Skip to content

মাযহাব কয়টি ও কি কি? চার মাজহাবের প্রধান চার ইমামের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

মাযহাব কয়টি ও কি কি, চার মাজহাবের প্রধান চার ইমামের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

মাযহাব হলো ইসলামী ফিকহ বা আইনশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত এক একটি চিন্তাগোষ্ঠী ও চর্চাকেন্দ্র। নবী মুহাম্মদ (স.)-এর ইসলাম প্রচারের পর আনুমানিক প্রায় দেড়শত বছরের মধ্যে অনেক মাযহাবের উৎপত্তি হয়। সাহাবাদের মধ্যেও অনেকেই নিজস্ব মাযহাব প্রতিষ্ঠার জন্য কৃতিত্বের অধিকারী হয়ে আছেন। সময়ের সাথে সাথে সেগুলো বিবর্ধিত, বিভিন্ন স্থানে সম্প্রসারিত ও বিভাজিত হয়, কিছু আবার সীমিত চর্চার মাধ্যমে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অবশেষে সাম্প্রতিক শতকে মোট চারটি প্রধান মাযহাবকে বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায় কর্তৃক সার্বিকভাবে গড় হিসাব অনুযায়ী পালনযোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। মাযহাব শব্দটি বাংলায় মাজহাব, মজহাব, ইত্যাদি বানানেও প্রচলিত।

এই আর্কিকেলটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- মাযহাব কয়টি ও কি কি, তা বলতে পারবেন। চার মাজহাবের প্রধান চার ইমামের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি জানতে পারবেন।

(১) মাযহাব কয়টি ও কি কি?

মাযহাব কয়টি ও কি কি

মাযহাব কয়টি ও কি কি: মুসলিম সমাজে অনেকগুলো মাযহাব বা মতবাদের উদ্ভব হয়। মাযহাবের সংখ্যা অনেক হলেও পৃথিবীতে ৪টি মাযহাব প্রসিদ্ধি লাভ করে। ৪টি প্রধান মাযহাব হচ্ছে- ১. হানাফী, ২. শাফিঈ, ৩. মালেকী এবং ৪. হাম্বলি।

সংখ্যাধিক্যের হার হিসেবে ভারতবর্ষে হানাফী, আফ্রিকার দেশগুলোতে মালেকী, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে শাফেয়ী এবং মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে হাম্বলী মাযহাব অনুসরণকারীদের সংখ্যাধিক্য রয়েছে। এর ব্যতিক্রম হিসেবে সবকটি মহাদেশ জুড়েই রয়েছে আহলে হাদীস মতাবলম্বী লোকেরা।

(২) চার মাজহাবের প্রধান চার ইমামের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

চার মাজহাবের প্রধান চার ইমামের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

ক) ইমাম আবু হানিফা (র) ও তাঁর মাযহাব

পরিচয়:

ইসলামি আইন শাস্ত্রের জগতে যে ক’জন মনীষী অসামান্য অবদান রেখে গেছেন ইমাম আবু হানিফা (র) তাদের অন্যতম। ইসলামি আইন শাস্ত্রের প্রদীপকে দুনিয়ার একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে প্রজ্বলিত করার কারণে মুসলিম মনীষীগণ তাকে ইমাম-ই-আযম বা শ্রেষ্ঠ ইমাম উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি ছিলেন প্রখর প্রজ্ঞা ও তুখোড় যুক্তিবাদী। পৃথিবীর ইতিহাসে তাঁর মত চৌকস ব্যক্তিত্ব বিরল।

ইমাম আবু হানিফা (র)-এর প্রকৃত নাম নুমান ইবনে সাবিত। উপনাম আবু হানিফা। পিতার নাম সাবিত। ইমাম আবু হানিফার উপনাম দ্বারাই হানাফি মাযহাবের নামকরণ করা হয়। তিনিই হানাফি মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা।

ইমাম আবু হানিফা (র) মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের পুণ্যভূমি বর্তমান ইরাকের কুফা নগরীতে ৮০ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলিম এবং ফিক্হশাস্ত্রের বিশ্ববরেণ্য পন্ডিত।

ইমাম আবূ হানিফা (র) বাল্যকাল হতেই অসাধারণ মেধার অধিকারী ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি তৎকালীন ইসলামি বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র কুফা নগরীতে জ্ঞান অর্জন করেন। ১২ বছর বয়সে তিনি হযরত মুহাম্মদ (স) এর খাদেম হযরত আনাস (রা.)-এর খিদমতে উপস্থিত হন।

ইমাম আবু হানিফা (র) প্রথমে কুরআন, হাদিস এবং আরবি ভাষায় গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তারপর তিনি দীর্ঘকাল দর্শন ও কালাম শাস্ত্রে পান্ডিত্য অর্জন করেন। এরপর ফিক্হ শাস্ত্রে গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন। তিনি কুফার বিখ্যাত ফকিহ মুহাম্মদ ইবনে সুলাইমান এর প্রতিষ্ঠিত ‘মাদরাসাতুর রায়’-এ পড়াশুনা করেন।

ইমাম আবূ হানিফার প্রাথমিক কর্মজীবন একজন কাপড় ব্যবসায়ী হিসেবে আরম্ভ হয়। সততা ও কর্মনিষ্ঠা দ্বারা তিনি অতি অল্প সময়েই ব্যবসায়িক সাফল্য লাভ করেন। সমসাময়িককালে তিনি অন্যতম ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হন। পরবর্তীতে তিনি মুহাম্মাদ ইবনে সুলাইমান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাতুর রায়-এ শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১২০ হিজরিতে ইমাম হাম্মাদের ইন্তিকালের পর আবু হানিফা তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন।

খলিফা উমর ইবন আব্দুল আযীযের ইন্তিকালের পর তিনি উমাইয়া খলিফাদের বিরাগভাজনে পরিণত হন। খলিফাগণ ইমামকে নিজ নিজ দলে আনতে চাইলেন। এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে ইমাম আবূ হানিফা (র) কে কারারুদ্ধ করা হয় এবং সৈন্যরা প্রতিদিন তাঁকে বেত্রাঘাত করতো।

ইমাম আবু হানিফাকে (র) এক সময়ে কারাগারে অজ্ঞাত ব্যক্তি কর্তৃক বিষ পান করানো হয়। অতঃপর তিনি ১৫০ হিজরিতে নামাযে সিজদারত অবস্থায় ইন্তিকাল করেন।

ইসলামি আইন শাস্ত্রে তাঁর অবদান:

ইসলামি আইন শাস্ত্রে আবু হানিফার ভূমিকা সুবিশাল। তিনি মানবজীবনের নানা জিজ্ঞাসা এবং উদ্ভূত সমস্যার কুরআন, সুন্নাহ এবং গবেষণাপ্রসূত যৌক্তিক সমাধান প্রদান করেন।

ইমাম আবূ হানিফা (র) ফিক্হ শাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ পন্ডিত ছিলেন। এটা সর্বজন বিদিত যে, তিনিই সর্বপ্রথম কুরআন ও হাদিসের ওপর গবেষণা করে ইসলামি আইন কানুন প্রণয়ন করেন। তিনি আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে কুরআন মাজীদকেই অধিকতর গুরুত্বারোপ করতেন। তিনি যে কোন জটিল প্রশ্নের সমাধান কুরআনের আলোকে প্রদান করতেন। কুরআনের পর তিনি হাদিসের ওপর নির্ভর করতেন।

ইমাম আবূ হানিফা (র) এর অন্যতম অবদান হলো উসূলে ফিক্হ’র উদ্ভাবন।

ফিক্হ সংকলনের পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি নিজে বলেছেন, ‘আমি সর্বাগ্রে কুরআনের সুস্পষ্ট বিধির অনুসরণ করি। সেখানে না পেলে হাদিসের অনুসরণ করি। আর সেখানে না পেলে সাহাবীদের যুক্তিযুক্ত অভিমত গ্রহণ করি। তাদের সকলের অভিমত পরিত্যাগ করে আমি নতুন কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না।’

সারসংক্ষেপ:

ইমাম আবূ হানিফার (র) এর হানাফি মাযহাব ভারতীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করা মাযহাব বা স্কুল অব থট। ফিক্হের ক্ষেত্রে তিনি হাদিস, পারিপার্শ্বিকতা ও প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে কিয়াস ও ইসতিহসান-এর ভিত্তিতে সর্বজনগ্রাহ্য করে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান প্রণীত করার চেষ্ট করছেন।

ইমাম আবু হানীফা (র) বলেন,

“হাদীস যেটি সহীহ সেটাই আমার মাযহাব”

(রাদ্দুল মুখতার ১/১৫৪; মুকাদ্দিমাতু উমদাতুর রিয়ায়াহ- ১/১৪; হাশিয়াতু ইবনু আবেদীখ- ১/৬৩)

আল্লামা ইবনে আবেদীন বলেন,

“কোন মাসআলা সহীহ হাদীসের সাথে গড়মিল হলে ঐ হাদীসটিই আমল করবে । আর ঐ হাদীসই হবে তার মাযহাব। এরূপ আমল তাকে মাযহাব থেকে বের করে দেব না। হানাফী হলে সে হানাফীই থেকে যাবে।”

(রাদ্দুল মুখতার- ১/১৫৪)

খ) ইমাম মালিক (র) ও তাঁর মাযহাব

পরিচয়:

ইমাম মালিক (র)-এর মূল নাম হচ্ছে মালিক, কুনিয়াত আবু আব্দুল্লাহ, উপাধি হলো ইমাম দারিল হিজরাহ। তাঁর পিতার নাম হলো- আনাস। ইমাম মালিক (র)-এর জন্ম হয়েছে হিজরি ৯৩ সালে।

তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন নিজের পরিবার থেকেই। তাঁর পিতা আনাস (র) পিতামহ মালিক ইবন আবু আমর মদীনায় হাদিস বিশারদ ছিলেন। তিনি তাঁর কাছে হাদিস বিষয়ে জ্ঞান অর্জন শুরু করেন।

ইমাম মালিক (র) প্রখ্যাত ফকিহ রাবিয়াতুর রায় এর নিকট ফিক্হ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তিনি প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আব্দুর রহমান ইবনে হরমুযসহ যুহরী ও নাফে (র) প্রমুখের নিকট হাদিস শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ইমামুল র্কুরা নাফে বিন আব্দুর রহমান থেকে ইলমে কিরাত শিক্ষাগ্রহণ করেন। তাঁর শিক্ষকদের সংখ্যা প্রায় ৯০০ বলে জানা যায়।

তাঁর শিক্ষকবৃন্দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ইবনে শিহাব আয-যুহরী, ইবনে উমায়ের আবুয্ যিনাদ, হাশেম ইবনে ওরওয়া, ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ, আব্দুল্লাহ ইবনে দীনার, মুহাম্মাদ আল-মুনকাদির। ইমাম সুয়ুতী (র) তাঁর ৯৫ জন উস্তাদের নামের তালিকা প্রকাশ করেছেন।

এই জগদ্বিখ্যাত হাদিস সংকলকের নিকট থেকে সমসাময়িক কালের সেরা সেরা জ্ঞানপিপাসুগণ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, আওজায়ী, ইবনে সা’দ, শু’বা, সাওরী ও ইবনে উয়াইনা অন্যতম।

গবেষণা ও ইসলামি আইন প্রণয়ন:

ইমাম মালিক (র) ইসলামি আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে কুরআন ও হাদিসের ওপর ব্যাপক গবেষণা করেন। তিনি হানাফি মাযহাব থেকে ভিন্নভাবে তাঁর গবেষণা শুরু করেন এবং কিয়াস পরিত্যাগ করেন। তিনি মানবজীবনে প্রয়োজনীয় নানা আইন কানুন প্রণয়ন করে তা পরবর্তীতে নিজস্ব মাযহাবের অন্তর্ভুক্ত করেন।

ইমাম মালিক (র) হাদিস সংকলনে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করেন। তিনি সংগৃহীত হাদিসগুলো সঠিক ও সুন্দরভাবে যাচাই করে নিতেন। যে সকল হাদিস তাঁর নিকট সন্দেহজনক মনে হতো সেগুলো তিনি বাদ দিয়ে দিতেন।

তিনি ইসলামি আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে মদীনার প্রচলিত রীতি-নীতির ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করতেন। ফলে তাঁর উদ্ভাবিত আইন-কানুন সকলের নিকট সহজবোধ্য। তাঁর উদ্ভাবিত সকল আইন-কানুনই সহজ, সরল ও স্বাভাবিক। জীবনের অধিকাংশ সময়ই তিনি মদীনায় অতিবাহিত করেন। সে সময় তাঁকে হযরত আলী (রা)-এর বংশধরের পরিচয়ে খিলাফতের দাবিদার মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ বিদ্রোহের সাথে জড়িত করা হয়।

ইমাম মালিক জনগণের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তিনি প্রকাশ্যে খলিফা আল-মনসুরের বিরোধী ছিলেন। ৭৬২ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুহাম্মদ মদীনার অধিপতি হয়ে ইমাম বলে ফতোয়া জারি করলেন যে, আল-মনসুরের আনুগত্য বাধ্যতামূলক নয়। কারণ তিনি আনুগত্য জোর করে আদায় করেছেন। মুহাম্মদের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে গেলে ইমাম মালিক (র) মদীনার গভর্নর জাফর ইবনে সুলায়মান-এর বেত্রাঘাতে দন্ডিত হন।

ইমাম মালিক (র)-এর মৃত্যু:

ইমাম মালিক (র) ৮৪ মতান্তরে ৯৩ বছর বয়সে অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৭৯ হিঃ সনে রবিউল আউয়াল মাসে মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন। জান্নাতুল বাকীতে তাঁকে দাফন করা হয়।

হাদিস সংকলন:

ইমাম মালিক (র)-এর যুগ পর্যন্ত হাদিসশাস্ত্র ততটা সুবিন্যস্ত আকারে প্রকাশিত হয়নি। বিভিন্ন হাদিস বিভিন্ন জনের কাছে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছিল। তিনি আব্বাসীয় খলীফা আল-মনসুরের অনুরোধে জনগণের জন্য সহজ সরল করে মুয়াত্তা রচনা করেন।

হাদিসশাস্ত্রে মুয়াত্তার স্থান নির্ণয় করতে গিয়ে ইমাম শাফিঈ (র) বলেন,

“আল্লাহর কিতাবের পর মালিক (র) সংকলিত হাদিসের কিতাব অপেক্ষা অধিক বিশুদ্ধ গ্রন্থ দুনিয়ার বুকে আর নেই।”

(রিওয়াত ইবনে হাসান, আল-মুআত্তা-১/২৫)

সারসংক্ষেপ:

ইমাম মালিক (র) হাদিস শাস্ত্রে এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। নানা প্রতিকূলতা ও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। হাদিস শাস্ত্র সংকলনে পৃথিবীর ইতিহাসে তাঁর অবদান চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মহানবি (স)-এর বিশুদ্ধ বাণী অনাগত কালের উম্মতের নিকট উপস্থাপনের সাহসী প্রয়াসের প্রথম বাস্তব নমুনা হচ্ছে তাঁর অমর সংকলন মুয়াত্তা গ্রন্থ। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাযহাবের নাম মালিকি মাযহাব।

ইমাম মালেক (র) বলেন,

“আমি নিছক একজন মানুষ। ভুল করি, শুদ্ধও করি । তাই আমার মতামতকে যাচাই করে নিও। কুরআন ও সুন্নাহর সাথে যতটুকু মিলে সেটুকু গ্রহণ করো, আর গড়মিল পেলে সেটুকু বাদ দিয়ে দিও।”

(ইকাযুল হিমাম, পৃষ্ঠা ১০২)

ইমাম মালিক (র) কুরআন ও হাদিসকে অত্যন্ত কঠোর দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করতেন। তিনি তাঁর রেখে যাওয়া ফিক্হের মাধ্যমে চিরদিন অমর হয়ে থাকবেন।

গ) ইমাম শাফিঈ (র) ও তাঁর মাযহাব

জীবন চরিত:

যে সমস্ত মনীষীর আপ্রাণ চেষ্টায় ইসলামি ফিক্হ শাস্ত্রের ব্যাপক উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে ইমাম শাফিঈ (র) তাঁদের অন্যতম। তিনি শাফিঈ মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা। কুরআন ও সুন্নাহর মাঝে সমন¦য় সাধন করে তিনি শক্তিশালী মতামত উপস্থাপন করেন।

ইমাম শাফিঈর (র) পূর্ণ নাম হলো আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন ইদরীস আশ-শাফিঈ। তাঁর ঊর্ধ্বতন বংশসূত্র কুরাইশ নেতা কুসাই-এর সঙ্গে সংযুক্ত। তিনি কুরাইশ বংশোদ্ভূত হাশিমী শেখার লোক ছিলেন।

তিনি বর্তমান ইসরাঈল দখলীকৃত ফিলিস্তিনের গাজা ভূখন্ডে ১৫০ হিজরি সনে (৭৬৭ খ্রি:) জন্মগ্রহণ করেন।

দু’বছর বয়সের সময় তাঁর পিতা মারা গেলে তাঁর মাতা উম্মুল হাসান গাজা ছেড়ে তাঁকে নিয়ে মক্কা নগরীতে উপস্থিত হন। মক্কাতেই তিনি লালিত-পালিত হন। কুরআন মাজীদ নিয়ে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। তিনি দশ বছর ধরে মক্কার বিখ্যাত হুযায়ল গোত্রে বসবাস করে আরবি ভাষা, সাহিত্য ও কাব্যে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।

ইমাম শাফিঈ (র) দশ বছর বয়সে পূর্ণ কুরআন মাজীদ মুখস্থ করেছিলেন। তিনি মক্কার প্রসিদ্ধ মুফতি মুসলিম ইবন খালিদ যানজীর নিকট থেকে ফিক্হ শিক্ষা লাভ করেন।

তিনি পনের বছর বয়সে ফাতাওয়া দেওয়া শুরু করেন। তারপর তিনি মদীনায় উপস্থিত হয়ে সরাসরি ইমাম মালিক (র)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তার প্রণীত মুয়াত্তা তাকে শুনান। তিনি ইমাম মালিক (র)-এর নিকট থেকে বিপুল পরিমাণে ফিক্হ শাস্ত্রের ওপর জ্ঞান হাসিল করেছিলেন। ইমাম মালিক (র) তাঁর অপূর্ব মেধা, অনন্য ধীশক্তি ও অবিস্মরণীয় অধ্যয়ন পিপাসা দেখতে পেয়ে তাঁকে অত্যধিক সম্মান ও স্নেহ করতেন। তিনি অন্যান্য বিখ্যাত ফিক্হ শাস্ত্রবিদদের নিকট থেকেও জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।

এই জগদ্বিখ্যাত ইসলামি আইন প্রণেতা ২০৪ হিজরি সনের রজব মাসের শেষ দিন (২০ জানুয়ারি ৮২০ খ্রি:) ফুসতাতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে মোকাত্তাম পর্বতের পাদদেশে সমাহিত করা হয়।

ইমাম শাফিঈর (র) অবদান:

ইসলামি আইনশাস্ত্রে তিনি যে অবদান রেখেছেন তা হলোইমাম শাফিঈ (রহ.) শিয়া মতবাদ প্রচারের মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ১৮৭ হিজরি সনে। তাঁকে বাগদাদে খলিফা হারুন আর-রশীদের দরবারে হাজির করা হলে দরবারের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ফজল ইবন রাবি-এর সুপারিশে মুক্তি দেওয়া হয়।

ইমাম শাফিঈ ১৮৮ হি সনে মক্কা, সিরিয়া হয়ে মিসরে উপস্থিত হন এবং ইমাম মালিকের শিষ্য হওয়ার সুবাদে মিসরের লোকজন তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫ হিজরি পর্যন্ত মিসরে অবস্থান করার পর পুনরায় ইরাকে গমন করেন এবং সেখানে অনেক দিন অতিবাহিত করেন।

হিজরি ১৯৫ সনে ইরাকে অবস্থানকালে সেখানকার আলিম-উলামা তাঁর শিক্ষা গ্রহণ ও যথার্থ সম্মানে অধিষ্ঠিত করেন। তিনি সেখানকার আলিমগণের সহযোগিতায় হানাফি ও মালিকি মাযহাবের নির্যাস নিয়ে একটি মাযহাব প্রবর্তন করেন। ইতিহাসে একে শাফিঈ মাযহাব বলা হয়।

ইমাম শাফিঈ (র) কুরআন ও হাদিসের মাধ্যমে কোন সমস্যার সমাধান না দিতে পারলে কিয়াসের সাহায্য গ্রহণ করতেন। তাঁকেই ইসলামি ফিক্হশাস্ত্রে সর্বপ্রথম কিয়াসের ব্যবহারকারী হিসাবে ধরা হয়।

ইমাম শাফিঈ (র) ফিক্হ ও হাদিস শাস্ত্রের ব্যাপক উৎকর্ষ সাধন করেছিলেন। তিনি নিজকে বড় মাপের হাদিস ও ফিক্হ বিশারদরূপে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। তাঁর ছাত্র ইমাম আহমদ (র) বলেন, ‘হাদিস বিশারদগণ ঘুমন্ত ছিলেন, ইমাম শাফিঈ (র) তাদের জাগিয়ে তোলেন।’

ইমাম শাফিঈ (র) ফিক্হ শাস্ত্রের গবেষণা ও চিন্তা ভাবনায় অত্যন্ত স্বাধীনচেতা ছিলেন। তিনি মূলত হানাফি ও মালিকি মাযহাবের মধ্যবর্তী পন্থা অবলম্বন করে শাফিঈ মাযহাবের ভিত্তি নির্মাণ করেন।

উসূলে ফিক্হর সুশৃঙ্খল নিয়মাবলির উদ্ভাবনে ইমাম শাফিঈ যে অবদান রেখেছিলেন তা অন্য কোন ফকিহর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাঁর এই অসামান্য কৃতিত্বের ওপর ভর করেই পরবর্তীকালের ফিক্হ গবেষকগণ সামনে এগিয়ে যান।

ইমাম শাফিঈ একমাত্র ব্যক্তি যিনি ফিক্হ পন্থী (اصحاب الفقه) এবং হাদিস পন্থীদের (اصحاب الحديث) মাঝে দূরত্ব কমিয়ে একই সমতলে অবস্থান করার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তিনি এদেরকে কাছাকাছি নিয়ে এসে উভয়ের মাঝে এক মাযহাব প্রতিষ্ঠা করেন।

তিনি মূলত হাদিসের মধ্যে পারস্পরিক বাহ্যিক হুকুমের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসন করেন। তিনি হাদিসের বাণীগুলোকে আইনের উৎস হিসেবে মনে করেন। তিনি কুরআন ও হাদিসের সাথে কোন রূপ পার্থক্য আনতে নারাজ।

ইমাম আবু হানিফা (র)-এর প্রচেষ্টায় ফিক্হ শাস্ত্র বিষয়ক মূলনীতির প্রসার ঘটলেও তা সুবিন্যস্ত ও সুসংহতভাবে প্রতিষ্ঠা করেন ইমাম শাফিঈ (র)। আর এ কারণেই তাঁকে ফিক্হ-বিজ্ঞান বা উসূলে ফিক্হর প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।

ইমাম শাফিঈ (র) তাঁর বিচার বুদ্ধি প্রয়োগ করে বাহ্যত বিরোধী হাদিসগুলোর সুনিপুণ সমাধান করেন। তাঁর লিখিত গ্রন্থ ইখতিলাফুল হাদিসে (اختلاف الحديث) পরস্পর বিরোধী হাদিসগুলো এমনভাবে সমন্বিত করেছেন যে, দুটি হাদিস থেকে দুটি মত গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তার এ গ্রন্থটি সুধী মহলে বেশ সমাদৃত হয়েছিল।

সারসংক্ষেপ:

ইসলামি চিন্তাজগতে ইমাম শাফিঈ (র.) এক বিস্ময়কর প্রতিভা। মুসলিম বিশ্বে তাঁর চিন্তা দারুণভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি স্বীয় প্রতিভাদীপ্ত ইজতিহাদী কর্মকান্ডের মাধ্যমে অমর হয়ে আছেন।

ইমাম শাফেয়ী (র) বলেন,

“যদি তোমরা আমার কোন কথা হাদীসের সাথে গড়মিল দেখতে পাও, তাহলে তোমরা হাদিস অনুযায়ী আমল করো, আমার নিজের উক্তিকে দেয়ালে ছুড়ে ফেল।”

(হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ- ১/৩৫৭)

হাদিস ও ইসলামি আইন শাস্ত্রে ইমাম শাফিঈ যে অবদান রেখে গেছেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বিশ্বের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাখ লাখ শাফিঈ মাযহাবের অনুসারীরা। ইসলামি আইন শাস্ত্রের আকাশে তাঁর পদচারণা এতটা দাপটের যে, যার আভা উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় আলোকিত করে সারা বিশ্বকে সম্মোহিত করেছে।

ঘ) ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (র) ও তাঁর মাযহাব

জীবনী ও কর্ম:

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র.) ইসলামি ফিক্হ শাস্ত্রের চতুর্থ মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি হিজরি ১৬৪ মোতাবেক ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইবন হাম্বল নামে সুপরিচিত। তৎকালীন অনেক অভিজ্ঞ আলিমের নিকট থেকে তিনি শিক্ষা লাভ করেন। তিনি হাদিসের ওপর ব্যাপক গবেষণা করেন। হাদিসের ওপর তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আল-মুসনাদ। এতে প্রায় ত্রিশ হাজার হাদিস আছে। পুরোপুরি হাদিসের ওপর নির্ভর করতেন বলে তিনি ব্যক্তিগত বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগের প্রতি তেমন জোর দিতেন না।

তিনি আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত যুক্তি কম প্রয়োগ করতেন, আগে রাসূল (সা.) এর হাদিসকে প্রয়োগ করতে। কোন আকস্মিক ব্যাপার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উৎস সন্ধান যখন সম্ভব হত না, কেবল তখনই তিনি যুক্তি প্রয়োগের সাহায্য গ্রহণ করতেন। তিনি রাসূল (সা.) এর হাদিসের ওপর নির্ভর করতেন এবং মানুষের ব্যক্তিগত যুক্তি প্রয়োগের পক্ষপাতি ছিলেন না।

ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (র) রক্ষণশীল ছিলেন। মুতাযিলা মতবাদের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করায় মুতাযিলা মতবাদের পৃষ্ঠপোষক খলিফা মুনতাসির বিল্লাহ তাঁকে কারারুদ্ধ করেন। কিন্তু মুতাওয়াক্কিল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তাঁকে কারামুক্ত করেন। ৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে তিনি বাগদাদে ইনতিকাল করেন। আইন প্রণয়নের ব্যাপারে কড়াকড়ি নীতি অনুসরণের জন্য হাম্বলী মাযহাবের তেমন প্রসার হয়নি।

ঐতিহাসিক ইবন খাল্লিকান-এর মতে, ইমাম আহমদ ইবন হাম্বলের (র) জানাযায় প্রায় আট লক্ষ পুরুষ ও ষাট হাজার মহিলা উপস্থিত হয়েছিলেন। জানাযাতে এই বিরাট সমাবেশ তাঁর জনপ্রিয়তার কথাই প্রমাণ করে।

সারসংক্ষেপ:

শতাব্দীর গুলিস্তানে যারা ক্ষণিকের পুষ্পরাজ হয়ে আগমন করেন ইমাম আহমদ (র) ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তাঁর চিন্তাধারা ও দর্শন মুসলিম বিশ্বে সমাদৃত হয়। তিনি নিজ কর্মের মাঝে চির অম্লান। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ফিকহি মাযহাবের নাম হাম্বলি মাযহাব। তিনি ছিলেন একাধারে প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ, তেমনি ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের অধিকারী এবং হাম্বলী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) বলেন,

“তুমি আমার অন্ধ অনুসরণ করো না। মালেক, শাফেয়ী, আওযায়ী, সাওরী- তাঁদেরও না; বরং তাঁরা যেখান থেকে (সমাধান) নিয়েছেন তুমিও সেখান থেকেই নাও।”

(ইবনুল কাইয়্যিম রচিত ‘ঈলামুল মুওয়াকেয়ীন- ২/৩০২)

তিনি আরো বলেন,

“যে ব্যক্তি রাসূল (স)-এর সহীহ হাদীসকে প্রত্যাখ্যান করবে সে লোক ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত।”

(ইবনুল জাওযী রচিত, আল মানাকিব: ১৮২)

প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলেচনার মাধ্যমে আমরা মাযহাব কয়টি ও কি কি? চার মাজহাবের প্রধান চার ইমামের সংক্ষিপ্ত পরিচিত জানলাম।

মাযহাবগুলোর ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোতে কোন পার্থক্য নেই, পার্থক্য কেবল আমল ও বিভিন্ন নিয়ম কানুনে। মৌলিক ভাবে সবকটি মাযহাবই সঠিক হিসাবে বিবেচিত। তবে মাযহাবের নিয়মকানুন নিয়ে সমসাময়িক পন্ডিতগণ গবেষণা চালিয়ে যান। এবং প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকেন। সর্বাধিক তাকলিদ বা বিষয়গত পাঠ্যের উপর নির্ভর না করে আইনী অনুশীলনগুলির বিশ্লেষণ এবং চর্চাকেই কেন্দ্রীয় আলোচ্য হিসাবে ধরে উচ্চতর ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ধর্মীয় বিধান এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের গ্রহণযোগ্যতার উপর তা চলমান।

সুনানে আবী দাউদ গ্রন্থের সংকলক মুহাদ্দিস আবু দাউদ (র) বলেন,

“এমন কোন লোক নেই, যার সব কথাই গ্রহণযোগ্য; কেবল রাসূলুল্লাহ (স) ছাড়া।”

(মাসাইলে ইমাম আহমদ: ২৭৬)

সর্বশেষে আল্লাহ তাআলার বাণীটি স্মরণ করি। তিনি বলেছেন,

“যারা (সব) কথা শুনে, অতঃপর উত্তমটি আমল করে তারাই হলো হেদায়াতপ্রাপ্ত, আর তারাই হলো বুদ্ধিমান।” (সূরা ৩৯; আয যুমার ১৮)

আজকের আলেচনাটি এখানেই শেষ করছি। আর্টিকেলটি উপকারি মনে হলে অবশ্যই বনাধুদের সাথে শেয়ার করে দিবেন। এই ধরণের ইসলামেক তথ্যবহুল আলোচনা পেতে আমাদের এই ওয়েবসাইট স্মরণে রাখার ও নিয়মিত ভিঝিট করার অনরোধ রইল। আমাদের সাথে থেকে সাপোর্ট করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। জাজাকাল্লাহু খায়রান।

[সূত্র: ওপেন স্কুল ও hadithbd.com]

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/islam

Islamic information to the point!View Author posts