না। তিনি পড়াশুনার জন্য ব্যবসায়ী কাফেলার সাথে বাগদাদ আসার পথে একটি ডাকাত দলের কবলে পড়েন। ডাকাত সর্দার অন্যদের সবকিছু নিয়ে যাওয়ার পর তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার সাথে কি আছে? তিনি বললেন, আমার নিকট ৪০টি স্বর্ণ মুদ্রা আছে। ডাকাত সর্দার আশ্চার্যান্বিত হয়ে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন হে যুবক। তুমি তো মিথ্যা কথা বলে আমার নিকট থেকে স্বর্ণ মুদ্রা লুকাতে পারতে? তখন হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) বললেন, আমার মা মিথ্যা কথা বলতে নিষেধ করেছেন। তাঁর এ সত্যবাদিতা দেখে ডাকাত দলের মনে পরিবর্তন আসল এবং তারা সবাই তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে এ পাপের পথ ছেড়ে দিলো এবং পুন্যের পথে তাদের জীবন পরিচালনা শুরু করল।

ঘ) অধ্যাত্মিক সাধনা ও ইসলাম প্রচার

হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) একজন মহান সাধক ছিলেন। তিনি তৎকালীন শ্রেষ্ঠ সুফিসাধক হযরত হাম্মাদ (রাঃ)-এর নিকট সুফিতত্ত্বে জ্ঞানলাভ করেন। তিনি একটানা ২৫ বছর মুরাকাবা-মুশাহাদা ও কঠোর আধ্যাত্মিক সাধনায় নিয়োজিত থাকেন।

তিনি জীবনের বাকী সবটুকু সময় ইসলামের সেবায় নিয়োগ করেন। তিনি বিভিন্ন জনসভার আয়োজন করে বক্তৃতা ও উপদেশ দিতে থাকেন। মুসলমানদের পাশাপাশি অমুসলিমরাও তাঁর সভায় আসতেন। তাঁর দাওয়াতে প্রায় ৫ হাজার অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়। পরবর্তীতে তিনি তাঁর শিষ্যদের নিয়ে একটি মুবাল্লিগ দল তৈরি করেন। তাদের দাওয়াতে বিমোহিত হয়ে সুদান, নাইজেরিয়া, চাদ, ক্যামেরুনের অসংখ্য মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি প্রায় এগারোটি বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি আরবি ও ফার্সি ভাষায় কবিতা রচনা করেন।

ঙ) ইবাদাত

হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কঠোর সাধনা করতেন। প্রতাহ কুরআান মার্জিন তিলাওয়াত করতেন; রাতের অধিকাংশ সময় জিকির ও ইবাদাত বন্দেগীতে কাটাতেন। নিষিদ্ধ পাঁচ দিন ব্যতীত সারা বছরই তিনি রোযা পালন করতেন।

চ) অসহায়দের সাহায্য

তিনি গরীব-দুঃখী ও অসহায় মানুষের সেবা করতেন; তাদেরকে অকাতরে দান করতেন। তাঁর শিক্ষাজীবনে একবার বাগদাদে অভাব দেখা দেয়। তিনি তাঁর সকল স্বর্ণমুদ্রা গরীব-দুঃখী ও অসহায় মানুষকে দান করে দেন। এবং নিজে না খেয়ে জীবন অতিবাহিত করেন। তিনি নিজে পেটপুরে খাওয়া আর প্রতিবেশি অনাহারে থাকাকে অপছন্দ করতেন।

ছ) মৃত্যু

ইসলামের এ মহান সেবক ৯০ বছর বয়সে ৫৬১ হিজরী সনের ১১ রবিউসসানি ইন্তেকাল করেন। বর্তমান ইরাকের বাগদাদ শহরে তাঁর মাজার রয়েছে।

এ পাঠ থেকে আমাদের জন্য শিক্ষণীয়:

  • আমরা বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রা.) -এর আদর্শে আমাদের জীবন গড়ব;
  • সদা সর্বদা সত্য কথা বলব, কখনও মিথ্যাচার করবো না;
  • গরীব, অসহায়, অভাবী ও দুস্থদের সাহায্য ও সেবা করব:
  • মাতাপিতার কথা শুনব, তাঁদের আদেশ মেনে চলব;
  • মহান আল্লাহর ইবাদাত করব।

(৯) খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.)

হযরত খাজা মুঈন উদ্দীন হাসান চিশতী (রহ.) ছিলেন আল্লাহর একজন ওলী ও ইসলামের একনিষ্ঠ আধ্যাত্মিক সাধক। তিনি ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, আফগানিস্তানসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলাম প্রচার ও প্রসারে বিশেষ অবদান রাখেন। আজ আমরা এ মহান সাধকের জীবনাদর্শ সম্পর্কে জানব।

ক) জন্ম ও পরিচয়

খাজা মুঈন উদ্দীন চিশতী (রহ.) ৫৩০ হিজরি সনে পারস্যের ইস্পাহান নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খাজা গিয়াস উদ্দীন হাসান এবং মাতা উম্মুল ওয়ারাহ। তাঁরা ইমাম হাসান (রা.)-এর বংশধর ছিলেন। এ জন্য তাঁর মা শৈশবে তাঁকে শুধু হাসান নামেই ডাকতেন। তাঁর পিতা ইসলামের একজন মহান সাধক ও সিস্তানের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি ১৫ বছর বয়সে পিতৃ ও মাতৃহারা হন। তিনি গরিবে নেওয়াজ নামে অধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন।

খ) শিক্ষা জীবন

কুরআন মাজিদ শিক্ষার মাধ্যমেই খাজা মুঈন উদ্দীন হাসান চিশতী (রহ.)-এর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। মাত্র ৯ বছর বয়সে তিনি কুরআন মাজিদ হেফয করেন। এরপর তিনি খোরাসানের বিখ্যাত আলেমদের নিকট তাফসির, হাদিস, ফিকহ, ইলম ও মারিফাতের জ্ঞান লাভ করেন। এরপর তিনি বুখারা গমন করে কুরআন, হাদিস, শরিয়াত ও মারিফাতের জ্ঞানার্জন করেন। ২২ বছর বয়সে তিনি আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.)-এর সান্নিধ্য লাভ করেন। তিনি তাঁর নিকট থেকে শরিয়াত, মারিফাত, তরিকত ও হাকিকতের বাতিনী ফায়িয লাভ করেন। ৩২ বছর বয়সে তিনি আধ্যাত্মিক পুরুষ উসমান হারুনীর (রহ.)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেন। এখানে তিনি চিশতীয়া তরিকায় দীক্ষা গ্রহণ করেন।

গ) ভারতবর্ষে আগমন ও ইসলাম প্রচার

খাজা মুঈন উদ্দীন হাসান চিশতী (রহ.) স্বপ্নযোগে মহানবি (সা.)-এর নির্দেশ পেয়ে ভারতবর্ষে আগমন করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ৯০ লক্ষ লোক ইসলাম গ্রহণ করে বলে জানা যায়। তিনি ভারতের আজমিরে এসে ইসলামের আলো ছড়ানোর সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি মারিফাত চর্চার নামে সমাজ-সংসার ত্যাগ করেননি। তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য আজমির, বাদায়ুন, বেনারস, কনৌজ ও বিহার প্রভৃতি স্থানে খানকাহ প্ৰতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ভারতের বর্ণ প্রথার অমানবিকতা থেকে নিম্ন বর্ণের মানুষদের রক্ষার চেষ্টা করেন।

ঘ) ইন্তেকাল

ইসলামের এ মহান সাধক ৬৩২ হিজরী ৬ রজব ইন্তেকাল করেন। ভারতের আজমিরে তাঁর মাজার রয়েছে।

ঙ) আমাদের জন্য শিক্ষণীয়

খাজা মুঈন উদ্দীন হাসান চিশতী (রহ.) অত্যন্ত সরল জীবনযাপন করতেন। তিনি ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা ও সমাজকে কখনও আলাদাভাবে চিন্তা করতেন না। এ জন্য তিনি সমাজ-সংসার ও রাজনীতির সাথেও যুক্ত থেকে মানব কল্যাণে কাজ করে গেছেন। তিনি একাধারে একজন সাধক, শাসক ও যোদ্ধা ছিলেন। আমরা তাঁর জীবনচরিত থেকে শরিয়াতের চর্চার মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতা চর্চার শিক্ষা পাই।

এই ছিল সংক্ষেপে ৯ জন ইসলামিক জীবনাদর্শ/জীবনচরিতের বর্ণনা। পরবর্তীতে প্রতিটি নির্দিষ্ট ইসলামিক জীবনাদর্শ নিয়ে আলাদা আলাদা করে বিস্তারিতভাবে তাদের জীবনী তুলে ধরার চেষ্টা করব, ইংশাআল্লাহ। তো আমাদের পরবর্তী ইসলামিক আলোচনা পাঠের আমন্ত্রেণ জানায়ে আজকের মত এই পোষ্টটি এখঅনেই সমাপ্ত করেছি। আল্লাহ হাফেয। জাজাকাল্লাহ খায়রান।

পবিত্র ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট ইসলাম’ (inbangla.net/islam) এর সাথেই থাকুন।

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/islam

Islamic information to the point!View Author posts