আজকের এই আলোচনাটির মাধ্যমে আমরা- কুরআনের সূরার নামকরণের ভিত্তি; সূরা আল-বাকারার নামকরণের কারণ; সূরা আল-বাকারা নামকরণের তাৎপর্য; সূরা আল-বাকারা নাযিলের সময়কাল এবং সূরা আল-বাকারা এর ফযিলত সম্পর্কে জানব।
(১) কুরআনের সূরার নামকরণের ভিত্তি
আল-কুরআন মানব রচিত কোন গ্রন্থ নয়। এটা আল্লাহ তা‘আলার বাণী। আল্লাহর মনোনীত সর্বশ্রেষ্ঠ বান্দাহ ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর উপর তা নাযিল হয়েছে। কুরআনের সূরার নামকরণ এবং নাযিলের কারণ হিসেবে বিশেষ কোন উপলক্ষ থাকলেও তা সেই বিশেষ উপলক্ষ বা কারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এর তাৎপর্য ব্যাপক।
মানব রচিত সাহিত্যকর্মের নামকরণ হয় কেন্দ্রীয় চরিত্র, বিষয়বস্তু বা অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের ভিত্তিতে, কিন্তু কুরআনের সূরার নামকরণ করা হয় এক সূরাকে অন্য সূরা থেকে পার্থক্য করার জন্য। এটা একটি বিশেষ প্রতীকী নাম। কেননা কুরআনের প্রত্যেকটি সূরায়ই এত বেশি বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে যে, কেন্দ্রীয় চরিত্র, বিষয়বস্তু কিংবা অন্তর্নিহিত ভাবধারার দৃষ্টিতে কোন সূরার সর্বব্যাপক শিরোনাম নির্ধারণ করা যায় না। এজন্যই আল্লাহর নির্দেশে শিরোনামের পরিবর্তে প্রতিটি সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
(২) সূরা আল-বাকারা নামকরণের কারণ
আল-বাকারাহ (البقرة) শব্দের অর্থ গরু বা গাভী। এ সূরার অষ্টম রুকুর ৬৭ নম্বর আয়াত হতে ৭১ নং আয়াত পর্যন্ত প্রত্যেকটি আয়াতে বাকারা শব্দটির উল্লেখ থাকার কারণে গোটা সূরার নামকরণ করা হয়েছে- ‘আল-বাকারা।
অন্য বর্ণনায় আছে, এ সূরার মধ্যে বনী ইসরাঈল জাতির গো-বৎস পূজার তীব্র প্রতিবাদ এবং হযরত মূসা (আ) কর্তৃক গরু কুরবানি প্রথা প্রবর্তনের প্রসঙ্গ রয়েছে। তাই এ সূরার নাম রাখা হয়েছে ‘সূরা আল-বাকারাহ’।
ক) গো-বৎস পূজার ঘটনা
হযরত মূসা (আ) তাওরাত কিতাব প্রাপ্তির জন্য ৪০ দিন তূর পাহাড়ে অবস্থানকালে বনী ইসরাঈল সম্প্রদায় সামেরীর প্ররোচনায় গো-বৎস পূজার মাধ্যমে শিরকে লিপ্ত হয়। হযরত মূসার বড় ভাই হযরত হারুন (আ)-এর নিষেধ অগ্রাহ্য করে তারা গান-বাজনায় মেতে ওঠে। মিসরীয় পৌত্তলিকদের মত আল্লাহর পরিবর্তে একটি গরুর বাছুরকে নিজেদের প্রভু ও উপাস্য হিসেবে পূজা করতে থাকে।
খ) তুর পাহাড় গাভী কুরবানির প্রসঙ্গ
বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের মধ্যে একজন ধনাঢ্য ব্যক্তির ধন-সম্পত্তি আত্মসাতের জন্য তার ভাতিজা তাকে হত্যা করে শত্রু গোত্রের কাছে লাশ ফেলে রাখে। নিহত ব্যক্তির হত্যাকারীর পরিচয় বের করার জন্য লোকেরা হযরত মূসা (আ) কে চাপ দিতে থাকে। হযরত মূসা (আ) আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে বনী ইসরাঈল জাতির গরুর বাছুর পূজার প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ একটি গরু কুরবানির আদেশ দেন। কিন্তু কুচক্রী ইয়াহুদিরা এ আদেশের প্রতি কটাক্ষ করে গরু সম্পর্কে নানা প্রশ্ন তোলে। অবশেষে একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আল্লাহর শাস্তির ভয়ে গরু কুরবানি করতে বাধ্য হয়। বিপুল অর্থের বিনিময়ে হযরত মূসা (আ) বর্ণিত রঙের গরু ক্রয় করে এবং তা জবাই করে। জবাইকৃত গরুর অংশ বিশেষ দ্বারা হযরত মূসা (আ)-এর কথামত মৃত ব্যক্তির দেহে আঘাত করায় অলৌকিকভাবে মৃত ব্যক্তি জীবিত হয়ে ঘাতকের পরিচয় জানিয়ে দিয়ে পুনরায় মৃত্যুবরণ করে। এই গরু জবাইয়ের ঘটনা এ সূরায় বর্ণিত হয়েছে।
(৩) সূরা আল-বাকারা নামকরণের তাৎপর্য
আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টির মধ্যে মানব জাতি হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ। মানব জাতি হচ্ছে আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা। মহান আল্লাহ ব্যতীত তার মাথা আর কারো কাছে নত হবে না। নত হবে না কোন জীব-জন্তু বা সৃষ্ট জীবের কাছে। আল্লাহ ছাড়া কোন কল্পিত বস্তুর পূজা মানুষের জন্য সমীচীন নয়। এ সূরায় গরু পূজা ও কুরবানির সেই ঘটনার প্রেক্ষিত আলোচিত হয়েছে। তাই এ সূরার এ রকম নামকরণ সার্থক হয়েছে।
অবশ্য বিষয়বস্তুর দিক থেকে আলোচনা করলে এ সূরাকে অন্য আরো বহু নামে অভিহিত করা যেত। কুরআনের সূরাগুলোর নাম যেহেতু শিরোনাম নয়, কাজেই নামের মধ্যে আলোচ্য বিষয়বস্তু সীমাবদ্ধ নয়।
(৪) সূরা আল-বাকারা নাযিল হওয়ার সময়কাল
এ সূরার অধিকাংশ আয়াত হিজরতের পর মদীনায় নাযিল হয়েছে। এজন্য এ সূরাকে মাদানি সূরা বলা হয়। এ সূরা কুরআনের দীর্ঘতম সূরা। এতে ৪০টি রুকু ও ২৮৬টি আয়াত রয়েছে।
(৫) সূরা আল-বাকারা এর ফযিলত
হাদিসের কিতাবসমূহে এ সূরার ফযিলত সম্পর্কে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
- ইমাম বায়হাকীর শু‘আবুল ঈমান নামক হাদিস গ্রন্থে ইমাম বায়হাকী (র) হযরত সালামা (রা)-এর একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। এতে বলা হয়েছে যে, ‘যে ব্যক্তি সূরা আল-বাকারা পড়বে জান্নাতে তাঁর মাথায় তাজ পরানো হবে।’
- ইবনে হিব্বান হযরত সাহল ইবনে সাদের একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘প্রত্যেক বস্তুরই একটি উচ্চতা আছে। আল-কুরআনের উচ্চতা হল সূরাতুল বাকারা। যে ব্যক্তি নিজ ঘরে সূরা আল-বাকারা তিলাওয়াত করবে, তিন দিন তার ঘরে শয়তান প্রবেশ করতে পারবে না।’
- ইমাম আহমাদ (র) হযরত বুরায়দার একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। সে হাদিসে উল্লেখ আছে যে, ‘তোমরা সূরা আল-বাকারা শিক্ষা করো। কেননা এটি শিক্ষা করা বরকত, আর শিক্ষা না করা আফসোসের কারণ।’
সূরা আল-বাকারা কুরআনের বৃহত্তম সূরা। এটা মদিনায় হিজরতের পর নাযিল হয়। এ সূরায় ইসলামের অনেক বিধিবিধান-ঘটনা কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এ সূরায় বর্ণিত শিক্ষা-গ্রহণ করে আমরা আমাদের জীবন সাজাতে পারি।
পবিত্র ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট ইসলাম’ (inbangla.net/islam) এর সাথেই থাকুন।