(১) শশুর শাশুড়ির খেদমত করা কি?
শশুর শাশুড়ির খেদমত করা কি: শ্বশুর-শাশুড়ীর খেদমত করা শরিয়তে ফরয বা বাধ্যতামূলক না হলেও নৈতিক দায়িত্ব।
(২) শ্বশুর বাড়ীতে বসবাস ও সকলের সাথে মিলে মিশে থাকার নীতি
শ্বশুর বাড়ীতে বসবাসের কতিপয় আদব ও নীতি রয়েছে, যা মেনে চললে শ্বশুর বাড়ীতে সকলের সাথে মিলে মিশে থাকা যায় এবং সকলের কাছে প্রিয় হওয়া যায়। এ নীতিগুলো অমান্য করলেই বিবাদ ও ঝগড়া কলহের সূত্রপাত ঘটে এবং অশান্তি সৃষ্টি হয়।
নীতিগুলো নিম্নরূপ-
১। স্বামীর হক যথাযথভাবে আদায় করা। (স্বামীর হক সম্পর্কে আলাদা একটি সম্পূর্ণ অঅলোচনা রয়েছে, এখানে আর পুনরায় উল্লেখ করা হলো না।)
২। যত দিন শ্বশুর-শাশুড়ী জীবিত থাকবেন তাদের খেদমত ও আনুগত্যকে ফরয বলে জানবে এবং সে মতে তাদের খেদমত ও আনুগত্য করবে। তাদের সাথে কথা-বার্তা ও উঠা-বসায় আদব-সম্মানের প্রতি খুব লক্ষ্য রাখবে। শ্বশুর-শাশুড়ীর খেদমত করা আইনতঃ ফরজ না হলেও নৈতিক দায়িত্ব।
৩। শ্বশুর-শাশুড়ী, ননদ প্রমুখদের থেকে স্বামীকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে ভিন্ন সংসার গড়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠবে না। যদিও স্ত্রীর অধিকার রয়েছে ভিন্ন হতে চাওয়ার, কিন্তু সে এরূপ দাবী করলে, এর জন্য পীড়াপীড়ি করলে শ্বশুর-শাশুড়ী যখন জানবে তখন তারা এই ভেবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে যে, পুত্রবধূ আমাদের পুত্রকে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়। এখান থেকেই ফ্যাসাদের সূত্রপাত ঘটবে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন ৪২৫ পৃষ্ঠা ৷
৪। শ্বশুর বাড়ীর কোন দোষ ত্রুটি মা-বাপের কাছে বলবে না বা শ্বশুরালয়ের কারও সম্পর্কে কোন গীবত শেকায়েত বাপের বাড়ীতে করবে না। এ থেকেই ক্রমান্বয়ে উভয় পক্ষের মন খারাপ হয়ে নানান জটিলতার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
৫। শ্বশুর-শাশুড়ী জীবিত থাকা অবস্থায় যদি একান্নভুক্ত সংসার হয় তাহলে স্বামী সংসার চালানোর টাকা-পয়সা স্ত্রীর হাতে দিতে চাইলে সে স্বামীকে বলবে শ্বশুর-শাশুড়ীর কাছে দেয়ার জন্য; যাতে শ্বশুর-শাশুড়ীর মন পরিষ্কার থাকে এবং তারা এই ভাবতে না পারে যে, পুত্রবধূ আমাদের পুত্রকে কুক্ষিগত করে ফেলেছে।
৬। শ্বশুর বাড়ীর সকল বড়দেরকে আদব-সম্মান এবং ছোটদেরকে স্নেহ করবে।
৭। শাশুড়ী, ননদ প্রমুখরা যে কাজ করবে তা করতে লজ্জাবোধ করবে না। তাদের কাজে সহযোগিতা করবে বরং তারা করার পূর্বেই সম্ভব হলে তাদের কাজ করে দিবে, তাহলে তাদের ভালবাসা লাভ করা যাবে।
৮। নিজের কাজ কারও জন্য ফেলে রাখবে না এই ভেবে যে, অমুক করে দিবে। নিজের সব কিছুকে নিজেই সাজিয়ে গুছিয়ে ও পরিপাটি করে রাখবে।
৯। দুই চারজনে কোন গোপন কথা বলতে থাকলে সেখান থেকে সরে যাবে, তারা কি বলছিল সেটা জানার জন্য খোঁজ লাগাবে না। অহেতুক এই সন্দেহ করবে না যে, তারা হয়ত আমার কোন দোষ বলাবলি করছিল।
১০। শ্বশুর বাড়ীতে প্রথম প্রথম মন না বসলেও মনকে বোঝানোর চেষ্টা করবে, কান্না জুড়ে দিবে না। এসে পারলে না- এরই মধ্যে আবার যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করবে না। এভাবে কিছুদিন পর মন ঠিক হয়ে যাবে।
(৩) পুত্র-বধূর প্রতি শ্বশুর-শাশুড়ীর যা যা করণীয়
১। পুত্র-বধূ এলেই শাশুড়ী মনে করবে না যে, এখন থেকে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম, ঘরের কোন কাজ আর আমাকে করতে হবে না, এখন কাজের মানুষ এসে গেছে। পুত্র-বধূ ঘরের বাঁদী বা চাকরানী নয় বরং পুত্রবধূ ঘরের শোভা, পুত্রবধূকে চাকরানী মনে করবে না এবং চাকরানী সুলভ আচরণ তার সাথে করবে না।
২। শ্বশুর-শাশুড়ীর খেদমত করা পুত্রবধূর আইনতঃ দায়িত্ব নয়, করলে সেটা তার অনুগ্রহ। অতএব শ্বশুর-শাশুড়ীর যতটুকু খেদমত/সেবা সে করবে তার জন্য শ্বশুর-শাশুড়ী প্রীত হবেন এবং সেটাকে তার অনুগ্রহ মনে করবেন। আর যতটুকু সে করবে না তার জন্য তাকে জবরদস্তী করতে পারবেন না। কিংবা তার কারণে তার সাথে খারাপ আচরণ করতে পারবেন না।
৩। পুত্র-বধূর অধিকার রয়েছে শ্বশুর-শাশুড়ীর সাথে একান্নভুক্ত না থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার। অতএব পুত্রবধূ যদি পৃথক হতে চায় তাহলে তাতে বাঁধা দিতে পারবে না। বরং হযরত আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) বলেছেনঃ এই যমানায় একান্নভুক্ত থাকার কারণেই পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি হয়ে থাকে। কাজেই শুরুতেই ফ্যাসাদ লাগার আগেই পুত্র ও বধূকে পৃথক করে দেয়া সমীচীন। তাতে মহব্বত ভাল থাকবে। অন্যথায় যখন ফ্যাসাদ লাগবে তখন পৃথকও করে দিতে হবে আবার মহব্বত ও সুসম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে।
৪। পুত্রের সাথে পুত্রবধূর অত্যাধিক ভালবাসা হতে দেখলে ঈর্ষাবোধ করবে না এবং অহেতুক এই সন্দেহ করবে না যে, বধূ আমাদের পূত্রের মাথা খেয়ে ফেলবে কিংবা আমাদের থেকে বুঝি তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রগাঢ় ভালবাসা হয়ে যাওয়াইতো শরী’আতের কাম্য তাদের মধ্যে মহব্বত হতে দেখলে ঈর্ষাবোধ করবে, আবার অমিল হয়ে গেলে মিল করানোর জন্য তাবীজের সন্ধানে ছুটাছুটি করবে- এই বিপরীতমুখিতার কোন অর্থ হয় না।
৫। পুত্রবধূকে স্নেহ করবে, আদর সোহাগ করবে এবং তার আরাম ও সুবিধার প্রতি খেয়াল রাখবে, যেন পুত্রবধূ শ্বশুর-শাশুড়ীকে স্নেহময়ী পিতা-মাতার মত পেয়ে তাদেরকে আপন মনে করে নিতে পারে এবং তাদের জন্য সব রকম কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করাকে নিজের গৌরব মনে করে নিতে পারে।
৬। পুত্রবধূর কাছে নিজেদেরকে তার কল্যাণকামী হিসেবে প্রমাণিত করতে হবে, যাতে তাদের প্রতি পুত্র-বধূর আজমত ভক্তি বৃদ্ধি পায়।
৭। যৌতুকের জন্য পুত্রবধূকে কোন রকম চাপতো দূরের কথা ইশারা ইঙ্গিতেও কিছু বলবে না। এমনকি পুত্রবধূ তার বাপের বাড়ী থেকে কি কি মাল সামান এনেছে, কি কি আনেনি বা কেন আনেনি-এ প্রসঙ্গে কোন আলোচনাই তুলবে না। মনে রাখতে হবে যৌতুক চাওয়া হারাম এবং এই যৌতুকের কারণে পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি হয়ে থাকে। এখন কোন পিতা-মাতা যৌতুকের কথা তুলে পুত্রের সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করতে চাইবে কি না, সেটা পিতা-মাতার উচিত হবে কি না, তা তাদের বিবেচনা করে দেখতে হবে। অনেক সময় পুত্র স্ত্রীকে এসব কথা কিছুই বলে না, পিতা-মাতাই নিজেদের থেকে এসব আলোচনা তুলে থাকে, কিন্তু পুত্রবধূ মনে করে স্বামীর ইশারাতেই এগুলো বলা হচ্ছে। এভাবে পিতা-মাতার এসব আলোচনা দ্বারা পুত্র ও পুত্রবধূর মধ্যে মন কষাকষি এবং ভুল বুঝাবুঝি শুরু হয়ে যেতে পারে।
৮। পুত্রবধূকে সংসার চালানো শিখিয়ে দিবে।
৯। পুত্রবধূকে এই নতুন সংসারে এবং নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দান করবে।
১০। পুত্রবধূ এক হিসেবে শ্বশুর-শাশুড়ীর অধীনস্থ। অতএব পুত্রবধূর দ্বীনদারী, ইবাদত বন্দেগী ও তার ইজ্জত আব্রুর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।
[সূত্র: মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন]