এই আর্টিকেলটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- হজ্জের পরিচয় ও পটভূমি বলতে পারবেন; হজ্জের ধর্মীয় গুরুত্ব বুঝতে পারবেন; হজ্জের সামাজিক শিক্ষা এবং হজ্জের অর্থনৈতিক শিক্ষা বিশ্লেষণ করতে পারবেন; সর্বপরি হজ্জের গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারবেন।
নিম্নে সহজ সংক্ষিপ্তভাবে হজ্জের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরা হলো-
(১) হজ্জের পরিচয় ও পটভূমি
হজ্জ অর্থ কি: হজ্জ একটি আর্থিক ও শারীরিক ইবাদাত। হজ্জ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম। হজ্জ-এর শাব্দিক ও আভিধানিক অর্থ-কোন সম্মানিত স্থানে গমনের সংকল্প।
হজ্জ কাকে বলে: ইসলামি পরিভাষায় হজ্জ-এর অর্থ মক্কা মুআযযামায় অবস্থিত কাবা শরীফের পার্শ্ববর্তী কয়েকটি স্থানে কতিপয় বিশেষ অনুষ্ঠান পালনের সংকল্প। নির্দিষ্ট দিনক্ষণে অনুষ্ঠানগুলো সম্পন্ন করাকেও হজ্জ বলে। নির্দিষ্ট স্থানগুলো হচ্ছে: মক্কা শরীফ ও পার্শ্ববর্তী মিনা, আরাফাত ও মুযদালিফা। হজ্জের সময় হচ্ছে যিলহজ্জ মাসের আট তারিখ থেকে বার তারিখ পর্যন্ত।
হজ্জ কাদের জন্য বাধ্যতামূলক: প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ-বুদ্ধিসম্পন্ন, সমর্থ্যবান মুসলিম নর-নারীর জন্য জীবনে অন্তত একবার হজ্জ করা ফরয বা অবশ্য কর্তব্য।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশে ঐ ঘরের হজ্জ করা তার আবশ্য কর্তব্য।”
(সূরা আলে-ইমরান,৩:৯৭)
তবে মক্কার মুসলমানের জন্য গরিব হলেও হজ্জ ফরয। কারণ, তারা মক্কা মুআযযামার এত নিকটে বসবাস করে যে, তারা পায়ে হেঁটে হজ্জ পালন করতে পারে। এছাড়া মক্কার বাইরের লোক গরিব হলেও হজ্জের সময়ে মক্কাতে উপস্থিত থাকলে তার জন্য হজ্জ ফরয বা বাধ্যতামূলক।
স্ত্রীলোক সম্বন্ধে ইসলাম বলে, যে স্ত্রীলোকের স্বামী জীবিত নেই সে এমন একজন সঙ্গীর সাথে মক্কা শরীফে গমন করতে পারবে যার সাথে উক্ত স্ত্রীলোকের বিবাহ হারাম। উপযুক্ত সঙ্গী না থাকলে স্ত্রীলোকের জন্য হজ্জ ফরয নয়।
হজ্জের শুরু বা প্রচলন কে করেন: হজ্জের নির্দেশ নতুন কিছু নয়। ইতিহাসে এর প্রবর্তনের কোন নির্দিষ্ট তারিখের উল্লেখ নেই। কুরআন মাজীদের বর্ণনানুসারে হযরত ইবরাহীম (আ) হজ্জের প্রচলন করেন।
আল-কুরআনে উল্লেখ আছে,
“নিশ্চয় মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা তো বাক্কায় (মক্কা) তা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী।”
(সূরা আলে-ইমরান, ৩: ৯৭)
কুরআন মাজীদে এ ঘরকে ‘আল-বাইতুল আতীক’ বা সুপ্রাচীন পবিত্র ঘর রূপে আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইবরাহীম (আ) হজ্জের প্রচলন করেন।
হজ্জ প্রবর্তনের সঠিক তারিখ জানা না গেলেও হজ্জের কতিপয় অনুষ্ঠান যথা- তাওয়াফ, হাজরে আসওয়াদ চুম্বন এবং সাফা মারওয়ায়ে সাঈ মহানবি (স)-এর নবুওয়াত লাভের পূর্ব থেকে প্রচলিত ছিল। হযরত ইবরাহীম (আ)-এর সময় থেকে হজ্জ একটি নিয়মিত অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। হজ্জের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ যা হযরত মুহাম্মদ (স) -এর সময় প্রচলিত হয় তা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর অনুষ্ঠানের ওপরই প্রতিষ্ঠিত।
কাবা ঘরকে হারাম বলা হয় কেন: কাবা ঘর আল্লাহ তা‘আলার ইবাদাতের সর্বপ্রথম ঘর। কুরআনে একে বাইতুল আতীক-সুপ্রাচীন ঘর বলা হয়েছে। এই স্থানে সকল প্রকার ঝগড়া-বিবাদ এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ বলে এর অপর নাম ‘বাইতুল হারাম’। দুনিয়ার প্রথম মানুষ হযরত আদম (আ)ও এখানে ইবাদাত করতেন।
উমরা হজ্জ কাকে বলে: হজ্জের নির্দিষ্ট দিনগুলো ব্যতীত শরীআত নির্ধারিত পন্থায় কাবা শরীফের তাওয়াফ করাকে উমরা বলা হয়।
হজ্জের ফরয হচ্ছে তিনটি: সেগুলো হলো-
১. ইহরাম বাঁধা।
২. তাওয়াফ করা।
৩. আরাফাতে অবস্থান।
অন্যান্য অনুষ্ঠানসমূহ যথাক্রমে ওয়াজিব ও সুন্নাত।
হজ্জের ওয়াজিব হচ্ছে নয়টি: সেগুলো হলো-
১. সাঈ করা। (অনেকের মতে এটা হজ্জের রুকন।)
২. ইহরাম বাঁধার কাজটি মীকাত পার হওয়ার পূর্বেই সম্পন্ন করা।
৩. আরাফাতে অবস্থান সূর্যাস্ত পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করা।
৪. মুযদালিফায় রাত্রি যাপন।
৫. মুযদালিফার পর কমপক্ষে দুই রাত্রি মিনায় যাপন করা।
৬. কঙ্কর নিক্ষেপ করা।
৭. হাদী (পশু) জবাই করা (তামাত্তু ও কিরান হাজীদের জন্য।)
৮. চুল কাটা।
৯. বিদায়ী তাওয়াফ।
যেসকল কাজ পালন না করলে কুরবানী করতে হয়, যে সকল কাজই ওয়াজিব, বাকিগুলো সুন্নাত।
(২) হজ্জের ধর্মীয় গুরুত্ব
হজ্জ ইসলামি জীবন ব্যবস্থার অন্যতম বুনিয়াদি ইবাদাত। এটি শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিক ইবাদাতের অনন্য সমন্বয়। হজ্জের ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব অপরিসীম। নিচে এ সম্পর্কে আলোচিত হলো।
হজ্জ একটি সার্বিক ইবাদাত: ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হজ্জ একটি সার্বিক ইবাদাত। হজ্জ একাধারে দৈহিক, আর্থিক ও মানসিক ইবাদাত। এ অনন্য ইবাদাত দ্বারা নিষ্ঠা, তাকওয়া, নম্রতা, আনুগত্য, প্রবৃত্তি কামনা বাসনা শুদ্ধি, ত্যাগ, কুরবানী, আত্মসমর্পণ ও আল্লাহর নৈকট্য ও সান্নিধ্য প্রভৃতির প্রেরণা ও ভাবাবেগ পৃথকভাবে বিকাশ লাভ করে।
মহান আল্লাহ প্রত্যেক সক্ষম ও সামর্থ্যবান মুসলিমের ওপর হজ্জ ফরয করে দিয়ে ঘোষণা করেন,
“মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ ঘরের হজ্জ করা তার অবশ্য কর্তব্য।”
(সূরা আলে-ইমরান, ৩:৯৭)
আর মুসলিমগণ হজ্জ করার মাধ্যমে মহান আল্লাহর এ নির্দেশই পালন করে থাকেন।
হজ্জব্রত পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। যার ওপর হজ্জ ফরয করা হয়েছে সে যদি বিনা কারণে হজ্জ ব্রত পালন না করে তা হলে ধর্মচ্যুতি হওয়ার আশংকা আছে।
দোযখের শাস্তি হতে পরিত্রাণ: হজ্জ দোযখের আগুন হতে পরিত্রাণ দেয়।
মহানবি (স) বলেন,
“আল্লাহ যাকে হজ্জব্রত পালনের সামর্থ্য দিয়েছেন যদি সে হজ্জ না করে ঐ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে তা হলে সে দোযখের যন্ত্রণাদায়ক আগুনে পতিত হবে।”
(আল-হাদিস)
এককেন্দ্রমুখিতা: হজ্জ মুসলমানদের এক ও অভিন্ন কেন্দ্রের অভিমুখী করে গড়ে তোলে। ব্যক্তি স্বার্থ, গোষ্ঠী, গোত্র, ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা, বর্ণ, ভাষা ইত্যাদির গন্ডির উর্ধ্বে উঠে বিশ্বের সকল বিশ্বাসী মানবতা একই আল্লাহর ঘর কাবাতে এসে একাকার হয়ে এক অখন্ড উম্মাহর অপরূপ নিদর্শন স্থাপন করে।
নতুন চেতনা শক্তি: কা‘বা বিশ্বমানবতার হিদায়াতের কেন্দ্রবিন্দু। হজ্জ আদায়ের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর গোটা দুনিয়ায় মুসলিম জনপদ এক ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামী চেতনায় জেগে ওঠে।
(৩) হজ্জের সামাজিক শিক্ষা
হজ্জের সামাজিক শিক্ষা অনেক। যথা-
একত্ববোধ জাগ্রত করে: হজ্জের মৌসুমে সারা বিশ্ব মুসলিম ঐক্যবদ্ধ হয়ে হজ্জের কার্যক্রম সম্পাদনের সময় মুসলমানদের মনে ঐক্যবোধ জাগ্রত হয় এবং জীবনেও এর প্রতিফলন দেখা যায়।
ধনী-নির্ধন, রাজা-প্রজা, মনিব-ভৃত্য, কালো-সাদা মানুষ হজ্জের সময় যখন সেলাইবিহীন একই কাপড় পরিধান করে সর্বময় ক্ষমতার মালিকের সামনে হাজির হয়- তখন এক অপরূপ সাম্যের দৃশ্যের অবতারণা হয়।
হজ্জের মাধ্যমে বিশ্বমুসলিমের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান হয় ও মেলামেশার সুযোগ লাভ করে এবং পরস্পর সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়। হজ্জের অনুষ্ঠানমালা পালন করতে অসাধারণ শৃঙ্খখলার পরিচয় দিতে হয়। সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মুসলিম হজ্জের প্রতিটি অনুষ্ঠান তথা তাওয়াফ, সাফা-মারওয়ার সাঈ, আরাফাতের ময়দানে অবস্থান প্রভৃতি অনুষ্ঠান পালনের সময় এক অপূর্ব শৃঙ্খলা ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচয় দেয়।
(৪) হজ্জের অর্থনৈতিক শিক্ষা
হজ্জের ধর্মীয়, সামাজিক গুরুত্ব যেমন ব্যাপক- এর অর্থনৈতিক ভূমিকাও তেমনি অনেক। যথা-
অর্থনৈতিক সাম্য: হজ্জ মানুষকে মিতব্যয়ী ও সংযমী হতে শিক্ষা দেয়। হজ্জ এক দিকে যেমন অর্থলিপ্সা ও কৃপণতা থেকে উদ্ধার করে উদার হতে শিক্ষা দেয়। তেমনি বিলাসিতা ও নিরর্থক অপচয় করা থেকে বিরত থাকতে শিক্ষা দেয়। শুধু দু’খন্ড সেলাইবিহীন সাদা কাপড় পরা, খালি মাথায়, খালি গায়ে নেহায়েত সরল সহজ ধরনের চালচলনের মাঝে মিত্যবায়িতার শিক্ষা লাভ করা যায়। হজ্জ মানুষকে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীভূত করে সাম্যের পতাকা তলে সমবেত করে।
বিশ্বমুসলিম অর্থ তহবিল গঠন: প্রতি বছর বিশ্বের লক্ষ লক্ষ বিত্তবান মুসলিম মক্কা নগরীতে হজ্জ পালনের উদ্দেশে গমন করে থাকে। তাতে আরব সরকার ও সেখানকার জনগণের আর্থিক সচ্ছলতা আসে, প্রচুর আয় বৃদ্ধি পায়। সৌদি সরকার হজ্জের আয় হতে বিভিন্ন গরিব দেশকে সাহায্য করে থাকেন। আর কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এমন অর্থ আয়ের সম্ভাবনা নেই। তবে হজ্জের আয় হতে যদি “বিশ্ব মুসলিম সংস্থা” সমবেত প্রচেষ্টার মাধ্যমে “বিশ্ব মুসলিম অর্থ তহবিল” গঠন করে বিশ্ব ব্যাংকের মতো বিরাট অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারত- তবে বিশ্ব মুসলিমের মহাকল্যাণ সাধন করতে পারত।
প্রিয় পাঠক বন্ধু, উপরোক্ত আলোচনা মাধ্যমে আমরা হজ্জের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত ধারণা অর্জন করলাম।
হজ্জ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলমান মক্কায় হজ্জ অনুষ্ঠান পালন করতে আসেন। হজ্জের প্রধান শিক্ষা হচ্ছে- হজ্জের কারণে হাজীদের জীবনের পাপরাশি মোচন হয় ও ঈমানকে শক্তিশালী করে। যখন তাঁরা মক্কাতে প্রবেশ করেন, তখনই ইসলামের প্রথম যুগের সমগ্র ইতিহাস তাঁদের মানসপটে ভেসে ওঠে। তাঁরা মক্কা নগরীর কাবাঘর, সাফা মারওয়া, মিনা, আরাফাত, মুযদালিফা প্রভৃতি স্থানে প্রাথমিক যুগের ইসলামের স্মৃতি দেখতে পান। এতে তাঁরা ইসলামের আদর্শে আবার অনুপ্রাণিত হন। এ ছাড়া মাসজিদে নববী দেখার ফলে মহানবি (স) ও তাঁর মহান সাহাবীদের কথা মানস্পটে ভেসে ওঠে। পৃথিবীর কোণে কোণে ইসলামের শান্তির বারতা পৌঁছানোর জন্য শক্তিশালী উপায় আর হতে পারে না। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা এ ইবাদাতকে সক্ষম বিশ্ব মুসলিমের ওপর ফরয করে দিয়েছেন।