নামাজের নিয়মসমূহ ১০০% সুন্দর সহজ ভাষায় বিস্তারিত বর্ণনা-
(১) নামাজ অর্থ, কি, কাকে বলে?
সালাত বা নামাজ এর আভিধানিক অর্থ দোয়া, রহমত, ক্ষমা প্রার্থনা করা ইত্যাদি।
ইসলামি পরিভাষায়, আহকাম, আরকানসহ বিশেষ নিয়মে ও নির্দিষ্ট সময়ে আল্লাহর ইবাদাত করার নাম সালাত বা নামাজ।
ইসলামে নামাজের গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামের পাঁচটি রুকন বা স্তম্ভের মধ্যে সালাত বা নামাজ দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ রুকন।
পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহ তা’আলা বলেন,
“এবং তোমরা সালাত কায়েম করো ও যাকাত আদায় করো।”
(সূরা আল-বাকারা, আয়াত ৩)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,
ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত; এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া যে আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর (আল্লাহ তা’আলার) বান্দা ও রাসুল, সালাত প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত আদায় করা, হজ করা এবং রমযান মাসে রোযা রাখা।
(বুখারি ও তিরমিযি)
প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, জ্ঞানবান পুরুষ এবং নারীর ওপর নির্ধারিত সময়ে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত বা নামাজ আদায় করা ফরয।
সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সালাত বা নামাজ আদায়ের নির্দেশনা দিয়েছে ইসলাম।
মহানবি (সা.) বলেন,
তোমরা তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়সে সালাতের নির্দেশ দাও। যখন তাদের বয়স ১০ বছর হয়, তখন সালাতের ব্যাপারে (প্রয়োজনে) শাসন করো।
(আবু দাউদ)
(২) নামাজের সময়সূচি
যথাসময়ে নামাজ আদায় করার জন্য আল্লাহ তা’আলা আদেশ দিয়েছেন। সময় অনুসারে নামাজ আদায় করা ফরয।
এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,
“নির্ধারিত সময়ে সালাত কায়েম করা মুমিনদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।”
(সূরা আন-নিসা, আয়াত ১০৩)
আল্লাহ তা’আলা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরয করার পর হযরত জিবরাঈল (আঃ)-এর মাধ্যমে নবি করিম (সা.) কে নামাজ আদায়ের পদ্ধতি এবং নামাজের সময় জানিয়ে দিয়েছেন।
ক) ফজর নামাজের সময়
ফজরের নামাজ শুরু হয় সুবহে সাদিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং সূর্য উদয়ের পূর্ব পর্যন্ত এর সময় থাকে। আকাশের পূর্ব দিগন্তে ভোর রাতে লম্বমান যে আলোর রেখা দেখা দেয়, তাকেই বলে সুবহে সাদিক। আলো ক্রমশ বৃদ্ধি পায় এবং শেষে সূর্যোদয় ঘটে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,
সুবহে সাদিকের পর থেকে সূর্যোদয় না হওয়া পর্যন্ত ফজর নামাজের সময়।
(মুসলিম)
খ) যোহর নামাজের সময়
সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই যোহরের ওয়াক্ত শুরু হয়। কোনো বস্তুর ছায়া তার মূল ছায়া (ছায়া আসলি) ব্যতীত দ্বিগুণ হওয়া পর্যন্ত এই সময় থাকে। ঠিক দুপুরের সময়ে কোনো বস্তুর যেটুকু ছায়া থাকে, তাকেই ‘ছায়া আসলি’ বা আসল ছায়া বলে।
যেমন এক হাত লম্বা একটি কাঠির আসল ছায়া দুপুরবেলা চার আঙুল ছিল। তারপর ঐ কাঠির ছায়া যখন দুই হাত চার আঙুল হবে, তখন যোহরের সময় শেষ হয়ে যাবে।
গরমের সময় যোহরের নামাজ বিলম্বে এবং শীতের মৌসুমে প্রথম ওয়াক্তে আদায় করা উত্তম।
গ) আসর নামাজের সময়
যোহরের সময় শেষ হলেই আসরের সময় শুরু হয় এবং সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত থাকে। সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করলে আসরের নামাজ আদায় করা মাকরুহ। তবে, সূর্যাস্তের সময় ঐ দিনের আসর ছাড়া সব ধরনের নামাজ নিষিদ্ধ।
ঘ) মাগরিব নামাজের সময়
সূর্যাস্তের পরপরই মাগরিবের নামাজের ওয়াক্ত শুরু হয়। পশ্চিম আকাশে যতক্ষণ লালিমা থাকে ততক্ষণ মাগরিবের সময় বাকি থাকে। তাই সময় হওয়ার সাথে সাথে নামাজ আদায় করা উত্তম।
ঙ) এশা নামাজের সময়
মাগরিবের সময় শেষ হওয়ার পর এশার নামাজের সময় শুরু হয় এবং সুবহে সাদিকের পূর্ব পর্যন্ত থাকে। তবে রাতের প্রথম প্রহরের মধ্যে এশার নামাজ আদায় করা উত্তম।
চ) বিতর নামাজের সময়
বিতর নামাজের প্রকৃত সময় শেষরাত। তবে এশার নামাজের পর পরও আদায় করা যায়। কিন্তু এশার আগে পড়া যায় না।
ছ) জুমার নামাজের সময়
যোহরের ওয়াক্তই জুমু’আর ওয়াক্ত। সাধারণত ওয়াক্ত শুরু হলেই আযান দেওয়া হয় এবং ইমামগণ হেদায়াত-নসিহতমূলক বক্তব্য দিয়ে থাকেন।
জুমুআর দুই রাকাআত ফরজ নামাজের আগে ইমাম সাহেব মিম্বারে দাঁড়িয়ে বক্তব্য (খুতবা) দেন। এসময় মুসল্লিদের চুপ থেকে তা শুনতে হয়।
(৩) নামাজ পড়ার নিয়ম
প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা ফরয। নামাজ আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। মহানবি (সা.) এর প্রদর্শিত পন্থায় আমাদের নামাজে আদায় করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে মহানবি (সা.) বলেন,
“তোমরা সালাত আদায় করো যেমনিভাবে আমাকে আদায় করতে দেখেছ।”
(বুখারি)
বিনীত ও একাগ্রচিত্তে নামাজ আদায় করতে হয়। লোক দেখানো কিংবা উদাসীনভাবে আদায় করা নামাজ। আল্লাহ কবুল করেন না।
নামাজ আদায়কালে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে যে, নামাজের শর্তগুলোর কোনোটাই যেন বাদ না পড়ে।
পবিত্র হয়ে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। মনে করতে হবে যে, আমি আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তিনি আমাকে দেখছেন।
দুই, তিন ও চার রাকআত বিশিষ্ট নামাজ আদায়ের নিয়মে কিছুটা তারতম্য আছে। নিচে এর বিবরণ দেওয়া হলো-
ক) দুই রাকআত বিশিষ্ট নামাজ আদায়ের নিয়ম
☛ কিবলামুখী হয়ে নিয়ত করে দুই হাত কান বরাবর ওঠাবো এবং আল্লাহ আকবার’ বলে নাভির নিচে (হানাফি মত) হাত বাঁধবো। তবে মেয়েরা কাঁধ পর্যন্ত হাত ওঠাবে এবং হাত বাঁধবে বুকের ওপর।
☛ নিয়ত মনে মনে করলেই চলবে, তবে মুখে উচ্চারণ করা উত্তম।
☛ এরপর ‘সানা’ পড়ব।
☛ তারপর ‘আউযু বিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ অনুচ্চ আওয়াজে পড়ে সুরা ফাতিহা পড়ব।
☛ ফাতিহা পড়া শেষ হলে মনে মনে আমিন বলবো।
☛ এরপর অন্য কোনো সূরার কমপক্ষে বড় এক আয়াত অথবা ছোট তিন আয়াত কিংবা একটি সূরা পড়বো।
☛ তারপর ‘আল্লাহ আকবার’ বলে রুকু করব।
☛ রুকুতে কমপক্ষে একবার ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আজিম’ বলব।
☛ তারপর ‘সামিআল্লাহুলিমান হামিদাহ’ বলে সোজা হয়ে দাঁড়াব।
☛ পাঁড়ানো অবস্থায় ‘রাব্বানা লাকাল হামদ’ বলব।
☛ তারপর ‘আল্লাহু আকবার’ বলে সিজদাহ করব।
☛ সিজদায় কমপক্ষে একবার ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আলা’ বলব।
☛ প্রথম সিজদাহুর পর সোজা হয়ে বসব।
☛ দু’টি সিজদাহ্ করার পর ‘আল্লাহ আকবার’ বলে সোজা হয়ে দাঁড়াব।
☛ এভাবে প্রথম রাকত নামাজ শেষ হবে।
☛ উল্লেখ্য, রুকু ও সাজদায় তিন বা ততোধিক বিজোড় সংখ্যক তাসবীহ পড়া সুন্নাত। এক তাসবীহ পরিমাণ সময় রুকু ও সিজদায় থাকা ফরজ।
☛ এখন দ্বিতীয় রাকআত শুরু হলো।
☛ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলে সূরা ফাতিহা পড়ব।
☛ তারপর পূর্বের মতো সুরা মিলাবো।
☛ তারপর প্রথম রাকআতের মতো রুকু ও সিজদাহ করে সোজা হয়ে বসব।
☛ তাশাহহুদ, দরুদ ও দোয়া মাসুরা পড়ে প্রথমে ডানে ও পরে বামে মুখ ফিরিয়ে ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বলব।
☛ এইভাবে দুই রাকআত বিশিষ্ট নামাজ শেষ হবে।
খ) তিন রাকজাত বিশিষ্ট নামাজ আদায়ের নিয়ম
☛ তিন রাকআত বিশিষ্ট ফরয নামাজে দ্বিতীয় রাকআতের পর শুধু তাশাহহুদ পড়ব।
☛ তারপর তাকবির বলে সোজা হয়ে দাঁড়াব।
☛ এরপর বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম বলে শুধু সুরা ফাতিহা পড়ব। অন্য কোনো সূরা পড়ব না।
☛ এরপর পূর্বের মতো রুকু, সিজদাহ করব।
☛ সিজদার পর সোজা হয়ে বসে তাশাহহুদ, দরুদ ও দোয়া মাসুরা পড়ে ডানে বামে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করব।
গ) চার রাকআত বিশিষ্ট নামাজ আদায়ের নিয়ম
☛ চার রাকআত বিশিষ্ট ফরয নামাজে দ্বিতীয় রাকআতের পর ১ম বৈঠকে শুধু তাশাহহুদ পড়ব।
☛ পরে তৃতীয় রাকআতের জন্য তাকবির বলে উঠে দাঁড়াব।
☛ এরপর বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলে শুধু সূরা ফাতিহা পড়ব।
☛ তারপর রুকু-সিজদাহ করে চতুর্থ রাকআতের জন্য উঠে দাঁড়াব।
☛ চতুর্থ রাকআতে তৃতীয় রাকআতের মতো সূরা ফাতিহা পড়ে রুকু সিজদাহ করার পর ২য় বৈঠকে বসে তাশাহহুদ, দরুদ ও দোয়া মাসুরা পড়ে ডানে ও বামে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করব।
☛ ওয়াজিব, সুন্নত বা নফল নামাজ হলে তৃতীয় ও চতুর্থ রাকআতে সুরা ফাতিহার সঙ্গে অন্য সুরা মিলিয়ে পড়ব।
(৪) নামাজের আহকাম ও আরকান
নামাজ আদায় যথাযথ হওয়ার জন্য কতগুলো শর্ত রয়েছে। যার কোনো একটি ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়। হোক, বাদ পড়লে নামাজ বাতিল হয়ে যাবে।
নামাজে মোট ফরয চৌদ্দটি।
ক) নামাজের আহকাম
নামাজের পূর্বে প্রস্তুতিমূলক সাতটি ফরয রয়েছে। এগুলোকে নামাজের আহকাম বলা হয়।
নামাজের আহকাম নিম্নরূপ-
- শরীর পবিত্র হওয়া।
- পরিধানের কাপড় পবিত্র হওয়া।
- নামাজের স্থান অর্থাৎ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করা হবে তা পবিত্র হওয়া। কমপক্ষে দাঁড়ানোর জায়গা থেকে সিজদাহর জায়গা পর্যন্ত পবিত্র হতে হবে।
- সতর ঢাকা। পুরুষের নাভি থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত এবং নারীদের মুখমণ্ডল, হাতের কবজি ও পায়ের পাতা ছাড়া সমস্ত শরীর ঢাকা।
- কিবলামুখী হওয়া, অর্থাৎ কিবলার দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করা। কিবলা অজানা হলে নিজের প্রবল ধারণা অনুসারে কিবলা নির্ধারণ করে নামাজ আদায় করতে হবে।
- নামাজের সময় হওয়া।
- নিয়ত করা, অর্থাৎ যে ওয়াক্তের নামাজ পড়তে হবে, মনে মনে সেই ওয়াক্তের নিয়ত করা। নিয়ত নিজ নিজ ভাষায়ও করা যাবে।
খ) নামাজের আরকান
আর নামাজের ভিতরে সাতটি ফরয রয়েছে। এগুলোকে নামাজের আরকান বলা হয়।
নামাজের আরকান নিম্নরূপ-
- তাকবিরে তাহরিমা তথা “আল্লাহ আকবার’ বলে নামাজ শুরু করা।
- দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করা। দাঁড়াতে অক্ষম হলে বসে এবং বসতে অক্ষম হলে শোয়া অবস্থায় ইশারায় নামাজ আদায় করতে হবে।
- কিরাআত পড়া, অর্থাৎ সূরা বা আয়াত তিলাওয়াত করা।
- রুকু করা
- সিজদাহ করা।
- শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ পরিমাণ বসা (যে বৈঠকের মধ্যে তাশাহহুদ, দরুদ ও দোয়া মাসুরা পড়ে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করা হয় সেটাই শেষ বৈঠক)।
- সালামের মাধ্যমে নামাজ থেকে বের হওয়া।
(৫) নামাজের ওয়াজিবসমূহ
নামাজের ওয়াজিব বলতে ঐ সব করণীয় বিষয় বোঝায়, যার কোনো একটি ভুলক্রমে ছুটে গেলে ‘সিজদায়ে সাহ’ আদায় করে নামাজ শুদ্ধ করতে হয়। কিন্তু ইচ্ছাকৃত ছেড়ে দিলে নামাজ ভঙ্গ হয়ে যায় এবং পুনরায় নামাজ আদায় করতে হয়।
নামাজের ওয়াজিব চৌদ্দটি। এগুলো নিম্নরূপ-
- প্রত্যেক রাকআতে সূরা ফাতিহা পড়া।
- সূরা ফাতিহার সঙ্গে কোনো একটি সুরা বা সূরার অংশবিশেষ পাঠ করা।
- রুকু, সিজদাহ ও তিলাওয়াতের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা।
- নামাজের রুকনগুলো সঠিকভাবে আদায় করা। অর্থাৎ রুকু, সিজদাহ, দাঁড়ানো, বসায় কমপক্ষে এক তাসবিহ পরিমাণ স্থির থাকা।
- রুকু করার পর সোজা হয়ে দাঁড়ানো।
- দুই সিজদাহ এর মাঝখানে সোজা হয়ে বসা।
- প্রথম বৈঠক অর্থাৎ তিন বা চার রাকআত বিশিষ্ট নামাজে দুই রাকআত আদায়ের পর তাশাহহুদ পড়ার জন্য বসা।
- প্রথম ও শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ পাঠ করা।
- ইমামের জন্য উচ্চস্বরে কিরাআত পড়ার নামাজে উচ্চস্বরে এবং চুপে চুপে পড়ার সালাতে চুপে চুপে কিরাআত পড়া।
- বিতর নামাজে দোয়া কুনুত পাঠ করা।
- নামাজের মধ্যে সিজদাহর আয়াত তিলাওয়াত করলে তিলাওয়াতে সিজদাহ করা।
- সিজদাহর মধ্যে উভয় হাত ও হাঁটু মাটিতে রাখা।
- দুই ঈদের নামাজে অতিরিক্ত ছয় তাকবির বলা।
- “আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বলে নামাজ সমাপ্ত করা।
(৬) নামাজের সুন্নতসমূহ
রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজের মধ্যে ফরয, ওয়াজিব ছাড়াও কিছু আমল বা কাজ করেছেন কিন্তু এগুলো আদায়ের ব্যাপারে ফরয ও ওয়াজিবের মতো গুরুত্বারোপ করেননি। এগুলোকে বলা হয় সুন্নত।
যদিও এগুলো ছুটে গেলে নামাজ নষ্ট হয় না কিংবা সাহু সিজদাহ দিতে হয় না, তবুও রাসুলুল্লাহ (সা.) এর অনুসরণ করে এগুলো মেনে চলা উচিত। কারণ, রাসুলুল্লাহ (সা.) এভাবে নামাজ আদায় করেছেন এবং অন্যকেও এভাবে আদায় করতে বলেছেন।
তিনি বলেছেন,
“তোমরা সালাত আদায় করো, যেভাবে তোমরা আমাকে সালাত আদায় করতে দেখছ।”
(বুখারি)
নামাজের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সুন্নত নিম্নরূপ-
- তাকবিয়-ই-তাহরিমা বলার সময় পুরুষের কানের লতি ও নারীদের কাঁধ পর্যন্ত দুই হাত ওঠানো।
- তাকবির বলার সময় দুই হাতের আঙুলগুলো খুলে রাখা এবং কিবলামুখী করে রাখা।
- নিয়ত করার পর ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা। পুরুষের জন্য নাভির নিচে এবং নারীদের বুকের উপর হাত রাখা।
- তাকবির-ই- তাহরিমা বলার সময় মাথা অবনত না করা।
- ইমামের জন্য উঁচু আওয়াজে তাকবির বলা
- সানা পড়া।
- প্রথম রাকআতে সানা পড়ার পর আউযুবিল্লাহ পড়া।
- প্রত্যেক রাকআতে সূরা ফাতিহার পূর্বে মনে মনে বিসমিল্লাহ পড়া।
- ফরয নামাজের তৃতীয় ও চতুর্থ রাকআতে শুধু সূরা ফাতিহা পড়া।
- সুরা ফাতিহা পাঠের পর আমিন বলা।
- সানা, আউযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ, আমিন আস্তে বলা।
- এক রুকন থেকে অন্য রুকনে যাওয়ার সময় তাকবির বলা।
- রুকু ও সিজদায় তাসবিহ পড়া।
- রুকুতে মাথা ও কোমর সোজা রাখা এবং দুই হাতের আঙুল দিয়ে উভয় হাঁটু ধরা।
- রুকু থেকে উঠে দাঁড়ানো অবস্থায় ইমানের সামি আল্লাহু লিমান হামিদাহ’ ও মুক্তাদির ‘রাব্বানা লাকাল হামদ’ বলা।
- সিজদায় যাওয়ার সময় প্রথমে হাঁটু, তারপর দুই হাত, তারপর নাক এবং সবশেষে কপাল মাটিতে রাখা।
- বসার সময় বাম পায়ের পাতা বিছিয়ে তার উপর বসা এবং ডান পায়ের পাতা খাড়া করে রাখা।
- শেষ বৈঠকে তাশাহহুদের পর দরুদ পড়া।
- দরুদের পর দোয়া মাসুরা পড়া।
- প্রথমে ডানে এবং পরে বামে সালাম ফিরানো।
(৭) নামাজের মুস্তাহাব
মুস্তাহাৰ অর্থ উত্তম, পছন্দনীয়।
ইসলামের পরিভাষায় মুস্তাহাব বলা হয় এমন আমলকে যা পালন করলে সাওয়াব আছে কিন্তু ছেড়ে দিলে কোন গুনাহ হয় না।
নামাজের মধ্যে এমন কিছু আমল আছে যা পালন করলে সাওয়াব পাওয়া যায়, কিন্তু পালন না করলে কোনো গুনাহ হয় না। এ গুলোকে নামাজের মুস্তাহাব বলে।
নিম্নে সালাতের কতিপয় মুস্তাহাব উল্লেখ করা হলো-
- নামাজে দাঁড়ানো অবস্থায় সিজদাহ এর স্থানে দৃষ্টি রাখা
- রকু করার সময় পায়ের উপর সিজদাহর সময় নাকের উপর এবং বসা অবস্থায় কোলের উপর দৃষ্টি রাখা।
- নামাজের মধ্যে হাঁচি, কাঁশি নেওয়া ও হাই তোলা থেকে বিরত থাকতে সাধ্যমত চেষ্টা করা।
- নামাজে ধীরস্থিরভাবে কুরান তিলাওয়াত করা।
- সিজদাহ আদায়কালে উভয় হাতের মাঝখানে মাথা রাখা।
- মাগরিব নামাজে ছোট সূরা পাঠ করা।
- একাকী নামাজ আদায়কালে রুকু ও সিজদাহর তাসবিহু তিনবারের বেশি (পাঁচ, সাত, নয় ইত্যাদি) পড়া।
(৮) নামাজ ভঙ্গের কারণসমূহ
নামাজের শুরুতে আমরা নিয়ত করে ‘আল্লাহ আকবার’ বলে হাত বাঁধি। একে বলা হয় তাকবির-ই-তাহরিমা। এ তাকবির বলার পর নামাজের সাথে সংশ্লিষ্ট ছাড়া অন্য কোনো কাজ বা কথা বলা হারাম হয়ে যায়। যদি কেউ এমন করে ফেলে, তবে তার নামাজ বাতিল হবে।
নামাজ বাতিল বা ভঙ্গ হওয়ার কারণগুলো নিম্নরূপ-
- নামাজের মধ্যে কাউকে সালাম দিলে বা সালামের উত্তর দিলে।
- নামাজের মধ্যে কথা বললে।
- কিছু খেলে।
- কিছু পান করলে।
- শব্দ করে অট্টহাসি হাসলে নামাজ এবং ওযু উভয়ই ভঙ্গ হয়ে যাবে।
- বিপন বা কষ্টের কারণে উচ্চস্বরে কাঁদলে।
- ব্যথা বা রোগের কারণে উহ্ আহ্’ এরূপ শব্দ করলে।
- নামাজ কুরআন মাজিদ দেখে পড়লে।
- কিবলার দিক থেকে সিনা ঘুরালে।
- দুই হাত দিয়ে কোনো কাজ করলে।
- মুক্তাদি ইমাম অপেক্ষা সামনে দাঁড়ালে।
- নাপাক স্থানে সিজদাহ করলে।
- নামাজ দুনিয়ার কোনো কিছু প্রার্থনা করলে।
- বিনা কারণে বারবার কাশি দিলে।
- নামাজের কোনো ফরয বাদ গেলে।
- কোনো সুসংবাদে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললে।
- কোনো দুঃসংবাদে ‘ইন্নালিল্লাহ’ বললে।
- হাঁচি দিয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললে।
- হাঁচির উত্তরে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বললে।
- নিজের ইমাম ছাড়া অন্য কারো ভুল ধরলে।
- আমলে কাসির করলে এমন কাজ করা যা দেখলে কেউ মনে করবে যে সে নামাজ আদায়ে রত নয়)।
(৯) নামাজ মাকরুহ হওয়ার কারণ
মাকরুহ অর্থ অপছন্দনীয়। এমন কিছু কাজ আছে যা নামাজের মধ্যে করা হলে নামাজ নষ্ট হয় না কিন্তু সাওয়ার কম হয়, সেগুলো নামাজের মাকরুহ কাজ।
নামাজের এমন কিছু মাকরুহ কাজের কথা নিচে উল্লেখ করা হলো-
- নামাজের মধ্যে ইচ্ছাকৃত আব্দুল মটকানো।
- অলসতা করে খালি মাথায় নামাজ আদায় করা।
- পরিধানের কাপড় ধূলাবালি থেকে রক্ষা করার জন্য গুটিয়ে নেওয়া।
- পরিধানের কাপড় জামার বোতাম, দাড়ি ইত্যাদি অহেতুক নাড়াচাড়া করা।
- অশালীন ও ময়লাযুক্ত কাপড় পরিধান করে নামাজ আদায় করা।
- প্রস্রাব-পায়খানার বেগ চেপে রেখে নামাজ আদায় করা।
- নামাজের মধ্যে এদিক-সেদিক তাকানো।
- সিজদাহর সময় দুই হাত কনুই পর্যন্ত জমিনে বিছিয়ে দেওয়া।
- ইমামের মিহরাবের ভিতরে দাঁড়ানো।
- প্রাণির ছবিযুক্ত কাপড় পরে নামাজ আদায় করা।
- সামনের কাতারে জায়গা থাকা সত্ত্বেও পিছনে একাকী দাঁড়ানো।
- নামাজের মধ্যে ইশারায় অন্যকে সালাম করা।
- শুধু কপাল বা শুধু নাক মাটিতে ঠেকিয়ে। সিজদাহ করা।
- বিনা কারণে শুধু ইমামের উঁচুস্থানে দাড়ানো।
- বিনা কারণে চারজানু হয়ে বসা।
- চোখ বন্ধ করে নামাজ আদায় করা।
- তিলাওয়াত পূর্ণ না করেই রুকুর জন্য ঝুঁকে পড়া।
- সিজদার সময় মাটি থেকে পা উঠানো।
- নামাজের মধ্যে আয়াত ও অন্যান্য তাসবিহ হাতের আঙ্গুল দিয়ে গণনা করা।
- মুখের ভিতরে এমন বস্তু রাখা যাতে তিলাওয়াতে অসুবিধা হয়।
(১০) নামাজের নিষিদ্ধ সময়
তিন সময়ে নামাজ আদায় করা নিষিদ্ধ-
- ঠিক সূর্যোদয়ের সময়।
- ঠিক দ্বিপ্রহরের সময়।
- সূর্যাস্তের সময়, আর কোনো কারণে ঐদিনের আসরের নামাজ আদায় করতে না পারলে তা ঐ সময় আদায় করা যাবে তবে মাকরুহ বা অপছন্দনীয়ভাবে আদায় হয়ে যাবে।
নামাজের মাকরুহ সময়-
- ফজরের নামাজ আদায়ের পর সূর্য উদয় না হওয়া পর্যন্ত।
- আসরের পর সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
- ফজরের সময় শুরু হলে ফজরের সুন্নত ছাড়া অন্য কোন নামাজ আদায় করা।
- ফরয নামাজের যখন তাকবির দেওয়া হয় তখন অন্য কোন নামাজ শুরু করা।
- যখন ইমাম সাহেব জুমুআর খুতবা দিতে থাকেন তখন কোনো নামাজ শুরু করা।
- বিনা কারণে এশার নামাজ মধ্যরাতের পরে আদায় করা।
(১১) সিজদাহ
ক) সিজদাহ কী/কাকে বলে?
‘সিজদাহ’ আরবি শব্দ। এর অর্থ মাথা অবনত করা। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জ বান্দাহ তার কপাল জমিনে রাখাকে সিজদাহ বলে।
সিজদাহ এমন এক সম্মাননা, যা শুধুমাত্র আল্লাহ তা’আলারই প্রাপ্য। মাটিতে কপাল ও নাক স্পর্শ করে সিজদাহ করতে হয়। একইসাথে সিজদার সময় উভয় পায়ের হাটু এবং উভয় হাতের তালু মাটিতে স্থাপন করতে হয়। সিজদাহ কিবলার দিকে মুখ করে দিতে হয়।
খ) সিজদাহ -এর প্রকারভেদ
i) ফরজ সিজদাহ
মানুষ নামাজ আদায়ের সময় যেসব সিজদাহ্ দিয়ে থাকে তাকে ফরজ সিজদাহ্ বলে।
ii) ওয়াজিব সিজদাহ
ভুলবশত নামাজে কোন ওয়াজিব ছুটে গেলে এবং সিজদাহ-এর আয়াত তিলাওয়াত করণে যে সিজদাহ্ দিতে হয় তাকে ওয়াজিব সিজদাহ্ বলে।
iii) মুস্তাহাব সিজদাহ
খুশির সংবাদ শুনে, কোনো নিয়ামতপ্রাপ্ত হলে বা বিপদমুক্ত হলে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে যে সিজদাহ্ দেওয়া হয় তাকে মুস্তাহাব সিজদাহ বলে।
iv) সিজদায়ে সাহু
সিজদায়ে সাহু অর্থ ভুলের জন্য সিজদাহ। ভুলবশত নামাজে ওয়াজিব বাদ পড়লে, তা সংশোধনের জন্য নামাঘের শেষ বৈঠকে দুটি সিজদাহ করা হয়, একেই সিজদায়ে সাহু বলে।
গ) সিজদায়ে সাহু দেওয়ার নিয়ম
“তোমাদের কারও সালাতে সন্দেহ হলে সঠিকটি ভেবে নিয়ে সালাত সম্পূর্ণ করে একবার সালাম ফেরাবে তারপর দুটি সাজদাহ করবে।”
(বুখারি ও মুসলিম)
সিজদায়ে সাহু আদায় করার নিয়ম-
নামাজের শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ পড়ার পর ডান দিকে সালাম ফেরাব।
তারপর ‘আল্লাহ আকবার’ বলে।
নামাজের সিজদাহ-এর ন্যায় দু’টি সিজদাহ করে তাশাহহুদ, দরুদ ও দোয়া মাসুরা পড়ব।
তারপর দুইদিকে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করব।
সিজদায়ে সাহু সম্পর্কে মহানবি (সা.) বলেন,
সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হওয়ার কারণ-
- ভুলবশত নামাজের কোনো ওয়াজিব ছুটে গেলে
- নামাজের কাজগুলো পরপর আদায় করতে বিলম্ব করলে (যেমন: সুরা ফাতিহা পড়ার পর চুপ করে থাকলে, কছুক্ষণ চুপ থাকার পর কোনো সূরা পড়লো;
- কোনো ফরয আদায় করতে বিলম্ব হলে।
- নামাজ আদায়ে ধারাবাহিকতার ব্যতিক্রম হলে (যেমন: রুকুর আগেই সিজদাহ করলে);
- কোনো ফরয একবারের স্থলে একাধিকবার হলে;
- কোনো ওয়াজিবের রূপ পরিবর্তন করলে। যেমন: সরবে তিলাওয়াতের স্থলে নীরবে এবং নীরবে তিলাওয়াতের স্থলে সরবে পড়লে) ইত্যাদি।
- মনে রাখা দরকার, প্রথম বৈঠক করতে ভুলে গেলে যদি দাঁড়ানোর পূর্বেই মনে পড়ে তাহলে বসে যাব। এবং বৈঠক পূর্ণ করব। আর যদি দাঁড়ানোর পর বা প্রায় দাঁড়াবার কাছাকাছি অবস্থায় মনে পড়ে তাহলে বসব না। নামাজ শেষে সাহু সিজদাহ করব।
ঘ) সিজদায়ে তিলাওয়াত
পবিত্র কুরআন মাজিদে কতগুলো আয়াত আছে যা পড়লে বা শুনলে সিজদাহ করা জরুরি। সিজদাহ আদায় না করলে গুণাহগার হবে।
হাদিসে আছে,
যখন কেউ সিজদাহ্-এর আয়াত পড়ে সিজদাহ করে তখন শয়তান একপাশে বসে বিলাপ করতে থাকে এবং বলে, হায় আফসোস! আদম সন্তানদের সিজদাহ্-এর হুকুম দেওয়া হলো, তারা সিজদাহ করল এবং জান্নাতের দাবিদার হলো। আর আমাকে সিজদাহ্-এর হুকুম দেওয়া হলো আমি অস্বীকার করে জাহান্নামি হলাম।
(মুসলিম)
সিজদায়ে তিলাওয়াতের নিয়ম-
কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে সিজদায়ে তিলাওয়াতের নিয়ত করে ‘আল্লাহ আকবার’ বলে সরাসরি সিজদায় চলে যাবে। এবং সিজদাহ করার পর ‘আল্লাহ আকবার’ বলে উঠে দাঁড়াতে হবে। তাশাহহুদ পড়া ও সালাম ফেরানোর প্রয়োজন। নেই। সিজদায়ে তিলাওয়াতে একটি সিজদাহ করলেই চলবে।
সিজদায়ে তিলাওয়াতের চারটি শর্ত-
- তাহারাত অর্থাৎ পবিত্র হওয়া;
- সতর ঢাকা;
- কিবলামুখী হওয়া;
- সিজদায়ে তিলাওয়াতের নিয়ত করা।
সিজদায়ে তিলাওয়াতের স্থানসমূহ-
- সুরা আল-আ’রাফ, আয়াত: ২০৬
- সূরা আর রাদ, আয়াত: ১৫
- সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৫০
- সূরা বানি ইসরাইল, আয়াত : ১০৯
- সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৫৮
- সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত: ১৮, ৭৭
- সূরা আল- ফুরকান, আয়াত: ৬০
- সূরা আন-নামল, আয়াত: ২৬
- সুরা আস সাজদাহ, আয়াত: ১৫
- সুরা সোয়াদ, আয়াত: ২৪
- সূরা হা-মীম আস-সাজদা, আয়াত: ৩৮
- সূরা আন-নাজম, আয়াত: ৬২
- সূরা আল-ইনশিকাক, আয়াত: ২১
- সূরা আল-আলাক, আয়াত: ১৯
(১২) সালাত আদায়ে একনিষ্ঠতা ও একাগ্রতা
আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের অন্যতম উপায় হচ্ছে একাগ্রতার সাথে সালাত আদায় করা। সালাতের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নিকট তার আবেদন নিবেদন পেশ করে তৃপ্তি লাভ করতে পারে। আর আল্লাহ তা‘আলাও বান্দার আবেদন গ্রহণ করে থাকেন। তাহলে বান্দাকে অবশ্যই বিনয়ের সাথে সালাতে দাঁড়াতে হবে।
যেমন: কুরআন মাজিদে আল্লাহ তা’আলা বলেন,
“তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে দাঁড়াবে।”
(সূরা আল বাকারা, আয়াত: ২৩৮)
নামায অবস্থায় বান্দার মন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে অথচ মুসল্লি টেরও পায় না। কারণ, মানব মন কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করতে অভ্যস্ত। গভীর মনোযোগের সাথে কোনো কাজে নিয়োজিত না হলে মন স্থির থাকে না। তা ছাড়া শয়তান হচ্ছে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। সে বান্দার সকল ইবাদাত বিশেষত সালাত নষ্ট করার জন্য বিভিন্ন বিষয় মনের মধ্যে হাজির করে দেয়। তাই বান্দার মন সালাতে ঠিক থাকে না। এজন্যই বান্দাকে খুশু খুযু (বিনয় ও একাগ্রতা) ও মনের স্থিরতার সাথে সালাত আদায় করতে হবে।
যেমন: পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন,
“মুমিনগণ অবশ্যই সফলকাম হয়েছে, যারা নিজেদের সালাতে বিনয়ী।”
(সূরা আল-মু’মিনুন, আয়াত ১,২)
(১৩) নামাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
নামাজ হচ্ছে ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। ইমানের পর ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত হচ্ছে নামাজ।
কুরআন ও হাদিসে অসংখ্য স্থানে নামাজের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। নামাজ এমন একটি ফরম ইবাদাত যার কোনো বিকল্প নেই।
ক) ব্যক্তি জীবনে নামাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
নামাজ বান্দাকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সহায়তা করে। নামাজ আদায়ের ফলে মনে প্রশান্তি আসে এবং সাহসের সঞ্চার হয়। কোনো বিষয়ে অস্থিরতা দেখা দিলে মহানবি (সা.) নামাজ আদায় করতেন। এতে তাঁর মানসিক প্রশান্তি লাভ হতো।
নামাজ ব্যক্তির নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক। নামাজ মানুষকে পাপকাজ এবং পাপ চিন্তা থেকে বিরত রাখে।
এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন,
“আর সালাত প্রতিষ্ঠা করো; নিশ্চয়ই সালাত অশ্লীল ও মন্দকাজ থেকে বিরত রাখে।”
(সূরা আল্- আনকাবুত, আয়াত ৪৫)
খ) সমাজ জীবনে নামাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
নামাজের মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে অশ্রীল ও অন্যায় থেকে বিরত থাকা যায়। জামাআতে নামাজ আদায় করলে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়। সবার মধ্যে ঐক্য, সংহতি এবং পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি হয়। জামা’আতে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে সমাজের উঁচু-নিচু, ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ দূর হয়।
গ) নামাজের ধর্মীয় গুরুত্ব
নামাজের মাধ্যমে আল্লাহ এবং বান্দার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। এর মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে।
মহানবি (সা.) বলেছেন,
“তোমাদের কারও বাড়ির সামনে যদি একটি নদী থাকে, আর তাতে যদি কেউ দৈনিক পাঁচবার গোসল করে তাহলে তার গায়ে কি ধুলাময়লা থাকতে পারে? সাহাবিগণ বললেন- না, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মহানবি (সা.) তখন বললেন- একইভাবে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মাধ্যমে আল্লাহ পাপ মোচন করে থাকেন।”
(আল-হাদিস)
(১৪) নামাজের শিক্ষা
সালাত বা নামাজ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। এর সঙ্গে নৈতিকতার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। ইসলামের বিধান মেনে নিয়মিত নামাজ আদায় করলে যেমন আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়, সেই সঙ্গে মানুষের নৈতিক চরিত্রেরও উন্নতি ঘটে।
নিয়মিত নামাজ আদায়ের ফলে একজন ব্যক্তির নৈতিক চরিত্রের যেসব উন্নয়ন ঘটে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিম্নে বর্ণনা করা হলো-
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: নামাজ আদায়কারীকে অবশ্যই পবিত্র ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। নামাজ আদায়ের আগে আমাদেরকে ওযু করতে হয় যা আমাদের দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে। এভাবে নামাজের মাধ্যমেই। একজন ব্যক্তি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার শিক্ষা পায়।
- সময়ানুবর্তিতা: নামাজ আদায়ের নির্ধারিত সময় রয়েছে। একজন মুমিন ব্যক্তি প্রতিদিন। পাঁচবার নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায় করেন। এভাবে নিয়মিত নির্দিষ্ট সময়ে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার দৈনন্দিন জীবনের অন্যান্য কাজেও সময়নিষ্ঠ হওয়ার শিক্ষা পায়।
- শৃঙ্খলা: শৃঙ্খলা অর্থ হলো নির্ধারিত কিছু নিয়মনীতি। একজন ব্যক্তি নামাজ একা আদায় করুক বা জামাআতে আদায় করুক, তাকে কিবলামুখী হতে হয়। জামাআতে নামাজ আদায় করলে ইমামের পেছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হয়। এভাবে একজন ব্যক্তির মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ জেগে ওঠে।
- একাগ্রতা: আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য একজন মুমিন ব্যক্তিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে নামাজ আদায় করতে হয়। এ সময় মন স্থির রাখতে হয়। মনে কোনো রকম অস্থিরতা কাজ করলে সঠিকভাবে নামাজ আদায় করা যায় না। এভাবে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি একাগ্রতার শিক্ষা লাভ করেন।
- স্বাস্থ্য: জামাআতে নামাজ আদায়কারী মুসুল্লিগণ মসজিদে একই কাতারে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে একই উদ্দেশ্য নিয়ে নামাজ আদায় করেন। এ সময় ধনী-দরিদ্র, ছোট- বড় কোনো ভেদাভেদ থাকে না। এখানে সবাই সমান। এটি ইসলামি ভ্রাতৃ ও সাম্যের প্রতীক। এভাবে নামাজ থেকে একজন ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সমাজজীবনেও সাম্যের চর্চার অনুপ্রেরণা লাভ করেন।
আজকেই এই পোষ্টটি থেকে আমারা নামাজের নিয়ম বিভিন্ন নিয়ম জানলাম। পরবর্তী পোষ্টে নামাজের নিয়ম সম্পর্কিত নির্দিষ্ট কোন বিষয় তুলে ধরা হবে ইংশাআল্লাহ।
এভাবেই আমাদের রব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে নামাজের নিয়ম মেনে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ জামাতের সাথে আদায় করিবার তৈফিক দান করুন। আমিন ইয়া রব্বুল আলামিন।
সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এই কামানায় আজকের আলোচনা এখানেই সমাপ্ত করছি।
পবিত্র ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট ইসলাম’ (inbangla.net/islam) এর সাথেই থাকুন।